#খোঁজ
#২১তম_ও_শেষ_পর্ব
মেঝেতে পড়ে থাকা মেয়েটির মুখটা দেখতেই অফিসার চিনতে পারলেন এটাই অদিতি। দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন ওর মাথায় আঘাত করা হয়েছে। তাই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে সে! অদিতি কে পুলিশ অফিসারের কথায় তারাতাড়ি হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো।
পুলিশ অফিসার আগেই মেনেজার কে বলে দিয়েছিলেন হোটেলের ভিতর থেকে কেউ যেনো বেরিয়ে যেতে না পারে। আর নতুন করে কেউ যেনো হোটেলের ভিতরে প্রবেশ করতেও না পারে। পুলিশের ধারণা বিল্লু হোটেলের ভিতরেই কোন না কোন জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে আছে।
কারণ বাইরে পাহারারত কনস্টেবল দ্বয় বিল্লুকে হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেনি। তাই বোঝাই যাচ্ছে সে অদিতি কে আঘাত করে হোটেলের কোথাও লুকিয়ে আছে। আর এখানে তো অদিতির মেয়ে মিতুলের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। অফিসার বুঝতে পারলো তবে মিতুল বিল্লুর সাথেই থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট।
হয়তো বা যে কোন ভাবে বিল্লু বুঝতে পেরেছে পুলিশের লোকজন তাঁকে পাহারায় রেখেছে? তাই বেরিয়ে যাবার জন্য অদিতিকে সে আঘাত করে। সে বুঝতে পেরেছে অদিতি কে তার সাথে নেওয়া আর সম্ভব নয়। কিন্তু মিতুল কে সাথে করে নিয়ে গেছে কেন? শেষ সময়ে কাজে দিতে পারে বলে? পুলিশ যখন তাঁকে ধরে ফেলার উপক্রম করবে তখন হয়তো সে মিতুল কে ঢাল বানিয়ে মুক্তির রাস্তা খুঁজে নিবে!
তবে পুলিশ এটা ভেবে খুব আশ্চর্য হয়েছে। এমন একটা ক্রিমিনাল ভালোবাসার মানুষ কে কাছে রাখতে কতকিছুই না করছে!
পুলিশ অফিসারের হুকুমে হোটেলের প্রতিটা রুম চেক করা হচ্ছে খুব সতর্কতার সঙ্গে। একটি করে রুমে পুলিশ হানা দিচ্ছে আর লোকজন কে হোটেলের বাইরে বের করে দিচ্ছে। এমন সময় মুখে চাপদাড়ি ও ভুড়িওয়ালা একজন লোক তার গর্ভবতী স্ত্রী কে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে অফিসারের কাছে এসে বললো। স্যার আমার বউয়ের খুব প্রসব বেদনা উঠেছে! তাঁকে তারাতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। নয়তো এখানেই একটা কিছু হয়ে যেতে পারে স্যার!
মহিলাটি প্রসব বেদনায় চিৎকার করে পুরো হোটেলটাই মাথায় তুলে ফেলেছন। অফিসার তবুও জিজ্ঞেস করলেন, আপনার স্ত্রীর এই অবস্থায় আপনি হোটেলে এসে কেন উঠেছেন ? এই অবস্থায় কেউ বেড়াতে আসে! লোকটা জবাব দেওয়ার আগেই মহিলাটি ভয়ংকর ভাবে চিৎকার করে উঠে।
লোকটা তবুও অফিসারের কথার জবাব দেয়, স্যার! আমার স্ত্রীর খুব ইচ্ছে হলো বাচ্চা পেটে নিয়ে সমুদ্র দেখবে। লোকটা বিরক্তির সাথে স্ত্রীর উপর ক্ষোভ প্রকাশ করলো। উনার ধারণা এই অবস্থায় সমুদ্র দেখলে নাকি বাচ্চার হৃদয় সমুদ্রের মতো সুন্দর আর বিশাল হবে? মহিলার চিৎকার চেঁচামেচির কারণে বিরক্ত হয়ে অফিসার আর কোন প্রশ্ন না করেই তাদেরকে ছেড়ে দিলেন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।
অফিসার কাজে মন দিলেন। রুমের পর রুমে পুলিশ বিল্লু আর মিতুল খোঁজে যাচ্ছে। কিন্তু প্রত্যেক রুম থেকেই তারা নিরাশ হয়ে বের হচ্ছে। আর লোকজন কে হোটেলের বাইরে বের করে দিচ্ছে। হঠাৎই অফিসারের মনে হলো ভুড়িওয়ালা লোকটার গালেও তো চাপদাড়ির ফাঁকে একটা তিল আছে। এবং সেটা বেশ বড়সড়। তবে কি বিল্লু ছদ্মবেশে তাদের সামনে থেকে তাদের সকলের চোখে ধূলো দিয়ে পালিয়ে গেলো?
অফিসার নিচে পাহারায় কথা কনস্টেবল কে ফোন করে জিজ্ঞেস করে, একটু আগেই যে একজন গর্ভবতী মহিলা তার ভুড়িওয়ালা স্বামী কে নিয়ে বেরিয়ে গেলো তারা এখন কোথায়? তাদেরকে আঁটকে রাখো। কনস্টেবল বলে স্যার এইমাত্রই তারা একটা মাইক্রো বাসে করে রওনা দিলো। অফিসার উর্ধ্ব শ্বাসে দৌড়ে হোটেল থেকে বেরুতে বেরুতে বললো, দ্রুত ওদের পিছু নাও! আমরা যাকে খোঁজে মরছি! এরাই মনে হচ্ছে তারা? কনস্টেবল বললো, জ্বি স্যার! আমি এখনই তাদের পিছু নিচ্ছি।
অফিসার কনস্টেবল কে পিছু নিতে বলে। অতি দ্রুতই দৌড়ে নিচে নেমে এলেন। তারপর গাড়ি নিয়ে বিল্লু যে দিকে গেছে সেই দিকে দ্রুত এগিয়ে চললেন। বিল্লুর পিছনে মোটরসাইকেল নিয়ে এক কনস্টেবল আগেই রওনা হয়ে গিয়েছে। গাড়িগুলো দ্রুত গতিতে শহর ছাড়িয়ে হিমছড়ির রাস্তায় চলতে লাগলো। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরেই দেখা গেলো। রাস্তার পাশে কনস্টেবল মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করতেই সে জবাব দিলো পেট্রোল শেষ হয়ে গেছে!
সে আরও বললো, আমি প্রায় ওদের নাগল পেয়ে গেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ পেট্রোল শেষ হওয়ার কারণে মোটরসাইকেল বন্ধ হয়ে গেছে!
অফিসার ড্রাইভার কে বললেন দ্রুত গাড়ি চালাও! নিশ্চয়ই খুব দূর যেতে পারে নি ওরা? ড্রাইভার যতটুক সম্ভব স্পিড বাড়িয়ে দিলো।
কিছু দূর যাওয়ার পরেই দেখতে পেলো মাইক্রো বাসটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। অফিসার দ্রুত মাইক্রোবাসের কাছে গিয়ে গাড়ি থামাতে বললেন। গাড়ি থামতেই তারা সবাই নেমে পড়ে। আর আশেপাশে চোখ বুলাতে লাগলো তাদেরকে কোথাও দেখা যায় কি-না? মাইক্রো বাসটি তখন রাস্তায় সম্পূর্ণ খালি পড়ে আছে।
এক কনস্টেবল হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো, ঐ যে দেখুন স্যার! ওরা পালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ অফিসার তাদেরকে দ্রুত ফলো করলেন। কিছু দূর যাওয়ার পরেই মহিলাটি তাদের হাতে ধরা পড়ে গেল। এখন আর তার পেটে কোন বাচ্চা নেই। কিন্তু বিল্লু’সহ তার সাথী কোথাও যেনো ঘাপটি মেরে বসে আছে। অনেক খোঁজেও তাকে আর তার সাথিকে পাওয়া গেল না। অফিসার বুঝতে পারলেন তাদেরকে এখন হাল ছেড়ে দিলে চলবে না!
বিল্লু যদি একবার তাদের হাত থেকে ফস্কে বেরিয়ে যায় তবে তাকে ধরতে অনেক বেগ পেতে হবে। পুলিশ দুদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে অবশেষে বিল্লু’সহ তার সাথীর খোঁজ পেলেন এক আদিবাসীর বাড়িতে। সেখান থেকেই তাদেরকে ধরে আনা হলো। অফিসার বিল্লুকে খোঁজে পাওয়া মাত্র কয়েক ঘা বসিয়ে দিলেন।
নিশ্চয়ই তিনি এই দুদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের শোধ নিলেন? অফিসারের শক্তিশালী হাতের চড়ে বিল্লুর আগলা দাঁড়ি খুলে পড়লো আর সেই সাথে তার একটি দাঁতও!
এদিকে এই দুদিন অদিতি মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছে। অদিতির মা তার মেয়ের সাথেই আছেন। তিনি খবর পাওয়া মাত্রই আর দেরি করেন নি! আর আমি তো এই দুদিন পুলিশের সাথেই আঠার মতো লেগে ছিলাম। যদিও এটা তারা মোটেও পছন্দ করছিলেন না। আমারও ইচ্ছে ছিলো বিল্লু কে সবার আগে আমিই কয়েক ঘা বসিয়ে দিবো। কিন্তু পুলিশ অফিসার আমাকে তার কাছে যেতে দিলেন না!
বিল্লু’সহ তার সাথীদের আলাদা আলাদা করে জিজ্ঞেস বাদ করা হলো। আর অদিতি কে কিছু কথা জিজ্ঞেস করে তার মায়ের সাথে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আমি অনেকবার চেষ্টা করলাম তার সাথে দেখা করার জন্য কিন্তু অদিতি কেন জানি আমার সাথে দেখা করতে চাইলো না! আমি মনে মনে কিছুটা আশ্চর্য হলেও তা প্রকাশ করলাম না। বুঝতে পারলাম হয়তো এই ঘটনার জন্য সে আমার সামনে আসতে প্রচন্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে আছে?
তাই একবুক হতাশা নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে এলাম! আমার খুব ইচ্ছে ছিলো বিল্লু কে আঘাত করতে করতে জিজ্ঞেস করি কেন সে আমার সুখের সংসারে এমন হঠাৎ ঝড় তুলেছে? যার কারণে আমরা দু’জন আজ দুদিকে ছিটকে পড়েছি!
অফিসার অদিতি কে জিজ্ঞেস করে, মিতুল কি সত্যি আপনার গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তান? অদিতি মাথা নেড়ে সায় দেয়, জ্বি! আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু আপনি কেন কাউকে কিছু না বলে হুট করে একাই আপনার মেয়ে কে বাঁচাতে ছুটে গেলেন? অদিতি চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু বিন্দু মুছে জবাব দেয়, এছাড়া আমার সামনে আর কোন রাস্তা ছিলো না। আমাকে বলা হয়েছে মেয়ে কে যদি সত্যি অক্ষতদেহে পেতে চাই! তবে যেনো একথা কেউ না জানে!আমি মিতুলের কথা চিন্তা করে মা’কে ছাড়া আর কাউকে কিছু জানাইনি।
মা আমার সাথে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের অনুমতি ছিলো না। অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, তারা বলতে ঠিক কারা? অদিতি আবারও চোখের জল মুছে বলে, কয়েকজন আমার সাথে ফোন করে এ বিষয়ে কথা বলেছে। কিন্তু কাউকে আমি সনাক্ত করতে পারিনি। এমনকি তারা এক নাম্বাবে দুবার কথা বলেনি আমার সাথে! অফিসার গম্ভীর কন্ঠে বলে, হুম সেটা আমারা জানি।
তাই তো সঠিক ভাবে কোন নাম্বার ধরে আমরা তদন্ত এগিয়ে নিতে পারিনি। যে নাম্বার ধরে এগিয়ে যেতে চেয়েছি। তা হয় ফেক ছিলো নয়তো একেবারেই অপরিচিত কারও কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে ফোন করা হয়েছিলো।
আচ্ছা ওরা যদি কাউকেই সাথে যেতে দেবার অনুমতি দেয়নি। তবে হঠাৎ করে আপনি মিথিলাকে সাথে নিতে চেয়েছিলেন কেন? আমি একা এমন একটা বিপদের মধ্যে যেতে ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। তাই বারবার তাদেরকে বলেছি অন্তত একজন কাউকে নিয়ে আসি! ওরা তখন মিথিলা কে সাথে নিতে পারি বলে জানালো। আমিও তাই মিথিলার সাথে যোগাযোগ করতে যাই। কিন্তু সে তার বিয়ে নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলো। এবং সেই কথা ভেবে আমাকে না করে দেয়। আমিও বুঝতে পারি ওঁকে আর জোর করে কোন লাভ নেই। আমার বিপদ আমি নিজেই সামাল দিবো এই পণ করি মনে মনে।
অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, মিথিলা কে কেন? ওরা কি মিথিলাকে আগে থেকেই চিনতো? অদিতি একটু ভেবে নিয়ে বলে, সেটা আমি বলতে পারবো না। তবে আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসাবে ওর নাম করি আমি নিজেই! অদিতির জবাবে অফিসার কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেল।
তারপর বললো, আচ্ছা ঠিক আছে সেটা না হয় গেল।এবার আমাকে সত্যি করে বলুন তো আপনি বিল্লুকে কেমন করে চিনেন? অদিতি হঠাৎ করে বলে উঠে বিল্লু কে? অফিসার ততোটাই আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনি বিল্লুকে চিনেন না? না স্যার! আমি কোন বিল্লুকে চিনি না!
অফিসার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তবে আপনাকে এতোদিন কে অপহরণ করে রেখেছিলো? আর কোথায় আপনি তাদের সাথে দেখা করেন? অদিতি জবাবে বলে, আমি প্রথমে একটা হোটেলে যাই। সেটার ঠিকানা তারাই আমাকে দিয়ে ছিলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি কাউকে দেখতে পাইনি। যখন ফিরে আসবো বলে ভাবছি ঠিক তখনই একজন মহিলা চুপিচুপি এসে আমাকে বলে, আপনি যাকে খোঁজে ফিরছেন। সে আমাকে পাঠিয়েছে আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য।
একজন নারীকে দেখতে পেয়ে আমি মনের মধ্যে কিছুটা শান্তি পাই। মনের মধ্যে আশার আলো দেখতে পাই! ধারণা করলাম মিতুল কে নিয়ে তারাতাড়িই বাড়িতে ফিরতে পারবো। কিন্তু মহিলাটি আমাকে ভালোভাবে সেখানে নিয়ে গেলেও। আমার উপর তার কোন অজানা রাগের প্রতিশোধ নিতো প্রতিদিন। এই মহিলা রোজ আমাকে প্রহার করতেন। কিন্তু কি জন্য আমার উপর তার এতো রাগ তা প্রকাশ করেনি কখনো।
পুলিশ অফিসার অদিতির কথায় ভীষণ ঘোরের মধ্যে পড়ে গেল। তাই জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সাথে কোন পুরুষ মানুষের দেখা হয়নি? জ্বি একবার মাত্র আমি একজন মানুষের সাথে কথা বলতে পেরেছিলাম। ঐ মহিলার স্বামী সে! আমি তাকে অনেক অনুরোধ করি আমার মেয়ের সাথে দেখা করিয়ে দিতে। কিন্তু সেই চাপদাড়ি ওয়ালা মানুষটি আমার কোন কথাই শুনেনি!
অফিসার আবারও অবাক হয়ে অদিতিকে জিজ্ঞেস করে, তার মানে এখনো আপনি আপনার মেয়ের সাথে দেখা করতে পারেন নি? অদিতি এবার উচ্ছসিত ক্রন্দনে বলে উঠে না, স্যার!
ঐ মহিলাটি শুধু বলতো তোমার মেয়ে কে অচিরেই দেখতে পাবে! আমিও সেই আশায় বুক বেঁধে সেখানে পড়ে থাকতাম। প্রথম প্রথম সে আমাকে বেঁধে রাখেনি। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই আমাকে সবসময় বেঁধে রাখা হতো।
অফিসার বুঝতে পারে অদিতির উপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে। এবার অফিসার তাঁকে সমবেদনা জ্ঞাপন করে জিজ্ঞেস করে, আপনার সাথে তাহলে কোন পুরুষ মানুষ কোন প্রকার জোরজবরদস্তি করেনি?
এই কথায় অদিতি অফিসারের মুখের দিকে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তার চোখ থেকে অঝোরধারায় অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়তে থাকে। অফিসার এবার মায়া ও তার বিল্লুর ছবিটা তার সামনে এনে জিজ্ঞেস করে, ভালো করে দেখুন তো! ছবির মেয়েটাকে ও পুরুষটিকে চিনতে পারেন কি-না?
ছবিটি দেখেই চিনতে পেরে অদিতি চেঁচিয়ে উঠে বলে, হ্যা! এটা তো রঞ্জুর ছবি! তার সাথে মেয়েটি কি তার বউ? অফিসার অদিতি কে শান্ত হয়ে বসতে বলে, জবাব দেয় হ্যা! মেয়েটার নাম মায়া! কিন্তু রঞ্জুর সাথে আপনার পরিচয় কেমন করে?
অদিতি বলে, কলেজে পড়ার সময় রঞ্জু আমাকে প্রায়ই বিরক্ত করতো! তার এমন আচরণের কারণে আমি ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎই সেই বিরক্ত হওয়ার হাত থেকে আসলাম নামের একজন আমাকে উদ্ধার করে। আসলামের একদিনের কথায় রঞ্জু আর কখনো আমাকে বিরক্ত করতে আসেনি।
এরপর পুলিশ অদিতি কে আর কোন প্রশ্ন করে না। বলে প্রয়োজন পড়লেও হয়তো আমি আপনার কাছে আবারও যেতে পারি। অদিতি চোখের জল মুছে বলে, ঠিক আছে। আমরা তবে এখন যাই! অফিসার বলে একটা কথার জবাব কিন্তু এখনো আপনি আমাকে দেননি!
জানেন তো পুলিশ আর ডাক্তারের কাছে কিছু লুকাতে নেই? অদিতি তবুও অফিসারের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলে, এবার আমর আসি স্যার!
এবার রঞ্জু ওরফে বিল্লু কে অফিসার ভালো করে কিছুক্ষণ ধোলাই করে হাতের শখ মিটিয়ে নিলেন। তারপর নিজে একটা চেয়ার টেনে এনে বসে পড়ে বিল্লুকে মেঝেতে বসে পড়ার ইশারা করলেন। বিল্লু তখন অফিসারের হাতে ধোলাই খাওয়ার ভয়ে কুঁকড়ে আছে। তাই তিনি যেভাবে বললেন, সে-ও তাই করলো।
অফিসার বিল্লুর ভয় পাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, যা জিজ্ঞেস করবো সত্যি সত্যি বলবি তো? বিল্লু অফিসারের পা দুটি জড়িয়ে ধরে বলে, জ্বি স্যার! যা জিজ্ঞেস করবেন, সব সত্যি সত্যি বলবো। তবুও দয়া করে আর মারবেন নাহ্!
অফিসার তাকে অভয় দান করে জিজ্ঞেস করলেন, অদিতি ও তার মেয়ে কে কেন অপহরণ করেছিস? স্যার অদিতির সাথে আমার যেদিন প্রথম দেখা হয়। সেদিন থেকেই আমি তাঁকে ভালোবাসি! কিন্তু অদিতি আমাকে কোন সময় পাত্তা দিতো না। আমাকে সে এক প্রকার ঘৃণা করতো। তাই আমিও তার পিছনে সবসময় লেগে থাকতাম। চাইতাম তার মন জয় করার জন্য। কিন্তু তাতেও সে আরও বিরক্তবোধ করতো। একদিন আসলাম এসে আমাকে অনেক হুমকি দেয়। আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম অদিতি কে আমার আর পাওয়া হবে না!
কারণ তখন আসলামের অনেক পাওয়ার ছিলো। আমি তার তুলনায় চুনোপুঁটি মাত্র। কিন্তু তবুও আমি কোনদিন অদিতি কে ভুলতে পারিনি স্যার! এর কিছুদিন পরে আসলাম অদিতি কে ভালোবেসে বিয়ে করে নেয়। স্যার বলতে গেলে একরকম আমার মুখের গ্রাস সে কেড়ে নেয়! সেদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম স্যার! সুযোগ পেলেই আমি আসলাম কে সরিয়ে দিবো। একদিন শুনতে পেলাম তাদের সংসারটা ভেঙে গেছে! সেদিন ঐ খবরটা শুনে আমার মতো খুশি হয়তো কেউ হয়নি? আমি তখনই ছুটে যেতে চেয়েছিলাম অদিতির কাছে। কিন্তু ততোদিনে হিট লিস্টে আমার নাম উঠে গেছে। তাই আর কিছু করতে পারলাম না।
কিন্তু আসলাম কে সরিয়ে দেওয়ার একটা রাস্তা হঠাৎই আমার সামনে এসে গেলো। তখন আমি যেমন পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছি। তেমনি সে-ও লুকিয়ে আছে। দেখা হয়ে গেলো দুজনের। নির্জন পুকুর পাড়ে! সুখ দুঃখের কথা বলতে বলতে পিছন থেকে তার পিঠে ছুরিটা আমূল বসিয়ে দিলাম। তারপর ছুরিটা কয়েকবার ঘুরিয়ে লাথি মেরে তাকে পানিতে ফেলে দিলাম।
অফিসার জিজ্ঞেস করে, তবে তুই আসলাম কে খুন করে ছিলি? হ্যা স্যার! অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কি হয়েছে? এক এক করে বলে যা!
বিল্লু একটুখানি নড়েচড়ে বসে বলে, আমি সবসময় অদিতির খোঁজ নিতাম। খবর রাখতাম সে কখন কি করে? অদিতির মেয়ে মিতুল কে যখন একটা বাসায় রেখে আসে ওর মা! আমি তখনও দূর থেকে তা জানতে পেরেছি। কিন্তু আমি যে অদিতির সামনে গিয়ে দাঁড়াবো তেমন কোন পরিস্থিতি আমার তখন ছিলো না। তাই অদিতির পিছনে গিয়ে মায়া নামের একটা মেয়ের সাথে বেশ ভাব জমে যায়।
তাঁকে বিয়ে করে ফেলি আমি! কিন্তু সেই সংসার আমার বেশিদিন টিকলো না! তখন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কাজ করে আমি চলতে লাগলাম। ভেবেছিলাম পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে অদিতির সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। কিন্তু তেমন পরিস্থিতি! ভালো সময় কখনো আমার সামনে আসেনি।
অনেক দিন পরে খবর পেলাম অদিতির বিয়ে হয়ে গেছে! খবরটা শুনে আমার হৃদয়টা মোচড় দিয়ে উঠে! ভেবেছিলাম অদিতির একটা খুঁত আছে! সেটা তার জন্য বড় একটা দূর্বলতা! আমি তার সামনে গিয়ে ভালো হয়ে যাওয়ার অঙ্গিকার করলে নিশ্চয়ই সে আমাকে ফিরিয়ে দিবে না? তাই অদিতির বিয়ের খবরে আমার মনের সকল আশা হতাশার রুপ নিলো।
ছুটে গেলাম দূর থেকে তাকে একবার দেখার জন্য! কেমন বাড়িতে তার বিয়ে হলো? তা দেখার জন্য! দেখতে পেলাম অদিতির সুখের সংসার! কি নেই তার কাছে? গাড়ি বাড়ি টাকা পয়সা ধন-দৌলতের সাথে সাথে শিক্ষিত সুদর্শন স্বামী! আমি আসলামের কাছে ছিলাম চুনোপুঁটি! আর অদিতির বর্তমান স্বামীর সামনে নিজেকে সামন্য কীটপতঙ্গের মতো মনে হলো।
তাই তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি যাকে পেলাম না। তাঁকে আর কেউ পাবে, তাও হতে দিবো না! তাই কৌশলে আলম সাহেবের বিশ্বাস অর্জন করে ফেললাম। আমি জানতাম অদিতির অতীত জানতে পারলে, আলম সাহেব যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে?
আর একদিন সুযোগ বোঝে আলম সাহেবের কানে তুলে দিলাম কথাটা আরও একটু রঙ মাখিয়ে। বেশ আমি যা চাইছিলাম তাই হতে লাগলো। অদিতি আমার কৌশলে আমার হাতে বন্দিনী হয়ে গেলো। কিন্তু তবুও তার সামনে যাবার সাহস আমার হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাকে স্পর্শ করা ছাড়া থাকতেও পারছিলাম না!
তাই তাঁকে নেশা জাতীয় ঔষধ খাইয়ে দিয়ে তার সাথে মধুর সময় পার করতে লাগলাম। যদিও এমনটা আমি চাই নি! আমি চেয়েছিলাম অদিতি সম্পূর্ণ স্বজ্ঞানে আমার বাহুডোরে আবদ্ধ হোক। কিন্তু আমি জানতাম তা অদিতি কোনদিনও হতে দিবে না। আমার ধারণা ছিলো এমন ভাবে একদিন ঠিক সে আমার সম্পূর্ণ আপন হবে। কারণ যখন সে জানতে পারবে তার সবকিছু আমি নিয়ে নিয়েছি! তখন আর তার ফিরে আসার পথ থাকবে না। বাধ্য হয়েই সে আমাকে নিশ্চয়ই মেনে নিবে?
তাই একদিন নিজের আসল পরিচয়, আসল চেহেরাটা নিয়ে তার সামনে গেলাম। যা হয়েছে সবকিছু তাঁকে খোলে বললাম। সবকিছু শুনে অদিতি আমার দিকে থুঃথুঃ ছুড়ে দিলো! আমারও প্রচন্ড রাগ হলো বলে দিলাম আসলামের শেষ পরিনতির কথা! তারপর তাঁকে জোর করে বিছানায় নিয়ে গেলাম। অদিতি আমার সামনে প্রচুর কেঁদেছে। কিন্তু আমি তাকে বলে দিলাম আমার কাছ থেকে কোনভাবেই তার মুক্তি নেই!
সে-ও হয়তো তাই বুঝতে পেরে ছিলো। তাই শেষ বারের মতো মায়ের সাথে দেখা করতে চায় সে! আমিও তাকে অনুমতি দিয়ে দেই! আমি জানতাম তার আমার কাছে ফিরে আসতেই হবে। কারণ মিতুল কে সে নিজের থেকে অনেক বেশিই ভালোবাসে! আর মিতুল কোথায় তখনও সে জানে না।
অফিসার বিল্লুর কথা শুনে একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারলেন না। অদিতি কেন এ-সব কথা তার কাছে গোপন করলো? নিশ্চয়ই বিল্লুকে বাঁচাতে নয়? তবে কি সেটা?
যাইহোক বিল্লুর কথা শুনে অফিসার আর তার মেজাজ ঠিক রাখতে পারলেন না। অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু বলার আছে তোর? নাহ্ স্যার! আর সবকিছু তো আপনাদের জানাই আছে।
অফিসার বিল্লুর কথা শুনে চেয়ার থেকে উঠে এসে ওর কলার ধরে টেনে দাঁড় করালেন। তারপর আর-ও কিছুক্ষণ ধোলাই করে বললেন, এখনো কয়েকটি কথা জানা হয়নি। বিল্লু মুখে লেগে থাকা রক্ত মুছে বলে, স্যার আপনি কথা দিয়েছেন আর মারবেন না। যদি আমাকে আপনার আরও মারতে ইচ্ছে করে। তবে একেবারে মেরে ফেলুন! আমি আমার জীবনে আর কিছু চাই না!
অফিসার বিল্লুকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, যা আর তোকে মারবো না। এবার বল মিতুল কোথায়? বিল্লু সোজাসাপটা জবাব দেয়, মেয়েটি অনেক আগেই মারা গেছে! মানে, কি বলতে চাস তুই? আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন অফিসার। বিল্লু বলে আমি মারতে চাইনি স্যার! খুব বিরক্ত করেছিলো বাচ্চাটি! তাই মাথা গরম করে প্রচন্ড জোরে একটা চড় মেরেছিলাম মিতুলকে। সে মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যায়। কাছে তুলে দেখি বেঁচে নেই! বিল্লুর কথা শুনে অফিসার মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন না!
আবার ধোলাই করলেন ওকে! বিল্লু বলে মারুন স্যার! আমাকে একেবারে মেরে ফেলুন! অফিসার তাকে ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা না-হয় তুই ইচ্ছে করে করিস নি। কিন্তু মায়াকে মারলি কেন? এবার বিল্লু হাসতে চেষ্টা করে বলে, কি করবো স্যার! মায়া আমার টার্গেট ছিলো না, কিন্তু ওর সাথে হয়তো এমনই হওয়ার কথা ছিলো?
আপনারা আমাকে খোঁজে বের করার পণ করে বসেছিলেন। তাই ভাবছিলাম কেসটা বন্ধ হবে এমন একটা কাজ করা দরকার। আপাততঃ অদিতির খোঁজ বন্ধ হবে। তাই ওর মতো দেখতে একজন কে আমার মারা খুব প্রয়োজন ছিলো। সবাই জানবে অদিতি আর বেঁচে নেই! তখন একসময় ওর খোঁজ করা বন্ধ হয়ে যাবে। আর আমি তো সবার অজানাই ছিলাম। সবাই তো জানতো এর পিছনে রয়েছে আসলাম।
তাই তো মিথিলা আর তার বাবাকে আটক করে কেসটা সেই দিকেই ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম। কাজও হয়েছিল বেশ! সবাই হন্যে হয়ে আসলাম কে ধরার চেষ্টা করতে লাগলো। কেউ আমার কথা জানতো না! কিন্তু সব নষ্টের গোড়া ঐ সায়েম! তাই তাকেই শেষ করার চেষ্টা করে ছিলাম। কিন্তু শালার বিড়ালের প্রাণ! বেঁচে গেল আমার হাত থেকে।
অফিসার উত্তেজিত হয়ে বলে, কিন্তু তুই যেনো বাঁচতে না পারিস আমি সেই ব্যবস্থাই করবো!
এখন বল তোর দলের আর লোকজন কোথায়? বিল্লু হেসে বলে, স্যার আমি একাই একশো! আমার কাজ আমি নিজে করতেই বেশি ভালোবাসি!
সেই মোটর সাইকেলে করে টাকার ব্যাগ নিয়ে যাওয়া লোকটাও আমি! পত্রিকার পাতায় মুখ আড়াল করে রাখা খবর সংগ্রহ করা লোকটাও আমি! অফিসার বললেন শাস্তিও তাই তুই একাই পাবি।
অফিসার এক কনস্টেবল কে ইশারা করে চলে আসার সময় জিজ্ঞেস করলেন, তা তোর সাথে কাজের মহিলা কি তোর বউ? বিল্লু হেসে না স্যার! আমার প্রেমিকা! সে অন্ধের মতো ভালোবাসে আমাকে। অফিসার অবাক হয়ে হেসে বলে, তোকেও কেউ এতোটা ভালোবাসে?
পরের দিন অফিসার অদিতির সাথে দেখা করে জিজ্ঞেস করে আপনি কেন আমার সাথে মিথ্যা কথা বলেছেন? অদিতি অফিসারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমার জীবনের অসহনীয় জঘন্যতম স্মৃতি গুলো আমার মুখ থেকে শুনলেই আপনি কি বেশি খুশি হতেন? হয়তো বা হতেন! কিন্তু আমি তা মনে হলেই নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠি! নিজেকে ঘেন্না লাগে আমার!
একটা মুখের দিকে তাকিয়ে এখনো হয়তো বেঁচে আছি আমি। প্লিজ স্যার! তাকে একবার খোঁজে এনে দেন। ওকে জড়িয়ে ধরে আমি আমার এই অশান্ত হৃদয় মাঝে একটু শান্তি পেতে চাই! আমার মিতুল কে খোঁজে এনে দেন স্যার!
অফিসার একবার বলতে চেয়েও কথাটা বললেন না। ভাবলেন মিথ্যা হলেও অদিতি সেই অপেক্ষায় বেঁচে থাকুক! তাই তিনি চেষ্টা করবো বলে কোনরকমে অদিতির সামনে থেকে পালিয়ে এলেন!
আমি সবই শুনতে পেলাম লিটুর কাছে। তাই স্থীর করলাম। এই দূর্ঘটনার জন্য অদিতির কোন দোষ নেই! আর আগের ঘটনা যা ঘটেছে। অদিতি মায়ের কারণে আমাকে বলতে পারেনি! সুতরাং আমার ভালোবাসা আমি আমার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম।
বেশ কিছুক্ষণ কলিং বেল বাজালাম। কিন্তু কেউ এসে দরজা খুলে দিলো না। আরও কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ দরজা খুলে তরু আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বললো, আপু বলেছে তার সাথে আপনার আর কোনদিন দেখা হবে না। আপনি আপনার বাড়িতে চলে যান।
এরপরও আমি কলিং বেল বাজালাম কিন্তু কেউ আসবে না বলে মনে হলো। তাই চিঠিটা খুলে দেখলাম। তাতে লেখা আছে। তোমার বাবা যা করেছেন, তাতেই হয়তোবা দুজনের জন্য ভালো হলো! আর কখনো এখানে এসো না! আমি এই জীবনে তোমার সাথে আর দেখা করতে চাই না!
বুঝতে পারলাম অদিতির খোঁজ পেয়েও আমি তার খোঁজ পেলাম না।
কয়েক সপ্তাহ পরে একদিন শুনতে পেলাম। বিল্লুকে কোর্টে হাজির করার সময় সে পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে পালিয়েছে!
সমাপ্ত,,,,,
লেখক মোঃ কামরুল হাসান