#গজপ্রিয়া~6
#Chhamina Begam
গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে । সম্রাট আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে রানীর দিকে । কিন্তু রানি চোখ মুখ শক্ত করে স্টিয়ারিং ধরে আছে । ইচ্ছে থাকলেও আর টু শব্দটি করল না সম্রাট । এই মেয়ের অল্পতেই রেগে যাওয়ার ধাত আছে । ভরসা নেই । রেগে গেলে সত্যি সত্যি লাথি মেরে ফেলে দিতে পারে ।
মেয়ে এতদিন পর আসছে শুনে সেই সকাল থেকে জাহানারার বিশ্রাম নেওয়ার জোর নেই । যদিও জানে রানি বেশিক্ষণ থাকবে না । তবুও এই অল্প সময়ের মধ্যেই দুধপিঠা , তেলের পিঠা , পাটিসাপটা, পোলাও আর কষা মাংস রান্না করে ফেলেছে । তবে রানির জন্য সাদা ভাত রান্না করেছেন । কারণ ও পোলাও পছন্দ করে না । পোলাও টা জাহানারা রান্না করেছে সম্রাটের জন্য । খুব ভালোবাসে ছেলেটা পোলাও খেতে । ছোট বেলায় যখনি বেড়াতে আসত প্রতিবার খালামনির কাছে আবদার করতে পোলাও এর ।
বাণী ছোট হলেও সকাল থেকেই মায়ের সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করছে । আর বিলকিস, তার তো কথাই নেই । হাতে তেল, হলুদ লাগাতে তার ঘোর আপত্তি । বিয়ে বাড়ি যাবে জন্য সকাল থেকে চুলে হেনা , মুখে কি সব ফেসপ্যাক লাগিয়ে বসে আছে । জাহানারা বার কয়েক বলেছেন ওনাকে সাহায্য করতে । এটা সেটা অজুহাত দেখিয়ে প্রত্যেকবার বেরিয়ে গেছে সে।
রান্নাবান্না সারতে সারতেই আড়াই টা বেজে গেলে জাহানারা ঝটপট গোসল সেরে জোহরের নামাজ আদায় করে নিলেন । বিলকিস ঘন্টা খানেক আগে বলেছে রুমার ছেলে সম্রাট ও নাকি আসছে । অধীর আগ্ৰহে অপেক্ষা করছেন তিনি ছেলেমেয়ে দুজনকে দেখার জন্য । নিজের নাড়িছেড়া ধনের সাথে সাথে রুমার এই মেজ ছেলেটাকে দেখার ইচ্ছে প্রবল ভাবে মাথা চারা দিচ্ছে । সদা হাসিখুশি এই ছেলেটিকে তিনি নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করেন । অপেক্ষার প্রহর সবসময় দীর্ঘ মনে হয় । জাহানারা অস্থির হয়ে ঘরের লাগোয়া বারান্দা থেকে বার বার রাস্তার দিকে উকি দিচ্ছেন । দেখা যায় কি না ?
অবশেষে একটা গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে । রানি রাস্তার পাশে গাড়িটা পার্ক করে নেমে এল । মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে দেখল কিছুক্ষণ বারান্দায় দাড়ানো নিজের আপনজনদের । প্রায় পাচঁ মাস পর দেখছে ওদের । খুশিতে চোখের কোণে মুক্তোর মতো জল চিককিক করে উঠল । পাশে দাড়িয়ে সম্রাট দেখল পড়ন্ত বিকেলের সোনালী আলোয় ওই শ্যামলা মেয়েটির মায়াময় মুখখানি । টলটলে চোখে একটা সুখময় হাসি দিয়ে আপনজনদের দেখতে ব্যস্ত সে । জাহানারা স্বস্থির হাসি হেসে কিছুক্ষণ দেখল রানি কে । তার বাকি তিন মেয়ে তার নিজের গায়ের রঙ পেলেও রানিটা একদম বাবার মতো হয়েছে ।মুখের আদলটাও বাবার মতো । সারাক্ষণ একটা মায়া মায়া ভাব লেগেই থাকে । ওকে দেখলেই জাহানারা মোশারফ হোসেনের মুখটা দেখতে পান । ভাবতে ভাবতেই জাহানারা বারান্দা থেকে নেমে গেল সামনে । বিলকিস ,বানীও দৌড়ে গেল সেদিকে ।
রানি গাড়ি থেকে নামতেই ‘ আপু ‘ বলে চিৎকার করে জাপটে ধরল বাণী , বিলকিস । টাল সামলাতে না পেরে পড়েই যাচ্ছিল রানি , ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল । কারণ এমন পাথুরে রাস্তায় পড়ে গেলে কোমড়ের আস্ত থাকবে না । তখনি পেছন থেকে একটা শক্ত হাত বেড়ি দিয়ে ধরল রানিকে । ধাতস্থ হতে সময় লাগল কিছুক্ষণ । পরক্ষণেই এই হাতের মালিক কে হতে পারে বুঝতে পেরেই ঝট করে সোজা হয়ে দাড়িয়ে সরে গেল ।
-“আম্মুউউউ ” মাকে আল্লাদি সুরে ডেকে জড়িয়ে ধরে রানি । জাহানারা একটা প্রসস্থ হাসি হেসে বলে ,
-“কেমন আছে আমার সোনা মনিটা ? ”
-” খুব ভালো আছি আম্মু ”
-” আম্মু, তুমি সবসময় আপুকে বেশি বেশি আদর কর কেন ? আমাকে তো কখনই সোনামনি বলে ডাকো না ? ” বাণীর অভিমানী সুরে উপস্থিত সকলেই মুচকি হাসে । রানি মায়ের কাছ থেকে সরে এসে কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্রু কুচকে বলে ,
-“ওরে আমার হিংসুটি রে । আমাকে এত হিংসে হয় তোর ! আমি তো মাঝে মাঝে আসি মায়ের আদর খেতে । আর তোরা তো সারাবছর আমার ভাগের আদর খাস । তখন তো আমি কিছু বলি না । ”
-“তুই সারাবছর না আসলেই যখন আসিস তখন তো ড্রাবল ট্রিপল আদর পাস । ” বিলকিস ও সুর মেলায় ।
রানি চোখ বড় বড় করে তাকায় । বলে,
-“আরে আরে , তোরা তো দেখি জোট বেধে ঝগড়া করতে আসছিস । তোদের দুজনের সাথে আমি পারব কি করে ? “তারপর জাহানারার দিকে ফিরে বলে ,
-“শোন আম্মু , তুমি কিন্তু সবসময় আমার দলে থাকবে বুঝছো । ”
জাহানারা হাসি মুখে মাথা নাড়ায় । বাণী, বিলকিস অবাক হয়ে দেখে । সম্রাট এতক্ষণ কৌতুক চোখে দেখছে সব । জাহানারাকে বলল,
-“কেমন আছেন খালামনি?”
-” ভালো আছি বাবা । তুই কেমন আছিস ? তোর মা কেমন আছে ? ”
-” আমিও ভালো আছি । তবে আম্মুর শরীর টা একটু খারাপ । বাতের ব্যাথার জন্য বেশি চলাফেরা করতে পারছে না । ”
-” ওহ । এই বয়েসেই বাতের ব্যাথা ধরে গেল !” আফসোস করে বলল জাহানারা । তারপর বলল,
-“আচ্ছা ,চলো সবাই…. ভিতরে চলো । ”
মাগরিবের আজান দিয়েছে অনেকক্ষণ হল । মোশারফ সাহেব এসেছেন একটু আগে । হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে দেয়ে রানির সাথে বসে গল্প করছেন । দুজনেই খোশমেজাজে গল্প করছে , পড়াশোনার খবর , স্বাস্থ্যের খবর আরো কত কি ? এক সময় তিনি উঠে চলে গেলেন ঘরে খাবার পরে তাকে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় ।
-“ভাইয়া আর একটু মাংস দেই । ”
-” হুম ,দে । ”
বিলকিস মাংসের বাটি থেকে কয়েক পিস তুলে দেয় সম্রাটের বাটিতে । খেতে খেতেই সম্রাট বলল,
-” তা বিউটি কুইন , শুধু কি বাড়িতেই এমন টিপটপ হয়ে থাকিস নাকি মিস ইন্ডিয়া কন্টেস্টে নাম দিয়েছিস ? ”
সম্রাটের কথায় বিলকিস একটু সংকুচিত হয়ে যায় । লাজুক হেসে বলে,
-” ধুর । কি যে বলো না ভাইয়া ? মিস ইন্ডিয়া আর আমি? না না । আমি এতটাও সুন্দর নই যে মিস ইন্ডিয়া কন্টেস্টে নাম দেব …..”
-” হুম । দেওয়ারও দরকার নেই । তার থেকে বরং পড়াশোনা কর মন দিয়ে । তোদের তো মনে হয় পরীক্ষা সামনে । ”
-” হুম ”
-“জানো তো খালামনি ,তোমার হাতের রান্না জাস্ট ফাটাফাটি হয়েছে বুঝলে । তুমি তোমার মেয়ে গুলোকেও তো শেখাতে পারতে । ”
বাড়ির ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে রানি আর বাণী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে তাদের আম্মু আর বোনকে । আম্মুর টা না হয় ঠিক আছে । বান্ধবীর ছেলে এসেছে উপরন্তু ভাতিজা হয় একটু বেশি আদর যত্ন করবে । এটা স্বাভাবিক । কিন্তু বিলকিস কি জন্য এত আদিক্ষ্যেতা দেখায় এই ছেলেকে রানি বুঝতে পারছে না । হয়তো কিশোরী বয়েসের ভালোলাগা হবে । কিন্তু এই ছেলে যা বদমাইশ । এর থেকে দুরে রাখতে হবে বিলকিসকে । নাহলে নিশ্চয়ই কোনো অঘটন ঘটিয়ে ছাড়বে । ”
-” আপু , বিলকিস আপু এমন ছ্যাচরামি করছে কেন বলত ?…… । ”
রানী যেন চমকে গেল কথাটা শুনে । আশ্চর্য , এইটুকু মেয়েও কিনা বিষয়টা লক্ষ্য করেছে। অবশ্য বাণী বরাবরই শান্ত অথচ বুদ্ধিমতী মেয়ে । সব বিষয়ে তার সর্বদা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকে । সেই তুলনায় বিলকিস একটু ছটপটে । সাজগোজ ছাড়া বাকি দুনিয়ার প্রতি ওর কোন বিশেষ কোনো আগ্ৰহ নেই । রাণীর হরিনের মতো টানা চোখ দুটি বিস্ময়ে যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে । বাণীর দিয়ে তাকিয়ে রাণি গভীর ভাবনায় পড়ে যায় । একজন ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া ছাত্রী কিভাবে এসব চিন্তা ভাবনা করতে পারে ? অবশ্য হতেই পারে । আজকাল অনেক কিছুই হচ্ছে ।
সম্রাটরা যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত প্রায় নটা বাজে । বাণী আর বিলকিস কে আনতে গেলেও শেষমেশ জাহানারাও এসেছেন সাথে । মোশারফ সাহেব নিজে স্ত্রীকে যেতে বললে জাহানারা কিছুক্ষণ গাইগুই করছিল । তবে বাপের বাড়ি যাওয়ার আনন্দে সেই গাইগুই কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাটা পড়ল । সবকিছু গোছগাছ করে রাণিদের সাথে বেরিয়ে পড়লেন তিনিও ।
To be continue..