উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৩০
সকালের স্নিগ্ধ সুষমায় ভরা ছোট্ট পরিসরের উঠোন। তার কিছু জায়গাজুড়ে পায়রাদের অবিরাম খেলা চলছে। তাদের ডানা ঝাপটানোর ফলে উৎপন্ন বিকট শব্দগুলো কোন প্রলয়ঙ্কর ধ্বনির চেয়ে কম কিছু নয়। কেউ হঠাৎ শুনলে নির্ঘাত প্রাণপাখি ফুড়ুৎ করে দেহ থেকে বেরিয়ে আসবে। মায়ার নতুন স্কুলের জামাটার সেলাই শেষ, গলার কাজটা বাকী কেবল। মায়া ওঁৎ পেতে বসে আছে নতুন জামা হাতে পাওয়ার। মিতু সুঁইয়ের মধ্যে সুতো ভরে বসল মাত্র। অমনি কারো পায়ের শব্দ কানে আসতেই দরজার দিকে মুখ স্থির করে মাথা কাত করে তাকায়। তিরিক্ষি মেজাজের নুরুল আজ বেশ শান্ত। মায়া তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে পড়ে মিতুর কোল দখল করে নেয়। কাঁপতে থাকে থরথর করে। দশ দিন পর নুরুলকে চোখের সম্মুখে দেখে মিতুরও কম ভয় লাগছে না। তবে সে আর ভয় পাবে না নুরুলকে। এমন চিন্তা থেকে মনে অদম্য সাহস জুগিয়ে কন্ঠে উগ্রতা ঢেলে বলে বসল, ‘কই ছিলেন গত দশদিন? পাওনায়ালারা দিনে রাইতে খোঁজ লইতে আহে আপনার। তাগো ক্যাওক্যাও, চ্যাওচ্যাও আর কয়দিন সইহ্য করমু আমি? এমনে আর কয়দিন টেকন যাইব?’
নুরুল নিস্তেজ কন্ঠে বলল, ‘পাওনাদারেরা যাতে আর বাড়ি বয়ে কথা শোনাতে না পারে, সেই বন্দবস্ত করেই এসেছি আজ।’
‘তুমি বাড়ি বেইচ্চ্যা দিছো!’ মিতুর কন্ঠে বিষ্ময়।
নুরুল মাথা নাড়িয়ে ‘নাসূচক’ জবাব দিয়ে পরক্ষনেই বলে ওঠে, ‘বাড়ি এখনও বিক্রি করিনি। তবে উপায় টা সময়মতো না পেলে, এ ছাড়া পথ থাকতো না।’
‘উপায়! কি উপায়?’ শুধায় মিতু।
‘তুই শহরে যাবি। মডেলিং করে আমাকে আর পাওনাদরকে টাকা দিবি। চেয়ারম্যানের ছেলে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। সে অনেক টাকা দিয়েছিল, এই কয়দিন সেগুলো দিয়েই দিন পার করেছি।’
মিতু বিস্ময়ে হতবাক। ক্রোধের পরিমান সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় মিতু কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলল। মিতুকে চুপ থাকতে দেখে নুরুলই বলে,
‘আগামীকাল সকালে রওয়ানা দেবেন চেয়ারম্যানের ছেলে বাদশা। তোকে নিয়ে যাবে বলল। চাইলে তোর এই পাতিলের তলাটাকেও নিয়ে যাস। সহ্য হয়না এইটাকে আমার। এই মেয়ের বাপ নাকি আমি! আমার ভাবলেই ঘেন্না লাগে, থু!’ এক দলা থুতু ফেলল নুরুল। সাথে সাথে মিতু বলল,
‘আরেকটা কথা কইলে তোমার আজকেই এই দুনিয়ায় শেষ দিন কইয়া রাখলাম!’
নুরুল মিতুকে মারার জন্য উদ্যত হয়েও কি মনে করে পিছালো। দরজার কাছে গিয়ে বলল,
‘তুই যাবি, সাথে তোর চৌদ্দগুষ্টিও যাবে। ভোর হতেই তুই এই বাড়ি ছাড়বি, নইলে লাশ হবি। যদি তা না চাস, তাহলে আমি যা বলি তাই শুনবি। আমি কাল ভোরে আবার আসবো।’
নুরুল চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। মিতু এখনও ঘোরের মধ্যে আটকে আছে। মায়া থুতনি ধরে নাড়া দিতেই মিতুর সম্বিৎ ফেরে। মায়ার দিকে তাকাতেই মিতুর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। কেমন এক কৌতূহল মিতুর সেই চোখে। সে মায়াকে দু’হাতে জড়িয়ে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘কাইল হয় তার দিন, নয় আমার!’
***
গতকাল মোটামুটি গ্রামের প্রায় অনেক বাড়িতেই রিপোর্ট নেওয়া হয়ে যায়। হবে নাই বা কেন? কাব্যরা সেই সকালে কাজে নেমেছিল, আর সন্ধ্যায় গিয়ে ক্ষান্ত হয়েছে। অবশ্য নিজ নিজ সুবিধার জন্য বিরতিও নিয়েছিল। তবে সেক্ষেত্রে তেমন সময় অপচয় হয়নি। কাব্যদের বেশিরভাগ সময় কাজের মধ্যেই অতিবাহিত হয়েছিল। আজ ফুটপাতের দোকানগুলোতে এসেছে। কোলাহলে ভরপুর বাজার। বাজারের ভেতর শত শত দোকানের সমাহার। সবগুলো দোকানই খদ্দরে ভরপুর। দোকানের বাহিরে ক্রেতাদের বসার জন্য দুই কর্ণার দিয়ে দুটো বেঞ্চ ফেলান। ফুটপাতের দোকানে গ্রামের প্রায় প্রতিটা পুরুষই আসে চা, সিগারেট খেতে ও আড্ডা দিতে। চা খাওয়ার সাথে আড্ডা দিয়ে সময় পার করা, জওয়ান-বুড়ো প্রায় সকলেরই নিত্যদিনের অভ্যাস। চা, সিগারেট ছাড়াও অন্যান্য পণ্যসামগ্রীও মজুদ রয়েছে সেসব দোকানে। সকলে বলার সুবিধার্থে বিক্রেতাদের চা ওয়ালা বলেই ডাকে। কিছু দোকানকে মুদি দোকান বলে থাকে ,তবুও বেশির ভাগ লোক চায়ের দোকান বলেই সম্মোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কাব্যরা ভীড় কম এরূপ বিবেচনা করে যেকোন একটি দোকানে প্রবেশ করল। দোকানীকে তাদের জীবনযাত্রা নিয়ে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলে দোকানী নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায় যথাসম্ভব উত্তর দেন। এক এক করে সেখানে বসে থাকা ক্রেতাদের সাজানো গোছানো কিছু প্রশ্ন শুধানো হয়। যে, যেভাবে, যতটুকু পারল উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল। খানিক বাদে আবুল কালাম এসে একটা সিগারেট চাইলেন দোকানীর নিকট। কাব্যর কাছে কন্ঠস্বরটি চেনা লাগায়, আবুল কালামের মুখপানে চাইতে সময় নিল না তেমন। প্রথমে আবুল কালাম কাব্যকে খেয়াল করেনি। তবে পরমুহূর্তে যখন সে আশেপাশে চোখ বুলায়, তখন গিয়ে কাব্যর চোখে চোখ পড়ে তার। দুজনের চোখাচোখি হতেই কাব্য ব্যস্ত পায়ে রাত্রি ও সাজিদকে নিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করে অন্য আরেকটি দোকানের দিকে গেল। সাথে সাথে আবুল কালামও তাদের পিছু নেয়। কাব্য লক্ষ্য করল আবুল কালাম ওদের পিছন পিছন আসছে। ফলে পায়ের গতি কমিয়ে ছোট কদম ফেলতে লাগে। আবুল কালাম সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কাব্যর সামনে গিয়ে পথ আটকায়। কাব্য কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো কি তার আগেই আবুল কালাম কাব্যর পা জড়িয়ে ধরল। অপরাধীদের ন্যায় বলল,
‘হামারে তুমি মাফ কইরা দেও বাবা। হামার অনেক বড়ো ভুল হইয়া গেছে। আমি অনেক বড়ো পাপ কইরা ফেলাইছি তোমার লগে।’
ঘটনাক্রমে কাব্য স্তম্ভিত, হতভম্ব হয়ে গেল। এরকম কিছু সে মোটেও আশা করেনি। কাব্য তড়িঘড়ি করে আবুল কালামের দুই বাহু ধরে দাঁড়
করালো। তারপর বলল, ‘আপনি আমার গুরুজন। আপনি আমার পা কেন ধরছেন? ছি! ছি! এমন করবেন না দয়া করে।’
‘হামারে তুমি শাস্তি দেও বাবা। আমি তোমার লগে অন্যায় করছি। এই হাত দুইখান দিয়া মারছি তোমারে। তুমি হামারে শাস্তি না দিলে আমি জীবনেও শান্তি পামু না। মইরা গেলেও পামু না। নরকেও ঠাই পামুনা।’
আবুল কালামের কথায় কাব্যসহ সেখানে উপস্থিত সকলেই নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে রইল।
হঠাৎ কাব্য বলল, ‘আমি আপনাকে মাফ করে দিয়েছি। তাই মাফ চাইতে হবে না। আর তাই শাস্তিও দেব না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’
‘না বাবা না। হামার শাস্তি পাওনের দরকার আছে। তুমি হামারে শাস্তি না দিলে হামার পাপের বুজা কমবো না।’
‘আমি মাফ করে দিয়েছি বললাম তো!’
‘মাফ দিয়া আমার পাপ ঘুচবো না, বাবা। আইজ হামার মাইয়ারা সুখে নাই। তারা হামার মুখ দেখতে চায়না। হামারে বাজান কইয়া ডাক দেয়না কতকাল! সব হামার পাপের ফল গো বাবা, সব পাপের ফল।’ আবুল কালামের চোখ ভিজে আসল কথা বলতে বলতে।
‘মাইয়ারা সুখে নাই’ বাক্যটা কাব্যকে ভীষণ করে বিচলিত করে তুলল। ‘কেন কাকু? মিতু কি ভালো নেই? কি হয়েছে ওর? ও কেন ভালো নেই?’
আবুল কালাম হাতের উল্টো পিঠ দ্বারা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘না বাবা, হামার মিতু মায় ভালা নাই। সেতু মায়ও নাই। মিতুর বর নুরুল মদ খায়,জুয়া খেলে। ঘরে অশান্তি করে। হামার মাইয়ারে মারে। হামার ছুডু নাতনিডারেও দেখতে পারেনা। অনেক টাহা ঋণ কইরা ফেলাইছে হেয়। এহন আমার মিতু মায় সংসার চালাইতে সেলাইয়ের কাজ করে। কি করবো হেয় স্বামী খারাফ হইলে?’
কাব্য যেন বিশ্বাস করতে পারছে তার কানকে। তার মিতুবুড়ি এত কষ্ট করছে, এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে কাব্যর তার মিতুবুড়ির এমন দুঃসহ সংবাদ শুনে।
‘কি বলছেন কাকু! মিতু এতটা কষ্টে আছে?’
‘হ বাবা। হামার কিছু করার মতো ক্ষমতা নাই। হামার মাইয়ার কপালডা আইজ হামার লাইগ্যাই পুড়ছে। যদি কম বয়সে মাইয়াগো বিয়া না দিতাম, তাইলে আইজ এই দশা হইত না হেগো।’
‘কাকু আমি আগামীকালই যাব মিতুর শ্বশুর বাড়িতে৷ আর ওর হাসবেন্ড নুরুলেরও শাস্তির ব্যবস্থা করবো। এভাবে বাড়ির বউকে নির্যাতন করা আইনত অপরাধ। আমি দেখে নেব অমন খারাপ লোককে। মিতুবুড়ির উপর জুলুম করে, ওর কত্ত বড়ো সাহস! মেরেই ফেলব তাকে আমি!’
কাব্যর ফুটন্ত চোখ খুবই ভয়ংকর লাগল রাত্রির কাছে। কাব্যর রাগ দেখেছে তবে আজকের মতো এতটা কখনোই দেখা হয়নি তার। আবুল কালাম কাব্যর হাত দুটো তার হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, ‘হামার অনেক বড়ো উপকার হইব যদি তুমি নুরুলরে শাস্তি দিতে পারো। তুমি হামার মাইয়ার লাইগ্যা কিছু করো বাবা। নুরুলরে কঠিন শাস্তি দেওনের ব্যবস্থা কইরো কিন্তু জানে মাইরো না। তাইলে আমার মাইয়াডা বিদবা হইয়া যাইব। নুরুল ভালা হইয়া বউ বাচ্চার লগে ভালা ব্যবহার করুক আর অশান্তি না কইরা, মদ-জুয়া থেইক্যা যেন ফেরত আহে। এইটুকুনই চাই আমি। কিন্তু হেরে বাঁচাইয়া রাইহো। জানে মাইরো না।’
কাব্য সময় নিয়ে নিজের রাগ সংবরণ করল। এরপর আবুল কালামকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘তাই হবে কাকু৷ আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব আপনার কথাগুলো রাখার। কাকী, রুজন তারা কেমন আছে কাকু?’
আবুল কালাম মাথা নুইয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কান্নার রেশ ধরে রেখে বললেন, ‘রুপালি মাইয়াগো কষ্ট সইতে না পাইরা গলায় দড়ি নিছিল। পরে পোলাডারে মাদ্রাসায় দিয়া দেই। হেরে দেইখ্যা রাহনের কেউ তো আর নাই।’
‘কাকী আত্মহত্যা এটেম্পট করেছে! এত ভয়াবহ অবস্থা তাহলে সেতু আর মিতুর! আমাকে যত দ্রুত সম্ভব সেতু,মিতুর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের পুলিশের আওতায় নিতে হবে। এদের মতো নরপশুদের কঠিন শাস্তি প্রাপ্য! এরা নর্দমার কীট।’
কাব্যর সারা শরীরে রক্তের পরিবর্তে যেন আগুন চলাচল করছে। আপাদমস্তক রাগে ফেটে পড়ছে।
সে কোনমতে আবুল কালামকে শান্তনা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর যাবতীয় সকল কাজ শেষে রাত্রিকে নিয়ে নদীর ঘাটে আসল। কাব্য একাই আসতে চাচ্ছিল কিন্তু রাত্রি সঙ্গে যাওয়ার বায়না সাধলে কাব্য না করতে পারেনি। সাজিদ ক্লান্ত থাকায় হোটেলে ফিরে যায়। নদীর চেহারা দেখে কাব্যর পুরনো স্মৃতিগুলো তাজা হয়ে ওঠে। সেই গাঙচিল, ভীড় জমানো কচুরিপানা, শ্যাওলা, পালতোলা নৌকা, গাঙের কালো পানি সবাই তাদের নিজ নিজ জায়গা দখল করে আছে। শুধু দূরের দুর্বাঘাসগুলো একা নির্জনে পড়ে। যেখানে বসে দুটো শরীর কতো রকম আলাপচারিতায় মত্ত থাকতো কোন এক সময়। পাওয়ারের চশমা চোখে থাকায় চোখের পানিতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসল কাব্যর। সে দ্রুত হাতে চোখের চশমাটা খুলে শার্টের হাতলে চোখ মুছে নিয়ে আবার চোখে জড়িয়ে নিল। রাত্রির চোখে কাব্যর সেই দুর্বোধ্য রহস্যটা দৃষ্টিগোচর হলো না।
সে হিম শীতল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘পুরনো সকল স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছে চোখের সামনে! তাইনা কাব্য স্যার? ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে আগের সোনালী দিনগুলোতে?’
কাব্যর গলার স্বর কণ্ঠনালিতেই আটকা পড়ে আছে। সমস্ত শব্দ গুলো গলার সন্নিকটে এসেও দলা পাকিয়ে যাচ্ছে বারবার। ফলে মৌনতা ধরে রাখাই সে শ্রেয় বলে মনে করল। স্তব্ধতার সময় দীর্ঘ হতে থাকল।
রাত্রি কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বলল,
‘স্যারের থেকে ছুটি নিয়েছেন কি? না মানে আগামীকাল যে মিতুর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি, স্যার শুনলে রাগ করবেন না?’
জবাবে কাব্য বলে, ‘না,আমি যাওয়ার কারণটা বলেছিলাম। তাই উনি নিজে আগ্রহ নিয়েই আমাকে যাওয়ার পারমিশন দিয়ে দেন।’
‘ওহ, গ্রেট! তাছাড়া এখানকার কাজ তো প্রায় শেষ আমাদের। তাই গেলেও সমস্যা হবে না। ঝিকাতুলি গ্রামটা বেশ ছোট। ভেবেছিলাম সাতদিন কম পড়বে কাজ শেষ হতে। কিন্তু সারপ্রাইজড হলাম। কাল তাহলে আপনার মিতুবুড়িকে সরাসরি দেখতে পারবো! ইচ্ছেটা পূরণ হবে সেই ভাগ্যবতীটাকে দেখার।’
রাত্রির শেষ কথাটায় কাব্যর শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল। ক্ষীণ গলায় বলল,
‘আমি সেটা নিয়েই ভাবছিলাম। মিতুবুড়িকে দেখলে আমি কি করবো? নিজেকে কি সামলাতে পারবো? পারবো বলে তো মনে হচ্ছে না।’
‘আপনাকে যে পারতে হবে মিস্টার কাব্য। শত কষ্ট হলেও পারতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে মিতু এখন বিবাহিতা। তার হাসবেন্ড আছে, সংসার আছে। মিতুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন যদি অসামাজিক কিছু দেখে, তাহলে মিতুর জন্য সেটা বিপদজনক হবে। তাই আপনাকে কন্ট্রোল করতে হবে নিজেকে।’
‘এটাই তো চিন্তার বিষয়, রাত্রি। আচ্ছা, আপনি কি আমায় একটা সাহায্য করতে পারবেন?’
‘জ্বি অবশ্যই। বলেই দেখুন।’
‘আগামীকাল সর্বক্ষণ আমার সাথে সাথে থাকবেন। আমাকে ভুল কিছু করার সুযোগ দিবেন না। অস্বাভাবিক কিছু দেখলে তৎক্ষনাৎ বাঁধা দেবেন। পারবেন তো?’
রাত্রি একটু সময় নিয়ে বলল,
‘অবশ্যই। আমি সবসময় আপনার সাহায্যের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই। আপনার পাশে থাকতে চাই সর্বদাই। এমনকি সারাজীবন আপনার পাশে থেকে, হাতে হাত রেখে হাঁটতে চাই। পরিপূরক হতে চাই আপনার।’
রাত্রি কথাটাগুলো আনমনে বলে ফেলল। বলার পর কাব্যর দিকে তাকায়। রাত্রি ভেবেছিল কাব্যর ভাব ভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। কাব্য নিজের খেয়ালেই মগ্ন। নদীর পানি ছুঁতে ব্যস্ত সে। কাব্য যে তার কথায় কর্ণপাত করেনি, সেটা জেনে ঢের স্বস্তি পেল রাত্রি। তিনি কয়েক কদম এগিয়ে কাব্যর নিকটে চলে গেল। ঘোরগ্রস্ত গলায় বলল, ‘পরিবেশটা খুব মনোমুগ্ধকর। নজর কাড়ার মতো। এমন পরিবেশে দু চার লাইন কবিতা বা কাব্য শুনলে মনটা আরও ফুরফুরে হয়ে যেত। আর সেটা যদি আপনার কন্ঠের আবৃত্তির ছোঁয়া পায়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। আপনার মায়ের থেকে শুনেছিলাম, স্কুল/কলেজে আবৃত্তি করে প্রথম হতেন সবসময়। ঝুলি ঝুলি পুরস্কারও পেয়েছেন। ইশ, যারা আপনার আবৃত্তি শুনেছে, তারা কত্ত সৌভাগ্যবান/সৌভাগ্যবতী!’
রাত্রি যে কায়দা করে কাব্যর কাছে আবদার করছে, তা ঠাওর করতে তেমন সমস্যা হলো না কাব্যর। সে জানে রাত্রি তার লেখা পড়তে খুব পছন্দ করে। কাব্য কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ভাবল কিছু। তারপর বড়ো একটা শ্বাস ছেড়ে বলতে লাগল,
”তোমার হাতের ভাজে,অনেক না বলা কথা জমা রেখেছিলাম। কখনো কি তা কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছিলে?
শুকনো পাতার মতো,কিংবা বেঁচে যাওয়া উচ্ছিষ্ট খাবাবের মতো,
আমাকে ঘিরে জমানো সকল স্মৃতি ফেলে দিয়েছো কি জলন্ত উনুনে বা নর্দমার কোনো খালে? নাকি রেখে দিয়েছো উড়ন্ত কেশ নামের ডালে!
কখনো কথার ঝংকার তুলে মনের জমিনে বৃষ্টি হয়ে নেমো, কখনো বা কোকিলার কন্ঠে গান গেয়ে থেমো।
মনের খালি জায়গাটুকু আজও খালি রয়ে গেল।
ভরাট হবে কি তা? আমি বলবো, যাকে চাই তাকে পাওয়া কি এতই সোজা!
পাইনি তোমায়, হওনি আমার।
জানি, আমি মানেই মস্ত বড়ো বোঝা, তাইতো বন্ধ তোমার মনের সকল জানলা-দরজা।
কেন জানি বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকি,
শূন্য বুকের অথৈ জলে তোমায় খালি ডাকি।”
‘আমি তোকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবো না মিতুবুড়ি। কখনোই পারবো না। আমার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস শুধুই তোকে ঘিরে। আমি পুরো দুনিয়ার সাথে যুদ্ধ করে হলেও তোকে জয় করতে প্রস্তুত। লাজলজ্জার কোরবানি দিয়ে হলেও তোকে আমার চাই!’
কাব্যর শেষ কথাগুলো আগুনের ঝড় হয়ে বয়ে গেল রাত্রি বুক, চিবুক চিড়ে। সেই সাথে বুঝতে পারল, কাব্যর চোখের ওই দুর্বোধ্য রহস্যগুলো শুধুমাত্র মিতু নামের ডাকঘরে গিয়েই জমা হয়। এও বুঝল, সামনের ক্রন্দনরত সুদর্শন যুবকটি তার জন্য নয়। তার খেদ, সে কেন মিতু হয়ে জন্ম নিল না? রাত্রির প্রতিটি নিশ্বাস অপ্রাপ্তির হাহাকার হয়ে মিশে যাচ্ছে গোধূলিলগ্নের ওই লাল রঙেতে।
চলবে ইনশাআল্লাহ…