#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-২৯
আদনান কে এবার সাউথ আফ্রিকা সিরিজ খেলতে একা যেতে হচ্ছে। স্পাউজ এলাউড না। এই নিয়ে ওর কিঞ্চিৎ মন খারাপ আছে। তবে সেটা দেখে বোঝার উপায় নেই। জয়ীর অবশ্য এতে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তবুও একবার মুখ ফসকে বলে ফেলল, আপনি না থাকায় আমার অনেক সুবিধা হবে। হাত, পা ছড়িয়ে ভালোভাবে ঘুমাতে পারব। অনেক রাত জেগে লাইট জ্বালিয়ে মুভি, সিরিজ দেখব।
আদনানও তাল মিলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ ভালোই তো। লাফালাফি করে খাট থেকে পড়েও যেতে পারবে। ”
“ইশ! বাজে কথা বলবেন না। আমার ঘুমানোর স্টাইল টা একটু খারাপ। সেটা আমি স্বীকার করি। ”
আদনান আর কথা বলল না। ওর খানিকটা অভিমান হলো। জয়ীর খারাপ না লাগুক তাই বলে ও না থাকায় এতো ভালো লাগবে! আদনান সিদ্ধান্ত নিলো ও শক্ত হয়ে থাকবে। তাও যেমন তেমন শক্ত না। দাঁত ভাঙা টাইপ শক্ত। আদনান কথা বলা কমিয়ে দিলো। একদিন বাদে ওর যাবার ডেট। আজই সমস্তরকম কথাবার্তা বলা বন্ধ করলো। বিকেলে বাসায় যেটুকু সময় থাকতো সেটাও আজ বন্ধ। গাড়ি নিয়ে একাই বেরিয়ে গেল। কতো বড় একটা কথা, আপনি না থাকলে আমার সুবিধা হবে! হুহ!
আদনান কে বিয়ে করার কারণে জয়ীতা বিশেষ কিছু সুবিধাও পাচ্ছে। সুজয় সরকারের এসিট্যান্ট থেকে সোজা এক লাফে দেশের অন্যতম খ্যাতিমান পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেল। এই সুবিধাটুকু ভোগ করতে ওর অবশ্য খারাপ লাগছে না। জীবনে যা কিছু আসে সেটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। মানুষ তো কেবল উছিলা। তবে এই ব্যাপারের জন্য জয়ীতা আদনানের উপর কৃতজ্ঞ। তাছাড়া এই মুহুর্তে আদনান যদি ও’কে দেশের বাইরে যেতে বলতো তাহলে খুব অসুবিধায় পড়ে যেত। সামনে ওর কতো কাজ। জুলিনার বিয়ের ব্যাপার টা সেট করতে হবে। কতোকিছু যে ম্যানেজ করতে হবে তার তো হিসাব ই নেই। তাই সব মিলিয়ে আদনানের সঙ্গে না যেতে পেরে খুব খুশি।
***
যাবার আগের রাতে আদনান নিজের সব জিনিস নিজেই গুছিয়ে নিলো। জয়ী একবার জিজ্ঞেস করলো,
“আমি কী হেল্প করব?”
আদনান হাতের কাজ করতে করতেই জবাব দিলো,
“আমার কাজ আমি করতে পারি। ”
“সে তো জানি আপনি পন্ডিত। তবুও কোনো হেল্প লাগবে কী না?”
“না। আমি নিজের কাজ নিজেই করতে পছন্দ করি। ”
জয়ী ভেংচি কাটলো আদনানের অলক্ষ্যে।
রাতে ঘুমানোর সময় আদনান বলল,
“আমি না থাকা অবস্থায় একটু সামলে ঘুমিও। একটা কিছু এক্সিডেন্ট ঘটিও ফেলো না আবার। আর সিড়ি বেয়ে নামার সময় কাউকে পাশে রেখো। ”
জয়ীর চোখ মোবাইলে। সেদিকে তাকিয়েই বলল,
“এক কাজ করলেই তো হয়। একজন লোক রেখে দিন আমার জন্য। যে সবসময় কোলে করে সিড়ি থেকে নামাবে। ”
আদনান হেসে ফেলল শব্দ করে। ওর রাগ পানি হয়ে গেছে। এই মেয়ের সঙ্গে রেগে থাকা যাচ্ছে না। আদনান হাসি থামিয়ে জয়ীর দিকে ফিরলো। হাত ভাজ করে তাতে মাথা রেখে বলল,
“আচ্ছা একটা কথার জবাব দাও তো। সত্যি জবাব দিবে কিন্তু। ”
“আমি সত্যি কথা তেমন একটা বলি না। সবসময় মিথ্যেই বলার অভ্যাস। ”
“তাহলে বরং মিথ্যেই বলো। আমার অনুপস্থিতিতে কী তুমি আমাকে মিস করবে?”
“একদম ই না।”
আদনান নিঃশব্দে হাসলো। বলল,
“সাউথ আফ্রিকা থেকে ফিরে আমি তোমাদের বাড়ি যাব। তোমার বাবা, মা এতো করে বলছে….
জয়ীতা কথা শেষ করতে দিলো না। বলল,
“আপনি একা যাবেন। আমি যাব না।”
আদনান চুপ করে রইলো কিছু সময়। তারপর টেবিল লাইট টা অফ করে দিয়ে বলল,
“তুমি কেন যেতে চাইছো না সেই প্রশ্ন আমি করব না। তবে যদি যাই অবশ্যই তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব। ”
জয়ীর কথা বলতে ভালো লাগছে না। একটুও ভালো লাগছে না। তাই চুপ করে রইলো। আদনানও আর কথা বলল না।
***
পরদিন যাবার সময় জয়ী আদনান কে বলল,
“আমি আপনার সঙ্গে এয়ারপোর্টে গেলে সমস্যা আছে?”
আদনান খানিকটা অবাক হলো। বলল,
“না সমস্যা নেই। কিন্তু কী মনে করে যেতে চাচ্ছো? ”
“অনেক ছবি তুলতে। নিজের ছবি পত্রিকার পাতায় দেখতে ভালোই লাগে। নিজেকে হিরোইন টাইপ মনে হয়। ”
আদনান মৃদু হেসে বলল,
“আচ্ছা।”
জয়ীতার সঙ্গে তাসিন, নওশিনও গেল। ওরা গাড়িতেই থেকে গেছে। গাড়ি থেকে বের হয় নি। জয়ীতা গাড়ি থেকে বের হলো। এমনকি এয়ারপোর্টেও গেল।
ফিরে আসার সময় হঠাৎ ওর মন টা এতো খারাপ হলো! আদনান কে বলতে ইচ্ছে করলো,
“শুনুন, আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। আপনার যাওয়ার দরকার নেই। ”
কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না।
আদনান ভেতরে ঢুকে যাবার সময় ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। ও হাসার চেষ্টা করলো। আদনান হাত নেড়ে ইশারায় বলল, সাবধানে যেও।
জয়ীতা হাসলো। মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করলো। আদনান ভেতরে ঢুকেও একবার পেছনে ফিরে ওর দিকে তাকালো। এই জয়ীতা ওর কাছে অচেনা। চোখ, মুখের ধরন, এমনকি হাসিটাও অন্যরকম লাগছে। একদম অন্যরকম।
গাড়িতে যাবার সময় জয়ীর মন খারাপ ভাব টা তাসিন, নওশিনও খেয়াল করলো। নওশিন বলল,
“ভাবী মন খারাপ কোরো না। ”
জয়ী হাসার চেষ্টা করে বলল,
“মন খারাপ করতে চাইছি না। তবুও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ”
তাসিন বলল,
“এটাই স্বাভাবিক ভাবী। চিন্তা কোরো না, ফোন আছে তো! ভাইয়াকে সারাক্ষণ জ্বালিয়ে মারবে ফোন করে। ”
জয়ী হাসলো। নওশিন বলল,
“সিনেমা দেখতে যাবে? তাহলে মন ভালো হয়ে যাবে দেখো। ”
জয়ী ক্লান্ত গলায় বলল,
“নাহ! কিছু ভালো লাগছে না। ”
***
আদনান কে ছাড়া এই বাসায় এই প্রথম সকাল জয়ীর। আদনান নেই আজ ওর হাত, পা ছড়িয়ে ঘুমানোর কথা। কিন্তু রাতে এক ফোঁটা ঘুমও হয় নি। ভোরের দিকে ঘন্টাখানেক ঘুম হলেও আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পর বিছানার পাশের জানালার কাঁচ সরিয়ে দিলো। কাকের কর্কশ গলায় কা কা ডাকের শব্দে মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেল। মাত্র সকাল টা শুরু হয়েছে অথচ রোদটাও কেমন ওর চোখেই এসে পড়েছে। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ খুঁজতে গেলে মনে হলো যে চা রাখা মানুষ টা আজ বাসায় নেই।
ডাইনিং এ গিয়ে নোট পেল। লেখা সেখানে,
“ভাবী ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি। ক্লাস নেই, অন্য কাজ আছে। সরি ভাবী। ”
সকালের চা’টা নিজেই বানিয়ে গেল। প্রথম চুমুকেই মনে হলো, এমন জঘন্য চা ও জীবনে কোনোদিন খায় নি।
চায়ের কাপ ওভাবে রেখে বারান্দায় বসলো। খানিকটা বসে আবার উঠেও গেল। কাগজ নিয়ে সেখানে লিখলো,
“আপনাকে খুব মিস করছি। আপনি ছাড়া এই বাসার সকাল টা ভীষণ বাজে। বিরক্তি ধরিয়ে দেবার মতো বাজে। ”
কাগজ টা ওয়াশরুমের আয়নার সঙ্গে লাগিয়ে রাখলো।
বড়বেলায় এই প্রথম অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে জয়ীতার। একদম অন্যরকম অনুভূতি। সেটা কী শুধুই বৈবাহিক বন্ধনের কারণে নাকি মানুষ টা আদনান বলে!
চলবে…..