#গাংচিল
#৩য়_পর্ব
মৌপ্রিয়ার সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। গলার স্বর নামিয়ে দাঁতে দাঁত পিসে বললো,
“মশকরা করছেন?”
এবার কিঞ্চিত চিন্তিত হয়ে গেলো সীমান্ত। তার হাস্যজ্জ্বল মুখখানা মিয়ে গেলো। গাঢ় ভ্রুযুগল কুচকে আসলো। কপালে পড়লো ভাঁজ। থুতনিতে হাত দিয়ে কিছু সময় কিছু একটা ভাবলো সে। এর পর গম্ভীর মুখে বলল,
“সকল লেখকেরা ভুল, সবাই তো মিথ্যে কথা বলে।“
মৌপ্রিয়া সুতীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“আবলতাবল না বকে, ঝেড়ে কাশুন তো”
সীমান্ত মাথা তুললো, তার দৃষ্টি মৌপ্রিয়ার চোখ বরাবর। স্পষ্ট চাহনী, সেই চাহনীতে আত্মবিশ্বাসের ছাপ। চায়ের কাঁপটা সরিয়ে কনুই গেড়ে এগিয়ে এলো মৌপ্রিয়ার দিকে। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
“লেখকেরা বই তে বলে, প্রশংসা করলে নারীর রাগ গলে যায়। রাগান্বিত নারীদের প্রশংসা করলে তারা লজ্জা পেয়ে যায়। লজ্জায় তাদের গাল রঙ্গিন হয়ে উঠে। কিন্তু তোমার সাথে এমন কিছু হলো না যে, বরং তুমি বোধ হয় আরোও রেগে গেছো। তবে কি বলা যায় না সব লেখকেরা মিথ্যে বলে! সবাই মিথ্যাবাদী। তাই মিথ্যাবাদী হলে লেখক হওয়া যায় না কথাটা ঠিক নয়। ভুল, উচ্চপর্যায়ের ভুল। বরং তুমি বলতে পারো, মিথ্যেবাদীরাই ভালো লেখক হতে পারে।“
“চুপ, একে বারে কথা বন্ধ। আরেকটা কথা বললে মাথা ভেঙ্গে দিবো একেবারে“
এবার নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না মৌপ্রিয়া। বরং নিজের ভেতরের উত্তপ্ত টগবগে রোষের লাভা উগড়ে দিলো সে। সেই লাভায় আজ সীমান্ত নামক ব্যক্তিটিকে জ্বালিয়ে দিবে সে। উত্তেজনায় গা কাঁপছে তার। উঠে দাঁড়ালো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করলো সে। হ্যা ব্যার্থ চেষ্টা, কারণ তাতে সফলতার কোনো ছিটা ফোটাও ছিলো না। চোয়াল শক্ত করে বললো,
“ওই যে আলমারীটা দেখছেন। ওখানে মোট সাইত্রিশ হাজার টাকার বই রয়েছে। সবকটা আমার লেখা। আমার লেখা অবিক্রিত বই। যদিও সেগুলোকে অবিক্রিত বলা চলে না। কারণ আমার বাবা সেগুলো কিনে নিয়েছেন। আমার বাবার অনেক টাকা, তিনি টাকা উড়াতে পছন্দ করেন। নিজে কামাই করা না হওয়ায় টাকার মোহ তার নেই। তাই যেকোনো ছাগল পাগলকে কিছু চিন্তা না করেই দান করেন। আপনার টাকার প্রয়োজন আর আমার বাবা হাতেম তাই, তার টাকা খরচ করা প্রয়োজন। সুতরাং মাসশেষে এসে টাকাটা নিয়ে যাবেন। দয়া করে আমার মাথা খাবার চেষ্টা করবেন না। আমি হয়তো আমার বক্তব্য স্পষ্ট করেছি। এবার আপনার কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। সুতরাং“
“কিন্তু আপত্তি রয়েছে।“
মৌপ্রিয়ার কথা শেষ হবার পূর্বেই বাধ সাধে সীমান্ত। তার মুখে চিন্তার ছাপ। গভীর চিন্তা। বেশ উদ্বিগ্ন এবং উদ্ভ্রান্ত লাগছে তাকে। মৌপ্রিয়া বললো,
“কি সমস্যা?”
“সমস্যাটা হলো, বিনা পরিশ্রমের টাকা আমার পছন্দ নয়। আমার কাছে যেগুলো বিষাক্ত কাঁটা মনে হয়। মনে হয় ছুলেই মারা যাবো আমি। তাই বিনা পরিশ্রমে টাকাটা আমি নিতে পারবো না, ক্ষমা করবেন। আবার টাকাটা যে আমার খুব প্রয়োজন।“
সীমান্তের উচ্ছ্বাসিত কন্ঠ কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। বরং এক রাশ মলিনতা ভর হলো তার কন্ঠে। শ্রুতিমধুর কন্ঠটি থমথমে হয়ে গেলো। তার চোখজোড়ায় হতাশার কালো মেঘ ছেয়ে গেলো। সীমান্ত হাতে হাত ঘষছে। হয়তো টাকাটার যোগানের কথাই ভাবছে। ভাবছে হয়তো এই ঘাটতি কিভাবে পোষাবে। মৌপ্রিয়ায় মনে করুনার দেবী ভর করলো, সীমান্তের আষাঢ়ে মুখখানা দেখে তার দয়া হলো। হয়তো এতোটা রুক্ষ্ণ না হলেও পারতো। এবার সে জামাটা ঠিক করে চেয়ারে বসলো। নরম গলায় বললো,
“তাহলে কি করা যায়?”
মৌপ্রিয়ার কাছে এমন প্রশ্নই যেনো আশা করেছিলো সীমান্ত। তার মুখশ্রী পুনরায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো। বেশ ভাব নিয়ে বললো,
“আমি প্রতিদিন আসবো। এক ঘন্টা থাকবো। ষাট মিনিটের এক সেকেন্ড বেশি নয়, এক সেকেন্ড কম নয়। আমি আসবো দুপুরের সময়। দুপুরের খাবারটা এখানেই খাবো। তুমি প্রতিদিন যা লেখো তা আমি পড়ে দেখবো। পাঠক হিসেবে তোমাকে আমার অভিমত জানাবো। আমার কাজ হবে দুটো পেশার, পাঠক এবং স্টেনোগ্রাফার সংমিশ্রণ। আচ্ছা এই দুটো শব্দকে মিলালে কি হবে? হুমমম, না মনে পড়ছে না। যাক গে, তুমি বুঝেছো হয়তো। এতে আমারো টাকাটা আয় হবে, তোমার ও পান্ডুলিপিতে সাহায্য হবে। কি ভালো হবে না?”
মৌপ্রিয়া কোনো উত্তর দিলো না, কি উত্তর দিবে সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না। মানুষ ভিন্ন হয়, কিন্তু এতোটা ভিন্ন! ঠিক কি বিশেষণ খাটে সীমান্ত নামক ব্যাক্তিটির চরিত্রের সাথে? ধূর্ত নাকি লোভী নাকি মিথ্যুক। লোকটিকে কি খারাপ মানুষের দলে ফেলা যায়? তাকে মৌপ্রিয়া ভুলও বলতে পারছে না। সে বিরক্তিকর হতে পারে, জ্বালাতক হতে পারে কিন্তু শয়তান নয়। মৌপ্রিয়া কোনো কথা বললো না। অজানা কারণে রাগ হচ্ছে তার। এই রাগটি কি সীমান্তকে নিজের কাছে ভুল প্রমাণ না করতে পারার জন্য? হয়তো। কিন্তু সীমান্তের সাথে একই ঘরে বসে থাকাটা সম্ভব নয় তার পক্ষে। সে উঠে দাঁড়ালো। নিজের হাত ব্যাগ এবং মোবাইলটা হাতে নিলো সে। মৌপ্রিয়া চলে যেতে নিলে সীমান্ত আগ্রহী কন্ঠে বললো,
“আজ দুপুরে কি রান্না হচ্ছে? ২ টা তো বেজে গেলো। ক্ষুধা লেগেছে।“
“নীলাঞ্জনার কাছ থেকে শুনে নিয়েন। খাওয়া শেষে বসে থাকার প্রয়োজন নেই। চাইলে চলে যেতে পারেন, চাইলে বাবার সাথে সময় কাটাতে পারেন।“
“তুমি থাকবে না?”
সীমান্তের কথাটা বুকে তীরের মতো লাগলো। সামান্য প্রশ্নে কি রয়েছে? এতো টান, এতো আবেগ। এই আবেগটা অপরিচিত কোনো মানুষের প্রতি অনুভব করার কোনো কারণ নেই। সীমান্তকে আজ প্রথম দেখেছে সে, প্রথম কথা হয়েছে। তাহলে এতো কিসের মায়া? তিনটি শব্দ তার হৃদয়কে যেনো পরিপূর্ণ করে তুললো। কাব্যিক ভাষায় বললে, “তার হৃদয় তৃষীত হয়ে উঠলো”। মৌপ্রিয়ার কন্ঠ আটকে এসেছে। অতিকষ্টে বললো,
“না”
ছোট “না” টুকু বলেই বেড়িও গেলো সে রুম থেকে। সীমান্ত এখনো বসে রইলো সেই ঘরে। ঝিরিঝিরি বাতাস আসছে জানালা দিয়ে। আবারো বৃষ্টি শুরু হবে। দুষ্টু বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা। সীমান্ত চোখ বন্ধ করে বাতাসের ফিসফিসানি শুনতে লাগলো। আহা কি মধুর সেই শব্দ____________________
২.
তিয়াশার সামনে বসে রয়েছে মৌপ্রিয়া। তার থমথমে মুখখানা চেয়ে আছে উষ্ণ কফির কাপখানার দিকে। তিয়াশা ঠান্ডা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। মৌপ্রিয়া কোনো কথা না বলে এক নিঃশ্বাসে পানিটা শেষ করলো। বিগত আধা ঘন্টা যাবৎ এই গুমোট মুখেই বসে আছে মৌপ্রিয়া। কিন্তু আর সময় নেই হাতে, লান্স টাইম শেষ হতে চলেছে তিয়াশা। তাই এবার ধীর গলায় বললো,
“কি হয়েছে? এখানে আগমনের কারণ?”
“বাবা, আমার জন্য একটা আবালচন্দ্রকে রুলে নিয়ে এসেছেন।“
কফিটার দিকে তাকিয়েই কথাটা বললো মৌপ্রিয়া। এবার তিয়াশা একটু এগিয়ে এসে বললো,
“বিয়ে?”
“আরে ধুর, সে আমার লেখালিখির মাস্টার।“
মৌপ্রিয়ার কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো তিয়াশা। “লেখালিখির মাস্টার” শব্দটা যেনো চরম বিনোদন দিচ্ছে। ইফতেকার সাহেবের উদ্ভট কাজের প্রতিটি সম্পর্কে তিয়াশার বেশ ভালোই ধারণা রয়েছে। তবে এবার যেনো তিনি নিজের টপ উদ্ভট কাজকেও ছাপিয়ে গেছেন। মৌপ্রিয়া সুতীক্ষ্ণ চাহনী নিক্ষেপ করে কড়া কন্ঠে বলে,
“হাসি বন্ধ, আমি মরছি আমার জ্বালায় আর তুই হাসছিস?”
“হাসবো না? আংকেলের এমন কান্ড একটু হাসি তো প্রাপ্য। আচ্ছা যা এই বন্ধ করলাম। এবার সব টুকু খুলে বল তো।“
মৌপ্রিয়া দুপুরের সকল ঘটনা তিয়াশাকে খুলে বললো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিয়াশা বললো,
“যতই যাই বলিস না কেনো, আংকেল কিন্তু বেশ একটা কাজ করেছেন।“
“মানে?”
“দেখ ব্যাটা বাংলার টিচার। মানে বাংলা নিয়ে তার বিস্তর জ্ঞান আছে। বই লিখুক না লিখুক সেটার প্রয়োজন নেই। কিন্ত তুই একজন ফ্রি পাঠক পাচ্ছিস। আগের বই তে তো তুমি ধপ মেরেছিলে। এবারটায় আর তা হবে না। লোকটা একজন পাঠকের দৃষ্টিকোন থেকে তোকে সাজেশন দিতে পারবে। ব্যাপারটা কিন্তু খুব একটা মন্দ নয়।“
“আমার তো তার সাজেশনের প্রয়োজন নেই তিয়াশা।“
“যার সাজেশনের আশায় বসে আছিস সে তো তোর জগতেই নেই। একটা দৃশ্যতঃ মানুষের উপর ভরসা করাটা কি খুব উপকারে দিবে?”
মৌপ্রিয়া উত্তর দিলো না। তিয়াশার কথার মর্মার্থ বুঝতে তার কষ্ট হলো না। “ব্যর্থ মানুষ” এর কথা তিয়াশা জানে। মৌপ্রিয়া বেশ কয়েকবার নিজের লেখা মানুষটিকে পাঠিয়েছিলো। ভেবেছিলো লোকটির উত্তর পাবে সে। উত্তরে হয়তো সে বলবে, “ভালো হয়েছে”, “এই বাক্যটা অন্যভাবেও লেখা যায়”, “তুমি তোমার প্লটের উপর আরোও কাজ করো।“ কিন্তু সে ভুল ছিলো কোনো উত্তর আসে নি। ম্যাসেজগুলো পেন্ডিং ই রয়ে গেছে। তখন মৌপ্রিয়ার মনে হতো লেখক সমাজে ঐ একটা মানুষ রয়েছে যাকে মুগ্ধ করাটাই তার কাজ। পাঠকের এতো এতো প্রশংসা যেনো তার কাছে কিছুই না। তার লেখিকা হবার মর্মই বৃথা যদি মানুষটি মুগ্ধ না হয়। প্রতীক্ষায়, প্রতীক্ষায় হাপিয়ে গিয়েছে মৌপ্রিয়া। লেখার আবেগগুলো প্রতীক্ষার উত্তাপে বাস্পীভূত হতে লাগলো। তবে এখণো মৌপ্রিয়ার মাঝে ক্ষীন আশা রয়েছে। হয়তো সে ঠিক তাকে উত্তর দিবে। হয়তো।
তিয়াশা মৌপ্রিয়ার কাঁধে হাত রেখে বললো,
“বেশি আশাও কিন্তু ভালো নয় মৌ”
মৌপ্রিয়া কিছু বলার আগেই একটা ভারী কন্ঠ কানে এলো। তিয়াশার মুখোভাব পালটে গেলো। উজ্জ্বল ফর্সা মুখখানা শ্রাবণে কালো মেঘের ন্যায় দমে গেলো। মৌপ্রিয়া মাথাটা কাত করে পেছনে দেখলো। অজান্তেই মুখ থেকে বের হলো,
“অন্তু…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি