গোধূলিলগ্ন ২৮

0
378

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ২৮

কাব্যর জরুরি সকল জিনিসপত্র ব্যাগে ভরা হয়ে গিয়েছে। ভোরে উঠেই সব গোছগাছ করে রেখেছিলেন রেখা বানু। কাব্য তার চার্জারটা ব্যাগে ভরে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিল আর মোবাইল রাখে বুক পকেটে। পরমুহূর্তে নিজ রুম থেকে বের হবে ঠিক তখনই রেখা বানু দরজার সামনে এসে দাঁড়ান। কাব্য রেখা বানুকে দেখামাত্র বলে,
‘আমি নিচেই আসছিলাম।’

‘তুই কি এখনই বেড়িয়ে পড়বি?’

‘কেন?’

‘কিছু কথা ছিল তোর সাথে। গতকাল ভেবেছি বলবো। কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি। পিছু ডাকা ভালো নয়, তাই সামনে এসে বললাম।’

কাব্য হাতের ঘড়িটার দিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘গাড়ি প্রথমে রাত্রির বাড়ি হয়ে আমাদের এখানে আসবে। তাই যতক্ষণ না তিনি আসছেন, ততক্ষণ আমি বাড়িতেই আছি।’

‘তাহলে চল বসে কথা বলি।’

‘ভালো লাগছে না কথা বলতে।’

‘ও আচ্ছা, আমার বেলাতেই যত অযুহাত! বাবা-ছেলের তো ভালোই কথা হয়। আমিই শত্রু তাইনা?’

কাব্যর বিরক্তির সীমা তুঙ্গে পৌঁছায়। তবে যাত্রাপথ বলে তা মুখে প্রকাশ করার ইচ্ছে জাগল না। তাই স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল, ‘আমার শত্রু নেই। যা বলবে জলদি বলো।’

‘আপাতত এ ব্যাপার নিয়ে ঘাটলাম না, গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তাই।’

রেখা বানুর কণ্ঠে গম্ভীরতার হাবভাব। কাব্য বেশ বুঝতে পারছে রেখা গুরুতর কিছু একটা বলবে তাকে। আর সেটা যে ঝিকাতুলি বা মিতুকে নিয়ে, তা মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে ঠিকই আন্দাজ করতে পারছে। তবুও অজানা ভাব করে কাঁধের ব্যাগটি খুলে বিছানার উপর গিয়ে বসলো।
তারপর বলল, ‘এবার বলো কি বলবে।’

রেখা বানু কাব্যর মুখোমুখি হয়ে বসা। তিনি গলার স্বর নরম করে বললেন, ‘তোর আব্বু রাতে তোকে অনেক কথাই বুঝিয়েছেন জানি আমি। তাও আমি কথা বলতে আসলাম। যা না বললেই নয়।’

‘আমি দুর্বল নই, চেষ্টা করব না হওয়ার। এটা নিয়েই বলবে তো?’

রেখা গলায় তেজ তুলে বললেন,
‘আগে শোন কাব্য!’ এরপর আবারও নরম হয়ে বললেন, ‘আমি তোকে একটা উপদেশ দেব। তুই ভাবিস না তোর আব্বুর কথার পুনরাবৃত্তি করতে এসেছি। তোর আব্বু কি বলেছেন জানি না, তবে যা বলেছেন তাতো মানবিই, সাথে তোকে আরও একটা কথা মানতে হবে।’

‘কি কথা?’ উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করল কাব্য।

‘এটা আমি অনেক আগে থেকেই বলবো, বলবো ভাবছিলাম। কিন্তু তুই মেনে নিবি, না নিবি তা নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিলাম বলে বলা হয়নি।’

‘আহা কি এমন বলবে বলে ফেলো না!’

রেখা বানু কাব্যর কাঁধে আলতো করে হাত রাখলেন। এরপর বললেন,
‘দেখ জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। সবাই বলে সময়ের স্রোত কারো জন্য থেমে থাকেনা। আমি তার সাথে জীবনকেও যোগ করলাম। কারণ সময়কে ঘিরেই মানুষের জীবন। জীবনকে ঘিরে সময় নয়। জীবন প্রতি মুহুর্তে তার আপন গতিতে চলে এসেছে,চলছে এবং চলবে। এটাই স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় কেউ যদি সব কিছু ত্যাগ করে অতীত নিয়ে পড়ে থাকে, তাহলে ২দিনের জীবন অবধি কিভাবে পৌঁছাবে কেউ?’

‘ঘুরে ফিরে ওই এক কথা! আমি বিরক্ত খুব, মা!’

‘সম্পূর্ণটা শোন না তুই, বোঝাচ্ছি তো। আগে কথাগুলো মন দিয়ে শোন, তারপর গিয়ে নিজের মতো বলিস।’

কাব্য পুনরায় মনস্থির করে বলল, ‘আচ্ছা বলো।’

রেখা বলতে লাগে, ‘মানুষের মস্তিষ্ক হচ্ছে স্মৃতির ভান্ডার। মানুষ মানেই স্মৃতি। কিছু কিছু স্মৃতি মরণ পর্যন্ত ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে আমাদের জীবনের সাথে। স্মৃতির ধরণ দুটি। ভালো ও খারাপ। যে যত খারাপ স্মৃতিকে মুছে ফেলতে পারবে, সে-ই জীবনযুদ্ধে জয়ী বলা যায়। আর ভালো স্মৃতির আরেক নাম আনন্দ বলতে পারি। তাই বলে ভালো স্মৃতিতে মগ্ন হয়ে থাকার মানেই হয়না। কারণ স্মৃতি মানেই বর্তমানকে অলস করার এক অদৃশ্য ফাঁদ। যাই হোক, তোকে অতীতের সব ভালো,খারাপ স্মৃতি ভুলে যেয়ে সামনের দিকে এগোতে হবে। তাহলেই তুই সব পারবি।’

‘মা আমি বুঝি সেটা। তুমি আর আব্বু কেন বুঝতে চাইছো না আমাকে?’

‘বুঝলে এতদিনে মিতুকে ভুলে যেতে পারতিস। কিন্তু তুই তা করিসনি। বরং নির্ঘুম চোখ জোড়ার ময়লাগুলো চোখের পানি দিয়ে পরিষ্কার করতেই ব্যস্ত থাকিস। এটা কি কোনো সুস্থ মানুষের জীবন! তুই যে ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছিস, সেটা আমি খুব ভালো করেই বুঝি। মা তো আমি।’

কাব্য তার চুলের মধ্যে দুহাত ডুবিয়ে ব্যথাতুর স্বরে বলল, ‘উফ! আমি কিভাবে যে বোঝাই তোমাদের?’

‘কিছুই বোঝাতে হবে না তোকে। শুধু আমার কথাটা রাখ তাহলেই হবে। আমি বুঝে যাব।’

কাব্য বিচলিত হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ তাই বলো। আমি তোমার সব কথাই শুনব। তাও যেসব কথা আমি শুনতে পারিনা, তা বলো না।’

রেখা কিছুক্ষণ উশখুশ করে শেষমেশ বলেই
ছাড়ে,
‘রাত্রি মেয়েটা খুব ভালো। চরিত্র, চালচলনও খুব সুন্দর। যতটুকু চিনেছি সেই জের ধরে বলতে পারি, মেয়েটা তোর জন্য যোগ্য। তোর বউ হলে মন্দ হবে না।’

‘তুমি এটা কি বললে মা!’ আঁতকে ওঠে কাব্য।

‘যা বলছি তোর ভালোর জন্যই বলছি। তুই যতক্ষণ না নতুন সম্পর্কে জড়াচ্ছিস, ততক্ষণ মিতুর স্মৃতি তোর মাথা থেকে নামবে না। তুই চাইলেও না।’

‘না মা, আমি পারবো না তা। কিছুতেই আমার মিতুবুড়িকে ভুলে থাকতে পারবো না। আমি মরে যাব তাহলে।’

রেখা বানু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘চুপ! একদম এসব কথা মুখে আনবি না। কেউ কারো জন্য মরে যায়না। যারা নির্বোধ তারাই এসব বলতে পারে শুধু।’

‘আমি নির্বোধই মা। আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। আমার ভালো লাগে না শুনতে। তোমাকে আর কত বোঝাবো বলতে পারো?’

‘তুই যদি ভালো থাকিস বা সব বুঝিস তাহলে এই জিনিসটা কেন বুঝতে চাইছিস না? নিজের ভালো কুকুরও বোঝে। সেখানে তুই একজন মানুষ। লোকে দশটা বিয়ে করেও আরেকটা বিয়ের কথা চিন্তা করতে পারে। আর তুই একটাই করতে চাস না!’

‘মা আমি আর কোনো কথা শুনবো না বিয়ে নিয়ে। আমার বাকী জীবনটুকুতে হস্তক্ষেপ করোনা। আমাকে নিজের মতো করে বাঁচতে দাও। স্বাধীনতা দাও আমাকে।’

রেখা বানু এবার রেগেমেগে উঠে দাঁড়ালেন। তিরিক্ষি মেজাজে বললেন,
‘তোর অনেক কামাই খেয়ে ফেলেছি আমি আর তোর বাবা। আর খেতে চাইনা। বড়ো হয়ে গিয়েছিস তাইনা? নিজের ভালো খুব বুঝে গিয়েছিস! এখন আর আমাদের লাগবে তোর। আমরা চলে গেলেই তুই শান্তিতে থাকবি বুঝেছি। আমরা তো আর কেউ না।দায়িত্ব শেষ আমাদের।’

‘মা তুমি কোন কথায়, কি টেনে আনছো? এখানে কামাই খাওয়ার কথা কিভাবে আসলো?’

‘ভুল কি বলেছি? আর থাকবো না তোর বাড়িতে। বাড়ি করে,গাড়ি কিনে অনেক বড়ো মনে করিস নিজেকে তাইনা? তার জন্য মায়ের কথার কোনো গুরুত্ব নেই তোর কাছে। কি ভুল করেছি আমি? একটু মিথ্যেই বলেছিলাম। মিথ্যে বলেছি কার জন্য?নিজের ছেলের ভালোর জন্য। তাই আজ আমি ছেলের কাছে অপরাধী। ভালো মা নই আমি। আমি তো খলনায়িকা। চমৎকার একটা নাম দিয়েছে আমার ছেলে। কথায় আছে না, যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর। আমার দশা হয়েছে ঠিক তেমনই। আজই মাস্টার মশাইকে বলবো,আমাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যেতে। ওনার পেনশনের টাকায় তিনবেলা খাবার জুটে যাবে আমাদের। এখন তো আর কোনো ভয় নেই আমাদের। ভয়ের একমাত্র কারণ ছিল ছেলেটি। তবে এখন ছেলে আমার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। বিচার বিবেচনা করতে পারে সে। আর কিসের চিন্তা, ভয়? বাবা মাকে তার আর লাগবে না।’

রেখা বানুর প্রতিটি কথা কাব্যর বুকে তীরের ফলা হয়ে বিঁধল। রেখা চলে যাবার জন্য পা বাড়ালে কাব্য রেখার এক হাত বন্দী করে আটকে ফেলল। বুকে পাথর চাপা দিয়ে বলল,
‘ঠিক আছে আমি বিয়ে করবো। তোমার ইচ্ছেই রাখবো।’

রেখা বানুর ঠোঁটের আলিজে হাসি ফুটে। তিনি অনাবিল আনন্দে উত্তেজিত হয়ে কাব্যর গালে হাত ছুঁইয়ে বললেন, ‘সত্যি বাবা! তুই বিয়ে করবি?’

কাব্য বলল, ‘হুম করবো। তবে রাত্রিকে নয়৷ উনি আমাকে তার ভালো বন্ধু মনে করেন। অনেক রেসপেক্ট করেন আমাকে। আমি চাইনা আমাকে নিয়ে ওনার মনে পোষা সম্মানটা নষ্ট হয়ে যাক।’

রেখা বানু হো হো করে হেসে উঠলেন। তাকে হাসতে দেখে কাব্য অবাক না হয়ে পারল না। কাব্য আবারও বলল, ‘মা আমি হাসির কিছুই বলিনি এখানে। সিরিয়াস একটা কথা বলেছি। হাসার কারণ বুঝলাম না!’

‘হাসবো না তো কি কাঁদবো? মেয়েটাকে এত কাছ থেকে দেখেও ওর মন পড়তে পারলি না তুই! আমার ছেলেটা আসলেই অনেক বড়ো বোকা। তোর বোকামি দেখে আমি সত্যিই আশাহত হলাম।’

‘তুমি কি বলতে চাচ্ছো, মা? একটু স্পষ্ট করে বলবে?’

‘এখনও বুঝিসনি? আরে গর্দভ, রাত্রি তোকে ভালবাসে। তুই এখনো বুঝতে পারলি না, অথচ আমি বুঝে সারা! আমি তো সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম, যেদিন ওকে প্রথম আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলি। তোর প্রতি এতটা জানার ইচ্ছা দেখে আমার বুঝতে একটুও সমস্যা হয়নি যে ও তোকে ভালবাসে। তবে আফসোস! মেয়েটার কপালটাই খারাপ।’

‘মা তুমি না জেনে কাউকে নিয়ে কিছু বলতে পারো না। এটা খুব খারাপ লাগল।’

রেখা স্মিত হেসে বলল, ‘আমি মা। সাথে নারীও। একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের মনের কথা খুব সহজেই বুঝে যায়। আমি জোর দিয়ে বলতে পারব রাত্রি তোকে ভালবাসে। লিখে রাখ,অক্ষরে অক্ষরে মিলবে।’

‘মা আমি এসব নিয়ে সত্যি কথা বলতে চাইনা। আর আমি জানি না তুমি কতটা নিশ্চিত। তবে যদি তোমার কথা সত্যি হয়, তাহলেও আমার কিছু করার নেই। আমি দুঃখিত। এখান বসে থাকলে তুমি আমার মাথা ঝালাপালা করে ছাড়বে, তাই আমি উঠলাম।’ কথাগুলো বলে সত্যি সত্যি পা চালালো কাব্য। তখন রেখা পেছন থেকে বলল,
‘ভেবে দেখতে পারিস। অনেক সময় আছে তোর কাছে। মনোযোগ দিয়ে ভাব।’

‘আমার আর কিছু বলার নেই মা। মিতুবুড়িকে আমি ভালবাসি আর আজীবন ভালবেসে যাব।’ কাব্যর শেষ কথার পরে রেখা কিছু বলেছি কিনা, তা কাব্যর জানা নেই। কারণ ততক্ষণে সে অনেকটা দূরে চলে এসেছিল রেখার থেকে। এরপর গাড়ি চলে এলে বাবা-মার থেকে দোয়া চেয়ে পাড়ি জমালো চেনা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
চলবে ইনশাআল্লাহ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here