#গজপ্রিয়া~15
#Chhamina_Beagm
-” ওয়াও ভাবি , এতো আয়োজন কার জন্য ? কেউ এসেছে নাকি ? বাইরে গাড়ি দেখলাম ..”
রান্নাঘরের সিঙ্কের ওপর বসতে বসতে মৌসুমীকে উদ্দেশ্য করে বলল সম্রাট । সিঙ্গের একপাশে রাখা ফলের ঝুরি থেকে একটা আপেল তুলে কামড় বসিয়ে আড়চোখে দেখল রানিকে । রানি তখন মেসিনে কমলার জুস তৈরি করছিল । একবার চোখ গরম করে সম্রাটকে দেখে আবার মুখ ফিরিয়ে নিল ।
সম্রাটের প্রশ্নে হাসল মৌসুমী । বলল,
-“হুম, খুব ইম্পরট্যান্ট গেস্ট ”
-” আচ্ছা ? আর সেই ইম্পরট্যান্ট ব্যক্তিটি কে জানতে পারি কি ?”
-“অবশ্যই জানতে পারো ।… আশিক ভাইয়া এসেছে ওনার মাকে নিয়ে । অনেক দিন পর নাকি উনি গ্ৰামে এসেছেন । তাই পরিচিত সবার বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছেন । ”
প্লেটে স্ন্যাক্স সাজাতে সাজাতে মৌসুমী একবার আড়চোখে রানিকে দেখে বলল,
-“রানি , একটু দেখ না তান্নু কি করছে ? একা একা বাইরে ঘুরছে না তো আবার ”
-“হুম ,যাচ্ছি ” বলে রানি বেরিয়ে যেতেই মৌসুমী একবার দরজার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল সম্রাটকে ,
-” আমি মিথ্যে বলেছি তোমাকে । আসলে ওরা রানিকে দেখতে এসেছে । আম্মা বারণ করেছে রানিকে জানাতে । তাই ওর সামনে বললাম না । ওরা চলে গেলে ধীরে সুস্থে বলবে বাবা । তুমি আবার ওকে বলো না যেন। ”
মৌসুমির কথায় বিষম খেল সম্রাট । মুখের চিবোনো আপেলের টুকরো তালুতে লেগে জোরে কাশি উঠে গেল। মুহূর্তেই চোখ লাল হয়ে গেল ওর । হাতের অর্ধেক খাওয়া আপেলটা শক্ত করে ধরল মুঠোর ভেতর । মৌসুমী সম্রাটের অবস্থা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি এক গ্লাস জল এসে সম্রাটের মুখের সামনে ধরল,
-” ধীরে ধীরে খাবে তো !এতো তাড়া কিসের তোমার ? নাও , ধরো । জল খাও একটু … ”
সম্রাট মাথা নাড়িয়ে লাগবে না জানাল । মৌসুমী অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিল । বলল,
-” সম্রাট , এই স্ন্যাক্স গুলো রানি বানিয়েছে । খেয়ে দেখতো কেমন হয়েছে ? ”
স্ন্যাক্স গুলোর দিকে তাকাল সম্রাট । বুকে অদ্ভুত এক চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করল সে । তখনি রানি প্রবেশ করল রান্নাঘরে । বলল,
-” ভাবি , তান্নু মামানির কোলে বসে আছে ..”
-“ওহ …”
সম্রাট রানির দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্লেট থেকে একটা স্ন্যাক্স তুলে মুখে দিল । মৌসুমী আবার বলল,
-“বললে না তো কেমন হয়েছে ? ওদের দেওয়ার আগে তুমি একবার রাধুনীকে তোমার রিভিউ জানাও তো ”
সম্রাট দেখল রানি উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে । বলল,
-“ভালো..”
-” শুধু ভালো ? “বলল মৌসুমি ।
-” একটু ঝাল বেশি হয়েছে “..আবার স্ন্যাক্সে কামড় দিয়ে বলল সম্রাট । ওর লাল হয়ে যাওয়া চোখ দুটি দেখে রানি একটু যেন মিইয়ে গেল । মৌসুমী আবার জিজ্ঞেস করল ,
-” ঝালটা খুব বেশি হয়েছে কি ? ”
-“না চলবে …”সংক্ষেপে বলল সম্রাট ।
-“তাহলে ঠিক আছে । আ-রানি আমি এগুলো নিয়ে যাচ্ছি । তুমি জুসের গ্লাস গুলো নিয়ে আসো ।
-“হুম , ঠিক আছে । ”
মৌসুমী বেরিয়ে যেতেই রানি হাত ধুয়ে জুসের ট্রে টা হাতে নিতে উদ্যত হতেই বাঁ হাতে হ্যাচকা টান অনুভব করে । কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনুভব করল এক জোড়া রুক্ষ্ম ঠোঁট ওর ঠোঁটের ওপর চেপে বসেছে । বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যায় রানি । মুখের ওপর তপ্ত বাতাসের ঝাপটা পড়তেই জমে স্থির হয়ে যায় । ততক্ষণে সম্রাট ছেড়ে দিয়েছে ওকে । তখনি বিমূঢ় রানি শুনতে পেল সম্রাট বলছে ,
-” উফফ, ঝালটা বেশি হয়ে গেছে । বিয়ের পর যদি তরকারিতে ঝাল বেশি দিয়েছিস তবে মনে রাখিস এই শাস্তি কিন্তু ফিক্সড রইল । আর এটা পিঠে লাগিয়ে নিস, দাগ মুছে যাবে ” বলেই প্যান্টের পকেট থেকে একটা ওনিয়নমেন্ট বের করে সিঙ্কের ওপর রেখে জুতোয় শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল গটগট করে ।
সম্রাট বেরিয়ে যেতেই দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বাণী । দেখল ঠোঁটে হাত চেপে ওর মেজ আপু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে । তার চোখে মুখে হতভম্ব ভাব । বাণী একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল মেইন গেটের দিকে চলে যাওয়া সম্রাটকে । সে মামানির কথায় রানিকে ডাকতে এসেছিল । এসে দুজনকে ওরকম ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখে যারপরনাই বিস্মিত । যে আপু কিনা সম্রাটকে দু চোখে সহ্য করতে পারে না তাকেই কিনা ….। ওর কিশোরী মন এর সঠিক কোনো উত্তর খুঁজে পেল না । শুধু গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে রানির হাত ঝাকিয়ে বলল,
-“আপু , এই আপু । মামানি তাড়াতাড়ি যেতে বলল তোকে । ”
হাইস্কুলের সামনে বড়ো বট গাছটার পাশে বাইক রেখে বেদীতে বসল সম্রাট । স্কুলের সামনের মাঠে তখন ফুটবল খেলেছে পাড়ার ছেলেরা । সম্রাট নির্মিশেষে তাকিয়ে রইল সেদিকে । চোখ খেলার মাঠে থাকলেও মস্তিষ্কে তখন ঘূর্ণিঝড় বইছে । ও বাড়ি থেকে আসার সময় বসার ঘরে উকি মেরে দেখে এসেছে আশিক ভাইয়া তার মা আর চাচাকে নিয়ে এসেছে । ছোটবেলা থেকেই রানির উইক পয়েন্ট ছিল আশিক । যাকে সোজা ভাষায় ক্রাশ খাওয়া বলে । এটা নিয়ে কত ক্ষেপিয়েছে ও রানিকে । কিন্তু এখন সেই বিষয়টাই যে মাথা ব্যাথার কারণ হবে তা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি সে । দুঃচিন্তায় মস্তিষ্কের শিরা গুলো হয়তো ফেটেই যাবে । অস্থির লাগছে সম্রাটের । কই সে তো কত ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে রানিকে যে সম্রাট ওকে কতটা পছন্দ করে । কিন্তু রানি কখনোই ওর অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করেনি । সব সময় ঠাট্টা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছে । তবে কি রানি এখনো পছন্দ করে আশিককে ?করলে কেমন ভাবে পছন্দ করে ?শিক্ষক হিসেবে নাকি বিশেষ একজন হিসেবে ? মাথা নিচু করে মুখ হাঁ করে নিশ্বাস নেয় সম্রাট । দুহাতে খামচে ধরে নিজের চুল । হয়তো ভাবছে এভাবে আরাম দেওয়া যাবে মস্তিষ্ককে । কিন্তু চিন্তার পোকারা ওকে ক্রমশই বিচলিত করে তোলে । চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় সম্রাট । মনে মনে সংকল্প করে ফেলে রানি শুধুই সম্রাটের । আর কারো নয় । বাবা মায়ের পর তুই আমার আমানত রানি । তোকে আমি কিছুতেই যেতে দিতে পারি না রানি । হয়তো আশিক ভাইয়া একজন বেস্ট হাসবেন্ড প্রুফ হবে । এই মুহূর্তে তার সামনে আমার যোগ্যতা শুন্যের কোঠায় । তবুও আমি প্রমিজ করে বলতে পারি আল্লাহর পরে আমার মতো ভালো তোকে আর কেউ বাসতে পারবে না । আশিক ভাইয়া বেস্ট হতে পারেন তবে আমি বেস্ট পার্টনার হব দেখিস ।
-“আশিক , তুই কি মেয়ে আর খুজে পেলি না দুনিয়ায় ? খুঁজে খুঁজে ওই কালো মেয়েটাই পছন্দ হলো তোর ?”
-” মা, কি বলছ এসব ? রানি কালো নয় । ও শ্যামলা ।”
-“ওই একি তো হলো । আমি কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখলাম তোর জন্য ! এই তো পরশু তোর চাচার সাথে এক মেয়ে দেখে এসেছি । কি সুন্দর ফর্সা সুন্দর মেয়েটা । আর তুই কি দেখে ওই মেয়ে তে মজে গেলি ? নিশ্চয়ই জাদুটোনা করেছে তোকে । না হলে কখনো এমন হয় ?” অবিশ্বাস্যের সুরে বলে উঠলেন আশিকের মা ।
-” উফফ মা । কোন যুগে থাক তুমি ? এই টুয়েন্টি ফাস্ট সেঞ্চুরিতে এসেও তুমি এমন পুরোনো ভাবধারা ধরে রাখ কি করে ? আশ্চর্য তো । আর এসব কি কালো সাদার মেলা নিয়ে বসেছ বলো তো ? আর আমাকে কোন এঙ্গেল থেকে তোমার ফর্সা মনে হয়? আমিও তো রানির মতোই কালো । ”
-” আমাকে লেকচার শুনাতে আসবি না বলে দিলাম আশিক । মনে রাখিস আমি তোর পেটে নই তুই আমার পেটে জন্মেছিস । তাই আমাকে বোঝাতে আসবি না । আর তুই যেটা বললি সেটা বলি , ছেলে মানুষ কালো হলেও সারে । তুই কত ভালো জায়গায় জব করিস । তোকে কেউ অপছন্দ করবে সেই ক্ষমতা কেউ রাখে না । কিন্তু মেয়েদের বেলায় তা খাটে না । মেয়েদের ফর্সা, সুন্দর হতে হয় ।না হলে আমি সমাজে মুখ দেখাব কি ভাবে ?”
-” কি অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা তোমার মা !একজন শিক্ষিকা হয়ে তুমি এই কথা কিভাবে বলতে পারছ ? তুমি তো ছোট বেলায় আমাকে শিখিয়েছ বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাড়াতে । আর আজ নিজের বেলায় তুমি সেই চিরাচরিত বর্ণবাদের দোহাই দিচ্ছ । আমি ছেলে বলে আমার কালো হওয়াটা দোষের নয় তোমার কাছে অথচ মেয়ে বলে সেই একই দোষে দোষী হয়ে গেল রানি । এটা তো আনফেয়ার মা । ”
ছেলের বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়ে ভাষা হারিয়ে ফেললেন আশিকের মা । একসময়ের নিজের বলা কথাই আজ তাকে আষ্টেপিষ্ঠে বেধে ফেলেছে । এতদিন যার হাত ধরে আঙ্গুল দিয়ে ঠিক ভুল চিনিয়ে এসেছেন আর সেই ছেলের কাছেই ঠিক ভুলের পাঠ নিতে গিয়ে মনে মনে লজ্জিত হলেন তিনি । এত বড়ো বর্ণবাদের বীজ কবে তার মনে রোপন করেছেন ভেবে পেলেন না । আজ ছেলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে হয়তো একসময় নিজের সামনে মাথা তুলে দাড়াতে পারতেন না । কিছুক্ষণ আগের নিজের বলা কথা গুলো ভেবে দ্বিতীয়বার কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না আর তিনি ।
বসার ঘরে গোল টেবিল বৈঠক বসেছে মামা, লাবিব ফাহিম , আর সম্রাটের বাবা মিলে । সন্ধ্যার পর রানির বাবাকেও ফোন করে ডেকে আনা হয়েছে । সবার মুখে খুশি খুশি ভাব । কারণ মুসুর কাছ থেকে লাবিব জেনে নিয়েছে রানি ছোট থেকেই পছন্দ করত আশিককে । তা ছাড়াও রানিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে সে পছন্দ করে কিনা আশিককে । উত্তরে রানি নীরব থেকেছে । আর হতভম্ব রানির বাক্হীনতাকে সম্মতি ভেবে সবাই ঝটপট আকদের কাজ সেড়ে ফেলতে চাইছে ।
একই গ্ৰামের ছেলে হওয়ায় ছোট থেকেই আশিককে চেনে রানির মামারা । ভালো ছাত্র হওয়ার সাথে সাথে ভীষণ শান্তশিষ্ট একটা ছেলে আশিক । পড়াশোনা শেষ করে এখন ভালো কলেজে চাকরি করছে । পাত্র হিসেবে রিজেক্ট করার মতো কোনো কারণ নেই । উপরন্তু রানির সম্মতি তাদের উৎসাহ ,উদ্দীপনা আরো বৃদ্ধি করেছে । যেহেতু আশিক মাত্র এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছে । যেখানে চারদিন ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছে তাই দু দিনের ভিতর ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের উপস্থিতিতে আকদের কাজ সেড়ে ফেলতে চান লাবিবের বাবা । সবাই তার কথায় সম্মতি জানালে রাতেই আশিকের মাকে ফোন করে ডেট ফাইনাল করে ফেললেন লাবিবের বাবা । আজ বাদে কাল আকঁদ হবে রানি এবং আশিকের ।
To be continue….