#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-৩২
গাড়িতে উঠে আদনান এদিক ওদিক তাকিয়ে জয়ীকে জিজ্ঞেস করলো,
“ড্রাইভার কোথায়?”
জয়ী এক চোখ টিপে বলল,
“আমিই আজ ড্রাইভার। ”
আদনান অবাক গলায় বলল,
“সত্যি তুমি ড্রাইভ করবে? সিরিয়াসলি! ”
“এতো অবাক হবার কী আছে? আমি স্টিয়ারিং ধরতেও পারি। হাতা, খুন্তি ধরতে পারতাম না। সেটাও শিখে গেছি।”
আদনান হেসে বলল,
“ভেরি গুড।”
জয়ী ড্রাইভিং সিটে বসলো। পাশেই আদনান। জয়ী জিজ্ঞেস করলো,
“ভয় লাগবে না তো?”
আদনান গাঢ় গলায় বলল,
“না। তুমি আছ তো।”
হেমন্তের শেষের দিকে। শীত টা ভালো করে লাগতে শুরু করে নি। রাস্তাঘাট এখন অনেক ই ফাঁকা। আদনান ঘড়ির দিকে তাকালো। ছয়টা বেজে তেইশ মিনিট। আদনান গাড়ির কাঁচ টা খুলে দিলো। আজকের তারিখ টা ওর অনেক দিন মনে থাকবে। এতো মিষ্টি একটা সকাল এর আগে ওর জীবনে আসে নি। এভাবে কেউ গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে এমন টা স্বপ্নেও দেখে নি।
জয়ীতা ভালোই গাড়ি চালাচ্ছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে যে খুব একটা অভিজ্ঞ না। তবে মোটের উপর ভালো।
আদনান জয়ীতার দিকে তাকালো। হুডিটা খুলে ফেলেছে। গায়ে কালো রঙের টিশার্ট এখন। চুলগুলো সব একসঙ্গে গুছিয়ে উপরে উঠিয়ে বাঁধা। দেখতে ভালো লাগছে। তবে আদনানের মনে হলো জয়ীতাকে এলোমেলো চুলেই বেশী ভালো লাগে। এতো গোছানো চুলে স্নিগ্ধ যেমন লাগছে তেমনি শান্তও লাগছে। এলোমেলো চুলের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। দেখলেই মনে হয় বেপরোয়া।
জয়ীতা খেয়াল করলো আদনান ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অনীশও ক্যাবলার মতো তাকিয়ে ছিলো। এতো বিরক্ত লেগেছে! কিন্তু আজ একটুও বিরক্ত লাগছে না। ছিঃ ছিঃ ও কী তবে বেহায়া হয়ে যাচ্ছে!
আদনান হঠাৎ বলল,
“তুমি মনে হয় আগের থেকে রোগা হয়ে গেছ।”
জয়ীতা সামনের দিকে তাকিয়েই জবাব দিলো,
“আমি ডায়েটে আছি। বিয়ের পর একটানা খেয়েদেয়ে অনেক মোটা হয়ে গেছি। ”
আদনান বলল,
“ওহ! আমি ভাবলাম তুমি বুঝি আমার বিরহে রোগা পাতলা হয়ে গেছ। ”
জয়ীতা এক পলক তাকালো। তাকাতেই আদনান বলল,
“সামনে তাকাও। আমি অনেকগুলো সকাল এভাবে তোমার পাশে বসে যেতে চাই। এক্ষুনি মরতে চাই না।”
জয়ীতা সামনের দিকে তাকালো। ঠোঁটে লেগে থাকা মিষ্টি হাসিটা আটকাতে ব্যস্ত। আদনান নিঃশব্দে হাসলো। আবারও বাইরে তাকালো। মনে মনে বলল, এই পথ শেষ না হলেই ভালোই হতো।
****
জুলিনা আজ বোরখা পরে বেরিয়েছে। শেষ কবে বোরখা পরেছিল মনে নেই। গা কুটকুট করছে। ইচ্ছে করছে খুলে ফেলে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে। কিন্তু যে কাজে বেরিয়েছে সেই কাজ শেষ না করে কিছুতেই ফিরে যাবে না। জুম্মন আলী না কুব্বত আলী লোকটার একটা দফারফা করে যাবে। লোকটা সমানে ফোন করে দেখার করার জন্য মরে যাচ্ছে। আজ ও’কে আধমরা করে যাবে। কাঁধে যে জোলা টাইপ ব্যাগ আছে তার মধ্যে আছে আসল অস্ত্র। সিড়ি ঝাট দেয়া ঝাড়ু।
জুম্মন আলী নামের লোকটাকে দেখে জুলিনা হা হয়ে গেল। প্রথমেই যে কথাটা মাথায় এলো সেটা হলো এই লোক কী আসলেই মানুষের বাচ্চা! নাকি তালগাছের বাচ্চা! তালগাছ চিড়ে বের হয়েছে কী না কে জানে!
জুম্মন আলী জুলিনাকে দেখে চিনে ফেলল। এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
“মিস জুলেখা?”
জুলিনার তখনই ইচ্ছে করলো জুতা খুলে শপাং শপাং দিতে। মিস না মিসেস তাতে তোর দরকার কী! কিন্তু নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কে?”
“জুম্মন আলী।”
“কী চান? আলইম্যারে বলবেন আমার সাথে ফাজলামি করে লাভ নাই। আপনার মতো তালগাছ ওয়ালা উকিল মোক্তার আমি বহু দেখছি। ঝামেলা করলে কোনো টাকা পয়সা পাবে না।”
জুম্মন আলী বুঝতে পারলেন না আলইম্যা কে। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“জি কার কথা বলছেন?”
জুলিনা ধপাস করে চেয়ারে বসলো। কাঁধের ব্যাগ টা লাফিয়ে মাটিতে পড়লো। ভাঙা ঝাড়ুর এক কোনা বেরিয়ে গেল। জুম্মন আলী স্পষ্ট দেখলেন। তিনি কী বুঝলেন কে জানে! গড়গড় করে সব বলে দিলেন। মেট্রিমোনি সাইটে জুলিনার খোঁজ পেয়েছে। জয়ীতার সঙ্গে কথা বলে মোবাইল নাম্বার নিয়েছে। জুলিনা নিজের কান কে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলেন না। পরে জুম্মন আলীর মোবাইলে মেট্রিমোনি সাইটের গ্রুম ওয়ান্টেড পোস্ট দেখলেন। অল্পের জন্য বেহুশ হয় নি। এবার সবকিছু ক্লিয়ার। বাচ্চা নওশিনের বদলে তার মানে ওর বিয়ের পোস্ট দেয়া হয়েছে!
***
আদনান ওয়াশরুমে ঢুকে জয়ীতাকে ডাকলো। জিজ্ঞেস করলো,
“জয়ীতা এখানকার আয়না কেন সরিয়েছ?”
জয়ীতা নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“আমার ওই আয়নাটা পছন্দ না।”
“তাহলে এখানে আর আয়না লাগাবে না?”
“আপনি লাগিয়ে নিন।”
আদনান বুঝতে পারলো না আয়না বিষয়ক ঘটনা। তবে বোঝার চেষ্টাও করলো না।
আদনান সারাদিন, বিকেল ঘুমিয়ে কাটালো৷ সন্ধ্যেয় খানিকক্ষন কথাবার্তা বলে আবারও ঘুমালো।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই প্রথম চমক টা পেল। পাশে জয়ীতা নেই। ঠিক ও যেমন করে জয়ীতার জন্য চা রেখে দিতো জয়ীতাও তেমন করে রেখে দিয়েছে। আদনানের যেমন ভালো লাগলো তেমনি চমৎকৃত হলো। বারান্দার গাছগুলোতেও পানি দিয়েছে। ঘরে, বারান্দায় কোথাও জয়ীতা নেই। আদনান চায়ের কাপের পাশে ছোট চিরকুট রাখলো। সেখানে লিখলো,
“আমিও প্রতিটি সকালে তোমার মতো করে এভাবেই মিস করেছি। ”
****
পত্রিকার আজকের লেখাটা পড়ে জয়ীতার একটু মন খারাপ হয়েছে। বিয়ের পর আদনান ফয়সালের পারফরম্যান্স তুলনামূলকের চেয়েও বেশী খারাপ। অনলাইন পোর্টালে কেউ কেউ নেগেটিভ কমেন্টও করেছে। দুয়েকটা ওর চোখে পড়েছে। বউটা আদনানের জন্য আনলাকি।
জয়ীতা এসবে বিশ্বাস না করলেও ওর মন খারাপ হয়েছে। এই মন খারাপ থাকার কারণে বাসা থেকে বেরিয়েও এসেছে। বাসায় থাকলে বাকীরাও ওর মন খারাপ ভাব বুঝে ফেলবে। লোকে অনেক কিছু বলে ঠিকই, সেগুলো কানে না তুললেই হয়। তবুও এই বিষয়ে এতো মন খারাপ হয়ে গেল!
আদনান বারবার ফোন করছে কিন্তু জয়ীতা ফোন টা ধরছে না। কথা বলতে ভালো লাগছে না।
জয়ীতা ফোন ধরছে না বলে আদনান জয়ীতাকে টেক্সট পাঠালো,
জয়ীতা,
প্রথমেই সরি বলে নেই। তুমি এমন একজন মানুষ কে বিয়ে করেছ যে আর দশ টা ছা পোষা সাধারণ মানুষ এর মতো না। আমি যতই ডাউন টু আর্থ থাকতে চাই না কেন, কিছু লোকের কাছে সেলিব্রিটি হিসেবেই পরিচিত। এরা ভাবে সেলিব্রিটিদের দুঃখ, কষ্ট নেই। এদের বুকের বা পাশে হৃদয়ের বদলে কঠিন পাথর থাকে। খেলায় হার জিত থাকে এই বিষয় টা অনেকেই বুঝতে চায় না। ক্রিকেট অনেকের কাছেই কঠিন এক আবেগ। ভালো পারফরম্যান্স হলে এরা যেমন মাথায় তুলে নাচে, খারাপ হলে জুতা মারতেও ভুলে যায় না। তবে সবটার সঙ্গেই কিন্তু আবেগ জড়িত। আমার কাছে বিষয় টা স্বাভাবিক। তোমার কাছে বিষয় টা খারাপ লাগবে জানি। আমি এর আগে যখন খারাপ খেলেছি তখন শুনতাম আদনান ফয়সাল গার্লফ্রেন্ড এর পিছনে সময় বেশী দেয় বলে খেলা খারাপ হচ্ছে। অথচ আজ অবধি আমি কখনো প্যাশনের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করিনি। কখনো করবও না। তবুও স্ট্রেস তো থাকেই। আশা করি বিষয় টা বুঝতে পারছ। আমি কিন্তু ভীষণ রেগে গেছি। তোমাকে প্রাপ্তমনস্ক বলেই জানতাম।
তবে একটা ব্যাপার সত্যি, গ্যালারিতে তুমি থাকলে আমি আরও একটু ভালো খেলতাম। (চোখ টেপার ইমোজি)।
জয়ীতা এই ম্যাসেজ পেয়ে আর দেরি করলো না। বাড়ির দিকে ছুটলো।
ঘরে ঢুকে কোনোদিকে না তাকিয়ে আদনান কে খুঁজতে গেল। আদনান কে পেয়ে গেল বারান্দায়। জয়ীতা একটা কথাও না বলে আদনান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
চলবে….