#গল্প
#পথের_শেষে_১
#অনামিকা_ভট্টাচার্য্য
চৈত্রের দুপুরে কেমন ঘুম ঘুম অলসতায় পেয়ে যায়।যেদিন কোনো কাজ থাকে না সেদিন দুপুরবেলা খাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে সৈকত। শেষ বিকেলের দিকে ছাদে গিয়ে অল্প সময় হাঁটাহাঁটি করে। শেষ বিকেলের দিকে ছাদে যাওয়ার কারণ হলো এই সময় ছাদ ফাঁকা থাকে। তা না হলে রোদে শুকাতে দেওয়া কাপড় এসে প্রায়ই মাথা-মুখ ছুঁয়ে দেয়। বিরক্ত লাগে সৈকতের। নির্বিঘ্নে হাঁটাচলা করা যায় না।
এই পাঁচতলা ফ্ল্যাটের সবচেয়ে উঁচুতে সৈকতের বাস।সৈকত থাকে ছাদের চিলেকোঠায়। একটা রুম, সাথে এটাচড ওয়াশরুম। রুমের একপাশে একটা সিঙ্গেল চুলা। তরকারি,ডিম ভাজি চুলায় রান্না করে। ভাত,ডাল রান্নার জন্য রাইস কুকার,প্রেশার কুকার আছে। চা/কফি ইলেকট্রিক কেটলিতে বানিয়ে নেয়।
রুমে আসবাবপত্র বলতে একটা সিঙ্গেল খাট, প্লাস্টিকের ওয়্যারড্রব, চেয়ার-টেবিল, তালা দেওয়া জং ধরা লোহার একটা ট্রাংক আর একটা বুকসেলফ। নামে বুকশেলফ হলেও এটাতে একটাও বই রাখা নেই। তাঁর বদলে রাখা আছে চিনির ঢিবি, বিস্কিটের কৌটা, চানাচুরের বৈয়ম, তেলের বোতল, মসলার কৌটা আর কিছু ছোট ছোট বাসন-কোসন। হাঁড়ি-পাতিল ফ্লোরে পলিথিন বিছিয়ে তার ওপর উল্টো করে রাখা আছে।টেবিলের ওপর একটা চৌকোনা প্লাস্টিকের বক্সে একটা ছোট আয়না, চিরুনি আর শেভিং এর সরঞ্জাম রয়েছে।আলনা কেনা হয়নি। কাপড়-চোপড় দড়িতেই ঝুলানো থাকে। সৈকতের একার সংসার এভাবেই বেশ চলে যায়।
এই ফ্ল্যাটের মালিক রায়হান সাহেব। উনি দোতলায় থাকেন। নীচতলায় গাড়ীর গ্যারেজ আর সার্ভেন্ট কোয়ার্টার। তিন, চার আর পাঁচতলা দুই ইউনিট করে ভাড়া দিয়েছেন।
রায়হান সাহেবের তিন মেয়ে। কাকলী, কুসুম, কাঁকন।তবে উনার বেশি চিন্তা ছোটোটাকে নিয়ে। এই মেয়েটার পড়াশুনোয় একেবারেই মন নেই। সারাক্ষণ স্বপ্নের জগতে বাস করে। সিনেমা দেখা তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ। চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথা বলে।
বড়ো মেয়ে কাকলী মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। মেজো মেয়ে কুসুম একটা সরকারি মেডিকেলে পড়ছে। ছোটো মেয়ে কাঁকন এইবার ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে এবং সাথে সাথে ঘোষণা দিয়েছে সে আর পড়াশুনা করবে না।
কাঁকনের পাসের খবর জেনে রায়হান সাহেব কয়েক কার্টুন মিষ্টি এনে পুরো ফ্ল্যাটে বিলি করেছেন। তাও সাধারণ লাল-সাদা রসগোল্লা নয়। দামী মিষ্টি।মালাইকারী আর ছানার সন্দেশ।
যদিও রায়হান সাহেবের এমন পাগলামিতে ফ্ল্যাটের অনেকেই মুখ টিপে হেসেছিল। এই বছর করোনার কারণে এইচএসসিতে সবাইকে অটোপাস দেওয়া হয়েছে। কেউ ফেল করেনি। কিন্তু রায়হান সাহেবের ভাবে মনে হচ্ছে উনার মেয়ে তুমুল প্রতিযোগিতামূলক কঠিন কোনো পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। আসলে মেয়ে এক চান্সে পাস করতে পেরেছে। এতেই রায়হান সাহেব খুশি। তা সে যেভাবেই হোক না কেন। আড়ালে মিষ্টি বিলি নিয়ে হাসাহাসি করলেও, মিষ্টির কার্টুন কিন্তু একটাও খালি থাকেনি।
এটা বোধহয় আমাদের সমাজের খুবই সাধারণ একটা নিয়ম। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে গণ্ডেপিণ্ডে গিলে এসে আমরা কোন তরকারিতে লবণ বেশি আর কোনটায় ঝাল কম হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করি। অথচ বিয়ে বাড়ির হাঁড়ি-পাতিল সবই খালি হয়ে যায়। কেউ কেউ আবার একই আইটেম দু’চার বার করে চেয়ে নিয়ে চেঁটেফুটে খেয়ে খাবারে শর্ট লাগাতে পারেন। কিন্তু তরকারির দোষ-মন্দ বিচারে উনিও সমানতালে সামিল হোন।
সৈকতও কাঁকনের পাসের মিষ্টি খেয়েছে। সৈকত অবশ্য এতে অবাক হয়নি! যে লোক ঘরে তিন তিনটে যুবতী মেয়ে থাকতে একজন ব্যাচেলরকে ঘর ভাড়া দিতে পারেন উনার পক্ষে এসব কান্ডকারখানা করা কোনো ব্যাপারই না। সৈকত প্রায় দুই বছর ধরে এই ফ্ল্যাটে বসবাস করছে। ঢাকা শহরে নিজের মতো একটা রুম ভাড়া পাওয়া আর বুয়েটে মেরিট লিস্টে চান্স পাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই ব্যাচেলর ছেলেদের জন্য। মেসে থাকতে ভালো লাগে না সৈকতের। ও একটু নিজের মতো করে নিরিবিলি থাকতে চায়। তাই এখানে রুম নেওয়া। তাছাড়া বাসা ভাড়ার চা চওড়া অবস্থা! চাইলেই দু কামরার বাসা নেওয়াও সম্ভব নয়। সবদিক দিয়েই এই বাসাটা পারফেক্ট সৈকতের জন্য।
সৈকত ওদের তিন বোনকেই দেখেছে। দেখেছে বলতে সরাসরি দেখা হয়নি কখনও। বিকেলবেলা অনেকেই ছাদে আসে। নিজ রুমের জানালা দিয়ে তাকালে অনেক কিছুই দেখতে পায় সৈকত।
কাকলী মানে রায়হান সাহেবের বড়ো মেয়ে ছাদে এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মাঝে মাঝে পাকা বেদীতে বসে কবিতার বই পড়ে। ছাদের দড়িতে শুকাতে দেওয়া কোনো কাপড় নীচে পড়ে গেলে সেটা নিজেদের না হলেও তুলে আবার মেলে দেয় কাকলী। খুব যত্ন করে টবে পানি দেয়। শুধু নিজেদের নয়। পাশে থাকা সবগুলো টবই ওর হাতের পানি পায়। এ থেকে বুঝতে পারা যায় ওর মধ্যে মমত্ববোধ প্রবল। মেয়েটার চোখে যেনো গভীর এক মায়ার সমুদ্র লুকানো আছে।
আচ্ছা,হুমায়ূন আহমেদের সাথে কখনপ এই মেয়েটার দেখা হলে কী ভাবতেন উনি? নিশ্চয়ই “মায়াবতী” নাম দিয়ে দিতেন। হুমায়ূন আহমেদের মায়াবতীরা তো এরকমই হয়। অতি সুন্দরী, মায়াবী। মেয়েটা তো হুমায়ূন আহমেদের গল্পের নায়িকাদের মতোই রূপসী।
এসব কী ভাবছে ও? নিজের ভাবনায় নিজেই বিস্মিত হয় সৈকত!
কুসুমকে দেখে কখনো কাকলীর মতো কোমল হৃদয়ের কোনো মেয়ে মনে হয়নি সৈকতের কাছে। আবার কঠিন মানবী বলেও মনে হয়না। আসলে কেউ কেউ আছেনা নিজেকে শামুকের খোলসের ভেতর রাখতেই পছন্দ করে। কুসুম কিছুটা ওরকমই। যেনো নিজের চারপাশে আই হোল গ্লাস ফিট করে রেখেছে সে। বাইরে থেকে দেখে কিচ্ছু বুঝার উপায় নেই ওর ভেতরটা আসলে কেমন। মেয়েটা ছাদে এসে ফুল স্পীডে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে। চোখে সবসময় চশমা পরা থাকে। কারো কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না সে। কারো সাথে তেমন একটা কথাটাও বলে না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে অতি সংক্ষেপে উত্তর দেয়। শরীরচর্চা শেষ হলে আবার নীচে নেমে যায়। সপ্তাহে পাঁচদিন নিয়ম করে একটানা চল্লিশ মিনিট হাঁটাহাঁটি করাটা কুসুমের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। মেডিকেল স্টুডেন্ট বলে নয়।খাওয়াদাওয়া,শরীরচর্চা এসব ব্যাপারে ছোটোবেলা থেকেই খুব সচেতন কুসুম। স্কুলে থাকতে গার্লস গাইডের সদস্য ছিলো। কলেজে পড়াকালীন সময়েও নিয়মিত খেলাধুলায় অংশ নিতো।
এখন মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে পড়াশুনার বাইরে আর কিচ্ছু করতে পারেনা। ঐ হাঁটাহাঁটিটুকুই ধরে রেখেছে শুধু।
কাঁকন ছাদে এসে যে কারো সাথে গল্প জুড়ে দেয়।খিলখিল করে হাসে। ছাদে কেউ না থাকলে কারো রোদে শুকাতে দেওয়া বরই কিংবা আমের আচার থেকে কিছুটা নিজের হাতে নিয়ে অনায়াসে খেয়ে নেয় সে।মাঝে মাঝে দোলনায় বসে দোল খায়। গুনগুনিয়ে গান গায়।
সৈকত ভাবে একটা ছাদ। এক একজন মানুষ এক এক উদ্দেশ্য ব্যবহার করে। কেউ শরীরচর্চার জন্য। কেউ মন ভালো করতে ছাদে ঘুরে বেড়ায়। কেউ সাংসারিক প্রয়োজনে আচার,মসলা এটা-সেটা রোদে শুকাতে দেয়।কেউবা আবার আচার চুরি করে খাওয়ার জন্য ছাদে আসে।
চুরির ব্যাপারটা মনে হতেই নিজের অজান্তেই হেসে ফেলে সৈকত।
#চলবে