#গল্প= গর্ভধারিণী
#পর্ব______২
প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ
আমায় প্রশ্নটা করে আম্মা আরোও একটা ভাতের গ্রাস মুখে তুলে নিলো,আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সেইদিকে।
—বিষ কি আম্মা,কি হয় বিষ খাইলে?
—কিছু হয় না বাবা…
—কই আমিও একটু খাই,তুমি তো রোজ খাইয়ে দাও আমায়।তাইলে আজ দিচ্ছো না কেনো,
–না, বাবা।ভুলেও না,তুই কাছেও আসিস না আমার।
বুঝতে পারছি মায়ের গলার স্বর কেমন জানি ভারী হয়ে আসছে,শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।বুঝতে পারছি না কি করবো আমি।
—আম্মা,কি হইছে তোমার,এমন করতেছে ক্যান তুমি,
—আমায় একটু পানি দিবি বাবা?
আম্মা কেমন হাফিয়ে হাফিয়ে বলতে লাগলো,আমি আমার গ্লাসটা আম্মার দিকে এগিয়ে দিলাম।আম্মা হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিবে সেই শক্তি নেই।আমি তার মুখের সামনে গ্লাসটা ধরি,অমনি ঢকঢক করে পুরোটা গলঃধকরণ করে নিলো।তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।আম্মাকে এখনো এরকম করতে দেখি নি আমি,প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম।
—ও মা,তোমার কি খুব কষ্ট হইতেছে,এমন করতেছো ক্যান?
আম্মা আমায় তার কাছে টেনে নিলো,তারপর ক্ষীনস্বরে বলতে থাকে।
—আমায় পারলে ক্ষমা করে দিস বাবা,আমি তোর সাথে অনেক বড়ো অন্যায় করছি,আল্লাহর কাছে বল যেনো উনি তোর আম্মারে ক্ষমা করে দেয়।
আম্মার করুণ অবস্থা দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না আমি।চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তুললাম।একটু পরে পাশের বাড়ি থেকে মর্জিনা ফুপি আর ওর ভাই দৌড়ে আসে।
—আকাইদ,কি হইছে তোর,এমন ভাবে কান্তেছিস ক্যান,মা মারছে নাকি?
—মর্জিনা ফুপু আমার আম্মা কেমন জানি করতেছে দেখো,আমার খুব ভয় করেছে মর্জিনা ফুপু।আম্মার কিছু হইবো না তো?
মর্জিনা ফুপু আর ওর ভাই আম্মার দিকে ছুটে গেলো।ওরা দুজনে ফিসফিস করে কি বলছে বুঝতে পারছি না আমি।শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।একটু পরে মর্জিনা ফুপুর ভাই আমায় বললো –
—আকাইদ,তোর আম্মারে হাসপাতালে নিতে হইবো,নয়তো বাঁচানো যাবে না।
—আহ,মরণ।বাচ্চাটার সামনে কি বলতেছিস এসব,চুপ কর।
মর্জিনা ফুপি ওর ভাইকে ধমক দিয়ে বললো।এরমধ্যে বাড়িতে আরোও কিছু লোক জড়ো হয়।পাশের বাড়ির ইসমাইল চাচা তার ভ্যান নিয়ে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়।আম্মাকে সবাই ধরাধরি করে গাড়িতে উঠালো।আমি দৌড়ে পেছন পেছন গেলাম।
—ও ইসমাইল চাচা,আম্মা কথা কইতেছে না কেনো,হাসপাতালে নিলে আম্মা ঠিক হইবো তো?
—হরে বাপ হবে,তোর আম্মার কিছু হবে না।এখন শোন ঘরে টাকা পয়সা কোথায় আছে জানোস কিছু,আমাগো কারো কাছে তো অতো টাকা নাই!
—টাকা,আছে আছে আমার কাছে আছে…
এই বলে আমি ছুটে ঘরের ভেতরে গেলাম।আম্মা গতকাল দুই টাকার কয়েকটা নোট দিছিলো আমায়,আর আজ যখন আব্বা বাড়িতে আসছিলো কিছু কয়েন দিয়ে গেছিলো।আমি টাকাগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে ভ্যানের সামনে দৌড়ে আসলাম।
—ইসমাইল চাচা,এই নাও টাকা।এইতে হইবে তো?
ইসমাইল চাচা কিছুক্ষণ হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
—ও মোর খোদা,এই কয়ডা টাকা দিয়ে কি হইবে,এই পোলা কয় কি?তোর মায়ের জন্য অনেক অনেক টাকা লাগবে রে বাপ।
–কিন্তু এতো টাকা আমি কই পামু,আমার কাছে তো নাই।
মর্জিনা ফুপুর ভাই এরমধ্যে কোথা থেকে চলে আসলো।তারপর ইসমাইল চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলে।
—সময় নষ্ট না করে তুমি চলো,টাকা পয়সার ব্যবস্থা আমি করতেছি।চলো তুমি…
আম্মার নিথরপ্রায় দেহ ভ্যানের ওপরে শুয়ে আছে,আমাকেও ভ্যানে উঠিয়ে দেয়া হলো।আসন গেড়ে আম্মার মাথার কাছে বসলাম আমি।তার একটা হাত শক্ত করে ধরলাম,যাতে গাড়ি থেকে পড়ে না যাই।প্রায় আধাঘন্টা পরে গাড়ি এসে হাসপাতালের গেটের সামনে থামলো।আম্মাকে ধরে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়।এরপর কি হয়েছে আমি জানি না।আমায় আবার বাড়িতে নিয়ে আসা হলো।অনেক করে হাসপাতালে থাকতে চাইলাম কেউ শুনলো না আমার কথা।
–
–
–
রাতের বেলা ঘরের সামনে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছি।এখন পর্যন্ত আম্মার কোনো খবর পাই নি।শুধু মাথায় আম্মার একটা কথা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে।আমায় ক্ষমা করে দিস বাবা।আমি অনেক বড়ো অন্যায় করছি তোর সাথে!এই কথার মানে কি?আম্মা আমার কাছে কিসের জন্য মাফ চাইলো, আর সে আমার সাথে কিই বা অন্যায় করেছে আল্লাহ আর আম্মাই ভালো জানেন।জানিনা এর রহস্য কি? হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একটা আমার কাঁধে হাত রাখলো।আমি চমকে উঠে ঘুরে তাকালাম।
—আব্বা, তুমি?
—হ রে আমি,
—শোন,তুই কাউরে কিছু বলিস নাই তো?
—কি বলমু,
—আমি যে তোরে বিষের শিশিটা দিছিলাম, কাউরে বলিস নি তো?
—না, কিন্তু বললে কি হইব..
—এতো,বুঝতে হবে না।তুই খালি কাউরে কিছু বলবি না।ঠিক আছে?
—ঠিক আছে, তুমি অহন আমারে আম্মার কাছে নিয়া যাও,আমি আম্মার কাছে যাবো।
—এতো রাতে গিয়ে কি করবি, আমি কাল সকালেই নিয়ে আসবো তোর আম্মারে।
—তাই নাকি,সত্যি আম্মারে তুমি নিয়া আসবা?
—হ,এখন যা।ঘুমা।
আমি বেশ আনন্দিত মনে ঘরের ভেতরে চলে গেলাম।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ি।না জানি আম্মা কখন আসবো।আব্বা তো কইলো সকাল সকাল নিয়া আসবে।এতো দেরী কেনো হইতেছে তাইলে কে জানে?মনটা বড্ড আনচান করছে আমার।বার বার ঘরের ভেতরে বাহির হচ্ছি।একটু পরে গাড়ি আর লোকজনের শব্দ ভেসে আসলো আমার কানে।ঘর থেকে দৌড়ে বাহির হতেই দেখি কেউ পলিথিনে প্যাচানো কিছু একটা গাড়ি থেকে নামালো,তারপর উঠানের সামনে রাখে।আমি আব্বারে গিয়ে কইলাম।
—ও আব্বা, এইডা কি নিয়া আইছো,আম্মা কোথায় আমার?আম্মা কই।
—তোর আম্মা এই পলিথিনের ভেতরে বাবা,
(আব্বা কাঁদতে কাঁদতে বললো)
—তুমি আম্মারে এই মোটা কাগজের ভেতর রাখছো কেনো,আম্মা যে শ্বাস নিতে পারবো না!
আমার কথা শুনে উপস্থিত লোকজনের ভেতরে কয়েকজন কান্না শুরু করে দিলো।বুঝতে পারছি না কি ঘটছে এখানে।আব্বা আমায় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো।
—তোর আম্মা আর বেঁচে নাই বাবা,তোর আম্মা আগাগো সবাইরে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে।
আব্বার কথা শুনে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো আমার।চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো।দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না আর,মাথা ঘুরে আম্মার পায়ের কাছে গিয়ে পড়লাম।ঠিক তখন একটা অদ্ভুত ব্যপার লক্ষ্য করি আমি।
এই পা তো আমার আম্মার পা না!আম্মার পায়ের আঙ্গুলগুলো এরকম লম্বা লম্বা লম্বা কেনো,আমি নিশ্চিত এটা আম্মার লাশ না। তাহলে আব্বা এটাকে আম্মার লাশ বলতেছে কেনো,আমার আম্মা কী সত্যিই বেঁচে আছে..?
চলবে….