#গাংচিল
#৭ম_পর্ব
তিয়াশা মাটিতে বসে পড়ে। চিনচিনে ব্যাথা তাকে গ্রাস করছে, এ যেনো অসহনীয়। মাথাটা ঘুরছে। এই বুঝি জ্ঞান হারাবে সে। তখনই এক জোড়া হাত তাকে আগলে ধরে। রুমালটা মাথায় চেপে ধরে তার কপালে। তিয়াশা মাথা তুললেই দেখে তাকে অন্ত তাকে আগলে রেখেছে। অন্তুর উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি তাকে দেখে যাচ্ছে। তার হৃদস্পন্দন অনুভব করতে পারছে তিয়াশা। বহুবছর পর এই চাহনী দেখেছে সে, বহুবছর পর এই স্পন্দন অনুভূত হচ্ছে। তিয়াশার মনে হলো তার আশেপাশে কেউ নেই। শুধু অন্তু এবং সেই রয়েছে এখানে। কোনো কোলাহল তার কানে আসছে না। সকল শব্দ যেনো থেমে গেছে। শ্রবণেন্দ্রীয় শূণ্য হয়ে গিয়েছে। তার চোখের সামনে শুধু একজন ব্যাক্তি, অন্তু। যাকে কোনোকালে ভালোবেসেছিলো সে। যার সাথে জীবনের হিসেবগুলো ভাগ করে নিতে চেয়েছিলো। তিয়াশা অনুভব করলো সে যেনো শূন্যে ভাসছে। অন্তুর ব্যাকুল কন্ঠ কানে এলো,
“আমি উনাকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা এই লোককে বের করুন এখান থেকে”
বহুবছর পর এই ব্যাকুলতা অনুভব করতে পারছে তিয়াশা। তার মনে হলো এই ব্যকুলতা কেবল ই তার জন্য। কেবলই তার জন্য। আচ্ছা, অন্য কেউ হলেও কি অন্তু এমনটাই করতো? হয়তো, হয়তো না। প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া বা না পাওয়ার উপর কিছুই যায় আসে না। কারণ সময়টা বদলে গেছে। বদলে গেছে সম্পর্কটা। এখন তারা কেবলই দুজন অপরিচিত মানুষ, যাদের পৃথিবী ভিন্ন, চাহিদা ভিন্ন।
ইমার্জেন্সি রুমের বেডে বসে রয়েছে তিয়াশা। অন্তু নিজ হাতে তার ট্রিটমেন্ট করছে। পেপারওয়েটটার ভার বেশি হওয়ায় বেশ খানিকটা থেতলে এবং কেটে গিয়েছে। চারটা স্টিচ লেগেছে। বোন ফ্রাকচার হয় নি ভাগ্য ভালো ছিলো। অন্তু বেশ ভালো করে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। কাঁটা স্থানে মেডিসিন দেবার সময় অসম্ভব জ্বলন অনুভুত হচ্ছিলো। এখন অনেকটাই কমে এসেছে। তিয়াশার সাহস অনেক তাই স্টিচের সময় সে একবারের জন্য উহ, আহ করে নি। এতোটা সময় অন্তু একটা কথাও বলে নি। তিয়াশা আড়চোখে শুধু অন্তুকেই দেখে গেছে। তার চোয়াল শক্ত, দৃষ্টি স্থির। সকল উচাটনের যেনো সমাধান হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ একজন নার্স এসে বললেন,
“স্যার আমি করে দিচ্ছি, আপনি লান্স এ যেতে পারেন”
অন্তু তার স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বললো,
“আপনি চিন্তা করবেন না, আমি খেয়ে নিবো। রোগী ছেড়ে খেতে যাওয়াটা আমার স্বভাবে নেই। আপনি বরং লান্স করে আসুন।“
নার্স কথা বাড়ালো না। তিয়াশা নীরবতা ভাঙ্গলো, ধীর স্বরে বললো,
“আমি ঠিক আছি, সামান্য চোঁট লেগেছে। আপনি খেতে যেতে পারেন।“
“আমি কি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি? ডাক্তারিটা মুখ দেখে পাস করি নি। নিশ্চয়ই আমার জ্ঞান আপনার থেকে বেশি। অহেতুক কথা বলবেন না।“
শক্ত কন্ঠে কথাটা বললো অন্তু, তারপর আবার প্রেসক্রিপশন লেখা শুরু করলো সে। তিয়াশার খানিকটা মানে লাগলো কথাটা, হ্যা সে ভালো কোনো ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করে নি; হ্যা, সে ডাক্তার নয়। তাই বলে তাকে নিচু করে কথা বলার অধিকারটা অন্তু রাখে না। আর তার শরীর, ভালো লাগছে না খারাপ সেটা নিশ্চয়ই অন্তু তার থেকে ভালো জানবে না। তিয়াশার একটি ভালো গুন রয়েছে, তার রাগ হলে সে চুপ হয়ে যায়। তার ফর্সা নাকটা রাগে লাল হয়ে যায়, কিন্তু মুখ ফুটে একটা শব্দ ও বের হয় না তার। অন্তু প্রেসক্রিপশন লিখে ধীর স্বরে বললো,
“স্টিচ সারতে সময় লাগবে, সাতদিন পর আমি স্টিচ কেঁটে দিবো। এই সময়ে পানি লাগানো যাবে না। আমি একটা নোট লিখে দিয়েছি, অফিসে গিয়ে দেখালে ছুটি হয়ে যাবে। সাত দিন রেস্ট নিলে তাড়াতাড়ি সেরে যাবেন। এখন আপনি বাসায় যাবেন। আমি খালিদের কাছে ঔষধগুলো দিয়ে দিচ্ছি। খালিদকে বললে ও একটা সিএনজি ভাড়া করে দিবে। “
“আমার তো ছুটি লাগবে না। দিন প্রেসক্রিপশনটা। আমি যাবার সময় ঔষধগুলো কিনে নিবো।“
বেশ স্বাভাবিক ভাবেই কথাটা বললো তিয়াশা। অন্তু থেকে যে সে কোনো সাহায্য নিতে চায় না, এটুকু বুঝতে বাকি রইলো না অন্তুর। অন্তুর স্থির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো, তার ভ্রু যুগলো কুঁচকে আসলো। কড়া কন্ঠে বললো,
“আপনার এখন রেস্টের প্রয়োজন। এখন আপনি বাসায় যাবেন।“
“আপনার ডাক্তারি জ্ঞান থাকতে পারে, কিন্তু আমার শরীর সম্পর্কে আমার ও জ্ঞান আছে। পঁচিশটা বছর এটাকে আমি সামলে রেখেছি কি না!”
“অহেতুক কথা আমার পছন্দ নয় তিয়াশা। এখন বাড়ি যাচ্ছো তুমি”
দাঁতে দাঁত পিষে কথা বললো অন্তু। রাগে তার চোখ থেকে যেনো আগুন বের হচ্ছে। চোয়ালগুলো আরোও শক্ত হয়ে রয়েছে। কিন্তু তিয়াশাও পিছিয়ে যাবার মানুষ নয়। যার সাথে সকল সম্পর্কের পাঠ চুকিয়ে এসেছে সে। তার কিসের এতো অধিকার! তার উপর এখন অন্তুর কোনো অধিকার নেই। নিজ হাতে এই অধিকারের স্থানটা নষ্ট করে দিয়েছে তিয়াশা। অন্তুর রাগকে পাত্তা না দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললো,
“সেটা না হয় আমাকেই বুঝতে দিন। অফিস কামাই করে বেতন কাটার বিলাসিতাটা আমি করতে পারবো না। দিন প্রেসক্রিপশনটা।“
প্রেসক্রিপশোন নেবার জন্য হাত বাড়ালে অন্তু বাধ্য হয় তাকে সেটা তিয়াশার হাতে দিতে। ইমার্জেন্সি রুমের মানুষের অভাব নেই। এখন একটা সিন ক্রিয়েট করার মানে হয় না। সত্যি ই তো তিয়াশার বিষয় সেই বুঝবে, তার মতো অযাচিত মানুষের টিপ্পনী সে কেনো শুনবে। অন্তুর রাগ আকাশ ছুলো। সে হনহন করে বেড়িয়ে গেলো ইমার্জেন্সি রুম থেকে। নিজের কেবিনে এসেও নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। সব কিছু ভেঙ্গে ফেললে হয়তো শান্তি পেতো। তিয়াশা একবার আবার তাকে বুঝিয়ে দিলো তার স্থান। সে এখন তিয়াশার জীবনের কোনো স্থানে নেই ব্যাপারটা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিলো তাকে। ভালোবাসা নামক জ্বলন্ত আগুনে অজান্তেই ঝাঁপ দিয়েছিলো সে। আজ সেই আগুনে নিজেই জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। এতই কি সোজা সব অনুভূতিকে অস্বীকার করা। এতোই কি সোজা সেই সুন্দর স্বর্ণালী মূহুর্তগুলো ভুলে যাওয়া। যেখানে ছিলো শুধু অন্তু এবং তিয়াশা। যেখানে ছিলো শুধু ভালোবাসা। না না, শারিরীক কাছে আসাটা তাদের হয় নি। সম্পর্কটা খুব পবিত্র হলেও বয়সটা ছিলো কম। তিয়াশার দাবি ছিলো যখন পরিবারের সম্মতিতে বিয়েটা হবে সেদিন ই দৈহিক মিলনটা ঘটুক। অন্তু ও কোনো আপত্তি করে নি। ভালোবাসা তো মনের মিলন, তাতে দেহের মিলনে কি যায় আসে। এই কথাগুলো মনে পড়লে মনটা বিষিয়ে উঠে অন্তুর। সবই ফাঁকা আওয়াজ ছিলো। অহেতুক স্বপ্ন, অহেতুক বেদনা। যদি থাকার ই না হয় তবে কেনো এসেছিলো। কেনো নিজের আধিপত্য করেছিলো মনের রাজ্যে। মাথাটা ব্যাথা করছে। রাগ হচ্ছে। নিজের টেবিলে সজোরে আঘাত করলো সে। হাতের ব্যাথায় মনের ব্যাথাটা কিছুটা হলেও ভুলে থাকা, যদিও তা নিতান্ত ব্যার্থ চেষ্টা____________
৪.
মৌপ্রিয়া তার লেখাগুলোকে সিন সিন বাই সিন সাজাচ্ছে। বাহিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানালা দিয়ে ছিটকে আসছে বৃষ্টির পানি। টেবিলের সামনের টুকু খানিকটা ভিজে গিয়েছে। এই আবহাওয়াতে লিখতে ভালো লাগে মৌপ্রিয়ার। মনটা শান্ত থাকে তখন, শব্দ গুছোনা খানিকটা সহজ হয়ে যায়। তার উল্টোপাশে গভীর চিন্তায় চোখ বুঝে রয়েছে সীমান্ত। আসার পর থেকে লোকটা কিছু একটা নিয়ে গভীর চিন্তা করছে। যেখানে তার মুখ আটকানো দায় হয়ে যায়, সেখানে সে আসার পর থেকে চুপ। মৌপ্রিয়া আড়চোখে তাকে দেখে নিলো খানিকটা। আজ নীল পাঞ্জাবী পড়ে এসেছে। পাঞ্জাবীটা খানিকটা কুচকে আছে। হয়তো কলেজের জন্য বের হবার সময় স্ত্রী করা হয় নি। সামনে দলামচা যা পেয়েছে তাই পড়ে ছুটেছে। লোকটাকে দুদিন আগে আগের বই টা পড়তে দিয়েছে মৌপ্রিয়া। তার কোনো রেসপন্স এখনো পায় নি। হয়তো পড়া শেষ হয় নি তার। মোউপ্রিয়াও কোনো প্রশ্ন করে নি। হঠাৎ সীমান্ত গভীর চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“নায়ক-নায়িকাকে সবসময় সুন্দর কেনো হতে হয় মৌপ্রিয়া। আমি, তুমির মতো সাধারণ মানুষ হলে ক্ষতি কি? ধরো গল্পের নায়ক আমি, নায়িকা তুমি। গল্পটা কি খুব বেমানান হবে?”
সীমান্তের প্রশ্নে …………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি