#গজপ্রিয়া~17
#Chhamina_Begam
-” একসপ্তাহের মধ্যে দু-দুটো বিয়ে ! ভাইয়া , রানি আপুর বিয়েতে তোমার ক্যামেরাটা আমাকে দিও তো । আমি আপুর ছবি তুলব অনেকগুলো ।…. খুব মজা হবে তাই না ভাইয়া । ”
ওয়াহিদের উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বিষম খেল সম্রাট । সদ্য বোতল থেকে জল মুখে দিয়েছিল, বিয়ের কথা শুনে নাকে মুখে জল উঠে এল । কাশতে কাশতে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে একবার ওয়াহিদের দিকে আর একবার বাবার দিকে তাকাল । দুজনেই চিন্তিত হয়ে তাকিয়ে আছে । রুমা রান্নাঘর থেকেই চেচিয়ে বলল,
-” সম্রাট , কতবার বলেছি তোকে খাওয়ার সময় তাড়াহুড়ো করবি না । আমার কথা কেন শুনিস না তুই ? ”
-” আমি ঠিক আছি ..” বলল সম্রাট । তারপর ওয়াহিদ কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” বিয়ের কথা কি বললি এখনি ? কার বিয়ে ? ”
-” কার আবার ? রানি আপুর ।… একি, তুমি জানো না !একটু আগেই তো আব্বু , বড়আব্বুরা সবাই মিলে ঠিক করে এল । লাবিব ভাইয়ার যে বন্ধুটা এসেছিল না বিয়েতে , ওনার সঙ্গে । কাল বাদে পরশু আকদ হবে । তারপর আপুর মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে গেলে বড়ো করে বিয়ের অনুষ্ঠান করবে । ”
ওয়াহিদের কথা শুনতে শুনতে সম্রাটের চোখ দুটো জ্বলতে লাগল । রাগে কপালের শিরা দপদপ করতে লাগল । মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করল । হাতে ধরা জলের বোতলটায় চাপ পরে মরমর শব্দ হলে ওর আব্বু বলল,
-” কি হল সম্রাট ? কোনো সমস্যা ? শরীর ঠিক আছে তোর ? ”
-” আব্বু আজ আমি একটা অনুমতি চাইব । দেবে ? ”
সম্রাটের বাবা ফরিদ সাহেব ছেলের লাল হয়ে যাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন । জিজ্ঞেস করলেন ,
-” কি হয়েছে সম্রাট ? শরীর খারাপ লাগছে নাকি ?”
স্বামীর কথা শুনে রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন রুমা । বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল রুমা,
-” সম্রাট … কি হয়েছে বাবা ? তোর চোখ মুখ এমন লাগছে কেন ? ” ।
সম্রাট বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আমি বিয়ে করতে চাই আব্বু …”
ঘরের মাঝে পিন পতন নিরবতা । সম্রাটের কথায় হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ঘরে উপস্থিত তিনজনেই । তারপর উচ্চ স্বরে হেসে উঠল । ওর বাবা বলল,
-” আমার অনুমতি তো আছেই । আমরাও তো চাই, আমাদের ঘরে একটা ফুটফুটে বৌ আসুক । তা আগে পড়াশোনা শেষ করো , চাকরি বাকরি করো । তখন আমার সবাই মিলে দেখেশুনে না হয় তোমার জন্য একটা পুতুলের মতো বৌ মা খুঁজে আনব । কি বলো রুমা ?”
-” একদম “..
স্বামীর কথায় সায় দিল রুমা ।সম্রাট বাবা মায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
-” আমি রানিকে বিয়ে করতে চাই আব্বু ”
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল ।হতভম্ব, বাকহীন হয়ে চেয়ে রইল সবাই । সম্রাট বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করল ।
এবার আর বিষয়টাকে সহজ ভাবে নিলেন না ফরিদ সাহেব । চেহারায় গাম্ভীর্য এনে গমগমে স্বরে বললেন ,
-” এসব কি ফাজলামি হচ্ছে সম্রাট ?”
-” আমি সত্যি বলছি আব্বু । আমি রানিকে বিয়ে করতে চাই । ” চোখ নামিয়ে বলল সম্রাট ।
ফরিদ সাহেব হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন ,
-” ফাজলামি হচ্ছে আমার সাথে । সারাক্ষণ মেয়েটার পেছনে লেগে থাক । তোমার জন্য কোথাও শান্তিতে দু-দন্ড বসতে পারে না মেয়েটা । সারাক্ষন দুজনে ঝগড়া করতে থাক । কতবার স্কুল থেকে তোমাদের নামে কমপ্লেইন এসেছে । এবার তুমি মেয়েটার বিয়ে ভাঙতে চাইছ ? ”
-” আমি সত্যিই ওকে বিয়ে করতে চাই আব্বু । আমি ওকে পছন্দ করি । ”
-” চুপ । একদম চুপ । আর একটা কথাও বলবে না তুমি । দিনদিন চরম বেয়াদব হচ্ছ । এত ভাল ঘর থেকে সমন্ধ এসেছে মেয়েটার । কত্তো ভালো ছেলে আশিক । খবরদার বলছি , এবার কোনো রকম দুষ্টুমি করবে না । না হলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না । মনে রেখ কথাটা ”
কয়েক মুহূর্ত শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সম্রাট বাবার দিকে । তারপর তেমনি শীতল কন্ঠে বলল,
-” আমাকে কি তোমার ভালো মনে হয় না আব্বু ? আমি কি এতটাই খারাপ , অযোগ্য । যে তোমার আমাকে রানির যোগ্য বলে মনে হয় না । আর কোথায় লেখা আছে যে যাকে পছন্দ করি , ভালোবাসি তার সাথে দুষ্টুমি করা যাবে না । ”
বলেই উঠে চলে গেল সম্রাট । ফরিদ সাহেব , রুমা অবাক হয়ে চেয়ে রইল তাদের জেদি , বেপরোয়া ছেলেটার দিকে । আজ এই প্রথম সে কোনো কিছু চাইল অথচ জেদ করল না । এবং আজই প্রথম সম্রাট তাদের কিছু চেয়েছে যা তারা দিতে অপারগ । ওরা দুজনেই বুঝল নিজের চাওয়ার থেকে বাবামায়ের অবিশ্বাস সম্রাটকে বেশি আঘাত করেছে । দুজনেই অসহায় দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকাল ।
ঘরে এসে সজোরে দরজা বন্ধ করল সম্রাট । রাগে-দুঃখে পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে । সবচেয়ে বেশি অবাক লাগছে আব্বুর বলা কথা গুলো ভেবে । নিজের ছেলেকে তিনি বিশ্বাস করেন না । নিজের ছেলের ইচ্ছে, অনুভূতির কোনো মূল্য নেই তার কাছে । সম্রাটের থেকেও পাড়ার ছেলেটা বড়ো হয়ে গেল । বাহ আব্বু ….. স্বগোতক্তি করল সম্রাট । চোখের কোণে জমে থাকা জলকণা নিজের সীমানা পেরিয়ে গড়িয়ে পড়ল নিচে । সম্রাট চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায় । প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে গ্যালারি থেকে মুসুর বিয়েতে তোলা রানি আর ওর কাপল ছবি গুলো দেখতে লাগল এক এক করে । এগুলো ফাহিম ভাইয়া তুলে দিয়েছিল । যে কিনা আলোআধারিতে দাড়িয়ে দুর থেকে দেখেই বুঝে গিয়েছিল সম্রাটের মনের কথা । আর রানি , যে এত কাছে থেকেও এখনো ধরতে পারল না কোনটা দুষ্টুমি আর কোনটা ভালোবাসা । অভিমানে চোখ ছাপিয়ে জল এল সম্রাটের । কিছুক্ষণ ওভাবেই পড়ে রইল বিছানায় । রাত কটা বাজে কে জানে ? ইতিমধ্যে আম্মু দুবার এসে ডেকে গেছে সম্রাটকে । কিন্তু সম্রাট দরজা খোলেনি । সবার প্রতি এক সাগর অভিমানে ডুব দিয়ে পরে ছিল বিছানায় । চোখের জল শুকিয়ে মুখের চামড়ায় টান পড়েছে ততক্ষণে । সম্রাট ধীরে ধীরে উঠে বসল । দেয়ালে টাঙানো নিজের প্রিয় গিটারটা পেরে টুংটাং করল কিছুক্ষণ । কিন্তু কোনো সুরই তুলতে পারল না । ওর মনে হতে লাগল গিটারের সাথে সাথে মনের সুর গুলোও যেন ফিকে হতে হতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে । গিটার রেখে জানালার পাশে এসে দাড়াল সম্রাট । দেয়ালে হেলান দিয়ে তাকিয়ে রইল উত্তর-পশ্চিম কোণায় রানির ঘরের জানালায় । আজ আকাশে মেঘ জমে চাঁদকে ঢেকে দিয়েছে । ধরনী তাই ডুবে আছে নিকষ কালো অন্ধকার চাদরে । তবুও সম্রাট নির্মিশেষে চেয়ে রইল ।
অদ্ভুত এক নিঃসঙ্গতা চেপে বসেছে রানির ওপর । কি কারণে মন এত খারাপ বুঝতে পারছে না সে । নিজেকে বারবার প্রবোধ দিচ্ছে যাকে সে ছোটবেলা থেকে পছন্দ করত সেই মানুষটাকে নিজের করে পেতে চলেছে ।ওর এতে খুশি হওয়া উচিত । কিন্তু তবুও মনখারাপিয়া প্রহর কাটতে চাইছে না । এদিকে বাণি গায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে ঘুমুচ্ছে । রানি নড়াচড়া করতে পারছে না । ঘাড় ঘুরিয়ে একবার বানিকে দেখে খুব সন্তপর্ণে গায়ের ওপর থেকে হাত পা সরিয়ে দিয়ে নেমে এল রানি । জানালার পাল্লা খুলে দিতেই চোখ চলে গেল চার কোণা এক ফালি আলোয় দিশা অনুসরণ করে। সম্রাটের রুমেও লাইট এখনো জ্বলছে ! তার মানে সম্রাট এত রাতেও জেগে আছে ?অসঙ্গত ভাবে টুংটাং সুর ভেসে আসছে । কিছুক্ষণ পর আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল । তার পর একটা ছায়ামূর্তি হেটে এল জানালার পাশে । রানি অন্ধকারে দাড়িয়ে চেয়ে রইল ছায়ামূর্তির দিকে । সম্রাট বুঝতেও পারল না মাঝরাত্রিরে নিশাচরদের ন্যায় তারই মতো আরও একজন ওর দিকে তাকিয়ে প্রহর গুনছে ।
To be continue..
* আজ এটুকুই ,,,শুভরাত্রি