#গজপ্রিয়া ~2
#Chhamina Begam
রানি যখন গোসল করে বেরুলো তখনও সম্রাট গল্প করছে মোস্তাফিনার সাথে । সারা দিনের জার্ণি তে শরীর বেশ কাহিল হয়ে গিয়েছিল রানির। শরীরটা একটু ম্যাচম্যাচ করছিল । সাথে রাস্তার ধুলোবালি আর যানবাহনের ধোয়া তো আছেই । তাই চুল ভিজিয়ে গোসল করায় এখন অনেকটা ঝরঝরে লাগছে । অফ হোয়াইট কালারের কুর্তি আর কালো পাজামা পড়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রানি একবার সম্রাটদের দিকে তাকিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ায়। মোস্তাফিনার সাথে গল্প করতে করতে সম্রাট আড়চোখে তাকিয়ে দেখে রানীকে । মোস্তাফিনার কথার জবাব দিলেও ওর সম্পূর্ণ ধ্যান রানীর ওপরই নিবন্ধ । ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে রানি মুখে মইশরাইজার লাগিয়ে ভেজা চুলে চিরুনী করছিল । ওকে এখন খুব স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে । হঠাৎ করেই ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট সম্রাটের মনে হয় কোন মেয়েরই কখনো এভাবে ভেজা চুলে কোন ছেলের সামনে যাওয়া উচিত নয় । কারণ এই সময়টায় তাদের অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশি স্নিগ্ধ আর মোহময়ী দেখায় । এতদিন ভেতরে ভেতরে রানীর প্রতি একটা তীব্র অধিকার বোধ কাজ করত ওর । আজ সেখানে মুগ্ধতা এসে জড়ো হয়েছে । দৃষ্টি বার বার রানির ওপর আটকে থাকতে চাইছে । কিন্তু সম্রাট নিজের মনের এই নাজায়েজ ইচ্ছেকে প্রাধান্য না দিয়ে মোস্তাফিনার সাথে কথা চালিয়ে যায়।
সম্রাটকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রানী মোস্তাফিনার দিকে তাকিয়ে বলে ,
-” আপু, নানু কি ঘুমিয়ে পড়েছে ?”
-“না মনে হয় ”
-“তাহলে আমি আগে নানুর সাথে দেখা করে আসি । তারপর নাহয় খেতে যাব ”
-“আচ্ছা যা ”
রানি চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়ালেই সম্রাটের চোখ পড়ে রানির পিঠে । চুলের অবশিষ্ট জল দিয়ে পিঠ ভিজে গিয়ে সাদা কুর্তিটা পিঠের সাথে লেপটে আছে । রানি কি এভাবেই বাইরে যাবে নাকি ? পুরো বাড়ি লোক দিয়ে গিজ গিজ করছে। মুহূর্তেই মস্তিষ্ক মুগ্ধতার রেশ কাটিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে সম্রাটের । রানিকে আটকাতে হবে ভেবেই কিছু বলার জন্য মুখ খোলে । কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে রানিকে থমকে দাড়াতে দেখে কিছু না বলে অনুসন্ধিৎসু হয়ে তাকায় । রানি আলনার কাছে ফিরে এসে একটা ওড়না বের করে গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । সম্রাট স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে ।
রানির সাথে সাথে মোস্তাফিনাও খেতে বসেছে। মনিরা বাচ্চাদের ও বসে যেতে বলেন । এমনিতেও সাড়ে আটটা বেজে গেছে । বাচ্চারা অনেকেই ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে । সম্রাটের সিগারেটের নেশায় পেয়েছে । তাই ও বাইরে যাচ্ছিল । মনিরা ওকেও বসতে বলল সবার সাথে । সম্রাট বলল ও এক্ষুনি আসছে ।
রানির পাশে সম্রাটের ছোট ভাই ওয়াহিদ বসেছে। ওয়াহিদ খুব শান্ত ছেলে , কথা কম বলে । এবার মাধ্যমিক দিয়েছে । রানির সাথে ওর খুব ভাব। নিজের বড় বোনকেও হয়তো এতটা পছন্দ করে না যতটা রানিকে পছন্দ করে । রানি আপু মানেই ওর একটা আবদারের জায়গা।
উলটো দিকের চেয়ারে বসে মৌসুমী তান্নুকে খাইয়ে দিচ্ছে । পাশে মোস্তাফিনা খেতে খেতে মোবাইল ঘাটছে । রানি বলল,
-“আপু , তামিম ভাইয়া কোথায় ? এসে থেকে দেখছি না ওকে !”
কোনো সাড়া না পেয়ে মৌসুমী হাতের কুনুই দিয়ে মোস্তাফিনাকে একটা গুতো দিয়ে বলল,
-” মুসু , এখন একটু ফোনটা রাখ। বরটা তোমার পালিয়ে যাচ্ছে না । কথা বলার জন্য তো সারারাত পড়ে আছে । এখন দয়া করে আমাদের দিকেও একটু কৃপাদৃষ্টি দিলে ধন্য হব গো ”
মৌসুমীর কথায় রানি, ওয়াহিদ হেসে ওঠে । মোস্তাফিনা লজ্জা পেয়ে ফোনটা অফ করে পাশে রেখে দেয় ।
-“কি বললি রানি তুই ?”
-“বলছি তামিম ভাইয়া কোথায় ? আসার পর থেকে দেখলাম না ওকে । ”
-” ওহ ,মেজভাইয়া । ও তো শহরে গেছে । আজ ওর একটা ইন্টারভিউ ছিল । আসছে মনে হয় ”
-“ওহ , কয়েকদিন আগে যে শুনলাম কি পরীক্ষায় যেন পাশ করেছিল । ওটার নাকি? ”
-” হ্যাঁ , ”
মনিরা মাংসের বাটি হাতে রান্নাঘর বেরিয়ে আসেন। টেবিলে সম্রাটকে না দেখে প্রশ্ন করেন,
-” সম্রাট আসেনি এখনো ? ওয়াহিদ, যা তো বাবা ডেকে আন ওকে । দুপুরেও ঠিক মতো খায়নি ও ”
বড়মার কথা শুনে ওয়াহিদ সম্রাটকে ডাকতে যায় । একটু পরেই সম্রাটকে সাথে নিয়ে আসে । সম্রাট এসেই রানির পাশের চেয়ারটা দখল করে বসে পড়ে ।
-“ভাইয়া ওটা আমার জায়গা। তুই অন্য কোথাও গিয়ে বস । ”
-” কেন রে ? জায়গায় কি নাম লিখে রেখেছিস ? আর সারাক্ষণ এই পেতনির পাশেই বসতে হবে এমন কোথাও লেখা আছে নাকি ? যা ওই পাশে বস গিয়ে ”
ওয়াহিদ মুখ ভার করে মোস্তাফিনার পাশে গিয়ে বসে । ছোটবেলায় শত কান্নাকাটি করেও কখনো সম্রাটের থেকে কিছু আদায় করতে পারত না ওয়াহিদ । তাই এখন আর ওর সাথে কিছু নিয়ে ঝগড়া করে না । রানি চোয়াল শক্ত করে সম্রাটের কথা গুলো হজম করে । এমনিতেও সম্রাটের কথা বলার সময় সিগারেটের গন্ধ পেয়েছে । নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ওর । তার ওপর ওয়াহিদকে মন খারাপ করতে দেখে রাগটা বেড়ে যায় । কিন্তু রাগের প্রকাশ না ঘটিয়ে ঠান্ডা সুরে বলে ,
-“সম্রাট , এতই যদি প্রবলেম তোর আমাকে নিয়ে তাহলে তুই কেন বসেছিস এখানে ? অনেক জায়গা তো খালি আছে । ওদিকে গিয়ে বস না । ”
-” সেটা আমার ইচ্ছে । আমি কোথায় বসব নাকি বসব না তা তোকে বলে দিতে হবে না । এখন বেশি কথা না বলে চুপচাপ খা । বড়মা, এই পেতনি টাকে বেশি করে খাওয়াও তো । খেয়ে দেয়ে আরো মোটা হোক । ”
-” সম্রাট , কেন লাগছিস বলতো ওর সাথে ? এখনো বড়ো হলি না তোরা ! আগের মতোই রয়ে গেছিস দুজনে । ….আগে খেয়ে নে । তারপর যত ইচ্ছে ঝগড়া করিস ।”
-” আমি ঝগড়া কোথায় করছি বড়মা ? পেতনি কে পেতনি না বলে কি পরী বলব বলো ? এটা তো পরী জাতির প্রতি অন্যায় করা হবে । ”
অপমানে রানির মুখটা থম থমে হয়ে যায় । পামশু পড়েছিল ও । গোড়ালি দিয়ে সম্রাটের পা পিসে দেয় । ব্যাথায় মুখ কুচকে যায় সম্রাটের । ওর চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে রানির মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি ফুটে ওঠে ।
রানি মুরগির কলিজা পছন্দ করে । তাই দুপুরে মনিরা ওর জন্য একটু বেশি করে তুলে রেখেছিল । সবার পাতে অল্প অল্প করে তুলে দিয়ে রানিকে বাটিটা দেয় । ওয়াহিদ কে জিজ্ঞেস করে ,
-” রুমা যে কেন এল না ? ওয়াহিদ , তোর আম্মু কি করছে বাড়িতে ?”
-” বড়মা ,আম্মুর বাতের ব্যাথাটা বেড়েছে অনেক । বেশি হাটতে পারছে না ” খেতে খেতে জবাব দেয় ওয়াহিদ ।
-“ওহ । শোন , খাওয়া হয়ে গেলে আমার কাছে আসিস ।রুমার জন্য খাবার দিয়ে দেব । ও তো রান্নাও করেনি মনে হয় । ”
খাওয়া দাওয়ার পর মোস্তাফিনা সহ সবাই উঠোনে চেয়ার পেতে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে । রানির ফোন আসায় একপাশে সরে আসে। সম্রাট আড়চোখে তাকিয়ে দেখে ।
-” আপু তুই কি রে ? সেই কখন আসছিস আর একটা ফোন ও করলি না । আম্মু-আব্বু চিন্তা করছিল তোর জন্য । আর তুই নাকে তেল দিয়ে আছিস । লাবিব ভাইয়াকে ফোন না করলে তো জানতেই পারতাম না তুই নানুবাড়ি চলে এসেছিস । .. ”
ফোন কানে ধরতেই বিলকিসের একঝাঁক অভিযোগ শুনে মুচকি হাসে রানি । বলে,
-“এসে থেকেই এত ব্যস্ত ছিলাম । বেমালুম ভুলে গেছি । তার জন্য অনেএএক গুলো সরিইইই । আচ্ছা বল, কেমন আছিস তোরা ? আব্বু আম্মু কেমন আছে ? ”
-“আমরা সবাই ভালো আছি । আপু , এই নে বাণীর সাথে কথা বল । ও কিছু বলতে চায় তোকে ..”
-“হুম দে .”
-“আপুউউউ কেমন আছিস ?”
-“খুব ভালো আছি । তুই কেমন আছিস ?”
-“ভালো না । আপু , আম্মু না আমাদের কাল যেতে দিচ্ছে না । বলছে পরশু একেবারে বিয়ের দিন যেতে । তুই একটু বল না আম্মুকে যেন কাল আমাদের যেতে দেয় । ”
-“ওক্কে , পুচকি । আমি বলে দেব । তুই মনখারাপ করিস না । ”
-“ওকে আপু , আমি যাই । বারবি শুরু হয়ে গেছে । তুই সেজ আপুর সাথে কথা বল “..
বানী খুশিতে ঝুমঝুম করে ওঠে । ওর উচ্ছ্বাস দেখে রানিও হাসে ।
ফোন রাখার আগে আম্মুর সাথে কথা বলে বিলকিস আর বানীকে কালকে আসতে দেওয়ার অনুমতি আদায় করল রানী । তবে জাহানারা একা আসতে দিতে রাজি নন । তিনি নিজেও আসতে পারবেন না কারণ রানির বাবা মোশারফ হোসেন ছুটি পাননি । জাহানারা কাউকে পাঠাতে বলল বানী বিলকিসকে নিতে । রানির বড় বোন মহাশেনা শুশুর বাড়ি থেকেই আসবে । রানি বলল সে কাউকে পাঠিয়ে দেবে ওদের আনতে ।
রানী কল কেটে ঘুরে দাড়াতেই দেখে ওয়াহিদ টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে যাচ্ছে ।
-“ওয়াহিদ দাড়া । আমিও যাব খালামনিকে দেখতে । একটু অপেক্ষা কর । আমি এক্ষুনি আসছি । ”
-“ঠিক আছে , আপু ”
রানি মনিরাকে বলে আসতে গেলে মোস্তাফিনাও ওর সাথে আসতে চায় । মনিরা মানা করে দেয় । বলে বিয়ের কনের রাতে ঘোরাঘুরি করা ঠিক নয় । উপরি হাওয়া লাগতে পারে । যদিও একটা ক্ষেত পার হয়েই সম্রাটদের বাড়ি । তবুও তিনি অনুমতি দেন না ।তখনি মোস্তাফিনার হবু বর জাহিদ ফোন করায় মোস্তাফিনা লজ্জা পেয়ে মায়ের সামনে থেকে সরে যায় । মনিরা রানিকেও মানা করে যেতে । কাল নাহয় দিনের বেলা দেখা করে আসবে । কিন্তু রানি জেদ ধরে । আল্লাদি সুরে বলে,
-“মামানি, যাই না প্লিজ । পাশেই তো । একটু পরেই চলে আসব । আর ওয়াহিদ তো আছেই সাথে ”
-“রাত ক’টা বাজে দেখেছিস । নয় ‘টা বেজে গেছে হয় তো । আর ওয়াহিদ বাচ্চা মানুষ । ওর ভরসায় তোকে আমি ছাড়তে পারব না । কাল সকালে গিয়ে দেখে আসিস তবুও এত রাতে যেতে হবে না । ”
রানি মন খারাপ করে । সম্রাট এতক্ষণ আড্ডার মাঝে বসে থাকলেও আড়চোখে রানিকে লক্ষ্য করছিল । রানির মুখ ভার দেখে এগিয়ে আসে । মনিরাকে আস্বস্ত করে বলে সে বাড়ি যাচ্ছে । রানি যেতে চাইলে একটু পরে না হয় দিয়ে যাবে । সম্রাটের কথায় মনিরা ভরসা পায় । রানিকে যেতে বলে ওর সাথে ।
রুমা বিছানায় শুয়ে আছে । রানি পাশে বসে । রুমা চোখ মেলে রানিকে দেখে খুশি হয়ে যায় । বলে,
-“রানি তুই ! কখন এসেছিস ?”
-“এই তো সন্ধ্যায় । তোমার বাতের ব্যাথাটা নাকি আবার বেড়েছে ? ওয়াহিদ বলল। তাই তোমার খবর নিতে চলে আসলাম । ”
-” হ্যাঁ , ঐ কাল থেকে একটু একটু ব্যাথা করছে । ”
-” তেল মালিস করেছ খালামনি । না করলে আমাকে দাও আমি করে দিচ্ছি ।
-” না থাক । তোকে ব্যস্ত হতে হবে না । আমি লাগিয়েছি ”
-“আচ্ছা আম্মু, আব্বু কোথায় ?
সম্রাটের প্রশ্ন শুনে রুমা ছেলের দিকে ফিরে বলেন ,
-“তোর আব্বু ওই ঘরে নামাজ পড়ছে । কেন ?”
-“এমনি ।
আরো কিছুক্ষণ ওখানে থেকে রানি সম্রাট বেরিয়ে আসে । দুজনের মাঝে এক আকাশ নিরবতা । চলতে চলতে নিস্তব্ধতা ভেঙে সম্রাট বলে,
-“রানি দাড়া । একটা সত্যি কথা বলতো , তুই আমাকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে রেখেছিস কেন ? আমি কল করলে তুলিস না , ফেসবুকে এখনো আমার রিকোয়েস্ট টা ঝুলিয়ে রেখেছিস ! ব্যাপারটা কি বল ?” ”
রানি থমকে ফিরে তাকায় । আকাশে পূর্ণ চাদঁ উঠেছে । চারিদিকে জোস্নায় ভরে গেছে। চাদের ওই স্নিগ্ধ আলোতেই সম্রাট তাকিয়ে দেখে রানিকে । এক অন্য রকম সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে । যদিও মুখটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে না । সম্রাট এক পলকের জন্য থমকে যায় । নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-”
To be continue….