গাংচিল, পর্ব:১

0
813

১.
“আমি চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই রাসেল ভাই আমার হাতটা টেনে ধরলেন। শক্ত হাতের চাপে ব্যাথায় কুকড়ে উঠি আমি, রেশমি কাঁচের চুড়িগুলো পিসছে আমার কবজিতে। চিনচিনে ব্যাথা, হয়তো কাচ ঢুকেছে। আমার রাগ হচ্ছে, কিন্তু তা মনের ভেতরেই পুষে রাখতে হচ্ছে। রাসেল ভাইয়ের অগ্নিমূর্তিরুপ যে আমার চেনা। আমি তার কাছে কেবল একটি চিমকে মশার মতো। একটা তালিতেই শেষ, আমি এক নজর তার মুখের দিকে চাইলাম। তার চোয়াল শক্ত, চোখজোড়া অগ্নিকুডের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত। রাসেল ভাইকে রাগতে দেখেছি, তবে এতোটা রাগতে কখনো দেখি নি। আমি ধীর স্বরে বললাম,
“ভাই, হাতটা ছাড়ুন”

ভাই উত্তর দিলেন না। শুধু ঘাড়টা ঘুরিয়ে আমার চোখের দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টি দেখে আমার মস্তিষ্ক চিন্তা করা বন্ধ করে দিলো। মূহুর্তপূর্বের রাগ, ক্ষোভ যেনো কিছুই নেই এই দৃষ্টিতে। বরং এক অজানা কষ্ট লুকিয়ে আছে, আছে কিছু হারানোর বেদনা। আমার হাতটা এখনো তার হাতে। সে খানিকটা এগিয়ে এলেন। কিন্তু আমি কেনো যেনো পিছাতে পারলাম না। আমার পা জোড়া আটকে রইলো মাটিতে। রাসেল ভাই আমার কাধে মাথা ঠেকালেন, তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার কাঁধ পোড়াচ্ছে। গলার স্বর খাঁদে নামিয়ে বললেন,
“আমাকে মেরে ফেললে কি তুই শান্তি পাবি মৌ? তবে তাই কর, মেরেই ফেল। তবে এভাবে কষ্ট দিস না। তুই কি আমাকে সত্যি বুঝিস না?”

আমার কাছে উত্তর নেই। এই প্রশ্নের উত্তর যে আমার জানাই নেই। কিভাবে দিতাম। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। অনুভূত হচ্ছে এক, দুই বিন্দু উষ্ণ গরম জল আমার কাঁধ ভিজিয়ে দিচ্ছে, রাসেল ভাই কি কাঁদছেন? এটা অসম্ভব। ছেলেরা বুঝি কাঁদে!”
_____________________________________

এটুকু লিখেই থেমে গেলো মৌপ্রিয়া। কিবোর্ড থেকে হাতটা তুলে ফেললো। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আবারো পড়লো লেখাটা। খারাপ হয় নি, তবে মনে দাঁগ কাটছে না। পাঠকেরা ভালোবাসবে কি না বুঝছে না। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাঁড়লো সে।

আজকাল লেখাগুলোকে শুধু শব্দ মনে হচ্ছে মৌপ্রিয়ার কাছে। অনুভূতিহীন জড় শব্দ। তাদের মাঝে না আছে হাসি, না আছে কান্না। এমনটা হবার কারণ তার জানা নেই। হয়তো অনুপ্রেরণার অভাব হচ্ছে। সে বইতে পড়েছিলো, লেখকদের নাকি মাঝে মাঝে মাথা অকেজো হয়ে পড়ে, তাদের সৃজনশীলতায় পড়ে জং। সে এতো বড় লেখিকা নয়, ছোট দু টাকার লেখিকা। যাকে মানুষ ট্রল করে বলে, ‘ফেসবুক লেখিকা’। ‘ফেসবুক লেখিকা’ দের ফ্যান ফলোয়িং হাজারের মাঝে থাকলেও তাদের পদবি সেই ফেসবুক লেখিকা অবধি সীমাবদ্ধ থাকে। যেমনটা মৌপ্রিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে। গত বই মেলায় শখ করে বই বের করেছিলো, গুনে গুনে উনিশখানা বই বিক্রয় হয়েছে, আর বাকি যে অবিক্রিত বই ছিলো তার বাবা কিনেছিলেন সেগুলো। এখনো বই গুলো আলমারির একটা থাকে পড়ে রয়েছে। মোট ২৮১টি বই। বিশাল লস, প্রকাশনী তার সাথে যোগাযোগ ছেড়ে দিয়েছে। মৌপ্রিয়া এই ধষের কারণ বুঝলো না। তার তো ফেসবুকে কম ফলোয়ারস নেই, পেজে তার ফলোয়ার হাজার পাঁচের উর্ধ্বে। তাহলে কেউ কেনো কিনলো না তার বই? রিভিউদাতা বলেছে সে নাকি ফালতু রাইটার, কেউ কেউ তো তার লেখনী চটির সাথেও তুলনা করেছে। মৌপ্রিয়ার অবশ্য তা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই, অজানা মানুষের খোঁচাখুঁচিতে তার মন কাঁদে না। তাই সে আবার উদ্যোগ নিয়েছে। এবার আবার বই লিখবে সে, বইটির নাম হবে “গাংচিল”। কিন্তু লেখাটা আগাচ্ছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে সে ভালো করে লিখতে পারছে না। অলংকার খচিত শব্দগুলো তার মনে পড়ছে না লেখার সময়। যদি খুব আহামরি কোনো শব্দ ব্যাবহার করছে সেটাকে মনে হচ্ছে একটা জড় শব্দ, যে শব্দ শুধুই শব্দ, মনে দাগ কাটে না। দুঃখের একটা সিন লিখেছিলো সে, যেখানে রাসেল অর্থাৎ গল্পের নায়কের চোখের সামনে মৌ অর্থাৎ গল্পের নায়িকার বিয়ে হয়ে যাবে। সিনটা লেখা শেষে যখন রিভাইজ করেছিলো তখন তার মনে হয়েছে এর চেয়ে নিম্মমানের লেখা হয়তো কোনো লেখিকার পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। তাই হাজার শব্দের লেখনীটার উপর চালিয়ে দিলো ব্যাকস্পেস। আজ অবশ্য সেটা করলো না সে। অজানা কারণে লেখাটা কাঁটতে ইচ্ছে করলো না।

ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিলো মৌপ্রিয়া। মনে মনে ঠিক করলো, তিয়াশাকে একবার লেখাটা পড়াবে। তিয়াশা তার ঘনিষ্ট বান্ধবী। তাদের বন্ধুত্বের সাত বছর পেরিয়ে গেছে। তিয়াশা মেয়েটি বেশ অন্যরকম। কিছু কিছু মানুষ কখনো কাউকে না করতে পারে না, মৌপ্রিয়ার মনে হয় তিয়াশা হলো সেই মেয়েটি। নয়তো সাতটা বছর বান্ধবী হিসেবে কম অত্যাচার তো করে নি সে।

হাতটা টানা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মৌপ্রিয়া। লম্বা কোকড়া চুল সাপের ন্যায় নেমে এসেছে কোঁমড় অবধি। ওড়নাটা শালের মতো জড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো মৌপ্রিয়া। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ভাদ্র মাসের গরমকে বলা হয় কুকুর মরা গরম। পিঁচঢালা রাস্তা থেকেও ভাপ উঠে। কিন্তু এবারটা তেমন কিছু হচ্ছে না। ভাদ্র মাস এসেছে অথচ বৃষ্টির কমতি হচ্ছে না। মৌপ্রিয়ার মনে হুচ্ছে আকাশের বুকে অনেক অভিমান জমেছে, তাই তো ছিচকে কাঁদুনীর মতো আকাশ ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠে। আবার যখন মন ভালো হয়ে যায় তখন ঝলমলে রোদের সাথে হেসে উঠে। বারান্দাটা স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। তবুও হাটু গেড়ে বসলো মৌপ্রিয়া। হাতের মোবাইলটা অন করলো। ফেসবুকের ফিডটা স্ক্রল করলো। না, সেই মানুষটি গল্প লিখে নি আজও। প্রতিটা মানুষ কোনো না কোনো মানুষ থেকে অনুপ্রেরণা নেয়। মৌপ্রিয়ার লেখিকা হবার পেঁছনের অনুপ্রেরণা ছিলো সেই মানুষটি। মানুষটির আইডির নাম “ব্যার্থ মানুষ”। যে কেউ ই বলবে এটা ফেক আইডি। কিন্তু মৌপ্রিয়া পাগলের মতো এই আইডিকে অনুসরণ করে। কারণটা ব্যাক্তিটির লেখনী। মৌপ্রিয়ার প্রচন্ড ভালো লাগে তার লেখনী। অবাককর ব্যাপার লোকটি হুট করেই লেখা ছেড়ে দিয়েছে। বিগত দেড়বছর যাবৎ সে কোনো লেখা পোস্ট করে না। লোকটি যেনো হুট করেই হারিয়ে গেছে। মোবাইলটা বন্ধ করে পাশে রেখে দিলো সে। অজানা কারণে বিষাধের নীল ঢেউ এর জোয়ার শুরু হয়েছে তার মনে। চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে বা পাশে। কাতর চোখে বাহিরের বৃষ্টি দেখতে লাগলো সে। হুট করেই নীলুর আগমন ঘটলো। হাতে কফি, এসেই ব্যস্ত গলায় বললো,
“আফা, উঠেন উঠে। এখানে বসলে তো ঠান্ডা লাইগে যাইবো।“

মৌপ্রিয়া খানিকটা বিরক্তভরা কন্ঠে বললো,
“নীলাঞ্জনা, আমার তোর কথা শুনতে ভালো লাগছে না। কফিটা রেখে বিদেয় হ।“

নীলু এবাসার কাজের মেয়ে। যখন সে মাত্র দশ বছর তখন এই বাসায় এসেছিলো। দেখতে দেখতে কতগুলো বছর কেটে গেছে। এখন সে আঠারো বছরের যুবতী। সবাই তাই নীলু বলে ডাকলেও মৌপ্রিয়া তাকে ডাকে নীলাঞ্জনা। তার সব সময় মনে হয়, নীলুকে ‘নীলাঞ্জনা’ নামটায় বেশি ভাল লাগে। কিছু কিছু মানুষের জীবনে কখনো সুখের হাতছানি থাকে না। নীলুও সেই রকম একটি মেয়ে। ছোট থাকতে মেয়েটি তার মাকে হারায়। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে। সৎমা তাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে নারাজ ছিলো। ব্যাস, সে তখন হয়ে যায় কাজের মেয়ে। মৌপ্রিয়ার মা সূবর্ণা বেগম তাকে এ বাসায় নিয়ে আসে। মৌপ্রিয়ার খেলার সাথী সে। তিনিও নীলুকে ডাকতেন ‘নীলাঞ্জনা’। মেয়েটির আঠারো বছর হবার পড়েও সুখের হাতছানিটা ঠিক মিললো না। এতো চেষ্টা করেও ইফতেকার সাহেব একটা ভালো ছেলের সন্ধান করতে পারছেন না। হয়তো এটা স্রষ্টার ই কোনো ইচ্ছে। নীলু কফির মগটি রেখে তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
“ভালো লাগতেছে বললে তো হবে না, লাগাতে হবে। আরেকটা কথা, খালু আপনারে ডাকে। আপনার জন্য নতুন মাস্টার খুঁজে আনছেন তিনি।“

কথাটা শুনতেই নড়েচড়ে উঠলো মৌপ্রিয়া। তার বাবার মাথা নষ্ট সেটা তার জানা আছে। তাই বলে এতোটা সেটা আন্দাজ করে উঠে নি সে। এক রাশ বিষ্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে মৌপ্রিয়া,
“কিসের মাস্টার?”
“আমি ক্যামনে কবো, আপনি নিচে যাইলেই বোঝবেন।“

মৌপ্রিয়া উঠে দাঁড়ালো। ছুটে গেলো নিচে। ইফতেকার সাহেব অর্থাৎ মৌপ্রিয়ার বাবা মানুষটি পেশায় ইতিহাসের শিক্ষক। শিক্ষকতার কারণে তার মনে হয় শিখার কোনো বয়স নেই। তাই তো মেয়ে যে এখন কলেজের পাঠ চুকিয়ে লিখালিখিতে মনোনিবেশ করেছে সেটা তিনি আমলে রাখেন নি। স্ত্রীর বিরহে তার মাথাটা অনেকটা অকার্যকর হয়ে গিয়েছে বলে মৌপ্রিয়ার ধারণা। কিন্তু সেটা যে এই পর্যায়ের হবে এটা ভাবতে পারে নি। বসার ঘরে যেতেই ইফতেকার সাহেবের ভারী কন্ঠ কানে আসে মৌপ্রিয়ার। তিনি হো হো করে হাসছেন। তার ঠিক অপরপাশেই হলদে বাদামী রঙ্গের পাঞ্জাবী পরিহিত এক যুবক বসে রয়েছে। শ্যমলা বর্ণের খানিকটা ধারালো মুখশ্রী তার, নাকটা একটু খাড়া, চোখের পাঁপড়ী গুলো বেশ লম্বা লম্বা, খোঁচা কোঁচা দাঁড়ি, বেশ অনিয়ন্ত্রিত ভাবে তার গালকে ঘিরে রেখেছে। চোখে কালো রঙ্গের প্লাস্টিকের ফ্রেম। লোকটির কাধে একটি চটের ব্যাগ। এই লোককে ঠিক কোথা থেকে তুলে এনেছেন ইফতেকার সাহেব সেই প্রশ্নের উত্তর শুধু তিনি ই জানেন। মৌপ্রিয়া শান্ত গলায় বললো,
“বাবা ডেকেছিলে?”
“আরে এসেছিস মা, ও হচ্ছে সীমান্ত। আজ থেকে তোর লেখালিখির শিক্ষক যাকে বলে গুরু……………

চলবে

#গাংচিল
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here