খোশের আড়ালে পর্ব ১

0
1625

#মুখোশের_আড়ালে
#পর্ব_১
#Saji_Afroz
.
.
.
একটা প্রশস্থ ঘরের খাটের উপরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে পৌষী । দরজার পাল্লাটি খোলা । বাইরে বাতাস বইছে । জানালার পাল্লাও খোলা থাকার কারণে জানালার ধারের পর্দাগুলো উড়ছে । এরই মধ্যে ফাহাদ দু’বার এসে পৌষীকে দেখে গিয়েছে । মেয়েটার শরীরটা ভালোনা ৷ জ্বর এসেছে ৷
আজ কেনো যেনো মায়া কাজ করছে এই মেয়েটির জন্য!
পৌষী…
ফাহাদের স্ত্রী । কুমিল্লার তালতলা গ্রামের মেয়ে সে । ছোট থেকেই তাকে চেনে ফাহাদ । তার বাবার বন্ধুর মেয়ে সে । খুব ছোট বেলায় মাকে হারায় পৌষী । সৎমায়ের সংসারে বড় হয়েছে সে ।
মা-বাবার জোরাজুরিতেই তাকে বিয়ে করতে হয়েছে ফাহাদের । পৌষী দেখতে সুন্দরী, সংসারী মেয়ে । তবে ফাহাদের মনের মতো নয়! ফাহাদ শিক্ষিত কোনো মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চেয়েছিলো । যে ফাহাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে । কিন্তু পৌষী অষ্টম শ্রেণীতে দুবার ফেল করার পর আর পড়াশোনায় করেনি ৷
তাছাড়াও এমন ঘরকুনো স্বভাবের মেয়ে ফাহাদের পছন্দ নয় ।
তাই পৌষীর সাথে সহজ হতে পারেনি সে । স্বামী-স্ত্রী হবার পরেও দুজনে আলাদা রুমেই থাকে । বিয়ের কিছুদিন আগে লাকসাম শহরে এই বাড়িটি কিনে নেয় ফাহাদ । দ্বিতল বিশিষ্ট বেশ বড়সড় বাড়ি এটি । দেখতে ঠিক বাংলো বাড়িগুলোর মতো । চারপাশে গাছগাছালিতে ভর্তি । ফাহাদের পরিবার তালতলাতেই থাকে । কাজের সুবাদে ফাহাদকে এই শহরেই থাকতে হয় ।
দুজন মানুষের জন্য যদিও এতো বড় বাড়ির প্রয়োজন নেই । তবে বাড়িটির চারপাশের পরিবেশ ফাহাদের হৃদয় কেড়েছে । নিজেকে প্রকৃতি প্রেমী হিসেবেই দাবী করে সে ।
.
.
মানুষের মনে আকুলতা যেমন রয়েছে তেমনি ব্যকুলতারও শেষ নেই! মনের অভিব্যক্তি কেউ সহজে প্রকাশ করতে পারে, কেউ পারেনা । পৌষীর মনে একটি আকুতি, ফাহাদ যেনো তাকে ভালোবাসে । সত্যি বলতে প্রথম দিকে অসুস্থতা ছিলো একটি বাহানা । ভেবেছিলো এই অজুহাতে খুব সহজে ফাহাদের কাছে যেতে পারবে সে । কিন্তু অজুহাতটা এই খারাপ রূপ নেবে ধারণাও ছিলোনা তার । সত্যি সত্যিই শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছে পৌষীর ।
.
.
রাত গভীর হতে থাকলে পৌষীর ঘুমে মগ্ন থাকার কথা । কিন্তু পৌষীর চোখে ঘুম নেই । আজ মশারির ভেতরে ঘুমোতে তার অস্বস্তি লাগছে । জানালা খুলে থাকার কারণে ঘরের ভেতর পর্যাপ্ত বাতাস থাকলেও তার মনে হতে লাগলো, তার নিশ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসছে । মশারি খোলার জন্য উঠে বসলো পৌষী । আচমকা ফাহাদকে দেখে চমকে উঠলো সে ।
ভাঙা গলায় পৌষী বললো-
আজ এতো রাতেও জেগে আছেন?
-অফিসের কিছু কাজ বাকি ছিলো । সেসবই করছিলাম এতোক্ষণ । তোমার রুমের জানালা খোলা । বন্ধ করতেই আসলাম ।
-আমার বাতাস ভালো লাগে । বন্ধ করবেন না দয়া করে ।
-এভাবে বলার কিছু নেই!
-কিভাবে বললাম?
-এই যে দয়া করে, এসব বলার কি প্রয়োজন! এমনিতেই বললে পারতে ।
-আপনি যদি কিছু মনে করেন ।
.
এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালো না ফাহাদ। পৌষীর উদ্দেশ্যে বললো-
তুমি উঠতে চাইছো কেনো? কিছু লাগবে?
-আসলে মশারি টা ভালো লাগছিলো না । খোলার জন্যই…
-জানালা খোলা রেখেছো, মশা ঢোকার জন্য উত্তম ব্যবস্থা । এখন আবার মশারিও খুলতে চাইছো । এই অসুস্থ শরীরটা মশাকে খাওয়ানোর খুব বেশি প্রয়োজন?
.
ফাহাদের কথা শুনে হেসে ফেললো পৌষী ।
অসুস্থ অবস্থায় পৌষীর ফ্যাকাসে মুখচ্ছবির পরিবর্তে হাস্যেজ্জ্বল সুন্দর মুখটা দেখে তারও মুখে হাসি ফুটে উঠলো ।
এই প্রথম পৌষীর হাসি দেখে ফাহাদের মুখেও হাসি ফুটেছে । বিষয়টি অবাক করার মতোই । কেননা ফাহাদ সবসময় গম্ভীরমুখেই কথা বলে পৌষীর সাথে । দুজনের মাঝে প্রয়োজন ছাড়া কথাও হয়না ।
ফাহাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পৌষী । ফাহাদ বললো-
মশারি খোলার প্রয়োজন নেই । আর যদি খুলতেই হয় জানালা বন্ধ করতে হবে । কোনটা করতে চাও?
-আপনি যেটা বলেন ।
-আমার ইচ্ছে? তবে শুয়ে পড়ো ।
.
ফাহাদের কথা শুনে চুপচাপ কম্বল শরীরে মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো পৌষী ।
.
.
দুদিন পর….
পৌষীর শরীরটা বেশ ভালোই এখন । তবে মনটা ভালো নেই । অসুস্থ থাকাকালীন ফাহাদ তার সাথে কথা বললেও বর্তমানে আগের আচরণেই ফিরে গিয়েছে । পৌষীর মনেহচ্ছে, ফাহাদের সঙ্গ পেতে অসুস্থ থাকাই যেনো ভালো ছিলো!
.
নীল রঙের একটা পাঞ্জাবি পরে হাতঘড়িটা খুঁজছে ফাহাদ । পৌষী তার দিকে হাতঘড়িটি এগিয়ে দিয়ে বললো-
এটা খুঁজছেন?
-হ্যাঁ ।
.
পৌষীর হাত থেকে ঘড়িটি নিতেই সে প্রশ্ন করে বসলো-
কোথাও কি যাচ্ছেন?
-এভাবে তৈরী হয়ে নিশ্চয় বাসায় বসে থাকবোনা ।
-আজ শুক্রবার ৷ অফিস তো নেই ।
-আমি কি অফিসে পাঞ্জাবি পরে যাই?
-তবে কোথায় যাচ্ছেন?
-আমার বন্ধুর জন্মদিন আজ ৷ দাওয়াত করেছে । ওখানেই যাচ্ছি ।
-আমাকে করেনি দাওয়াত?
.
পৌষীর মুখে এই প্রশ্নটি শুনে খানিকটা অবাকই হলো ফাহাদ । আজ হলো কি এই মেয়ের!
ফাহাদকে নিশ্চুপ দেখে পৌষী বললো-
বাসায় ভালো লাগছেনা আর । আমাকেও সাথে নিয়ে যাবেন?
.
বিয়ের চারমাসে এই প্রথম কোনো আবদার করলো পৌষী । মেয়েটার হয়তো সত্যিই ঘরের বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে ।
খানিকক্ষণ ভেবে ফাহাদ বললো-
চলো । তবে হ্যাঁ, ওখানে কথা কম বলার চেষ্টা করবে । কেউ যেনো জানতে না পারে, দুই দুইবার জে.এস.সি পরীক্ষা দিয়েও ফেল করেছো ।
.
.
ফাহাদের সাথে তার বন্ধুর বাসায় পৌষী আসলেও ঘরের এক কোণায় বসে রয়েছে মেয়েটি । মাঝেমাঝে ব্যাগ থেকে ছোট আয়নাটি বের করে নিজেকে দেখছে সে । তাকে কি এতোটাই খারাপ লাগছে দেখতে? যে কারণে ফাহাদ তার ধারেকাছেও আসছে না!
বেশকিছুক্ষণ কেটে যাবার পর হঠাৎ হইচই এর শব্দ কানে বাজলো পৌষীর । সকলের এমন হইচই করার কারণ কি হতে পারে জানার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে গেলো সে ।
ফাহাদের বন্ধু রবিনের জন্মদিন আজ । রবিনের দূর সম্পর্কের চাচা মিয়াজ শেখ এসেছেন তার বিশেষ অনুরোধে । মিয়াজ শেখ বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের সেরা প্রকাশকের মাঝে একজন । শুধু তাই নয় । তিনি একাধারে কবি ও সাহিত্যিক । জনপ্রিয়তা তার আকাশচুম্বী । রবিন ভাবতে পারেনি, তার দাওয়াতে ছুটে আসবেন মিয়াজ শেখ! মিয়াজ শেখ উপস্থিত সকলের সাথে আড্ডায় সামিল হলেন । আড্ডার এক ফাঁকে তিনি বললেন-
এখানে এমন কেউ কি আছে? যে লেখালেখির সাথে জড়িত আছে?
.
একটা মেয়েলি কণ্ঠ শুনতে পেলো সকলে-
জড়িত নেই । তবে হতে চাই । লেখালেখি করতে ভালোবাসি ভীষণ ।
.
অন্য কেউ অবাক না হলেও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ফাহাদ বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেলো । কেননা মেয়েটি আর কেউ নয়, পৌষী!
পৌষী এখানে এসেছিলো মাথায় ঘোমটা দিয়ে । এখন তার মাথায় ঘোমটা নেই । কোমড় সমান চুলগুলোও খোলা । এভাবে সে পৌষীকে কখনো দেখেনি!
আর কি যেনো বললো সে? লেখালেখি করতে ভালোবাসে? এটা কি করে সম্ভব! একটি বাংলা লাইন লিখতে যে মেয়ে চার-পাঁচটা বানান ভুল করে, সে কি করে লেখালেখি করবে!
.
মিয়াজ শেখ বললেন-
তাই নাকি! তা কি লিখতে পছন্দ করো তুমি?
-কবিতা, গল্প, উপন্যাস সবই লিখতে ভালো লাগে ।
-নিজের লেখা একটি কবিতা আবৃতি করে শোনাতে পারবে কি?
-নিশ্চয় ।
.
পৌষী কোন লেখকের কবিতা কে নিজের কবিতা বলে চালাতে চায়ছে বুঝতে পারছেনা ফাহাদ । আরো বুঝে উঠতে পারছেনা পৌষীর এমন ব্যবহারের কারণ!
পৌষী বলতে শুরু করলো-
ঐ দূর আকাশে
রোদের ভেলা যাচ্ছে ভেসে
সাথে নিয়ে কতো আলো!
আমারো ইচ্ছে জাগে
এক মুঠো রোদ নিয়ে
সরিয়ে দিতে আঁধার কালো।
জানিনা পারবো কিনা
সূর্য তা দেবে কি না,
তবু পথ চেয়ে থাকব।
এক মুঠো রোদ নিতে
সূর্যের কাছ থেকে
আঁচল ধরে রাখবো।
.
পৌষীর আবৃতি শুনে হাততালি দিলো সকলে । মিয়াজ শেখও তার প্রশংসা করলেন । তাদের সকলের সাথে আড্ডায় মেতে উঠলো পৌষীও । মিয়াজ শেখের সাথে তার ভালোই জমলো । সাহিত্য বিষয়ে কথা বললো তারা ।
পৌষীর দিকে তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরেই ফাহাদ । পৌষী আর সাহিত্য! কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছেনা ফাহাদ । পৌষীকে সে অনেক আগে থেকেই চেনে । পৌষীর এই রূপ সম্পর্কে অজানা তার । কিভাবে সম্ভব এসব!
.
(চলবে)
.
বি:দ্র:- উল্লেখিত কবিতাটি আফসানা আপুর লেখা৷ ছবিটি এডিট করে দিয়েছে তিশা আপু। ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here