#গাংচিল
#৪র্থ_পর্ব
মৌপ্রিয়া কিছু বলার আগেই একটা ভারী কন্ঠ কানে এলো। তিয়াশার মুখোভাব পালটে গেলো। উজ্জ্বল ফর্সা মুখখানা শ্রাবণে কালো মেঘের ন্যায় দমে গেলো। মৌপ্রিয়া মাথাটা কাত করে পেছনে দেখলো। অজান্তেই মুখ থেকে বের হলো,
“অন্তু”
মৌপ্রিয়াদের টেবিলের ঠিক দুটো টেবিল পড়েই একদল সাদা কোর্ট পড়া ছেলেমেয়ে বসা। তাদের কোলাহলে সিটি হসপিটালের ক্যান্টিন রমরমে হয়ে উঠেছে। খিলখিল প্রাণবন্ত হাসি। হয়তো আজ কোনো বিশেষ দিন, নয়তো ডাক্তারদের এতো সময় কই! সকলের মুখের দিকে একবার চোখ বোলালো মৌপ্রিয়া। প্রতিজনের মুখে ক্লান্তি, নির্ঘুম রাতের জানান দিচ্ছে চোখের নিচের কালি। কিন্তু মৌপ্রিয়ার চোখ একজনের দিকেই আটকে আছে। ফর্সা, লম্বাটে মুখের যুবকটি। পরণে সবার ন্যায় সাদা কোর্ট, চুল গুলো এলোমেলো, মুখ ভর্তি কালো ছোট দাঁড়ি। পুরুষালী ঠোঁটে সতেজ হাসি। লোকটিকে বহু আগ থেকেই চেনে সে। এবার তিয়াশার মুখোপানে চাইলো মৌপ্রিয়া। মেয়েটার মুখখানায় মলিনতা ছেয়ে আছে। নিজের সাথেই হয়তো লড়াই করছে। মৌপ্রিয়া তার হাতখানা ধরে গলার স্বর খাঁদে নামিয়ে বললো,
“অন্তু এখানে কাজ করে, এটা আগে বলিস নি কেনো?’
“বললে কি হতো?”
বিদ্রুপের হাসি হেসে উত্তর দিলো তিয়াশা। তার কন্ঠে বিষাদেরা জড় হচ্ছে। কারণটা অবশ্য মৌপ্রিয়ার বেশ ভালো করেই জানা। তিয়াশা মেয়েটি সত্যি অন্যরকম। তাই তো অন্তুর এখানে চাকরি করা সত্ত্বেও মেয়েটি এখানেই মাটি কাঁমড়ে পড়ে রয়েছে। অন্তুর সাথে তিয়াশার হিসেবটা অন্যরকম। তারা দুজন শুধুমাত্র সিটি হসপিটালের একজন সাধারণ ডাক্তার এবং রিসেপশনিস্ট নয়। তাদের মাঝে একটি গল্প ছিলো, একটি গভীর স্পন্দিত গল্প। কিন্তু গল্পটির সমাপ্তিটা সুখময় ছিলো না। কোনো এক কিশোর-কিশোরীর আবেগ ছিলো তা। আবেগে ভেসে তারা পরিবারের অজান্তে বিয়ে অবধি করে। দেনমোহর ছিলো মাত্র ছয় শত এক টাকা। সাক্ষী ছিলো মৌপ্রিয়া, অবনী এবং নিতুল। তাদের সংসারটা ছিলো ক্ষণিকের, পাঁচ মাস সতেরো দিন। সেই সংসারটাও বেশ মজার, যেহেতু পরিবারের অজান্তেই বিয়েটা হয়েছিলো তাই তাদের সংসার জীবনটা কলেজের গেট অবধি ই সীমাবদ্ধ ছিলো। বন্ধুমহল ব্যাতীত কেউ জানতো না তাদের এই সংসারের কথা। কিশোর-কিশোরীর খুনসুটির সংসার। ক্যান্টিনে তাদের সাংসারিক আলাপ আলোচনা। খুব প্রেমঘন ছিলো তাদের সম্পর্ক। এই পাঁচ মাস সতেরো দিন পর সব গল্পের মতো তাদের জীবনেও আসে ঝড়। তিয়াশার বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তিয়াশার পারিবারিক সমস্যা প্রবল হতে থাকে। ফলে মেয়েটি টেস্ট এক্সাম ও দিতে পারি নি। তিয়াশা এবং অন্তুর সম্পর্কের মাঝেও নানা সমস্যা উৎপন্ন হয়। দুজনের আলাদা দৃষ্টিকোন তাদের প্রেমের মাঝে বাঁধা হয়ে যায়। উষ্ণ হৃদয় জোড়া শীতল হয়ে যায়। ভালোবাসার যাত্রায় শিথিলতা চলে আসে। ফলে বিচ্ছেদের লাল ঘন্টা বেজে যায়, নীল ভালোবাসা হারিয়ে যায়। কিশোর কিশোরীর আবেগ হিসেবে সেই ছয়শত এক টাকার দেনমোহরের বিয়েটাও মূল্যহীন ভাবা হয়। তাদের মাঝে কাগজের বিচ্ছেদ কিংবা তালাকের বিচ্ছেদ না ঘটলেও ঘটে মনের বিচ্ছেদ। কলেজ শেষে তিয়াশা ভর্তি হয় জাতীয় ভার্সিটিতে। অন্তুর রেসাল্ট ভালো হবার জন্য সে চান্স পায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ। ব্যাস অন্তুর তিয়াশার গল্পের সমাপ্তিটা এভাবেই ঘটে। বই বা সিনেমার মতো আমাদের বাস্তব জীবনের নায়ক নায়িকাগুলো হ্যাপি এন্ডিংটা ঠিক হয় না। হলে হয়তো অন্তু আর তিয়াশার জীবনের এন্ডিং টা হ্যাপি হতো। মৌপ্রিয়া তিয়াশার ভালো বান্ধবী হবার কারণে তার এই গল্পটি অনেকটুকুই তার জানা। কিন্তু তাদের মাঝের সমস্যা ঠিক কি ছিলো তা মৌপ্রিয়া জানে না, কখনো জানতে চায় ও নি। মানুষের সুখের গল্পগুলো শুনতে হয়, দুঃখের গুলো নয়। দুঃখের গল্পগুলো মনের লুকায়িত প্রকোষ্ঠ্যে থাকাটাই শুভ। যেমনটা তার গুলো রয়েছে। সেই সিন্দুকে তালা দেওয়া। চাবিটা ফেলে দিয়েছে কোনো নীল জলাশয়ে। তিয়াশা হাত ঘড়ির দিকে তাকালো। ধীর কন্ঠে বললো,
“আমার সময় হয়ে এসেছে। যেতে হবে।“
“আমি একটু বসবো। তুই যা।“
“এখানের পুডিং টা মজা, খেতে পারিস চাইলে।“
বলেই উঠে দাঁড়ালো তিয়াশা। মোবাইলটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো ক্যান্টিন থেকে। মৌপ্রিয়া জানে তিয়াশার ব্যাস্ততা কোথায়, নিজের অবশ অনুভূতিগুলো থেকে পালানোর এতো তাড়া। যে মানুষটি বাহির থেকে যতটা হাসি খুশি মনে হয় ভেতর থেকে ততটাই ক্ষত বিক্ষত থাকে। একজন গুনী মানুষ বলেছিলেন,
“তার হাসিমুখে ভুলো না, তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ দেখার চোখ নেই তোমার।“
মৌপ্রিয়ার চোখ আবার অন্তুর দিকে গেলো। কি সুন্দর হাসছে। তার হাসিটা এখনো আগের মতোই আছে। ঝলমলে চোখ, যেখানে মায়ার নীল সাগর এবং ঠোঁটে জাদুকর হাসির প্রলেপ। কোথায় যেনো পড়েছিলো,
“তার হাসি হল সবচেয়ে সহজ অলৌকিক ঘটনা যা সে যেকোনো সময় তৈরি করতে পারে”
বেশ বিখ্যাত ব্যাক্তির উক্তি সেটা। কিন্তু ব্যাক্তিটা কে তার মনে নেই। অবশ্য উক্তিটা অন্তুর ক্ষেত্রে একেবারে খাপেখাপ। ছেলেটার এই হাসির মোহে ভেসেছিলো তিয়াশা। মৌপ্রিয়া উঠে দাঁড়ায়। তার হাতের কাছে গ্লাসটায় বরফ ঠান্ডা পানি ঢালে। তারপর গ্লাসটি হাতেই হাটতে শুরু করে। যখন অন্তুদের টেবিলের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলো তখন গ্লাসটি কাত করে পানিটুকু তার মাথায় ঢেলে দেয়। অন্তুর হাসিটা যেনো ভুতের মতো উধাও হয়ে যায়। টেবিলের সবার নজর মৌপ্রিয়ার দিকে। তাদের হতবাক দৃষ্টি তাকে নানা প্রশ্ন করছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজনীয়তাবোধ হচ্ছে না তার। অন্তু পেছনে ফিরে কিচ্ছুক্ষণ ফ্যালফ্যালিয়ে থাকে মৌপ্রিয়ার দিকে। মৌপ্রিয়ার সুতীক্ষ্ণ স্থির দৃষ্টি সূঁচের মতো আঘাত করছে অন্তুকে। পরিবেশ থমথমে হয়ে আছে। হসপিটালে তার পরিচিতি বেশ, তাই নিজের ইমেজটা রক্ষা করতে ঠোঁটে হাসির প্রলেপটা অক্ষুন্ন রেখে অন্তু বললো,
“মৌ, তোর এই স্বভাবটা পাল্টালো না। আমরা তো এখন কলেজে নেই। রিলাক্স গাইস, ও আমার বান্ধবী মৌপ্রিয়া। ওর বরাবরের স্বভাব আমার সাথে দেখা হলেই আমার মাথায় পানি ঢালা। আসলে ইউ নো কলেজ ফ্রেন্ডস।“
মৌপ্রিয়া বাঁকা হাসি হাসলো। ডাক্তার না হয়ে অভিনেতা হলে বেশ ভালো নাম কামাতে পারতো অন্তু। কি চমৎকার অভিনয়। বিদ্রুপের স্বরে বললো সে,
“আমরা সত্যি কলেজে নেই, ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন তো আমাদের অন্তুমশাই এতো বড় হাসপাতালের ডাক্তার। ভালো লাগলো, তবে তোর স্বভাব এখনো তেমন ই আছে। তেমন ই ধূর্ত, তেমন ই মেকি। বাদ দে, তোর প্রেসিয়াস টাইম নষ্ট না করি। এসেছিলাম তিয়ার সাথে দেখা করতে। ভালোই হলো তোর সাথে দেখা হয়ে গেলো। তিয়াকে মনে আছে না তোর?”
মৌপ্রিয়ার কথাগুলো সূঁচের মতো বিধছে অন্তুর। কিন্তু কলিগদের সামনে নিজেকে ছোট করার ইচ্ছে নেই নাই। তাই হাসি অক্ষুন্ন রেখেই বললো,
“থাকবে না কেনো? কতো ভালো বান্ধবী আমার।“
মৌপ্রিয়ার ইচ্ছে হচ্ছিলো ঠাটিয়ে একটা চড় লাগাবে অন্তুর গালে। মেকি মানুষদের খুব অপছন্দ তার। এরা মেকি হতে হতে নিজ স্বত্তাই হারিয়ে ফেলে, যেমনটা অন্তু। তার এখন মূল উদ্দেশ্য কলিগদের সামনে নিজের মানটা বজায় রাখা। তাই মৌপ্রিয়ার খোঁচা দেওয়া কথাগুলোও তার কাছে গুরুত্বহীন মনে হচ্ছে। মৌপ্রিয়া চোয়াল শক্ত করে বললো,
“যাক, নিজের স্থানটা তোর জানা আছে। এটাই ভালো, অতীত তো অতীত ই হয়, বর্তমানে তার কোনো জায়গা থাকে না। থাক, আমি আসি।“
মৌপ্রিয়ার কথার অর্থ কেউ না বুঝলেও অন্তু ঠিক বুঝেছে। তার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। অতীত অতীত ই হয়, কিন্তু সেই অতীতটা প্রেমঘন হলে সেটা বর্তমানকে নাড়িয়ে দেয়। প্রতিনিয়ত তিয়াশাকে চোখের সামনে দেখতে তার কেমন লাগছে সেই অনুভূতি কেবল সেই জানে। অন্তু ঠোঁটের কোনায় হাসি একে পুনরায় আড্ডায় শরীক হলো। তার শার্ট ভিজে গছে, চুল থেকে পানি পড়ছে। একটা টিস্যু দিয়ে সেটা মোছার চেষ্টা করছে সে। মুখে না বললেও সবার চোখে একটা কৌতুহল, মেয়েটি এমন কেনো করলো!
বাসায় পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে মৌপ্রিয়া। অহেতুক গাড়ি নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরেছে সে। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছিলো না। তিয়াশার জন্য খারাপ লাগছে, কিশোরী বয়েসের আবেগ ই হোক আবেগ তো। অন্তু তার জীবনের প্রথম এবং আপাতত শেষ পুরুষ ছিলো। তার জীবনে অন্তুর জায়গাটা অনেকটাই বিচিত্র। তার মোনোস্থিতি বোঝাটা খুব একটা দুষ্কর নয় মৌপ্রিয়ার জন্য। একদিকে নিজেকে বাহবা দেয় সে, তার জীবনে কোনো প্রেম ঘটিত কান্ড নেই। নেই কোনো প্রেম ঘটিত বেদনা। ব্যার্থ মানুষ তার অনুপ্রেরণা, সেটা কে কি প্রেম বলা যায়? ক্রাস বলা যেতেই পারে। তার পাঠকেরাও তো তাকে “ক্রাস” বলে দাবি করে, সেগুলোকে তো প্রেম বলা যায় না। এসব ভাবতে ভাবতেই কলিংবেল বাজালো মৌপ্রিয়া। দরজাটা খুললো নীলু। দরজা খুলতেই কানে এলো কবিতার গুঞ্জন। মৌপ্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“বাবা কি আসর বসিয়েছে?”
“হ, তবে একা না, আপনের মাস্টর ও আছে। দুজন মিল্লা একের পর এক গ্লাস ফাঁকা করতেছে আর কবিতা আওড়াইতেছে।“
“ব্যাটা এখনো যায় নি?”
“যাইতে ধরছিলো, খালুজানে আটকাইছে। খালু জানের মন আজ বেজায় খারাপ। শরষে ইলিশটাও খায় নাই।“
“বুঝেছি, তুই আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দে তো, আমার রুমে দিয়ে যাস। আমি দেখি ওখানে কি হচ্ছে।“
নীলু দরজা আটকে রান্নাঘরের দিকে গেলো। আর মৌপ্রিয়া গেলো স্টাডি রুমে। ঘরটি ইফতেকার সাহেবের বই এর ঘর বলা হলেও মন্দ হবে না। তার ইতিহাসের খন্ড খন্ড পাথরের ন্যায় বই গুলো সাজানো এই ঘরে। প্রতি সন্ধ্যায় এই স্টাডি রুমে তার কবিতার আসর বসে। ইতিহাসবিদদের মুখে কবিতাটা ঠিক জমে না। কিন্তু ইফতেকার সাহেব ভিন্ন, তার কবিতায় আলাদা রস হয়েছে। এক পেগ “Johnnie Walker Black level” পেটে পড়লে কবিতাগুলো এমনেই বের হয় তার। আজকে তার সঙ্গী আছে তাই কবিতার আসর জমে গেছে বলা যেতেই পারে। তার সকল কাব্যের উৎস সূবর্ণা। সূবর্ণা অর্থাৎ মৌপ্রিয়ার মায়ের চলে যাবার পর থেকেই ইফতেকার সাহেবের এই গুনটা প্রকাশ্যে এসেছে। নয়তো আগে তিনি কেবল ই একজন ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন।
স্টাডি রুমের কাছে যেতেই ইফতেকার সাহেবের ভারী কন্ঠের আবেগ শোনা গেলো। আজকের আবেগটা যেনো মাত্রায় বেশি। তাইতো জীবনানন্দ দাশের কবিতা আজ আবৃতি করছেন তিনি,
“আমি মুদ্রিত চোখ নিয়ে
তোমাকে অনুভব করি,
মনে হয়, যেন সূর্যাস্তের জাফরান আলোয়
সাদা গোলাপের বাগান ছড়িয়ে রয়েছে মাইলের পর মাইল,
একটা সজনে গাছে নেই,
তাই বিরাট আকাশচিল উড়ে এসে
শূন্য বাতাসের ভিতর আঁকাবাকা ব্যর্থ জ্যামিতির দাগ রেখে গেলো শুধু,
তারপর দূর নীড়ের দিকে উড়ে গেলো
হৃদয়ের পানীয়ের দিকে।“_________
কবিতা থামিয়ে নেশার ঘোরে তিনি সীমান্তকে বলতে লাগলেন,
“বুঝলে ইয়াং ম্যান, আগের কবিদের প্রতিটি লাইনে ছিলো আবেগ। সূবর্ণাকে যখন প্রথম প্রেম নিবেদন করেছিলাম এই কবিতাটি আবৃতি করেছিলা। উফফ, ওর লাজুক লালীমা, পাতলা ঠোঁটের সেই স্নিগ্ধ হাসি। আহা! ত্রিশ বছর পর ও এই হৃদয়ে জীবন্ত। তোমরা এগুলা বুঝবা না, এগুলো হলো প্রেম। এখনের ফেসবুকের যুগে এডি নাই। নাই, হারায় গেছে।“
“ঠিক বলেছেন স্যার, এখন শুধু লাইক, কমেন্টেই প্রেম হয়। ভিডিও কলে ব্রেকাপ। আগের সেই অনুভূতি গুলা নেই।“
“নাও নাও এবার তোমার পালা, শোনাও তো একখানা কবিতা। আবৃতি যেনো টপ নচ হয়, প্রেমিকার জন্য আবেগ নিয়ে করবে। ওকে ?“
ইফতেকার সাহেবের কথা শুনে লাজুক হাসি হাসে সীমান্ত। এই হাসিটা না দেখলে হয়তো মৌপ্রিয়া “হাসিতে মায়া এঁটে থাকে” কথাটা জানতো না। পুরুষের হাসিও কি মায়াপ্রবণ হতে পারে! যে হাসিতে নেকি কোনো ছলনা, স্বচ্ছ, প্রাণবন্ত হাসি। সীমান্ত তার আবৃতি শুরু করে, তার মিহি কন্ঠে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা যেনো আরোও প্রেমঘন হয়ে উঠে,
“বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল
স্বপ্নে বহুক্ষণ
দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন–
বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে
তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের
নীল দুঃসময়ে।
দক্ষিণ সমুদ্রদ্বারে গিয়েছিলে কবে, কার সঙ্গে? তুমি
আজই কি ফিরেছো?
স্বপ্নের সমুদ্র সে কী ভয়ংকর, ঢেউহীন, শব্দহীন, যেন
তিনদিন পরেই আত্মঘাতী হবে, হারানো আঙটির মতো দূরে
তোমার দিগন্ত, দুই উরু ডুবে কোনো জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো,
অথচ একলা ছিলে, ঘোরতর স্বপ্নের ভিতরে তুমি একা।“
নেশাঘোর কন্ঠের সীমান্তের কবিতা চোখ বুঝে শুনতে লাগলো মৌপ্রিয়া। মদের গন্ধে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে স্টাডি রুম। সেই মাদকতায় নেশার জোয়ার উঠালো সীমান্ত। হৃদস্পন্দন বাড়ছে, চোখের কোনায় আবেগ জমা হচ্ছে। কিসের আবেগ জানা নেই মৌপ্রিয়ার। সে মিহি কন্ঠে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছে। বুকের কোনায় চিনচিনে ব্যাথা, সে তো নীরা নয়, সীমান্ত ও কবি নয় তবে কিসের টান এটা। কিসের আকর্ষণ? কিসের অনুভূতি?
সময় পেরিয়ে গেলো কবি নামক মাতালেরা নেশায় বুদ। ঘোর কাটলো মৌপ্রিয়ার। এখন বাবাকে নিজ কক্ষে নেবার পালা। নিত্যরাতের ডিউটি এটা। নীলু নাকে কাপড় বেধে বোতল কুড়লো। মৌ কোনো মনে বাবাকে উঠালো। ইফতেকার সাহেব এখনো আওড়াচ্ছেন,
“সূবর্ণা, তোমায় আমার কত কথা বলার আছে। ফিরে এসো আমার হৃদয়হরণী।“
সে যে ফিরবে না তা ভালো করেই জানা ভদ্রলোকের। কিন্তু তবুও এই পাগলামী। প্রেমিকরা হয়তো একটু পাগল ই থাকে।
বাবাকে শুয়িয়ে এসে মাথায় হাত পড়লো মৌপ্রিয়ার। এই আবালচন্দ্র মাস্টারমশাইকে কি করবে। সে দিব্ব্যি পেগের পর পেগ ঠুষে গালিচায় পড়ে রয়েছে। মনে মনে ইচ্ছে হলো ব্যাটাকে এভাবেই ফেলে রাখতে। কিন্তু করুনা দেবী বাঁধ সাধলেন। তাই তো নারীর দায়ড়া ভেঙ্গে তাকেও উঠানোর প্রচেষ্টা করলো মৌপ্রিয়া। বসে থাকার জন্য উচ্চতা বুঝতে পারে নি তখন। কিন্তু ব্যাটা পাঁচ ফুট দশ তো হবেই। পাঞ্জাবী পড়ে থাকায় নিতান্ত কাঠি মনে হলেও ব্যাটার ওজন আছে। ভর ছেড়ে দেওয়ায় পুরো ওজন গিয়ে পড়লো মৌপ্রিয়ার কাঁধে। এ নাকি তাকে শিখাবে। প্রথম দিনেই বাবার বদঅভ্যাসের জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। নীলু সাহায্য করতে চাইলে মৌপ্রিয়া তাকে বলে,
“তুই বরং গেস্ট রুমটা খুলে দে।“
খুব কষ্টে সীমান্তকে গেস্ট রুম অবধি নিয়ে গেলো মৌপ্রিয়া। মদের গন্ধে পেট গুলোচ্ছে তার। দুপুরে না খাওয়ার জন্য বমি বমি ভাবটা বেশি হচ্ছে। সীমান্ত কিছু যেনো বিরবির করছে। মৌপ্রিয়া সেদিকে খেয়াল দিচ্ছে না। মূল উদ্দেশ্য এই পাহাড়কে বিছানায় চেলে ফেলা। অবশেষে বিছানা এলো। ভার জিনিসটার হাতটা কাধ থেকে নামিয়ে দিলো সে। কিন্তু তার হাত রয়ে গেলো সীমান্তের হাতে। ফলে টান খেয়ে সেও পড়ে গেলো সীমান্তের বুকে। ঘটনার আকর্ষিকতায় মৌপ্রিয়ার কোমল গাল লাল বর্ণ ধারণ করলো। অবিবাহিত নারী কিনা এক অবিবাহিত যুবকের বুকে লেপ্টে আছে। সমাজ জানলে তো ছি ছি করবে। নিজেকে সীমান্তের বাহুডোর থেকে ছাড়াতে তৎপর হলো সে। কিন্তু সীমান্তের অচেতন শরীরের ভার তাকে উঠতে দিচ্ছে না। হঠাৎ সীমান্ত চোখ খুললো। তার এলোমেলো দৃষ্টি দেখে যাচ্ছে মৌপ্রিয়ার কোমল মুখ। এরপর সে যা করলো তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না মৌপ্রিয়া। মৌপ্রিয়ার ঘন কালো চুলের মেঘ আলতো হাতে সরালো সে। তার ঠোঁটে এখনো সেই হাসির প্রলেপ। সীমান্তের পরশে লজ্জায়, রাগে কুকিয়ে উঠছিলো মৌ। তারপর……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি