গোধূলিলগ্ন ২৯

0
466

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ২৯

হোটেল ‘আলিশান’ এ উঠল কাব্য, রাত্রি ও ক্যামেরাম্যান সাজিদ। তারা হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে যার যার রুমের চাবি বুঝে নিল। দুপুরের খাবার শেষে, কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে একেবারে বিকেলের দিকে ঝিকাতুলি গ্রাম ভ্রমণে বের হলো। ভ্রমণ বললে ভুল হবে। কারণ তারা নির্দিষ্ট কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে। লক্ষ্য গ্রামবাসীদের অসুবিধা/অসুবিধাসমূহ ও জীবনযাত্রার মান তুলে ধরা। হাঁটার সময় গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, ভাঙা রাস্তা, মেরামত বিহীন বিদ্যালয় ও কলেজ ইত্যাদির ছবি তুলে রেখেছেন সাজিদ। সাথে সংক্ষিপ্ত সময়ের একটা লাইভ ভিডিও করে।

কাব্য এখানকার সবকিছু চেনে বলে তেমন সমস্যা হচ্ছেনা। এভাবেই পুরো বিকেল কেটে গেল। তারা হোটেলে ফিরে সন্ধ্যার আগ দিয়ে। পুরোটা বিকেল টান টান উত্তেজনা ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে পার করেছে কাব্য। সাথে এক অদ্ভুদ ধরনের অস্বস্তিবোধ হচ্ছিলো। ছটফট করছিল চেনা জায়গাগুলো দিয়ে হেঁটে। কিন্তু সেটা কাব্য তার মন অবধিই সীমাবদ্ধ রেখেছে। কাব্যর এই এক সমস্যা। তার বুকের ভেতরটা পুড়ে ঝলসে গেলেও মুখে তা প্রকাশ করবেনা। অবশ্য কাব্য নিজেই তা প্রকাশ করতে চায়না বলেই প্রকাশিত হয়না। পুরো বিকেল তার মুখে হাসির রেখা বজায় থাকলেও, রাত্রি ঠিক বুঝতে পেরেছে কাব্যর মনের অবস্থাটা। রাত্রি জানে, কাব্যর স্বভাবই যেকোন খারাপ পরিস্থিতিতে ভেতরটা আড়ালে রেখে মিথ্যে ভালো থাকা। আজ শুধু রাস্তাঘাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবধিই কাজ চালিয়েছে। এতটুকুতেই পুরো গ্রাম কাব্যর আসার খবর জেনে গেছে। অনেকেই কাব্যকে ঘিরে ধরেছিল। বিশেষ করে তৌসিফ সাহেবের ছাত্র/ছাত্রী, আত্মীয়স্বজন, কাব্যর বন্ধুগণ ও চেনা জানা পাড়া-প্রতিবেশীরা। সকলেই কাব্যকে নিয়ে গর্বিত হলো। অনেকেই তৌসিফ ও রেখা বানুর সম্মন্ধে জিজ্ঞেস করেছে। কোথায় থাকে না থাকে এসব ছাড়াও আরও নানান ধরনের কথা, কৌতূহল প্রকাশ করেছে। কাব্য কাজের ফাঁকে সকলকে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কথা বলতে পারেনি কাব্যরা। তবে আগামীকাল সকাল সকাল বের হবে, এই ভাবনা নিয়ে ফিরে আসে তারা।

কথামতো সূর্য মাথায় চড়তেই বেরিয়ে পড়ল। কোন বাড়ি আগে যাবে এমন চিন্তা মাথায় আসলে সর্বপ্রথম নয়নার কথা মনে পড়ে কাব্যর। বিলম্ব না করে সহকর্মীদের নিয়ে পা বাড়ালো নয়নাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে দেখে, উঠোনের মাঝখানে শ্যাম বর্ণের একটি মেয়ে গামলার মধ্যে ছোট একটা বাচ্চাকে গোসল করাচ্ছে। মেয়েটি কাব্যদের দেখে খানিক অবাকই হলো। সাথে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনারা কারা?’

রাত্রি দু কদম এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আমরা সাংবাদিক। মাশাআল্লাহ! খুব সুন্দর বেবি আপনার। আপনি কি এ বাড়ির কেউ?’

মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ‘আমি এই বাড়ির বউ। বলুন কি বলবেন আপনারা?’

কাব্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলল, ‘আপনি তাহলে মামুন ভাইয়ের স্ত্রী?’

মেয়েটি আরও কয়েক দফা অবাক হয়ে বলল, ‘জ্বি আমি তার স্ত্রী।তবে আপনি কিভাবে জানলেন ভাই?’

‘আমি এই গ্রামেরই ছেলে। আচ্ছা, মামুন ভাই বা তার মা কোথায় জানেন কি?’

কাব্যর কথার শেষে মেয়েটি ‘মা’ বলে ডাক ছাড়ল। রোকেয়া বেগম তুমুল মনোযোগে গরুর জন্য খড় কাটছিলেন। মেয়েটির ডাকে সাড়া দিয়ে বললেন,
‘কি হইছেরে ঝুমা? ডাকিস ক্যান আমারে?’

ঝুমা গলায় জোর টেনে বলল, ‘মা আপনাকে খুঁজতে কিছু লোক আসছে। এসে দেখুন তো একটু।’

রোকেয়া কাজ রেখে হাত ঝেড়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, ‘কেডায় আইছে আমার খুঁজ লইতে?’

রোকেয়া সামনে উপস্থিত লোকদের দেখে থমকাল। রাত্রি আর সাজিদকে না চিনলেও কাব্যকে কিছুটা হলেও চেনা চেনা ঠেকলো তার নিকট। পুরোপুরি চিনতে না পারায় কাব্যর উদ্দেশ্য বললেন,
‘তুমারে আমাগো আগের হেডমাস্টারের পোলাডার লাগান দেহা যাইতাছে ক্যান? কি যেন নাম আছিল পোলাডার? মনে আইতাছে না আমার।’

কাব্য হেসে বলল, ‘জ্বি ঠিক ধরেছেন। তবে আমি আপনাদের হেডমাস্টারের ছেলের মতো দেখতে না, তারই ছেলে কাব্য আমি।’

‘তার লাইগ্যাই কেমন চেনা চেনা লাগতাছিল। তহন তো অনেক ছুডো আছিলা। তুমরা তো চইল্যা গেছিলা গেরাম ছাইড়া মেলা বছর আগে। তয় কেমন আছে তুমার বাপ-মায়? তারাও কি আইছে? তুমরা কি আবার ফিরা আইছো গেরামে?’ রোকেয়া মুহুর্তেই একগাদা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন কাব্যর দিকে।

কাব্য বলল, ‘না কাকি। আব্বু-আম্মু আসেনি আর তারা আল্লাহর রহমতে ভালোই আছেন। আমি একজন রিপোর্টার। গ্রামের অবস্থা রিপোর্ট করতে এসেছি এখানে। কাজ শেষ হলে আবার শহরে চলে যাব।’

রোকেয়া বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘রিপ না কি কইলা বাবা? আমি তো বুঝি নাই তোমার কথাখান।’

‘মানে আমি সাংবাদিক। আমরা খবরের চ্যানেল থেকে এসেছি। অর্থাৎ সংবাদ মাধ্যম থেকে। আপনার সাথে কিছু কথা বলতাম। আর সেটা টিভির পর্দায় সম্প্রচার করতাম আরকি। তবে যদি আপনার সময় থাকে তাহলেই। নইলে পরে আসবো।’

‘ও আইচ্ছা বাবা। তুমরা তাইলে বইয়া কতা কও। কাজ পরেও করতে পারুম আমি। খাড়াও, তুমাগো লাইগ্যা চেয়ার আনি।’

কাব্য মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ কাকি।’

রোকেয়া চারটে চেয়ার বের করে আনলেন বসার জন্য। কাব্য সাজিদকে বলল, ‘ক্যামেরা রেডি করো সাজিদ।’
সাজিদ বলল, ‘ওকে স্যার।’
লাইভ ভিডিও শুরু করার আগে রাত্রি রোকেয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
‘আন্টি, প্রথমে আপনি আপনার নাম, পরিবারে কে কে আছে এগুলো এক এক করে বলবেন ক্যামেরার দিকে মুখ করে। তারপর আমরা যা যা প্রশ্ন করবো তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবেন।’

রোকেয়া সম্মতি জানালে রাত্রি রোকেয়ার বুকের কাছে মাইক্রোফোন সেট করে দিল। অনুমতি পেয়ে রোকেয়া ক্যামেরার দিকে মুখ করে বলতে শুরু করল, ‘আমার নাম হইতাছে রোকেয়া। আমার পোলা যহন ভালোই বড়ো আর মাইয়ার বয়স ছয় বছর ছিল, তহন আমার স্বামী মারা গেছে। তারপর থেইক্যা পোলায় শহরে গিয়া চাকরি কইরা আমাগো সংসারের খরচ চাইলাইতো। এহনো চালায়। আমার পোলার নাম মামুন। আমার পোলারে বিয়া দিছি ৩বছর হইল পিরায়। তার ঘরেও পোলা হইছে। আর আমার মাইয়ার নাম নয়না। হেয়ও আমারে ফাঁকি দিয়া বাপের কাছে চইল্যা গেছে।’
রোকেয়া নয়নার কথায় গিয়ে চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারলেন না। রাত্রি রোকেয়াকে ধাতস্থ করতে বললেন,
‘আন্টি আপনি কষ্ট করে বলতে থাকুন। আপনি যা যা বলবেন তা পুরো দেশের লোক শুনতে পারবে। এমনকি আপনাকে দেখতেও পারবে টিভির পর্দায়।’

রাত্রি থেমে গেলে কাব্য বলে উঠল,
‘জ্বি কাকি, আপনি বলুন আপনার মেয়ে নয়নার মৃত্যু কিভাবে হলো। আপনি কি এখনো আপনার মেয়ের খুনির খবর জানতে পারেননি? স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা কি তদন্ত করেছিল?’

রোকেয়া চোখ মুছে কথা বলতে গিয়ে বার দুই ফুঁপিয়ে উঠল। সময় নিয়ে বললেন, ‘না গো বাবা। আমার মাইয়ার খুনির খুঁজ আইজও পাই নাই। আমার মাইয়া কোন বনের হিয়াল-কুত্তার মুহে পড়ছিল জানি না। হেই বেধরম, অমানুষের বাচ্চায় আমার নয়নরে ধর্ষণ কইরা মাইরা ফেলাইছে। আমার মাইয়ার লাশ দেহনের মতো আছিল না। তুমি তো দেখছিলাই আমার কেমন অবস্থা হইছিল হেই সময়!’

‘দেখেছিলাম, তবে আপনি আপনার মুখে ঘটনাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বললে ভালো হতো।’ বলল কাব্য।

কয়েক সেকেন্ড পর রোকেয়া আবারও বলতে লাগলেন,
‘আমার কলিজার টুকরা মাইয়া, আমার নয়ন আমারে কইছিল গরুর মাংস ভুনা দিয়া ভাত খাইব। আমি হেই দিনই গরুর মাংস কিনার লাইগ্যা বাজারে গেছিলাম। আইতে দেড়ি হইয়া গেছিল আমার। নয়ন হগল দিন ইশকুল থেইক্যা দুপুর বেলায় আইয়া পড়তো। কিন্তু হেইদিন আর আইল না। কেমনে আইতো? আমার মাইয়ার রুহুখান যে আর দুনিয়ায় আছিল না। তারে তো কোন অমানুষ মাইরা ফেলাইছিল। আমার মাইয়া কি দোষ করছিল? এরম পাষাণ খুনি কোন মার পেট থেইক্যা জন্ম নিছিল?’
রোকেয়া এবার ভুবন কাঁপানো শব্দে কান্না করে দিলেন। খানিক বাদে একা একাই শান্ত হলেন। তারপর আবারও বললেন,
‘নয়নের লাশ দারোগারা খুঁইজ্যা পাইছিল অনেক রাইতে জঙ্গলের মইধ্যে। তারপর হেই লাশ আমাগো এই উডানে আনছিল। হেন থেইক্যা তদন্তের লাইগ্যা হাসপাতালে নিয়া যায়। তারপর দারোগা সাহেব কয় মোটা টাহা লাগব, নাইলে লাশ দিব না। হেরা আমার নয়নের লাশ কাডাছিঁড়া করতে চাইছিল। কিন্তু আমার পোলায় হেই দিনই টাহার জোগাড় কইরা লাশ নিয়া আইছিল তাগো থেইক্যা। আমার একটাই মাইয়া, হের লাশ কেমনে বিলাই কও?’

সেখানে উপস্থিত সকলেরই চোখ ভরে আসল রোকেয়ার কান্নায়। শুধুমাত্র সন্তান হারা মা-ই জানে হারানোর কষ্ট কতটা কুৎসিত! কাব্য সব জানা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার মেয়ের খুনিকে বের করার জন্য পুলিশরা কোন পদক্ষেপ নিয়েছিল কি তখন?’

রোকেয়ার গলা প্রায় বসে গিয়েছে। কথা বলা খুব কষ্টসাধ্য হলেও তিনি আধ ভাঙা গলায় বললেন,
‘না, তারা কিছুই করে নাই। উল্ডা দারোগারা কইছে মেলা টাহা দেওনের লাইগ্যা। মামুন সব জমানো টাহা নয়নের লাশ আনতেই দিয়া ফেলাইছিল। আর একটা টাহাও আছিল না ওর ধারে। তারপরও আমি কইছি সব বেইচ্চা হইলেও মাইয়ার খুনিরে শাস্তি দিমু দরকার পড়লে। তারপর স্বামীর ভিটা বাদে সব জমিজমা বেইচ্চা দারোগারে দিছিলাম। কিন্তু টাহা নেওনের পর দারোগায় কইছে এই ঘটনা পুরান হইয়া গেছে। তারা এহন আর কোনো তদন্ত করতে পারবো না। আর তাগোরে বেশি জ্বালাইলে নাকি মামুনরে জেলে দিয়া দিব। এই ভয় দেহাইয়া চুপ করায় রাখছে এহন পর্যন্ত। আইজ আট বছর হইয়া গেল আমার নয়ন মরছে। কিন্তু ওর আত্মারে শান্তি আর দিতে পারি নাই। চোখ বুঝলেই স্বপ্নে দেহি আমার নয়ন ওর খুনির বিচার চাইয়া ছটফট করতাছে।’

সব শুনে কাব্য বলল,
‘আপনি আপনাদের প্রতি হওয়া অবিচার এবং মেয়ে নয়নার খুনির শাস্তি চেয়ে কিছু বলুন সকলকে। এর মাধ্যমে যদি কোনো সাহায্য পান। আশা রাখি এবার আসল সত্যটা বেড়িয়ে আসতে পারে। আমি আছি আপনার সঙ্গে। চিন্তা করবেন না কাকি।’

রোকেয়া কাব্যর হাত ধরে পুনরায় কান্না করে দেয়। এরপর অসহায়ত্ব চাহনি নিয়ে ক্যামেরার দিকে চেয়ে বলে, ‘আপনারা তো সব হুনলেনই। আমার মাইয়া আইজ আমার কাছে নাই। কাইল যেন আপনাগো মাইয়ার লগেও এরম ঘটনা না ঘটে, হেইদিকে খেয়াল রাখবেন দয়া কইরা। আমার চাওয়া একটাই, আমগো এইহানের দারোগাগোরে কঠিন শাস্তি দিয়েন। পারলে ভালো কাউরে দারোগার চেয়ারে বসান। নাইলে আমাগো গ্রামে কোন পুলিশ দারোগা লাগতো না। ওরা সেবার নামে মাইনষেরে পথের ফকির বানাইয়া ফেলায়৷ ওগো মতো মানুষের দারোগা হওনের কোনো অধিকার নাই। ওরা চেনে খালি টাহা। দয়া কইরা আপনারা কিছু করেন। নাইলে কন আমাগো মতো অসহায় মাইনষেগো মইরা যাওনের লাইগ্যা। এমনে বাঁচার তনে মইরা যাওয়া অনেক ভালা। অনেক ভালা।’

রোকেয়াকে আরও বেশ কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়। রোকেয়া যথাসাধ্য সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। শেষে কাব্য ও রাত্রি রোকেয়াকে অঢেল ভরসা জুগিয়ে ‘ধন্যবাদ’ জানায়। এরপর সেখান থেকে বিদায় নিয়ে অন্য আরেকটা বাড়িতে ঢোকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ….
বিঃদ্রঃ গঠনমূলক মন্তব্য করলে লিখার আগ্রহ পাওয়া যায়, নইলে যেকোন লেখক/লেখিকাই আগ্রহ হারিয়ে তাড়াতাড়ি গল্পের ইতি টানেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here