#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-৩০
জুলিনার মেজাজ খারাপ ভাব কয়েকদিন ধরে। তার উপর মায়ের সকাল থেকে একই গান বেজে যাচ্ছে। তুই মর, তোর কলেরা হউক। আজ মেজাজ টা এতো খারাপ হলো যে ইচ্ছে করলো সব ছেড়েছুড়ে জনমানব শূন্য এলাকায় থাকতে।
মেজাজ খারাপ হবার আরেকটা কারণ হচ্ছে জয়ীর সঙ্গে সেদিনের পর আর ভাব হয় নি। ফাজিল মেয়েটা ও’কে ফোন পর্যন্ত করছে না। রাগ ভুলে নিজে ফোন করবে সেটাও পারছিল না। গত রাতে তাই ফন্দি আঁটে যে অন্য নাম্বার থেকে ফোন করে ভয় দেখাবে। যেমন টা আলম সাহেব কে দেখিয়েছিল! কিন্তু যেই ফোন করলো, জয়ী রিসিভ করে বলল,
“ব্যস্ত আছি আন্টি। আর আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। জ্বিনের বাদশাহর নাম্বার আমার ফোনে আগে থেকেই আছে। ”
জুলিনা ফোন রেখে সাথে সাথে বিছানা ছাড়লো। ঘরে পরা স্যান্ডেল দিয়ে নিজের বিশ্ববিখ্যাত কপালে মারলো পর পর দুবার।
সেই মেজাজ খারাপ ভাব এখনো যায় নি। খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত কিছু করে নি।
জুলিনার মেজাজ খারাপ ভাব ছিলো সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যা বেলা মেজাজ ফুরফুরে হয়ে গেল। জয়ীতা ওর পছন্দের খাবার রান্না করে পাঠিয়েছে। সেই সঙ্গে ছোট চিরকুট। যেখানে লেখা,
“রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। এখন সিদ্ধান্ত আপনার। রাগবেন নাকি হারবেন!”
জুলিনা হাত, মুখ ধুয়ে খেতে বসে গেল। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাগ পানি হয়ে গেল। পেটের কোনাকানি ভর্তি করে খেয়ে লম্বা ঘুম দিলো।
****
জয়ীতা বসে আছে আলম সাহেবের সামনে। ওর এক পাশে তাসিন, অন্যপাশে নওশিন। ওদের দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই মেজাজ খারাপ হয়েছে। জয়ীতা অবশ্য ঠান্ডা আছে। আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ঠান্ডাই থাকবে। এখানে আসার একটা কারণ হচ্ছে আলম সাহেবের সঙ্গে ডিল করা।
আলম সাহেব বিশ্রীভাবে নাক খুটছেন। নাক খোটার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করে এবার চায়ের কাপের দিকে হাত বাড়ালেন। জয়ীতাদের চায়ের অফার করলেও ওরা নিলো। আলম সাহেব শব্দ করে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। হাবভাবে মনে হচ্ছে জগতের সবচেয়ে জঘন্য জিনিস টা গলাধঃকরণ করছে। আফসোসের সুরে বলল,
“সংসার খরচ দিন দিন বাড়তেছে। তাতে দুধ চা খাইলে পোষায় না। তাই লিকার চা খাইতেছি। ”
জয়ীতা বলল,
“আপনার এই বয়সে ক্যাফেইন জিনিস টা এড়িয়ে চলা উচিত। চা একদম পরিহার করা উচিত। ”
সেই কথার কোনোরকম গুরুত্ব না দিয়ে আলম সাহেব বলল,
“টাকা, পয়সা সব বাজা মেয়ে মানুষটার কব্জায়। নাহলে আজকে এই অবস্থা হইতো না। ”
জয়ীর ঠান্ডা মেজাজ এবার খুব গরম হলো। বলল,
“তা আপনার টাকা পয়সার সমস্যা সেটা আপনাকে দেখে তো বোঝার উপায় নেই। বিশাল একখানা ভুড়ি বানিয়েছেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে যা দেখেছিলাম এখনো তো সেরকম ই দেখছি। ”
আলম সাহেব হকচকিয়ে গেলেন। তাসিন চোখ বড় করে তাকালো। নওশিন জয়ীর হাত ধরলে ও ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আপনার সময় নষ্ট করব না। যে কাজে এসেছি সেটা বলে বিদায় হবো। ”
আলম সাহেব জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। জয়ী বলল,
“আপনি জুলিনা আন্টিকে ডিভোর্স দিবেন।”
আলম সাহেব দায়সারা গলায় বলল,
“ক্যান?”
“কারণ মামীর আবার বিয়ে দেব। ”
আলম সাহেব ঠোঁট বাকিয়ে একটু হাসলো। এরপর দাঁত খোচাতে শুরু করলো। চা খেয়েও যে কারো দাঁত খোঁচানোর প্রয়োজন আছে সেটা ওনাকে দেখে বোঝা গেল। এরপর বলল,
“ডাইফোজ দেব আগে আমার পয়সাপাতি বুঝায়ে দিক।”
ডিভোর্স শব্দটা যে ডাইফোজ হয়ে গেছে সেটা বুঝতে জয়ীর একটু সময় লাগলো।
জয়ী এবার ঠান্ডা গলায় বলল,
“মামা শুনুন, ঝামেলা করবেন না। এমনিতেই ওই মহিলা আপনাদের লাইফে অনেক ঝামেলা করতেছে। ডিভোর্স হয়ে গেলে জুলিনা আন্টি এই বাসায় আসার সাহসও পাবে না।”
এবার আরেকটা নারীকন্ঠ বলে উঠলো, কথা সত্যি।
জয়ী পিছু ফিরে দেখলো আলম সাহেবের বউ দাঁড়িয়ে আছে। জয়ী বলল,
“আপনি আঁড়ি পেতে কথা শুনছেন কেন? এখানে আসুন। এখানে এসে তারপর শুনুন। ”
ভদ্রমহিলা এবার সামনের এসে বলল,
“আপদ বিদায়ের ব্যবস্থা নাও। রোজ রোজ পাগলের পাগলামি ভালো লাগে না। কোনদিন দেখা যাবে কুমড়োর মতো ফালা ফালা করে কাটবে।”
জয়ী বলল,
“সেটাই আপনার হাজবেন্ড কে বুঝাও। ”
আলম সাহেব হাই তুলে বলল,
“আদনান আসুক। তার সাথে কথা বলব। পয়সাপাতি বুঝায়ে দিয়া বাজা মহিলা জাহান্নামে যাক। ”
তাসিন এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাবী চলো। ”
নওশিনও বেরিয়ে গেল। জয়ীতা যেতে যেতে বলল,
“আদনানের সাথে কী বুঝবেন হুহ! আর আদনান কে? আমিই এখন ঘরের চেয়ারম্যান। ”
****
আগে জীবনেও জয়ীতা আগ্রহ করে ক্রিকেট ম্যাচ দেখেনি। কিন্তু এখন দেখছে। তাসিন, নওশিন কে ডেকেছে কিন্তু ওরা দেখতে রাজী হয় নি। কারণ এর আগে ওরা যতবার আদনানের ম্যাচ দেখতে বসেছে ততবারই হেরে গেছে। তাই একাই শেষ পর্যন্ত দেখতে বসে গেছে। চকলেট, চিপস, নানারকম খাবার সাজিয়ে নিয়েছে চারপাশে। এক সেকেন্ডের জন্যও কোথাও যাবে না।
কিন্তু ওর ভাগ্যটাই খারাপ। সত্যিই ম্যাচ টা হারলো। ওর এতো মন খারাপ লাগলো যে আর কিছু খেলই না রাতে।
আদনান কে ফোন করে বলল,
“আজকের ম্যাচ টা আপনারা আমার জন্য হেরেছেন।”
আদনান বিস্মিত গলায় বলল,
“মানে? এসব কেন বলছ?”
“কারণ আমি খুব আগ্রহ নিয়ে টিভির সামনে বসেছিলাম। ”
আদনান নিঃশব্দে হাসলো। এতো ভালো লাগলো কথাটা শুনে। ইচ্ছে করলো ও’কে একটু জ্বালাতে।
জয়ী জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার কী মন খারাপ? ”
“একটু। ”
জয়ী চুপ করে রইলো। আদনান জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার কী অবস্থা? হাত পা ছড়িয়ে খুব ঘুমাচ্ছো মনে হচ্ছে!”
জয়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আর ঘুম। কাল রাতেও খাট থেকে পড়তে যাচ্ছিলো। ও বলল,
“শুনুন, আপনার অস্কারের সঙ্গে আমার ভাব হয়েছে। চোখ, মুখ শক্ত করে তাকায় না। ”
“বাহ! তোমার সঙ্গে তো সবারই সদ্ভাব। শুধু আমি ছাড়া। ”
“কেন আমি কী আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করি?”
“তা করো না। কিন্তু দেখতে তো পারো না। এই যে আমি চলে এলাম দেখে খুশিতে নাচতে শুরু করে দিয়েছিলে!”
জয়ীতার মন খারাপ হলো। ইশ! এমন টা করা ঠিক হয় নি। ও আবারও বলল,
“বারান্দার কাঠগোলাপ গুলোয় কিন্তু আমিই পানি দেই প্রতিদিন। ”
“ভেরি গুড।”
ফোনের ওপাশ থেকে থেকে আদনানের বলা ভেরি গুড শুনে ওর মন আরও খারাপ হয়। কাঠগোলাপ গাছে পানি দিয়ে ও আদনান কে বোঝাতে চায় যে ও ভালো হয়ে গেছে। রোজ সকালে তাড়াতাড়ি উঠে।
আদনান ফোনের ওপাশে কান খাড়া করে থাকে। কথার আওয়াজ যেমন নেই তেমনি নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যায় না। খুব শুনতে ইচ্ছে করছে জয়ীতার মুখে যে, ওকে খুব মিস করছে।
জয়ীতাও চুপ করে থাকে। অপেক্ষা করে আদনান কখন বলবে, আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব।
আদনান বলে,
“এখন রাখছি। আমাকে আবার সকাল সকাল উঠতে হবে।”
জয়ীতাও বলল,
“আচ্ছা। ”
***
আদনানের রাতে একটুও ঘুম হলো না। একটু পর পর ফোন দেখতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো, এতো পাগলামী করে অন্যসময়! এখন একটু ফোন করে জ্বালাতে পারে না!
অন্যদিকে জয়ীতা বারবার নাম্বার ডায়াল করেও কেটে দিচ্ছে। এই নিয়ে উনসত্তর বার হলো। অথচ ফোন দেয়ার সাহস হচ্ছে না।
চলবে…..