উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ১২
দীর্ঘ একমাস পরিশ্রম শেষে আজ প্রাণ খুলে শ্বাস নিল কাব্য। একরাশ চিন্তার অবসান ঘটলো যেন। মনে তার প্রশান্তির আমেজ। অনেক দিন পর কাব্য পা বাড়ালো তার চেনা মুখের খোঁজে। এতদিনের জমে থাকা বিতৃষ্ণা কাটানোর পথে নিরন্তর ছুটে চলেছে সে। দ্রুত গতিতে পা চালাচ্ছে। আর মাত্র কিছুদূরের ব্যবধান মাত্র। কিন্তু তবুও এই সামান্য দুরুত্বটুকু কাব্যর কাছে মাইলের পর মাইল সমান দূর মনে হচ্ছে। এতোগুলো দিন পার করেও যেন এই অসহনীয় অনুভূতির জাগরণ হয়নি যা এই মুহুর্তে হচ্ছে। কাব্যর দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে না পেরে এবার দৌঁড় লাগালো দ্রুত পথ অতিক্রম করার জন্য। খানিক বাদে সে পৌঁছে গেল চিরচেনা, ভাললাগার জায়গাটাতে। তার নিশ্বাসের বেগ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক, অনেক বেশি ভারী। বুক ধকধক করছে। কাব্যর মনে হচ্ছে তার হৃদপিণ্ড এই বুঝে বাহিরে এসে লাফাতে শুরু করবে। সে মনে মনে যা ভেবেছিল তাই হলো। তার মিতুবুড়ি ঠিক তার পথ চেয়ে বসে আছে। এই ভেবে কাব্য বুকের ডান পাশে হাত রেখে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটিয়ে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘মিতুবুড়ি!’
মিতু প্রতিদিনের মতো আজও তার কাব্য ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। আজ মিতুর অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে তার কাব্য ভাইয়ের ডাকে। মিতু তার কাব্য ভাইয়ের হাসিমিশ্রিত মুখের দিকে এক ঝলক চেয়ে নাক কান খিচে দৌঁড় লাগায়। এক দৌঁড়ে কাব্যর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। মিতু যেন তার কাব্য ভাইকে নয়, কোনো এক অমূল্য রতন পেয়ে গেল। যা পাওয়ার খোঁজে এক নদী সমান বেদনার ঢেউ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে।
‘ওরে পাগলী ছাড় আমাকে। কেউ দেখে ফেললে মহাভারত শুরু হয়ে যাবে। কতবার এই এক কথা বলতে হবে হুম?’
মিতু কাব্যর বুকে মাথা ঠেকিয়েই বলল,
‘দেহুক না। যার যার দ্যাহার ইচ্ছা দেহুক। আমি আমার কাব্য ভাইরে বিশাল এক যুগ পরে পাইছি। আমি আমার কাব্য ভাইরে ছাড়ুম না কইয়া দিলাম। তুমি আইজ আর আমারে আটকাইতে পারবা না। আইজ আমার আর আমার কাব্য ভাইর মইধ্যে কেউ আইতে পারবো না। কেউ না।’
‘তুই এতো মিস করেছিস আমায়?’
‘হুম অনেকগুলান মিস করছি তোমারে।’
‘অনেকগুলো মিস! মিস করা বুঝি গোনা যায়?’
‘গোনা যায় তো। আমি তো তোমারে খাইতে, বইতে, উঠতে, যাইতে,ঘুমাইতেও মিস করছি। যেই কয়বার মিস করছি। গুনলে অনেকগুলানই হইবো। হেইগুলা হিসাব ছাড়া, বুঝলা কাব্য ভাই?’
‘আচ্ছা বুঝলাম। এবার আমাকে ছেড়ে দে। আমি তোর থেকে দূরে যাচ্ছি না। আজ অনেক সময় তোর সাথে আড্ডা দেব, অনেক কথা বলবো ঠিক আগের মতো।’
‘ছাড়মু না মানে ছাড়মু না। আগে আমার কলিজাডা ইকটু ঠান্ডা হোক হেরপর।’
‘ছি ছি, এভাবে বলতে নেই মিতুবুড়ি। তুই কথাটা যত সহজে বললি, তত সহজ কিন্তু না। খুব জটিল। বিশাল এক সমীকরণ জড়িয়ে আছে এর মাঝে।’
মিতু কাব্যর বুক থেকে মাথা তুলে নিল। কৌতূহলী চোখজোড়া কাব্যর দিকে তাক করে বলল,
‘তুমি কি কইলা কাব্য ভাই? কথার মইধ্যে আবার গণিত পাইলা কই?’
‘গণিত মানে?’ পাল্টা প্রশ্ন করে বসল কাব্য।
‘তুমি কি জীবনে গণিত বই দ্যাহো নাই?’
‘দেখেছি। কিন্তু কেন?’
‘তাইলে আবার জিগাও ক্যান, “গণিত মানে?”
‘আহা পাগলী মেয়ে! আমি বলতে চেয়েছি গণিত কোথা থেকে আসলো। গণিত নিয়ে তো কিছু বলিনি আমি।’
‘এইডাই তো আমার প্রশ্ন। তুমি আমার প্রশ্ন ক্যান জিগাইতাছো? তুমি কইলা সমীকরণ। তাই আমি কইলাম গণিত পাইলা কই? সমীকরণ তো গণিতের মইধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আমার খুব মজার একখান অধ্যায় হইতাছে সমীকরণের অধ্যায়।’
‘হায় আল্লাহ্! আমি কার পাল্লায় পড়লাম। এই মেয়ে দেখি কিছুই বোঝে না। আচ্ছা বাবা আমার ভুল হয়েছে। তুই চানামুঠ খাবি? আজ তোর জন্য পুরো এক ব্যাগ চানামুঠ এনেছি অনেক দূর থেকে। তুই সব শেষ করে তারপর বাসায় যাবি আজ।’
‘চানামুঠ! কই দেও। কতদিন আমারে চানামুঠ দেওনা তুমি। আইজ আমি অনেক চানামুঠ খামু।’
‘খাবি, খাবি, তোর জন্যেই এনেছি পাগলী।’ এই বলে কাব্য তার হাতের থলে দুটা এগিয়ে দেয় মিতুর দিকে।
মিতু থলের মধ্যে চোখ বুলিয়ে আঁতকে উঠে বলল,
‘কাব্য ভাই!’
‘হুম?’
‘তুমি চানামুঠের লগে এইগুলা কি আনছো?’
‘কেন চিনতে পারছিস না?’
‘চিনতে তো পারতাছি। এইগুলা তো মাইয়াগো সাজগোজের জিনিস। লিপিস্টিক, কাজল, চুড়ি, আরও কত কিছু! বাকীগুলার নাম তো জানি না আমি।’
‘আমিও তো জানি না এসবের নাম। দোকানদার যা দিল তাই নিয়ে এলাম।’
‘কিন্ত আমি যে এইগুলা দিয়া সাজতে পারি না কাব্য ভাই। তুমি টাকা দিয়া শুধু শুধু এইগুলা কিনতে গেলা ক্যান?’
‘কোনদিন তো তোকে সাজতে দেখলাম না আমি। আমার কত শখ তোকে বউ সাজে দেখবো। তুই টাটকা রক্তের মতো একটা লাল রঙের শাড়ি পরবি। তার সাথে বউ সাজ। ইশ! আমি যদি একবার সেই সাজে তোকে দেখতে পেতাম, তাহলে মন জুড়িয়ে যেত।’
‘যেইদিন আমার বিয়া হইবো, ওইদিন মন ভইরা আমারে দেইখ্যা নিও কাব্য ভাই।’
‘সেইদিনটা যে কবে আসবে? ওইদিনের অপেক্ষায় থাকবো আমি। কিন্তু ওইদিন তোকে শুধু আমি দেখবো। আর অন্য কোনো পুরুষকে দেখতে দেব না বলে দিলাম। শুধু আমি মন ভরে দেখবো আমার মিতুবুড়িকে।’
‘হেইডা কেমনে হয় কাব্য ভাই? অন্য পুরুষ না দেখলেও আমার বর তো আমারে দেখবোই দেখবো। হেয় না দেখলে আমার বিয়া কেমনে হইবো?’
‘আরে বোকা মেয়ে আমিই তো তোর ব….।’ কাব্য কথাটা শেষ করলো না। অসম্পূর্ণ রেখে বিরাম নিল।
‘থাইম্যা গেলা ক্যান কাব্য ভাই? পুরা কথাখান কও হুনি?’
‘কিছু নারে। তুই এগুলো দিয়ে একদিন সেজেগুজে দেখাস আমায়। কেমন?’
‘আইচ্ছা, কিন্ত বাজান যদি এইগুলা দেইখ্যা আমারে মারে আগের বারের লাগান?’
‘দেখাবি না। নয়নার কাছে রাখবি। তাহলে দেখতে পারবে না।’
‘হ, এই কাজখান করা যায়। নয়নার কাছেই রাখমু এইগুলা। আর নয়নারে কমু আমারে কাইল ইকটু সাজাইয়া দিস। নয়না তো খুব সুন্দর কইরা সাজতে পারে৷ আমারে কত কয় সাজার লাইগ্যা। আমিই সাজি না। বাজান কইছে মাইয়া মানুষের অত সাজা লাগে না।’
‘হুম তোর বাজান ঠিকই বলে। মেয়েরা শুধুমাত্র তার স্বামীর জন্য সাজবে। তোর ইচ্ছে তুই চাইলে সাজবি, আর না চাইলে সাজবি না। আমি জোর করবো না। আচ্ছা শুনলাম সেতু নাকি অনেক দিন হয়েছে তোদের বাড়ি এসেছে?’
মিতু বলল, ‘হ তোমার পরীক্ষা যেইদিন থেইক্যা শুরু হইছে, ওইদিন থেইক্যাই আমাগো বাইত্তে। এহনো আছে বুবু।’
‘কেন? ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন কিছু বলছে না এতদিন বেড়াচ্ছে বলে?’
মিতু ক্ষীণ গলায় বলল, ‘না কিছু কয় না তারা।’
‘ও আচ্ছা, ভালোই। এতদিন এসেছে সেতু, কিন্তু আমাদের বাড়ি একবার এলো না কেন বলতো? মা যেদিন শুনেছে সেতু এসেছে, সেদিন থেকেই ওকে দেখার জন্য পাগল হয়ে আছে। বাবা তো মাকে কোথাও যেতে দেয়না, তাই কোথাও যায়না মা। আমাকে আসার সময় বলে দিয়েছে তোকে যেন বলি সেতুকে আমাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য।’
‘কিন্ত বুবুতো কোনহানে যায়না। মায় আর বাজান নিষেধ কইরা দিছে কোনহানে যাইতে।’
‘তুই এভাবে চোরের মতো মুখ লুকিয়ে কথা বলছিস কেন মিতুবুড়ি? আমার দিকে তাকিয়ে কথা বল। আজব মেয়ে!’
‘কি আর কমু কাব্য ভাই? তেমন কিছু হয় নাই। আমি নয়নাগো বাইত্তে যাই। ওর প্রাইভেটের স্যার মনে হয় চইল্যা গেছে। আমি যাই গিয়া এইগুলা রাইখ্যা আসি ওগো বাইত্তে। নাইলে পরে মনে থাকবো না আমার।’
মিতু চলে যাবার উদযোগ পাতলে কাব্য বাঁধাসমেত বলে,
‘দাঁড়া তুই। আমাকে সত্যিটা না বলে এক পাও নড়বি না বলে দিলাম। আর তুই যে বললি কিছু হয়নি। আমি কি জিজ্ঞেস করেছি কিছু হয়েছে, কি হয়নি? আমি জিজ্ঞেস করেছি, এভাবে চোরের মতো মুখ লুকিয়ে কথা বলছিস কেন? তোর হাবভাবে বুঝলাম গুরুতর কিছু হয়েছে। তুই সোজাসাপটা উত্তর দে, নইলে তোকে আজ বাড়ি যেতে দিব না আমি৷’
‘উফ কাব্য ভাই! তুমি গোয়েন্দাগো মতো আমারে সবসময় জেরা করো খালি। কইতাছি কিছু হয় নাই, তারপরও জিগাইতাছো।’
‘জেরা করার মতো কাজ করলে, করতে তো হবেই। ভালোয় ভালোয় সত্যিটা বলে ফেল বলছি, নইলে আমিও নাছোড়বান্দা। জানিসই সেটা। তাই বলছি বলে ফেল জলদি।’ কাব্য এবার বেশ রুষিলা মেজাজেই বলল৷
তবে মিতু সেই আগের ভঙ্গিতেই বলে,
‘কোন সত্যি কওয়ার মতো নাই কাব্য ভাই। তুমি খালি প্যাঁচ ধরো। নয়না এতো প্যাঁচ ধরে না তোমার মতো।’
‘নয়না যে তোর মতোই বাচ্চা মেয়ে। তাই ধরতে পারেনা। শোন, আমি তোকে বেশিদিন চিনি না ঠিকই। কিন্তু যতটা চিনি তার পরিপ্রেক্ষিতে বলছি, তুই আমার থেকে খুব বড়সড় একটা সত্য লুকিয়ে যাচ্ছিস। কিছু একটা গোপন করার চেষ্টা করছিস। এত হেয়ালি না করে বলে ফেল না!’
‘মায় আমারে কারো কাছে কইতে মানা করছে। মায় কইছে এই কথাখান পুরা গেরামে ছড়াইয়া গেলে আমাগো মান সম্মান নাকি থাকবো না। লোকে আমাগো নিয়া ছি ছি করবো। তার লাইগ্যা আমি কইতে পারুম না কাব্য ভাই। আমারে তুমি মাফ কইরা দেও। দয়া কইরা এই বিষয়ডা নিয়া আর কোন প্রশ্ন কইরো না।’
‘তুই কি তোর কাব্য ভাইকে চিনিস না? আমি কেমন মানুষ তুই কি সেটা জানিস না? আমি কাউকে বলবো না। তুই নির্ভয়ে বল কি হয়েছে।’
‘সত্যি কাউরে কইবা নাতো? আমি কিন্তু আমার প্রিয় মিতা নয়নারে পর্যন্তও কই নাই কথাখান।’
‘হুম বলবো না বললাম তো। তুই আমাকে বিশ্বাস করে বলতে পারিস। এই কথাটা কেবল তোর আর আমার মধ্যেই থাকবে। এটা কাব্যর ওয়াদা।’
‘আইচ্ছা, ওয়াদা যহন দিছো কই তাইলে। তুমি কিন্তু আবার ওয়াদা ভঙ্গ করবা না কইয়া দিলাম। ওয়াদা ভঙ্গকারীরে আল্লাহ্ পছন্দ করেন না। আমি আমাগো ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইতে…..।’
‘থাক আর বলতে হবে না। আমি জানি ওয়াদা ভঙ্গ করা খারাপ কাজ। এতে আল্লাহ্ নারাজ হন। তুই আমার উপর বিশ্বাস না করলে যেতে পারিস। আমি তোকে আটকাবো না। কিন্তু মনে রাখিস, তোর সাথে আমি সারাজীবনের জন্য আড়ি করে নেব। তারপর তুই হাজার চাইলেও আর ভাব করবো না দেখে নিস।’
মিতু কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে শেষে হার মানে।
‘আইচ্ছা হুনো তাইলে। বুবুর ননাশে তারে মিথ্যা অপবাদ দিয়া হগলের কাছে ছোডো করছে। বুবু নাকি কোন ব্যাডার লগে লুকাইয়া কথা কইতাছিল। ঠিক তহনি বুবুর ননাশ বুবুরে আর হেই ব্যাডারে নাকি এক লগে দেইখ্যা ফেলাইছিল। এই নিয়া বুবুরে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বাইত থেইক্যা বাইর কইরা দিছে। তারপর থেইক্যা বুবু আমাগো লগেই আছে।’
কাব্য হত-বিহবল চাহনি নিয়ে বলল,
‘কি বলছিস তুই! সেতু এমন কাজ করেছে! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। ওতো খুব ভালো একটা মেয়ে। আমাদের গ্রামের প্রায় সবাই সেতুকে খুব ভালো জানে।’
‘নাগো কাব্য ভাই, আমার বুবু এইরকম কাজ করে নাই৷ উল্টা আমার বুবুই তার ননাশরে হাতেনাতে ধরছিল। কিন্তু হেই বেডি চালাকি কইরা আমার বুবুরেই ফাঁসায় দিছে।’
কাব্য বলল, ‘হুম, সেটাই হয়েছে। সেতুকে আমি চিনি। ও খুব ভালো একটা মেয়ে। একসাথে পড়েছি তাই জানি কার স্বভাব কেমন। তবে দেখবি আল্লাহ্ ওই খারাপ মহিলাটার বিচার একদিন না একদিন ঠিকই করবে। আচ্ছা তুই এখন যা তাহলে।’
‘আইচ্ছা, কিন্তু কাব্য ভাই আমি তো তোমারে একবার জিগাইলামই না তোমার পরীক্ষা কেমন হইছে! তোমারে দেইখ্যা এত খুশি হইছি যে জিগাইতে ভুইল্যাই গেছিলাম।’
‘সমস্যা নেই। খুব ভালো হয়েছে আমার পরীক্ষা। সবার দোয়া যে ছিলো আমার সাথে। ইমম, ভুল বলেছি। কারণ আমার পরীক্ষা খুব বেশি ভালো হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। তাছাড়া ভালো তো হতেই হবে কারণ আমি যে আমার বাবার লক্ষ্য, স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।’
‘তুমি খালি স্বপ্ন স্বপ্ন করো। কোনদিন তো কইলা না কি স্বপ্ন তোমার।’
‘সে বলবো একদিন। ওই তুই না নয়নাদের বাসায় যেতে চেয়েছিলি?’
মিতু মাথায় হাত তুলে বলে,
‘হায় হায়, আমি তো ভুইল্যাই গেছিলাম হেইডা।’
‘যা তবে। আগামীকাল আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। আর হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি আসিস।’
***
আজ বেশ কয়দিন মছিদা বেগমের ঠিকমতো খাওয়া নেই, নাওয়া নেই মেয়ের চিন্তায়। উম্মাদের ন্যায় বাড়ির এক কোণে পড়ে থাকেন তিনি। সেতুকে বের করে দেওয়ার ১সপ্তাহ পর থেকে রাবেয়া নিখোঁজ। সাথে আকিজও। তাদের দুজনের একসাথে নিখোঁজ হওয়ায় সবার কাছে বিষয় টা খোলাসা হয়ে যায় যে, সেতু সেদিন সত্যি কথাই বলেছিল। আকিজের সাথে সেতুর নয়, রাবেয়াই প্রেমে লিপ্ত ছিল। তবে বুঝতে দেরী করে ফেলায় আজ মছিদা কপাল থাপড়ানো ছাড়া আর কোনো কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না। উনি যে কতগুলো নির্ঘুম, যন্ত্রণাদায়ক রাত কাটিয়েছেন তা হিসাবযোগ্য নয়। একজন মা-ই বোঝে সন্তান হারানোর শোক ঠিক কতখানি! কথায় আছে না, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। অন্যের মেয়েকে কম জ্বালাতন করেননি মছিদা বেগম। পাপের সের ভরে গেলে হয়তো হারাবে ধন-সম্পদ, আর নয়তো ভুগবে কঠিন অসুখে। দুটোতেই আছে মহাসাগর সমান বেদনা। সেই বেদনা যেকোনো সময় একটি সুস্থ সবল ব্যক্তিকে নিমিষেই মরণব্যাধি রুগীতে পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। যেভাবেই হোকনা কেন, বিধাতা পাপের শাস্তি না দিয়ে কাউকে মৃত্যুর দুয়ারে আহবান জানান না। সেই শাস্তি থেকে যে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ভালোর পথে ফিরে আসে, সেই শেষ হাসির সুঘ্রাণ পায়। নতুবা পাপের ফল পেয়ে যায় অনন্তকাল পর্যন্ত। কুকর্ম মানুষকে টেনে নিয়ে যায় ধ্বংসস্তুপের দিকে।মায়ের এমন মরণাপন্ন অবস্থা দেখে নাহিদের মনেও সুখ নেই। যতই সে খারাপ চরিত্র বৈশিষ্ট্যবান হোকনা কেন, নাহিদ তার মায়ের জন্য জীবনও দিয়ে দিতে পারে। তাইতো সে মায়ের শুকনো মুখখানা দেখে মনকে শান্তনা দিতে পারছে না কোনো ভাবেই। প্রতিদিন খাবারের প্লেট নিয়ে বসে থাকে মায়ের পাশে। হাজার নলপত করার পর দু লোকমার একটা ভাতও বেশি খাওয়াতে পারেনা মছিদা বেগমকে। নাহিদ মছিদাকে সামলাতে না পেরে তার ছোট খালা রশিদাকে তলব পাঠিয়েছেন। রশিদা ওইদিনই চলে আসেন বোনের দুর্বিষহ খবর পেয়ে। তিনি বোনের মাথা ঘাড় ডলে আপ্রাণ চেষ্টা করে বোঝানোর। একটু খাওয়ানোর।
‘খেয়ে নেরে আপা। তুই এমন করলে বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারবি না। অমন নির্লজ্জ মেয়ের জন্য কান্না করে লাভ নেই। সে তো আর মায়ের চিন্তা করেনি। করলে তো এই বয়সে বংশের মুখে চুনকালি মেখে ধান কাটা লোকের সাথে পালাতো না।’
‘আমি যে আর পারি নারে। আমার মন যে আর মানে না রে। আমার মন খালি কু ডাকেরে। কিছুতেই বুঝাতে পারছি নারে। আমার রাবেয়া কইরে? কইরে রাবেয়া তুই? মার কথা কি মনে পড়ে নারে? তোরা আমার রাবেয়াকে এনে দেরে।’ মছিদা বেগম গীত গেয়ে গেয়ে কথাগুলো বলছেন। তিনি মনকে বোঝানোর জন্য যেভাবে পারছেন গলা ছেড়ে কান্নারসহিত হাবিজাবি বলে যাচ্ছেন। রশিদাও ব্যর্থ প্রায়। তিনি বুঝলেন, মছিদা তার মেয়ে রাবেয়াকে নিজ চোখে না দেখা পর্যন্ত শান্ত হবে না।
‘এরকম করিস না আপা। তুই নিজের নাক মুখের হাল দেখ কি বানিয়ে ফেলেছিস। সব ভুলে যা। মনকে শান্ত কর। আজ নয়তো কাল আমাদের রাবেয়া এখানেই ফিরে আসবে। গয়নাগাটি,টাকা পয়সা আর যা নিয়ে পালিয়েছে সব শেষ হলেই দেখবি চলে আসবে। অভাব সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা। অভাবে পড়লে ঠিক চলে আসবে রাবেয়া।’
‘আমার মন সেটা বলে নারে। আমার রাবেয়া ভালো নেইরে। আমার রাবেয়ার বড়ো কোনো বিপদ হয়েছেরে। তোরা কেউ বুঝবি নারে। আমার মন যে মানে না।’
মছিদা বেগম কোনভাবেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছেন না।
রশিদা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, ‘আজ তোর এই হাল কেন হয়েছে জানিস আপা? পাপের ফল পেয়েছিস তুই। নিরীহ, নিষ্পাপ ছেলের বউটার সাথে কি অত্যাচার টাই না করেছিস তুই! দেখ আজ তুই তোর মেয়ের জন্য কতটা কষ্ট পাচ্ছিস। এভাবে সেতুও কোনো এক মায়ের সন্তান। সেই মায়েরও তো বুক ফাটে মেয়ের জন্য। পেটের সন্তানের কষ্ট কোনো মা সইতে পারে না আপা। তার প্রমাণ তুই নিজেই।’
‘ওই মেয়েটারই সব দোষ। আমার বাড়িতে কুনজর লাগিয়েছে। কাল নিয়ে এসেছে এই বাড়িতে। কাল!’
‘ছি আপা! তুই এখনো অনুতপ্ত হসনি? খোদার গযব পড়েছে, তাও তোর পাষাণ মন গললো না?’
‘কখনোই গলবে না। ওই অশিক্ষিত, ফকিন্নির মেয়ের জন্য কখনো আমার মনে একটা বালি সমান অনুশোচনা জন্মাবে না।’
‘তুই যাকে অশিক্ষিত বলছিস, সেই অশিক্ষিত, ফকিন্নি মেয়েরই অভিশাপ লেগে গেছে তোদের উপর। মিথ্যে অপবাদে মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলি তোরা। দিনের পর দিন কতই না অত্যাচার করেছিস মেয়েটার উপর। ঠিক এগুলো চোখ দিয়ে দেখতে পারতাম না বলেই তোদের বাড়ির চৌকাঠে আসতাম না। মেয়েটাকে দেখলেই মায়া হয় আমার। কি সুন্দর মায়াবী মুখ। ওইরকম ফুটফুটে বউটার সাথে এত জঘন্য অপরাধ কিভাবে করতে পারলি রে তোরা? শোন রে আপা, এখনো সময় আছে মেয়েটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। আমার মনে হচ্ছে সেতু ওর অভিশাপ তুলে নিয়ে তোদের মাফ করে দিলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তোর রাবেয়াকে পেয়েও যেতে পারিস আল্লাহ চাইলে।’
মছিদার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো রশিদার কথায়। সে বলল, ‘তুই সত্যি বলছিস তো রশিদা? সেতু ওর অভিশাপ তুলে নিলে আমি আমার মেয়েকে পেয়ে যাবো!’
‘ইনশাআল্লাহ্। আল্লাহ কোনো না কোনো উপায় ঠিক বের করে দেবেন।’
‘তাহলে নাহিদকে বলি। নাহিদ, নাহিদ!’ মছিদা উচ্চস্বরে ডাকতে লাগলেন ছেলেকে। নাহিদকে ডাকার সাথে সাথেই নাহিদ এসে হাজির হয়ে গেল।
এসেই বলল, ‘কি হয়েছে মা? খালা, মার কি হয়েছে?’ নাহিদের নাকে মুখে খুশির ঝলক। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি।
‘তোর মার কিছুই হয়নি। তোকে কিছু বলবে বলে ডেকেছে। কিন্তু তুই এই দুঃসহ সময়ে হাসছিস কেন?’ রশিদা বললেন।
‘খালা এক সপ্তাহের মধ্যে মিঞা ভাই আসছে। আপার কথা জানতে পেরে এক মাস আগেই চলে আসছেন। ভাই এসে আপাকে খোঁজার জন্য গোয়েন্দার কাছে যাবে বলেছে।’
মছিদা বেগম বলল, ‘এটা তো খুব ভালো খবর রে। আমার নুরুল আসছে। কিন্তু বাবারে, আমার মনে তো আগের মতো খুশি নেই। তোর আপা যে আমার সব খুশি নিয়ে পালিয়ে গেল।’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে মা। তুমি বলো, কি বলবে আমায়।’
‘আসলে বাবা, আমি চাই তুই তোর বউ সেতুকে ওর বাপের বাড়ি থেকে ফেরত নিয়ে আয়।’
‘কিন্ত মা, তুমি তো বলেছিলে ওকে যেন আমি তালাক দিয়ে দেই। এখন আবার নিয়ে আসতে বলছো যে!’
‘না বাবা তালাক দিতে হবে না। পুরো এলাকায় কেউ তোর সাথে তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে চায়না। সেতুকে বিয়ে করার পর তোর আর যেকয়টা বিয়ে হয়েছিলো, সবগুলো বউই তো পালিয়ে গেছে। কেউ তোর সাথে থাকতে পারেনি। তাই ওকেই ফিরিয়ে আন। অন্তত বাড়ির সব কাজ করার জন্য হলেও।’
ঠিক তখন রশিদা বলে ওঠেন,
‘মার গুতা খেতে সবাই পারে নারে আপা! তার জন্য ধৈর্যশীল মেয়ে লাগে। সেতু হলো তেমন ধাঁচের মেয়ে। আচ্ছা অত কথা বাদ। নাহিদ বাবা, তোর বউয়ের সাথে আর অন্যায় করিস না। তোর মাকে আমি বুঝিয়েছি। তুই এবার ভালো হয়ে যা। খারাপ নেশা ছাড়। তোর মতো খারাপ স্বভাবের ছেলের সাথে সেতু ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে টিকতে পারবে না। প্রমাণ তো পেয়েছিসই। আরেকটা কথা, মেয়েটার বাচ্চা গাচ্চা হয়না ঠিক কিন্তু এর দোষ তো মেয়েটার না। দোষ তোর। তোরা সবাই মিলে মেয়েটাকে দোষ দিস শুধু শুধু। কিন্তু এটা ঠিক না। ভালো ডাক্তার দেখাতে যা। দেখবি তারাই বলবে তোরই দোষ আছে। কোন যুগে বাস করিস বলতো? তোরা তো শিক্ষার বড়াই করিস। কিন্তু তোদের আসলেই কি প্রকৃত শিক্ষা আছে? থাকলে নিজের দোষ পরের উপর চাপিয়ে দিনের পর দিন এমন নির্মম অত্যাচার গুলো করতে পারতিস না সেতুর প্রতি। আজ এর জন্যই তোরা শাস্তি ভোগ করছিস। পা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত পাপ ছড়িয়ে ফেলেছিস তোরা। আর না বাবা। এবার তোদের প্রায়শ্চিত্ত করার প্রয়োজন। আজ বিকেলেই রওনা দে তোর শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে। গিয়ে সেতুকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়।’
‘কিন্ত খালা, সেতু কি আর আসতে চাইবে আমার কাছে?’
‘মানাতে হবে। চেষ্টা করবি। দরকার পড়লে কটাদিন শ্বশুরবাড়িতে থাকবি৷ তোর মাকে আমি কয়েকদিন সামলে নিতে পারবো। চিন্তা করিস না আপাকে নিয়ে। আর আমার কথা মনে থাকে যেন! সেতুকে নিয়েই বাসায় ফিরবি বলে দিলাম।’
‘ঠিক আছে খালা। তোমরা যা ভালো মনে করো তাই হবে। আমি আজই যাচ্ছি সেতুকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে।’
চলবে ইনশাআল্লাহ….
বিঃদ্রঃআচ্ছা আপনারা গঠনমূলক মন্তব্য না করে চলে যান কেন? একদিন পর্ব না দিলে তো ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে পাগল করে দেন। এতই পড়ার ইচ্ছে হলে গঠনমূলক মন্তব্য করে আমাকে জানাতে তো পারেন আপনাদের অনুভূতিগুলো।