#গর্ভধারিণী
পর্ব—-০৮
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
—মর্জিনা আমি যে কথাটা এতোদিন বুকের ভেতরে পাথরচাপা দিয়ে রাখছিলাম।আজ আর পারলাম না নিজেকে ধরে রাখতে…এইটা ক্যান বললাম আমি,কি করলাম আমি এইটা?
—কি হয়েছে আমায় বলো,একটু আগে তুমি কি বললে ওটা।আকাইদ তোমার ছেলে নয়?
—না,কিছু না।আমায় আর কিছু জিজ্ঞেস করিস না তুই!
এই বলে আব্বা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।মর্জিনা ফুপু তাকে কয়েকবার পেছন থেকে ডাক দেয়,কিন্তু আব্বা সাড়া দিলো না।
—দূরত ভাই,কোথায় যাও?কিছু না বইলা চইলা যাইতেছো ক্যান তুমি?
আব্বা মর্জিনা ফুপুর কোনো কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে চলে গেলো।এরপর মর্জিনা ফুপু এসে আমার ঘরের দরজাটা খুললো।আমি দৌড়ে গিয়ে মর্জিনা ফুপুকে জড়িয়ে ধরি।
—মর্জিনা ফুপু,এইটা কি কইলো আব্বা?
—কী কইছে,কিছু কয় নাই তোর আব্বা।
—আমি শুনছি সে বলছে আমি নাকি তার ছেলে না।
—দেখ তুই এখনো অনেক ছোটো।এতো কিছু শুনতে নেই।আর কতটুক বুঝিস তুই।দূরত ভাইয়া তোর আব্বা না তো কি,রাগের মাথায় অনেক কিছু বলে মানুষ।
মর্জিনা ফুপুর কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম।একটু পরে মর্জিনা ফুপু কি জানি একটা ভেবে আমায় বললো।
—তোরে যেটা বলতে আসছিলাম,
—কি কথা?
—একটা জরুরী কথা।আমি তোর আম্মার একটা আত্মীয় বাড়ির খোঁজ পেয়েছি।যার বাড়ি কিনা হাসপাতালের ডানদিকের ঐ রাস্তাটা দিয়ে যাইতে হয়,
—সত্যি কইতেছো তুমি?
—হ রে,তাইলে আর বলি কি!খোদা চাইলে তোর আম্মারে এইবার পাইয়াও যাইতে পারি আমরা।
—সে তো বুঝলাম, কিন্তু আমার আম্মা ওখানেই আছে তার কি মানে?
—আমার তো মনে হয় ঐ বাড়িতেই আছে।দেখ কোনো মানুষ যখন বিপদে পড়ে বা তার আশ্রয়ের দরকার হয়,নিজের আপন মানুষের কাছেই যায়।দেখ তা না হইলে তোর মা হাসপাতালের ঐ রাস্তাটার দিকে ক্যান যাইবে?
—তাইলে আমরা কি করবো এখন?
—কি আর করবো,তোর মায়ের ঐ আত্মীয় বাড়িতে যাবো।আমার মনে হয় তুইও আগে গেছিস,এখন মনে করতে পারতেছিস না।
—হুমমম,হইতে পারে।কিন্তু কখন যাবো আমরা, দেখলে কাল রাতে কি কান্ড করলো আব্বা!
—এতো ভয় পাইলে চলবে না।আমরা আজকে বিকেলের দিকে যাবো।ঐ সময়ে এমনিতেও তোর আব্বা বাড়িতে থাকে না।যদি সন্ধ্যার পরপর ফিরে আসতে পারি আর কোনো চিন্তাই থাকবে না।
—ঠিক আছে।তাইলে তাই হবে।
মর্জিনা ফুপু এরপর তার বাড়িতে চলে গেলো।এদিকে আমিও আমার কাজে হাত দিলাম।
–
–
–
–
–
দুপুরবেলা আব্বা বাড়িতে ফিরে আসে।হাতে করে কিছু খাবার নিয়ে আসলো।আম্মা বেঁচে থাকতে আব্বা যখন বাড়িতে ফিরতো আমার জন্য কিছু না কিছু নিয়েই আসতো।আবার আজকে কিছু নিয়ে আসলো।আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকে প্রশ্ন করি।
—এইগুলা কি আনছো আব্বা?
—তোর জন্য গঞ্জ থেকে খাওয়ন নিয়া আইছি,তুই যেগুলা খাইতে পছন্দ করো।
খাবারগুলো সত্যিই আমার ভীষণ প্রিয়।কিন্তু আমি তেমন আগ্রহ প্রকাশ করলাম না।আব্বার সকাল আর গতরাতের চেহারা এখনো ভুলতে পারছি না।আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারে আব্বা আমার কাছে এসে আমায় আদর করতে করতে বলতে লাগলো।
—রাগ করছিস বাবা,দেখ আমি হয়তো তোর লগে একটু বেশিই খারাপ ব্যবহার করে ফেলছি! কি করবো বল, মাথা ঠিক থাকেনা।
—আমি এগুলা খাবো না আব্বা!
—ক্যান খাবি না,তুই না খাইলে যে আমি শান্তি পামু না।আগে তো আমি কিছু আনলেই ঝাপিয়ে পড়তি আমার ওপর।
—তুমি আর সেই আমার আগের আব্বা নেই।তুমি পাল্টে গেছো,সবাই ঠিকই বলে মা মরলে বাপও পর হইয়া যায়,
—ওরে বাবা, এতো পাকা পাকা কথা কে শিখাইলো তোরে,ঠিক আছে আমার সামনে খাইতে হবে না,যদি এই অধম বাপটারে ক্ষমা করতে পারিস পরে না হয় খেয়ে নিস।
এই বলে আব্বা খাবারগুলো আমার সামনে রেখে চলে গেলো।আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।এমনিতে ক্ষুধাও লেগেছে।নাহ,এতো চিন্তা করলে হয় না,আগে খাই।তারপর যা হবার হবে।আমায় খেতে দেখলে হয়তো আব্বাও খুশি হবে।কথাগুলো ভেবে কয়েকটা গজা তুলে মুখে পুরে দিলাম।আহ!কি স্বাদ।কতোদিন বাদে এতো ভালো খাবার খাচ্ছি নিজেও জানিনা।আরও কয়েকটা গজা নিয়ে মনের সুখে খেতে লাগলাম।
খেতে খেতে হঠাৎ কেমন জানি একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো আমার ভেতরে।মাথাটা ঘুরতে লাগলো,সাথে প্রচন্ড ঘুমও পাচ্ছে।এই সময়ে তো এতো ঘুম পায় না আমার।জেগে থাকার যতোই চেষ্টা করছি না কেন ঘুম আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ধরছে।হাত থেকে খাবারগুলো মাটিতে পড়ে গেলো আমার।তারপর কোনোমতে খাটের ওপরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।মুখ থেকে শুধু একটাই শব্দ উচ্চারিত হলো আমার।
—আম্মা, তুমি কোথায়?
এরপর,আর কিছু মনে নেই আমায়।
–
–
–
–
ঘুম ভাঙতেই দেখি চারদিকে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার।ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম আমায় কোনোকিছুর ভেতরে আটকে রাখা হয়েছে।হতে পারে কোনো বাক্স।আর এটাও বুঝতে পারলাম আমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
—কে আছো,আমায় কোথায় নিয়া যাইতেছো?আমার কথা কি কেউ শুনতে পাইতেছো না!
আমার চিৎকারের আওয়াজ বাক্স ভেদ করে কারোর কানে পৌঁছলো না।একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমি এখানে এলাম কিকরে?আব্বার দেওয়া গজা খাওয়ার পরে আর কিছু মনে করতে পারছি না আমি।বাক্সের দরজাটা খোলার প্রানপন চেষ্টা করি আমি।একটু পরে লক্ষ্য করলাম কেউ যেনো বাহির থেকে দরজাটা খুলছে।একটা লোক দরজা খুলে আমার দিকে একটা জলের বোতল এগিয়ে দিলো।
—জলটা খেয়ে নে,আর যতোই ছটফট করিস না কেনো এখান থেকে জীবনেও বের হতে পারবি না তুই।
লোকটার হাত আমার কাছাকাছি আসতেই আমি তার হাতের ওপরে সজোরে একটা কামড় বসিয়ে দিলাম।তারপর বাক্স থেকে বেরিয়ে আসি।সে আমাকে ধরার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।ইতিমধ্যে আমি গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছি।ভাগ্যিস গাড়িটা কিছু সময়ের জন্য থামানো ছিলো।তারপরেও এতো ওপর লাফ দেবার কারণে আমার কপাল খানিকটা কেটে যায়।আর পায়েও ভীষণ ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম।কিছুতেই উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না।অল্প কিছু সময়ের ভেতরে রাস্তায় লোকজন জড়ো হয়।সেই ড্রাইভারের হদিস নেই কোথাও।রাস্তার লোকজন আমায় নানান প্রশ্নে জর্জরিত করতে থাকে,অথচো আমি যে চোট পেয়েছি সেইদিকে হুশ নেই কারো।
—এই ছেলে,কোথা থেকে এলে,বাড়ি কোথায়,তোমার সাথে কি কেউ নেই,একা একা বেরিয়েছো কেনো,?
আমি এদের প্রশ্নের কি উত্তর দেবো বুঝতে পারছি না।একটু পরে একটা পরিচিত কন্ঠ কানে ভেসে আসলো আমার।
—কি হয়েছে এখানে,একটু দেখতে দিন আমায়। আমায় সামনে যেতে দিন।
সে ভিড় ঠেলে কেউ একজন সামনে এগিয়ে আসতে লাগলো।তার দিকে চোখ পড়তেই আমি বিস্ময়ে হতবাক!যেনো জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি।মুখ ফুটে বলে উঠলাম।
—আম্মা,তুমি!!!!
চলবে……