#গাংচিল
#১৯তম_পর্ব
বৃষ্টির দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিয়াশা, তখন ই রহিমা বেগমের আগমন ঘটে। তাকে স্বাভাবিক থেকেও উচ্ছ্বাসিত লাগছে। মহিলা সবসময়ই একটু বেশি উৎসাহিত থাকেন। তাই তিয়াশার আগ্রহ হলো না কারণ জিজ্ঞেস করার। তিনি তার মতো ঘর গুছাতে ব্যাস্ত। তিয়াশা বাহিরে মনোনিয়োগ করে। তখনই তিনি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলেন,
“একি তুই এখানে বসে আছিস কেনো? তাড়াতাড়ি গোসল করে রেডি হয়ে নে”
“আজ, অফিস নেই মা। তাই আজ কোথাও যাবো না। তোমাকে তো বলেছিলাম।“
“আরে তুই যাবি কেনো? তুই গেলে পাত্রপক্ষ কাকে দেখবে? মাঝে মাঝে এমন এমন কথা বলিস না! পাত্রী ছাড়া ওরা দেখবে কাকে। যা রেডি হয়ে নে। ওরা এক ঘন্টার মধ্যেই এসে পড়বে।“
রহিমা বেগমের কথায় স্তব্ধ হয়ে গেলো তিয়াশা। পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে আসবে—কথাটা মাথার উপর যেনো বাজের মতো পড়লো। ব্যাপারটা এতোটা অবাককর কিছুই না। কিন্তু তার জন্য এই পাত্রপক্ষের আসাটা পৃথিবীর সবথেকে দূর্যোগময় ঘটনা; ভয়ংকর স্বপ্ন। রহিমা বেগম যে এই কথাটা জানেন না এমনটা নয়; তিনি বেশ ভালো করেই জানেন তার মেয়ে বিয়ের নাম শুনলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। “বিয়ে” নামক শব্দে এতো কিসের আপত্তি সেটা তিনি বুঝে উঠেন না। তবুও ক্ষনে ক্ষনে এই বোম্বটা তিনি তিয়াশার উপর মারেন। আর তখন ই হয় বিপত্তি। বিপত্ততির এক পর্যায়ে রেগে মেগে ঘর ছাড়ে তিয়াশা। চলে যায় মৌপ্রিয়ার বাসায়। সব জানাস্বত্তেও আজ আবার এই পাত্রপক্ষ নামক খড়া তিয়াশার গলায় ঝুলিয়েছে তিনি। তিয়াশা আজ নিজেকে সংযত করে রাখতে পারলো না। খানিকটা কড়া স্বরেই বললো,
“পাত্রপক্ষ আসবে তুমি আমাকে জানাও নি কেনো? একটা কথা আজ স্পষ্ট করে বলো তো এই বিয়ের তামাশাটা কবে থামাবে তুমি? আমি আজ স্পষ্ট শুনতে চাই। প্রতিবার এই রঙ্গ আমার ভালো লাগছে না মা।“
“আমি রঙ্গ করছি? আমি? নাকি তুই রঙ্গ করছিস। বয়স পঁচিশ পার হয়ে গেছে। এখন বিয়ে না করলে কখন করবি শুনি? এমনেই তোর বাবা নেই, বাবা ছাড়া অনাথ মেয়েদের কি ভালো বিয়ের সম্বোন্ধ আসে? তাও তো এইবার খুব ভালো একটা বিয়ের সম্বোন্ধ এসেছে। কি ভালো একটা ছেলে, যেমন দেখতে তেমন পরিবার! আমি বুঝি না এই বিয়ের নাম শুনলেই কেনো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠিস তুই? বিয়ে তো সব মেয়েদের করতেই হয়।“
“বিয়ে না হলে হবে না, সবার বিয়ে করতে হবে সেই বাধ্যবাধকতা তো নেই। তাহলে কেনো এতোটা উঠে পড়ে লেগেছো তুমি? আমি কি তোমার বোঝা হয়ে গেছি? যদি তাই হয় বলে দাও। আমি চলে যাই। আমি একটূ শান্তি চাই মা, সারাটামাস কুত্তাখাটা দিয়ে এই যন্ত্রনা আর নিতে পারছি না। খুব তো বিয়ে বিয়ে লাফাচ্ছো। একটা বার ভেবে দেখেছো, আমার বিয়ে হয়ে গেলে তোমাদের কি হবে? ছুটকির কি হবে? যত ভালো ছেলেই হোক না কেনো? সে কি আমাকে বুঝবে? আমার সমস্যা গুলো বুঝবে? আমার মা বোনকে নিজের দায়িত্ব হিসেবে নিবে? নিবে না মা। একটু জাগো। প্রতিবার এই বোঝাতে বোঝাতে আমি ক্লান্ত।“
তীব্র প্রতিবাদ করে উঠে তিয়াশা, তার কন্ঠ কাঁপছে। অসংখ্য অভিমান জড়ো হয়েছে তার চোখে। চোখের বাধ ভেঙ্গে এখনি মুক্তি পাবে তারা। রহিমা বেগম ও কম যান না। তিনি খিঁচিয়ে উঠলেন,
“আমাদের নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আমার আল্লাহ আছেন, আমাদের সেই দেখবেন। মরে যাবো না, কিন্তু নিজের হাতে নিজের মেয়ের জীবন তো নষ্ট করতে পারি না। এতো ভালো ছেলের সম্বোন্ধ আমি ফিরিয়ে দেবো না। আর দেরি করলে বিয়েই হবে না তোমার। কি উত্তর দিবো তোমার বাবাকে। তুমি পাত্রপ্পক্ষের সামনে যাবে ,ব্যাস। এটা আমার শেষ কথা। আর মনে করো না মৌ এর বাসায় লুকাবে। আজ মৌও বাড়িতে নেই। যাও যেয়ে তৈরি হও।“
“আমি মরে গেলেও পাত্রপক্ষের সামনে সং এর মতো বসবো না।“
বলেই হন হন করে নিজের রুমে চলে গেলো তিয়াশা। ধরাম করে দরজা লাগিয়ে দিলো। রহিমা বেগম তখন চিৎকার করছেন। কিন্তু তার কানে যেনো কিছুই যাচ্ছে না। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়বেন তিনি। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, মেয়েটা এতো জিদী কেনো এই উত্তরটাই খুজে পান না তিনি। তবে সে যদি জিদী হয় তবে রহিমা বেগম ও তার মেয়ে। পাত্রপক্ষের সামনে ও না বসলে ওর ঘাড়ে বসবে। তবে এইবার তিয়াশার বিয়ে তিনি দিবেন, দিবেন ই_________________
রকিং চেয়ারে বসে আছেন সূবর্ণা বেগম। ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজছে। মান্নাদে এর গান______
“কতদিন দেখিনি তোমায়
তবু মনে পড়ে তব মুখখানি
স্মৃতির মুকুরে মম আজ
তবু ছায়া পড়ে রানী
কতদিন দেখিনি তোমায়
কত দিন তুমি নাই কাছে
তবু হৃদয়ের তৃষা জেগে আছে
প্রিয় যবে দূরে চলে যায়
সে যে আরও প্রিয় হয় জানি
কতদিন দেখিনি তোমায়” __________
গানটা বেশ প্রিয় সূবর্ণার। একাকীত্বে রকিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে গানটা শুনেন। আজ ও তিনি একা, সৌভিক কোচিং এ গেছে। বাসায় কেউ নেই। এই সময়টা শুধু তার। একান্ত নিজের। একান্ত সময় প্রতিটা মানুষের জন্য খুব জরুরি। জীবনের ভুল, ঠিকগুলোর হিসেবটা সে এই একান্ত সময়েই করে। শুধু তাই নয় জীবনের প্রতিটা মূহুর্তকে খোলা চোখে সিনেমার মতো দেখতে পায় সে। আক্ষেপগুলো সুদৃঢ় হয়। এমন একাকীত্ব সময় এর আগেও কাটাতেন তিনি। কিন্তু সেই একাকীত্বে শুধু আক্ষেপগুলোই সুগাঢ় হতো। বয়সের সাথে সাথে চিন্তাগুলো বেশ গুছানো হয়েছে তার। এই কৃতিত্ব পুরোপুরি নিশাদ সাহেবের। লোকটা তার জীবনে না আসলে হয়তো এই ম্যাচুরিটিটা আসতো না। ইফতেকার সাহেব তো শুধু আগলেই রাখতেন তাকে। তার জিদ, বাচ্চামোগুলো দেখে কখনো বকতেন না বরং হাসিমুখে বলতেন,
“সূবর্ণারানী তো আজ খুব মজার কাজ করেছো। উফ, এক্সিলেন্ট, ব্রিলিয়েন্ট।“
লোকটার সেই কথাগুলো তখন বিদ্রুপ মনে হতো। আজ মনে হয়, সেগুলো বিদ্রুপ নয়। সেগুলো ছিলো লোকটার ভালোবাসা। আজও মনে আছে সেই দিনের ঘটনাটা, তখন সূবর্ণা বেগম কেবল এসেছেন নববধু রুপে। ভাতের মাড় কিভাবে গালতে হয় সেটাও তার অজানা ছিলো। শ্বাশুড়ি যখন বলেছিলো,
“বউ মা, মাড়টা গাইলে আনো তো, খোকাকে খাওন দিমু।“
তখন ভয়ে শিটিয়ে গিয়েছিলো সূবর্ণা বেগম। মাড় গালতে যেয়ে ভাপ গেলে পাতিল ফেলে দিয়েছিলেন। রান্নাঘর মাড়, ভাতে একাকার অবস্থা। সেদিনো ইফতেকার সাহেব হেসেছিলেন, হেসে বলেছিলেন,
“তুমি সত্যি ই খুব সুন্দর।“
সেই স্মৃতিটা খুব সুন্দর একটা স্মৃতি, এখনো জীবন্ত। সম্পর্কগুলো এতোটা বাজে রুপ না নিলেও পারতো। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলে কল্পনায় ছেদ পড়ে সূবর্ণা বেগমের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে যান দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই মুখ থেকে একটা কথাই বেড়িয়ে আসে,
“মৌপ্রিয়া…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি