#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-৮
(কপি করা নিষেধ। তবে শেয়ার করুন)
জয়ীর ধারণা ছিলো আদনান কে বলা মাত্রই ফল, চকলেট চলে আসবে। জয়ী অপেক্ষা করতে লাগলো। একটা, দুইটা, তিনটা বাজলেও কলিংবেল বাজার নাম গন্ধও নেই। জয়ীর সঙ্গে জিহাদও জেগে আছে। লিজা অবশ্য জেগে নেই। তবে সে দফায় দফায় ভাই বোনেদের খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো সকাল পর্যন্ত দুজন জেগে থাকলেও কোনো কিছু এলো না। জিহাদ শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়লেও জয়ী ঘুমালো না। ভাবীর সঙ্গে ইগোর লড়াইয়ে জিততেই হবে এমন হাবভাব নিয়ে বসে রইলো। লিজা সকালে এসে বলল,
“কই তোমার খাবার, দাবার এসে গেছে। টাটকা ফল দিয়ে ব্রেকফাস্ট করব বলে বসে আছি। ”
জয়ী জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,
“ভাবী অত রাতে ফলের দোকান খোলা পায় নি তো তাই….
“কী বলছ! এতো বড় একজন মানুষ এইটুকু অসাধ্য সাধন করতে পারলো না!”
জয়ীও চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“রাত জেগে সিরিয়াল দেখা এবার একটু কমাও। এক ঘুষিতে গাড়ির কাঁচ ভাঙা, পুরো দোকান উঠিয়ে আনা এসব সিরিয়ালে হয়। বাস্তবে বড়লোকদেরও একটু সময় লাগে।”
লিজা তীর্যক হেসে বলল, ওহ আচ্ছা! তাই বলো।
“হ্যাঁ। ”
“আচ্ছা জয়ী, এটা তোমার কোনো প্ল্যান না তো?”
“কিসের প্ল্যান? ”
“বাই এনি চান্স তুমি কী নিজের দাম বাড়ানোর জন্য এসব করছো? অনীশ তোমার প্রতি আগ্রহ দেখালো বলেই কী এসব করছ?”
জয়ী সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল,
“সকাল সকাল তোমার ম্যুড টা খারাপ করে দেই ভাবী। তোমার ভাই অনীশ কে আমার পছন্দ হয় নি। আমি তাকে বিয়ে করতে এক ফোঁটাও ইন্টেরেস্টেড নই।”
“সেটা জানি। তোমার ম্যাসেজ আমি পেয়েছি।”
“ভেরি গুড।”
“তোমাকে একটা প্রশ্ন করি জয়ী? ”
“শিওর।”
“তুমি কী নিজেকে একটু এক্সট্রা অর্ডিনারী ভাবো? না মানে অনীশ কে পছন্দ হয় নি তো তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”
“না ভাবী ; আমি নিজেকে অর্ডিনারীই ভাবি। তবে যারা একটু এক্সট্রা অর্ডিনারী তাদের খুব ভয় পাই।”
লিজা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
“এক্সাক্টলি ঠিক কী ভাবছ তুমি আমি বুঝতে পারছি না।”
জয়ীও মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“তুমি বরং অন্যকিছু ভাবো ভাবী। একটু নিজেকে নিয়ে ভাবো। নিজের দিকে খেয়াল করো। আগের থেকে মোটা হয়ে গেছ। প্রেগন্যান্ট নাকি?”
লিজা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে কোথাকার টপিক কোথায় নিয়ে গেল!
***
জয়ী বিছানায় শুয়েও ঘুমাতে পারলো না। আদনানের ম্যানেজার কে ফোন করলো কিন্তু সে আর ফোন তুলল না। ব্যাপার টা তো রিতীমত ইনসাল্টিং এর পর্যায়ে চলে গেছে! জয়ীর ভীষণ রাগ হলো! একবার ভাবলো জুলিনা আন্টিকে ফোন করে সরাসরি আদনানের নাম্বার চেয়ে বসবে। তারপর নিজেই থেমে গেল। জুলিনা আন্টি যে টাইপ মানুষ, সে নিশ্চয়ই তিল কে তাল বানিয়ে ফেলবে। অনেক ভেবে ঠিক করলো বিকেলে জুলিনা আন্টির বাসায় যাবে। সেখানে আদনান ব্যটার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে হয়তো।
জয়ী নিজের আচরনে এবার খুব ই বিরক্ত হলো। ও শুধু শুধু আদনানের পিছনে লেগে আছে কেন! আর কেনই বা লিজার সঙ্গে জেদ করে আদনান কে টেনে আনলো! লিজার সঙ্গে ওর ইগোর লড়াই তো আজ নতুন না। কিন্তু আজ হঠাৎ এমন জেদ চাপলো কেন! কেনই বা উঠে পড়ে লাগলো আদনান ফয়সাল কে বন্ধু প্রমাণ করতে! না ব্যাপার টা বাড়াবাড়ির দিকে যাচ্ছে। এই বিষয়ে আর মাথা ঘামাবে না। জুলিনা আন্টির সঙ্গেও আর যোগাযোগ রাখবে না। আস্তে ধীরে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে।
***
আদনান দুদিন পর ই সিরিজ খেলতে চলে যাবে। এই সময় টা তাই বাড়িতে রিলাক্সেই আছে। প্র্যাক্টিস আর ঘর ছাড়া অন্য কিছুতে জড়াচ্ছে না। বিকেলের হালকা রোদ গায়ে মেখে ছাদের গাছপালার মধ্যে শুয়ে মেডিটেশন করছে। এই কাজটায় মন টাও শান্ত লাগে। আজ অবশ্য ও’কে বিরক্ত করার জন্য তাসিন আর নওশিন এসেছে।
আদনান চোখ বন্ধ করেই ওদের উদ্দেশ্যে বলল,
“মামীর ওখানে আমি যাচ্ছি না। তোরা যা। ”
তাসিন বলল,
“আমরা গেলেও আমাদের বিরক্ত করবে। ”
“দেখ পাগলখানায় যেতে কার ভালো লাগে!”
নওশিন বলল,
“তাহলে কী বলব?”
“বলবি আমি ব্যস্ত আছি।”
“এটা তো কমন অজুহাত ভাইয়া।”
“তাহলে আনকমন কোনো অজুহাত খুঁজে বের কর। তারপর বলিস। ”
ওরা আদনান কে আর বিরক্ত করলো না। আদনান এমনিতে শান্ত স্বভাবের। কিন্তু নিজের জেদে সবসময় অবিচল। যেটা একবার ভাবে সেটাই করে। কারো কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেয় না। অনেক বছর আগে একাডেমিক বই, পুস্তক ছেড়ে ব্যাট, বল হাতে নিয়েছিল। অনেকের অনেক বারন সত্যেও নিজের জেদ কেই গুরুত্ব দিয়েছে।
জুলিনা আদনান দের তিন ভাই বোনের জন্য অনেক কিছু করেছে। কথাবার্তার ধরন খানিকটা কর্কশ হলেও আদনান জানে এই মহিলাই পৃথিবীর একমাত্র মানুষ যে বাপ, মা মরা তিন টা ছেলেমেয়েকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে।
আদনানের জীবনে অনেকগুলো কঠিন ও খারাপ সময়ে এসেছে। আদনান সেই সময়টাতে অসহায়, ছেলে, ভাই হয়ে কেবল শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েই থেকেছে। সেই দিনগুলোতে জুলিনা না থাকলে ওর পথ টা আরও কঠিন হতো।
আদনান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জুলিনার মাথায় এখন আবার ওর বিয়ের ভুত ঢুকেছে। তাও আবার জয়ীতার সঙ্গে। আদনানের তো সন্দেহ হয় যে জয়ীতার মাথায়ও কোনো গন্ডগোল আছে কী না! আজ সারাদিন বাবলুকে ফোন করে বিরক্ত করেছে। আদনান ইচ্ছে করেই ফোন টা ধরতে বারন করেছে। মেয়েটা কী বলতে পারে সে সম্পর্কে ওর ভালোই ধারণা আছে। তাছাড়া আদনান আরও একটা ব্যাপার মনে করে, এতো বেশী প্রশ্রয় বোধহয় ও’কে দেয়াও ঠিক না।
তবে একটা ব্যাপার খুব ভাবাচ্ছে। ঘুরেফিরে বারবার জয়ীতার সঙ্গে ওর দেখা হচ্ছে কেন! দিল্লীতে দেখা হওয়া, জুলিনার সঙ্গে পূর্বপরিচিত। কেনই বা এই রহস্যময় কানেকশন!
***
বিকেল থেকে জয়ীকে ফোন করে করে অস্থির করে ফেলল জুলিনা। জয়ী যখন যেতে রাজী হচ্ছে না, তখনই জুলিনা বলে উঠলো,
“তাহলে আমি চলে আসি।”
জয়ী হাল ছেড়ে দিলো। এই নাছোড়বান্দা মহিলার সঙ্গে ও পারবে না। যেতেই হবে।
জয়ী ফোন করে সৌমিকেও ডেকে নিলো। দুজন মিলে জুলিনাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
***
দরজা খুলে যে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে তার বয়স আনুমানিক আশির উপরে। মাথায় অল্প ক’গাছা চুল। সব চুলই লাল রঙ। মেহেদী ব্যবহার করে নিয়মিত। ভদ্রমহিলা কপাল কুঁচকে খানিকক্ষণ দেখে অত্যন্ত কর্কশ গলায় বলল,
“কী চাও?”
সৌমি জয়ীর দিকে তাকালো। জয়ী বলল,
“জুলিনা আন্টি এই বাসায় থাকে না?”
ভদ্রমহিলা কর্কশ গলায় ডাকলো, ওই জুলেখায়ায়ায়া….
ডাক শুনে জুলিনা আন্টি এলো। এসেই জয়ীকে দেখে বলল,
“এটা কী কাপড় পইরা আসছ জয়ী?”
জয়ী নিজের দিকে তাকালো। মিলাদ আছে বলেই সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে। ওড়নাও আছে। তবুও এই পোশাকের মধ্যে ভদ্রমহিলা কী খারাপ খুঁজে পেল কে জানে!
জুলিনা বলল,
“আসছ যখন কী আর করার। আসো আসো। ”
জুলিনা সৌমিকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। জয়ী ভেতরের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুনলো,
বয়স্ক মহিলা ওদের কে গালি দিচ্ছে এই বাড়িতে আসার জন্য। জয়ী সৌমির দিকে তাকালো। সৌমি বেচারি খুব কৌতূহল নিয়ে সবকিছু দেখছে।
***
বসার ঘরে ঢুকে জয়ীর মন ভালো হয়ে গেল। তাসিন, নওশিন দুজনেই বসে আছে। জয়ীকে দেখে দুজনেই এসে জড়িয়ে ধরলো। ওর কী যে ভালো লাগছে! নওশিন বলল,
“এই ড্রেসে তোমাকে কিন্তু দারুণ লাগছে৷ তবে ওয়েস্টার্ন পরলে তোমাকে ছোট লাগে। ”
জয়ী হাসলো। জুলিনার বলা সেসময়ের কথা ভুলে গেল। তাসিন, নওশিনের সঙ্গে সৌমিরও আলাপ করে দিলো। সবমিলিয়ে এখন জয়ীর ভালোই লাগছে।
এখানে এসে জয়ী দুটো ভয়ংকর কথা জানতে পারছে। এক হলো, জুলিনার আসল নাম জুলেখা। একটু মডার্ন নাম রেখেছে সোসাইটির লোকজনের কারণে। আর মিলাদ বলতে যেরকম বড় কিছু ভেবেছিল সেরকম কিছু না। সাদামাটা আয়োজন। আর ওই বৃদ্ধ মহিলা জুলিনার মা। যিনি বিনা কারনে সবাইকে শাপ শাপান্ত করে বেড়াচ্ছেন।
জুলিনা তাসিন কে ডেকে বলল,
“আদনান কে ফোন কর।”
তাসিন চাপা গলায় বলল,
“ভাইয়া বিজি।”
“আমারে বিজি শিখাতে আসিস না। আমি জানি কিসের বিজি। ফোন দে, ওর সাথে দুইটা জরুরী কথা আছে। ”
তাসিন ফোন করলো, আদনান ধরতেই জুলিনা বলল,
“আমার একটা কথার ঠিকঠাক জবাব দে। তোর কী চিকন ঠ্যাংওয়ালা মেয়েগুলারে পছন্দ? ”
আদনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না মামী।
“ওসব পছন্দ করে লাভ নাই। তবে তোর হাবভাব আমার পছন্দ না। সামান্য একশ টাকার সিমের বিজ্ঞাপনের জন্য যে মডেলের সঙ্গে লালালালা করলি তার চেহারা দেইখাই ভাত খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়। ”
আদনান চুপ করে থাকলো। এই কথার পিঠে সৌজন্যমূলক কিছু যে বলবে সেটাও খুঁজে পাচ্ছে না।
জুলিনা আবারও বলল,
“তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়। জয়ীতা মেয়েটা তোর জন্য শাড়ি পরে এসেছে। তুই না এলে কষ্ট পাবে।”
তাসিন বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো। আদনান অবাক হলো। জুলিনা ফোন কেটে তাসিন কে বলল,
“দুই একটা মিথ্যা বললে কিছু হয় না। ভালো কাজের জন্য মিথ্যা বলাই যায়। ওই ভাত না খাওয়া মডেলগুলার হাত থেকে তোর ভাইরে উদ্ধার করতেছে। অমনে তাকায়ে থাকিস না ছেমরি।
চলবে….