#গজপ্রিয়া_13
#Chhamina_Begam
সাধারণত বিয়ের অনুষ্ঠান গুলোকে অঘোষিত স্বয়ংম্বর সভা বলা যায় । শিশু থেকে বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণীরা সবাই আপন আপন খোলস থেকে বেরিয়ে সেজে ওঠে বসন্তের হরেক রঙি ফুলের মতো । তাদের কুন্ঠাবর্জিত অবাধ চলাফেরায় এবং রঙিন সব লাইট-ঝালরে একটা নিষ্প্রাণ বাড়িও যে নিমেষেই প্রানবন্ত হয়ে উঠবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।
একবার খাওয়া হয়ে গেলেও জাহিদের বড়ো বোন , ভাবির অনুরোধে আবার যেতে হলো মোস্তাফিনাকে । মুসু মিলি,রানিকেও টেনে নিয়ে গেল সাথে । বিলকিসের সাথে যেহেতু রিয়ানার ইতিমধ্যে বেশ ভাব জমে গেছে তাই রিয়ানার অনুরোধ আর টানাটানিতে তাকেও যেতে হলো । মোস্তাফিনা এমনিতে ভোজন রসিক হলেও আজ লজ্জায় ভালোমতো খেতেই পারল না । আলতো হাতে নাড়াচাড়া করছিল বিরিয়ানি আর রোস্ট । তখনি ভোজবাজির মতো উদয় হলো সম্রাট । হাসিমুখে জাহিদের বড়োবোনের সাথে কুশল বিনিময় করে মুসুর দিকে তাকাল । বলল,
-“আপু খাচ্ছ না কেন ? লজ্জা পাচ্ছ? …. আরে ,লজ্জা পেয়ো না , এখন থেকে এরাও তোমার আপনজন । তাই না আপু ? ” শেষের বাক্যটা জাহিদের বড়ো বোনের দিকে নির্দেশ করল । তিনি হেসে মাথা নাড়ালেন । বললেন ,
-“.হুম ..একদম । লজ্জা কিসের ? এখানে সবাই আমরা আমরাই তো । হেজিটেড করো না … সচ্ছন্দে খাও….”
সবাই মুসুকে স্বচ্ছন্দ বোধ করানোর জন্য এটা সেটা বলতে লাগল । মুসু নিজের প্লেটের রোস্টটা তুলে এগিয়ে দিল সম্রাটের দিকে ,
-“সম্রাট …”
সম্রাট হেসে দিল । বলল,
-“তুমি এখন ও ভুলোনি যে আমার লেগ পিস পছন্দ ..”
-” বকবক না করে ধর …” হাসি মুখে বলল মুসু ।
খাওয়ার ফাকে ফাকে রিয়ানা আড়চোখে লক্ষ্য করছে সম্রাটকে । আজকের সাজে ও বেশ প্রসংশা কুড়িয়েছে । ছোটখাটো পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটার আশপাশে আজ বেশ কয়েকটি ভ্রমর গুনগন করছে । অথচ ওর দৃষ্টি এত লোকের ভীড়েও ওই ফর্সা সিল্কি চুলের ছেলেটার ওপরই আটকে আছে ।ওর ইতঃস্তত চোখ জোড়া ঘোরাফেরা করতে ব্যস্ত সম্রাটের টিকালো নাক, ঘন ভ্রু যুগলের নিচে গিরিখাতের ন্যায় গভীর চক্ষুদ্বয়ে । রুক্ষ শুষ্ক পুড়ে যাওয়া অধরযুগল দেখে মনে হল নিশ্চয়ই সম্রাট সিগারেট খায় । হালকা বিরক্তি লাগলেও রিয়ানার মনে হল ওই কালো ঠোঁটজোড়াই যেন সম্রাটের সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে ।
-“রিয়ানা খাচ্ছ না কেন ?”
হঠাৎ বিলকিসের কথায় থতমত খেয়ে যায় রিয়ানা । দেখে, রানি বিলকিস দুজনেই উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে ।মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে দেখে সম্রাট ওদের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে । ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসির রেখা ফুটিয়ে নিজেকে সামলে নেয় রিয়ানা ।
-” এই তো খাচ্ছি ” বলে ফের খাওয়ায় মন দেয় সে ।
ক্যাটারিংয়ের লোকজন আত্মীয়দের ঠিক মতো খাবার পরিবেশন করছে কিনা তার তদারকি করছে ফাহিম । সম্রাটকে দেখে এগিয়ে আসে । জাহিদের ভাবিকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
-” আপু, কেমন হয়েছে রান্না ?আর একটু নিন না । চাচা, এদিকে বিরিয়ানি দিয়ে যান তো ..”
-“না না , থাক । আর লাগবে না ..” মৃদু হেসে বলল জাহিদের ভাবি।
-” রানি , খাচ্ছিস তুই ?” রানির পাশে দাড়িয়ে বলল সম্রাট ।
উত্তরে চোখ পাকিয়ে তাকাল রানি । সম্রাট হাসল একটু । তারপর তারপর চেহারায় কৃত্রিম গাম্ভিয্য এনে বলল,
-” বিলকিস?”
-“-হ্যা ,ভাইয়া..”
-” ছোট বাচ্চাদের বেশি রোস্ট খেতে নেই তাই না …” বলেই রানির প্লেট থেকে চিকেন লেগ পিসটা তুলে নিল হাতে ।
-” হ্যা ভাইয়া .. ” মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেও রানিকে গরম চোখে তাকাতে দেখে কিছুটা মিইয়ে গেল বিলকিস । পাশে বসা রিয়ানা খিলখিল করে হেসে উঠল ।
-” এই যে তুমি । তুমি বলো তো আমি ঠিক বললাম কিনা ? “.. রিয়ানাকে উদ্দেশ্য করে বলল সম্রাট । রিয়ানা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো । রাগে রানি অগ্নিশর্মা হয়ে তাকাল । ঠোঁটের কোণে জোর করে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,
-” আচ্ছা, তাই বুঝি !ওফ হো… কিন্তু, তুই তো বুড়ো হয়ে গেছিস । ইস, কি রোগা লাগছে তোকে ! আর কটা দিনই বা রিজিক আছে দুনিয়ায় । আচ্ছা , তুই বরং আমার চেয়ারটাতেই বস । দাড়া, আমি চাচাকে ডাকি ..তোকে প্লেট ভর্তি করে রোস্ট দিতে বলি … ভালো করে খাবি বুঝলি ।একদম পেট ভরে । কি জানি, পরে সুযোগ মিলে কি না !চাচা, ….. একটু এদিকে আসুন তো …..” রানি একটু জোর গলায় ডাকল রোস্ট পরিবেশনকারী লোকটিকে ।
সম্রাট রানির সামনাসামনি দাড়িয়ে একটু খুটিয়ে দেখল ওকে । তারপর বলল,
-” তুই আমাকে নিয়ে চিন্তা করছিস ? সত্যি! কি সৌভাগ্য আমার ! তবে, একটা কথা , এত চিন্তা করিস না আমাকে নিয়ে । দেখ , আল্লাহ একদম সুস্থ সবল বানিয়েছে আমাকে । এখনো তো অনেক কিছু করা বাকি । তাই এত তাড়াতাড়ি মরব না । তুই বরং একটু বেশি করে খা । ফিউচারে কাজে লাগবে …” ভ্রু নাচিয়ে বলল সম্রাট ।
সম্প্রতি সম্রাট কথা বলার সময় বড়ো বেশি বেশামাল হয়ে যায় । ওর কথায় তাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল রানি । কে কি বুঝল জানে না তবে সে কি বলবে ভেবে পেল না । মনে হলো কেউ বুঝি ওর শব্দমালা কেড়ে নিয়েছে । লোকটি কাছে এলে সম্রাট রানির প্লেটে দিতে বলে রোস্টের বাকি অংশ চিবুতে চিবুতে চলে গেল প্যান্ডেলের বাইরে । পিছনে রেখে গেল দুজোড়া বিস্মিত চোখ । রানি এক অনির্বচনীয় লজ্জায় ডুব দিয়ে আলতো হাতে নাড়াচাড়া করতে লাগল প্লেটের অবশিষ্ট খাবার । আর রিয়ানা ঈর্ষান্বিত হয়ে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রানির দিকে । প্রথম দিকে ওদের খুনসুটি ভালো লাগলেও এখন তা কাটার মতো বিধছে যেন ।
বরপক্ষের খাওয়াদাওয়ার পর আত্মীয়রা সবাই একত্রিত হয়েছে প্রশস্ত উঠোনে । সবাই যে যার মতো সবার সাথে আলাপ করতে ব্যস্ত । লাবিব তার বাবা আর ফুপাজিদের নিয়ে জাহিদের বাবার সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে । সবার মুখেই প্রশান্তিময় বিনয়ী ভাব । একটু পরেই কন্যা সম্প্রদান করবেন লাবিবের বাবা । স্টেজের ওপর সিংহাসনে বসে জাহিদ মৃদু স্বরে কথা বলছে মুসুর সাথে । পাশে রিয়ানা আর ওর বেশ কিছু কাজিন আর বিলকিস -মৌনি মিলে ফোটো তুলছে নব বিবাহিত দম্পতির সঙ্গে । তার মাঝেই সবার চোখ এড়িয়ে জাহিদ কথা বলার চেষ্টা করছে মোস্তাফিনার সাথে । ফটো তোলায় বারবার বিঘ্ন ঘটায় রিয়ানা মনোখুণ্ণ হয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল ভাইয়ের দিয়ে। বলল,
-” ভাই, কথা বলার সময় চলে যাচ্ছে না । তুমি পরে অনেক সময় পাবে ভাবির সাথে কথা বলার । এখন প্লিজ , একটু এদিকে তাকাও । সুন্দর করে পোজ দাও তো দেখি একবার ”
জাহিদ মুসু দুজনেই লজ্জ্বা পেল । রিয়ানা হাত নেড়ে ডাকল কোট পরা ছেলেটাকে ,
-” সিরাজ ভাইয়া , আমাদের ছবি তুলে দিন না ..”
-“রানি আপু..”
-“বল ..”
-” সেজপুকে বারণ কর না এমন ঢলাঢলি করতে । আব্বু দেখলে কিন্তু খুব রাগ করবে …”
রানি সামনে তাকিয়ে দেখল বিলকিসকে । বরপক্ষের কয়েকটা ছেলের সাথে বসে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছে । রানি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ।বিলকিস টা আর সুধরালো না। কোনো অনুষ্ঠানে গেলেই ওকে চোখে চোখে রাখতে হয় । আজ এখানে ছাড় পেয়ে গেছে বলে লাগামহীন কথার সাথে নিজেও ছুটছে । রানি আশপাশে দেখল । না , আব্বু কাছেপিঠে নেই । তিনি এসব একদম পছন্দ করেন না । দেখলে আজ বিলকিসের খবর করে ফেলতেন ।
সিরাজ সেলফি স্টিক হাতে নিয়ে রানিকে ডাকল,
-“এই যে বিয়াইন । আসেন ছবি তুলি …”
রিয়ানা বিষ দৃষ্টিতে তাকাল রানির দিকে । সাথে সাথে দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল । রানি ভড়কে গেল কিছুটা । রিয়ানা ওকে ওভাবে দেখল কেন ? তাৎক্ষণিক স্মৃতি হাতড়েও এর কারণ খুঁজে পেল না রানি । মাথা নেড়ে না জানাল সিরাজকে ।
প্রত্যেক বাবা-মায়ের কাছে তাদের সন্তান অমূল্য রত্ন। কিছু ক্ষেত্রে মেয়েরা অবহেলিত হলেও বেশিরভাগ বাবার কাছেই মেয়েরা হয় তাদের চোখের মনি , যক্ষের ধন । কুড়ি-পঁচিশ বছর অবধি ভালোবাসার মোড়কে আগলে রাখেন কন্যাদের । অবশেষে যোগ্য ব্যক্তির কাছে কন্যা সম্প্রদান করে বাকি জীবন নিশ্চিন্তে কাটাতে চান ।
বিদায় লগ্ন এসে উপস্থিত । পুরো বাড়িতে মিহি কান্নার রোল উঠেছে । বরপক্ষের লোকেরা সবাই নিজের গাড়িতে বসে পড়েছে । ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ড্রাইভার । জাহিদের পাশে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদে চলেছে মুসু । এতদিন বিয়েবাড়ির এই কান্নাকাটির ব্যাপারটা অসহ্য লাগত রানির । বারবার মনে হত রাত পোহালেই তো ফিরে আসবে বাড়ির মেয়ে বাড়িতে । তাহলে এমন ঘটা করে কান্নাকাটি কেন ? কিন্তু আজ বাড়ির মেইন গেটের কাছে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে অনুভব করতে পারছে ও -কেন সবাই বুক ফাটিয়ে কান্না করে ? নিজের বড়ো বোন মহসেনার বিয়েতেও এত কষ্ট হয়নি রানির যতটা আজ মুসুর জন্য হচ্ছে । ইচ্ছে করছে আপুকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতে । ছোট শিশুরা যেমন নিজের কোনো খেলনা অন্য কেউ নিলে চিৎকার করে কাঁদে, জেদ দেখায় তেমনি করে মুসুকে নিজের কাছে রেখে দিতে ইচ্ছে করছে রানির । তবুও যেন মামানি এভাবে কান্না না করে । রানির খুব বলতে ইচ্ছা করল মামাকে ‘ কেন তুমি এমন অসহায় চোখে তাকিয়ে আছ মামা ? আপু তোমার মেয়ে , তোমার রাজকন্যা । কেন তুমি তাকে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছ ? অধিকার দেখিয়ে কেন নিজের কাছে রেখে দিচ্ছ না ? কেন শুধু নীরবে চোখের জল ফেলে বিদায় দিচ্ছ ? মামা রেখে দাও না আপুকে আমাদের কাছে..প্লিজ মামা …প্লিইইইজ। ‘
কিন্তু হৃদয়ে জমানো শব্দগুলো বাক্য হয়ে বেরিয়ে এল না । কুন্ডলী পাকানো ধোয়ার ন্যায় হৃদয়ের অলিগলিতে বিচরণ করতে লাগল অবাধে । শুধু দলা পাকানো কষ্টগুলোর বহিঃপ্রকাশ হিসেবে টপটপ করে নোনা জল চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অবিরত ।
-“বাপরে, আমার ঘাড়টা গেল আজ …উউউউউ ” বলতে বলতে রানির পাশে এসে দাড়াল সম্রাট । ও আর ফাহিম মিলে বিয়েতে পাওয়া সব উপহার একে একে গাড়িতে তুলে দিয়ে এল । এত লোকের কোলাহলের মাঝেও পাশে দাড়ানো রানির অনবরত নাক টানার শব্দ সব কিছুকে ছাপিয়ে সম্রাটের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সম্রাটের বুঝতে বাকি রইল না কান্না করছে রানি । ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল রীতিমতো ঝরণা ধারা বইছে গাল বেয়ে । বিচলিত বোধ করল সম্রাট । একবার ভাবল রানিকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবে । পরক্ষণেই ভাবনাকে জলাঞ্জলি দিল কারণ ও জানে এই মুহূর্তে রানিকে এখান থেকে সরানো সম্ভব নয় । মুসু আর রানির সম্পর্ক কতটা গভীর তা ওর অজানা নয় । তাই কষ্টটা অনুভব করতে পারছে সে । সম্রাট ভীড়ের মাঝে সবার অলক্ষ্যে আলতো করে রানির বাম হাতটা ধরল । সচকিত হলো রানি । ছলছল চোখে রানি তাকিয়ে দেখল একটা শক্ত পুরুষালি হাত ওর আঙ্গুলের ফাকে নিজের আঙ্গুল গলিয়ে ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে । চোখ তুলে তাকাল রানি । সম্রাটের চোখে কি খুঁজে পেল সেই জানে , কান্নার গতি বাড়ল কিন্তু হাত সরিয়ে নিল না । হাতের বাধন আরো শক্ত হল । দুজনের তাকিয়ে দেখতে লাগল গাড়ির আলো ক্ষীণ হতে হতে একসময় পথে বাঁকে মিলিয়ে গেল ।
To be continue….