গাংচিল, পর্ব:১৭

0
335

#গাংচিল
#১৭তম_পর্ব

সুঠাম পুরুষালী হাতের স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠে তিয়াশা। জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টি প্রয়োগ করে সে অন্তুর দিকে। কিন্তু অন্তু তো অন্তু। নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সে। হাতের বাঁধন ছাঁড়াতে অক্ষম হলে তিয়াশা স্বর খাঁদে নামিয়ে মিনমিন করে বলে,
“ছাড়ো”
“যদি না ছাড়ি, কি করবে?”

কথাটা শুনেই চমকে অন্তুর দিকে তাকায় তিয়াশা। অন্তু তখন তার গালে আলতো হাত ছোয়ায়। রক্তিম হয়ে উঠে তুলতুলে গালজোড়া। অন্তুর এমন আচারণ তিয়াশার জন্য একেবারে নতুন। যখন তাদের মাঝে গভীরতম সম্পর্কও ছিলো তখনও অন্তু তাকে এতোটা গভীরভাবে স্পর্শ করে নি। অন্তুর স্পর্শ তিয়াশাকে দিশাহীন করে তুলেছে। তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস যেনো হৃদয়কে পুড়াচ্ছে। তিয়াশার মনে হচ্ছে, মনের মাঝে হাজারো প্রজাপতি ডানা মেলেছে। মস্তিষ্কের নিউরণ কথা হারিয়ে ফেলছে, সব কিছু যেনো নিঃস্ব লাগছে। শুধু একটা মানুষই তার সামনে, সে হলো অন্তু। তিয়াশা অন্তুর চোখে চোখ রাখলো, স্বচ্ছ চোখ জোড়ায় শূধু নিজের প্রতিবিম্বটাই দেখতে পাচ্ছে সে। নিজের অনুভূতিগুলো তার উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করছে কথাটা বুঝতে ভুল হচ্ছে না তিয়াশার। অন্তু তাকে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে। এতোটা কাছে যে তার হৃদস্পন্দন ও শুনতে পাচ্ছে তিয়াশার।
সময় পার হতে লাগলো, অন্তু তিয়াশাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। এতোক্ষোন বেশ ছটফট করছিলো তিয়াশা। কিন্তু সময়ের সাথে নিজেকে অন্তুর বাহুডোর থেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টাটা ছেড়ে দিলো সে। চুপ করে লেপ্টে থাকলো তার স্বামীর বুকে। তবে মনের অস্থিরতাটা এখনো থামে নি, মন ক্ষণে ক্ষণে উৎসুক হয়ে আছে অন্তুর না বলা কথাগুলো জানতে, কেনো এই আচারণ করছে সেটা জানতে। অন্তুর চুপ করে থাকাটা যেনো অসহনীয় লাগছে তার কাছে। তিয়াশার চাহনী অন্তুর মুখের দিকে, ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। হয়তো কিভাবে কথা গুলো বলবে তা সাজাচ্ছে। অন্তু আলতো হাতে তার কপালের চুল গুলো সরিয়ে দিলো, গুজে দিলো তিয়াশার কানে। তিয়াশার চোখের কোনটা চকচক করছে। অবাধ অনুভূতির সাগরটা জড়ো হয়েছে ও কাজল কালো চোখ জোড়ায়। অন্তু এবার মুচকি হাসলো, মিহি কন্ঠে বললো,
“যদি সহ্য ই না করতে পারো তাহলে দূরে যাবার চেষ্টা করছো কেনো!”

অন্তুর এমন কথায় তিয়াশা একটু নড়ে উঠলো। নিজের অনুভূতিগুলো অন্তুর কাছে ধরা পড়ে যাওয়ায় নিজেকে পক্ষের প্রতিরোধ দেওয়াল গড়তে লাগলো সে। অন্যদিকে ফিরে কড়া কন্ঠে বললো,
“আমার ডেস্কে ফিরতে হবে। অহেতুক সময় নষ্ট করার সময়টা আমার নেই। আর একটা কথা ভুল ধারণা কিন্তু ভালো নয়। অহেতুক কোনো আশা করাটা অযৌক্তিক।“
“তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো আমি ভুল দেখছি? আমার স্পর্শে তোমার শিহরণটা কি ভুল? তোমার চোখে আমার জন্য অস্থিরতা ভুল? তোমার হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দনের সাথে আমার প্রতি তোমার অনুভূতিগুলো ভূল? চোখটা কিন্তু এখনো হান্ড্রেড পার্সেন্ট সঠিক আছে।“
“হ্যা, ভুল। ভুলের অসীম সাগরে আপনার বাস। কোনো অনুভূতি নেই আপনার প্রতি। কোনো অস্থিরতা নেই। অচেনা মানুষের স্পর্শে যে কেউ এভাবেই শিহরিত হবে। এটা সাইন্স।“

তীব্র কন্ঠে প্রতিবাদ করে তিয়াশা। তার অগ্নি দৃষ্টি অন্তুর দৃষ্টিতে স্থির। কিন্তু এই তীব্রতার মাঝে এক রাশ ভয় লুইয়ে আছে। ভয়টা ধরা পড়ার। তাই তো এই প্রতিরোধ দেওয়াল। অন্তু আবারো হেসে উঠে। তবে সে যে একটা সাংঘাতিক কাজ করবে এটা কল্পনা করতে পারে নি তিয়াশা। আরোও শক্ত করে চেপে ধরে সে তিয়াশাকে। খানিকটা ঝুকে নিজের উত্তপ্ত ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে তিয়াশার কম্পনরত ঠোঁটজোড়ায়। অন্তুর এমন আচারণে হতবাক হয়ে যায় তিয়শা। তার সকল অস্থিরতা, রাগ, অভিমান, ভয়কে নিমেশেই শুষে নেই সেই ঠোঁটজোড়া। বুকের মাঝে দামাদল বাজতে লাগে। এ যেনো এক অন্য অনুভূতি। পঁচিশ বছরের নারীর মাঝেও এক অন্যরকম কিশোরত্বের জন্ম দিচ্ছে। দমটা আটকে আসছে। এই অনুভূতি বহু বছর পূর্বে তিয়াশার একবার ই হয়েছিলো। যখন লাইব্রেরি অই থাকের আড়ালে এই উষ্ণ ঠোঁটজোড়া তার মাঝে বিলীন হয়েছিলো। আবারো সেই অনুভূতিটা জীবন্ত হয়ে উঠলো। জীবন্ত এবং তাঁজা। সময়ের খেয়াল যেনো ভুলেই গেলো তার মস্তিষ্ক। সময়টা থেমে গেলে হয়তো ভালো হতো। তিয়াশার ঠোঁটজোড়া যখন মুক্ত হলো তখন তার দৃষ্টি তোলার শোক্তি নেই। মাথা নিচু করে তাকিয়ে রয়েছে মাটির দিকে। লজ্জা রাগে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তিয়াশার। এর মাঝেও এক ক্ষীন ভালোলাগা কাজ করছে। অন্তু তার কানে ঠোঁট মিশিয়ে বললো,
“ভুলে যাস না, তুই কিন্তু এখনো আমার ছয়শ এক টাকার বউ। কথাটা ফিল্মি হলেও সত্য। অচেনা কেউ তোকে স্পর্শ করতে গেলে হাত ভেঙ্গে গলায় ঝুলায়ে দিবো। সব সহ্য করে নিবো,শুধু এই একটা জিনিস আমার কোনো জন্মে সহ্য হবে না। তা হলো আমার বউ এর উপর অন্য কারোর অনধিকার চর্চা।“

অন্তুর তীক্ষ্ণ কন্ঠে রাগের ছাঁপ রয়েছে। অন্তুকে রাগতে বহুবার দেখেছে, কিন্তু এভাবে রাগান্বিত হয়ে স্পর্শ করার সাক্ষী এই প্রথম হলো তিয়াশা। মাথাটা তুলে তাকালো সে অন্তুর দিকে। চোখজোড়া লাল হয়ে আছে অন্তুর। চোয়াল জোড়া শক্ত। হিংস্রতার এক সুপ্ত ছাপ বুঝতে পারছে সে। তবে তিয়াশাও দমে যাবার পাত্রী নয়। রুদ্র কন্ঠে বললো,
“অনধিকার চর্চা কেনো করতে যাবে, স্বধিকারে স্পর্শ করবে। ভুলে যাবেন না, ওই ছয়শ টাকার বিয়ের কোনো দাম এই সমাজে নেই। আমার পরিবার যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করবে আমি তার অর্ধাঙ্গিনী হতে প্রস্তুত। তখন আমার জীবন, আমার শরীর এবং আমার সবকিছুর উপর শুধু এবং শুধু মাত্র তার অধিকার থাকবে।“
“আমাকে চ্যালেঞ্জ করছিস?”
“যা ভাবার ভাবতে পারেন।“

বলেই অন্তুর বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় তিয়াশা। অন্তুর অগ্নিদৃষ্টিকে ভয় পাচ্ছে না তিয়াশা। অন্তু কিছুক্ষণ চুপ করে শুধু তিয়াশাকে দেখে। এরপর বরফ শীতল কন্ঠে বলে,
“এতোদিন তোকে ছাড় দিয়েছি, এখন তো দেখছি ভুলটা আমার ছিলো। মাথার উপর উঠে নাচানাচি করতে শুরু করেছিস। ব্যাশ, আমিও দেখবো কোন শালায় বিয়ে করে তোকে।“

কথাটা বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো অন্তু। অন্তু চলে গেলে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে তিয়াশা। তার পা জোড়া পাথর হয়ে গেছে। নড়ার শক্তিটাও নেই। চোখে জড় হয়ে থাকা প্লাবনকে আর রুখতে পারলো না তিয়াশা। নোনাজলের প্রবাহ বইতে লাগলো। কেনো অন্তু বোঝে না, এই কঠিন, শক্ত মানবীর মাঝে একটা রক্ত মাংসের হৃদয় আছে। যে হৃদয়ে কেবল একজন পুরুষের ই রাজত্ব। যতই কঠোর হবার ভান করুক, যতই প্রতিরোধের দেওয়াল তুলুক; সব গুড়িয়ে যায় তার সামনে। এভাবে চলতে থাকলে পুনরায় হেরে যাবে তিয়াশা। হেরে যাবে নিজের ভালোবাসার কাছে__________________________

সীমান্ত হেলান দিয়ে বসে রয়েছে। তার সামনে বেশ সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে পঞ্চভোগ। কেঁচকি মাছের বড়া, লাউ চিংড়ী, পটলের দোলমা, ইলিশ পাতুরী, গরু মাংস ভুনা, টাকি মাছের ভর্তা, বেগুনের আঁচার। এতোগুলো তরকারি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তার সামনে। সবকিছু একা হাতে বানিয়েছে মৌপ্রিয়া। অবাককর ব্যাপার হলো এই প্রতিটা তরকারি মারাত্বক ভাবে ভালোবাসে সীমান্ত। কিন্তু সে খাওয়া ছেড়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে মৌপ্রিয়ার দিকে। মৌপ্রিয়া চেয়ার টেনে পাশে বসলো। তারপর অবাক নয়নে জিজ্ঞেস করলো,
“খাচ্ছেন না যে?”
“এগুলো তুমি রেধেছো?”
“হ্যা, ভাবলাম অসুস্থ মানুষটার জন্য কি নেওয়া যায়? হরলিক্স আর আপেল তো সবাই নেয়। ছাত্রী হিসেবে ঠিক কি নিয়ে গেলে আমার মাস্টারমশাই এর ভালো লাগবে। অনেক চিন্তা শেষে ঠিক করলাম রান্না করে নিয়ে যাবো। নিন এবার কথা রেখে খান তো। নয়তো আপনার বুভুক্ষু বন্ধুর পেটেই সব চলে যাবে।“

আড়চোখে টগরকে একটু দেখে নিলো মৌ। কিন্তু তাতে কি সে তো বেশ আয়েশেই খাচ্ছে। তখন সীমান্ত প্রশ্ন ছুড়ে দিলো মৌ এর দিকে,
“তুমি জানলে কি করে আমি অসুস্থ? আমি তো তোমাকে বলি নি। সাথে আমার এড্রেস পেলে কিভাবে?”
“খুজলে ঈশ্বর ও পাওয়া যায় জানেন তো? কি ভেবেছিলেন ফোন নাম্বার দিবেন না তাই আমি আপনার টিকি টুকুও পাবো না? ভুল ভেবেছিলেন। আপনার মতো ফাকিবাজ মাস্টারকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় জানা আছে। উঠলাম আপনার কলেজে। যাই হয়ে যাক সেখানে তো কিছু লুকাতে পারবেন না। সেখান থেকেই এই ঠিকানা পাওয়া। এবার কি বোমকেশ বক্সী প্রশ্নোত্তর শেষ হয়েছে? হলে কেই তুচ্ছ মানবীর কষ্টের প্রতিদানটা দিন। খান।“

সীমান্ত হেসে উঠলো। তার হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা খুব প্রিয় মৌপ্রিয়ার। ঘরে ঢুকে তাকে বিছানায় শায়িত দেখেই কলিজায় কামড় পড়েছিলো। তার ফ্যাকাশে মুখখানা দেখে বুকে হাজারো তীর আঘাত হানছিলো। ভালোবাসা এতোটা বেদনার এই প্রথম টের পেলো মৌপ্রিয়া। সীমান্ত খেতে লাগলে মুগ্ধ নজরে তাকে দেখতে লাগে মৌপ্রিয়া। হঠাৎ ই বলে উঠে,
“আমার আপনাকে কিছু বলার আছে…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here