#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-২২
সকাল থেকে বৃষ্টি। প্রথমে অল্পস্বল্প হলেও যত বেলা হলো বৃষ্টি ততো বাড়তে লাগলো। আদনান বেরিয়ে গেল ওর কাজে। তাসিনও ইউনিভার্সিটি তে গেল। নওশিন থেকে গেছে জয়ীর জন্য। জয়ী বাড়িতে নওশিনের সঙ্গে সময় কাটালো। এই দুদিনে জয়ী তাসিন, নওশিন কে ভালোভাবে অবজার্ভ করেছে। তাসিন খানিকটা দুষ্ট। মিষ্টি টাইপের কিছু দুষ্ট ছেলেমেয়ে থাকে না তেমন। আর নওশিন পুরোপুরি শান্ত টাইপ। সবাই কে আগলে রাখে। কিছুটা মা মা টাইপ। সবার খেয়াল রাখে, যত্ন নেয়। গুরুজন ছাড়া এই সংসার টা গুছিয়ে রেখেছে নওশিন ই।
আদনানের সঙ্গেও ওদের খুব ভালো বন্ডিং। জয়ীতার সঙ্গে ওর ভাইয়ের বন্ডিংও ভালো। তবে সেটা ওই গার্ডিয়ান টাইপ। ফ্রেন্ডলি না।
এই বাড়িতে জয়ীতার দুটো দিন ভালোই লাগছে। ভালো লাগবে সেটা অবশ্য আগে থেকেই জানতো। ওর নিজের খুব ভালো একটা গুন হচ্ছে যেকোনো জায়গায় মানিয়ে নিতে পারে।
আর আদনান! আদনানও বোধহয় ভালো। আজ সকালের চা’টা আদনান বানিয়েছে। জয়ীর খুব ভালো লেগেছে। কাজ ছাড়া সকালে ওঠা হয় না বলে এমন বৃষ্টিমুখর সুন্দর সকাল দেখাও হয় না। জয়ীর চা খাওয়া অবস্থায়ই আদনান ঘরে ঢুকেছে। ঢুকে ও’কে বলল,
“গুড মর্নিং। এতো সকালে উঠলে যে?”
জয়ীতার মেজাজও ফুরফুরে ছিলো। আদনান জয়ীর পাশেই বসলো। জয়ী বলল,
“জানালা খুলে রেখেছেন না উঠে উপায় কী?”
আদনান জয়ীতার দিকে গভীর চোখে তাকালো। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ঘুম থেকেও উঠলেও মুখ টা স্নিগ্ধ লাগছে। জয়ী আদনান কে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“আমি যে এতো সুন্দর জানতাম না তো। ”
কথাটা বলে নিজেই লজ্জা পেল। ইশ! কিরকম সস্তা টাইপ কথাবার্তা! ছিঃ ছিঃ! থার্ড গ্রেডেড ফিল্মের নায়িকাদের মতো কথাবার্তা।
আদনান মৃদু হেসে বলল,
“জানালা খুলে এতো সুন্দর সকাল টা দেখে ভাবলাম তুমিও দেখো। ”
জয়ী আদনানের দিকে না তাকিয়েই বলল,
“থ্যাংকস। ঘুম ভাঙানোর জন্য না, চায়ের জন্য। তবে এভাবে রোজ রোজ আমার ঘুম ভাঙালে কিন্তু মাথা গরম হয়ে যাবে। ”
আদনান বলল,
“আমরা সবাই সকালে একসঙ্গে চা খাই। বিকেলেও এমন। যদি বাড়িতে না থাকি তখনকার বিষয় টা আলাদা। তুমি ঘুম থেকে সন্ধ্যেবেলা উঠলেও ঠান্ডা চা পাবে৷ কারণ আমরা যে সময়ে খাব তোমার জন্যও রাখব। তুমি আলাদা কেউ না, আমাদেরই একজন। ”
জয়ী তাকালো। আদনান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি বাইরে যাচ্ছি, তোমার কিছু লাগবে?”
জয়ী একটু ভেবে বলল, না লাগবে না।
“তোমার যেকোনো কিছু দরকার হলে বেলায়েত আঙ্কেল কে বলবে। বেলায়েত আঙ্কেল এই বাড়ির কেয়ারটেকার। ”
জয়ী হ্যাঁ, না কিছু বলল না। আদনান বেরিয়ে যাবার পর জয়ীর মিশ্র অনুভূতি হতে লাগলো। একটা মানুষ একটু বদমায়েশ হলে তার সঙ্গে অনেক খানি বদমায়েশী করা যায়। আদনান তো সেই সুযোগ টা’ই ও’কে দিচ্ছে না। ও তো ভেবেছিল বিয়ের পরদিন থেকেই আদনান কে বিরক্ত করে মারবে। তারপর আদনান ও’কে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে। তার পরের জীবন ও যেমন চায় ঠিক তেমনই হবে। একজন সফল পরিচালক। ঝুলিতে একের পর এক হিট ছবি। উফ! কবে যে আসবে সেদিন।
***
আদনান বাইরে বেরিয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে। ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম আজ নতুন কিছু না। সবসময়ই এমন। আগে ও গাড়িতে যেতে যেতে গান শুনতো কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় খানিকক্ষণ সময় কাটাতো। আজ সেসব কিছু ভালো লাগছে না। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনলেও ওর ভাবনায় বিচরন করছে জয়ীতা। প্লে স্টোর থেকে একের পর এক গান প্লে হয়ে শেষ হলেও আদনানের মনোযোগে অন্যকিছু। এরকম উতলা হবার কী কোনো মানে হয়! কাজ শেষ করে সেই তো বাসায় ই যাবে।
আদনান একবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। এতোটা অধৈর্য্য বোধহয় এর আগে কখনো হয় নি। আদনান নওশিন কে ফোন করলো। জয়ীতাকে ফোন করা যেত কিন্তু সেটা না করে নওশিন কে ফোন করাই ভালো মনে করলো।
নওশিন ফোন ধরে বলল,
“হ্যালো ভাইয়া।”
আদনান কথা ভুলে গেল। বলল,
“কিছু না। জাস্ট, এমনিই ফোন করা আর কী। কী করছিস তোরা?”
নওশিন মৃদু হেসে বলল,
“কিছু না। ”
আদনান একটু চুপ করে থেকে বলল,
“আচ্ছা রাখছি। ”
“আচ্ছা। ”
হঠাৎ মনে পরে গেল এমন ভাব করে বলল,
“এই জয়ীতা কী করছে রে?”
নওশিন নিঃশব্দে হাসলো। এই একটা কথা জিজ্ঞেস করবে বলে ফোন করেছে। অথচ এমন ভাব করছে যেন হঠাৎ মনে হলো।
নওশিন বলল,
“ভাবী মনে হয় শাওয়ার নিতে ঢুকেছে। ডেকে দেব?”
“না। জাস্ট র্যান্ডমলি জিজ্ঞেস করা। ”
“আচ্ছা। ”
“আচ্ছা রাখি। ”
আদনান ফোন রেখে নিজেই অপ্রস্তুত হলো। এরকম কী সবার সঙ্গেই হয়! নাকি ও একাই বেহায়া!
*****
জুলিনার মেজাজ টা খুব খারাপ। আজ ও আদনান দের বাসায় যাচ্ছে। নওশিন কে ফোন করে বলেছে দুপুরে রান্না করার দরকার নেই। ও খাবার নিয়ে যাবে। বাইরে যখন বেরোলো তখন বৃষ্টি নেই। খানিকদূর যাবার পর বৃষ্টি শুরু হলো। যদিও গাড়িতে করে যাচ্ছে তবুও মেজাজ খারাপ লাগছে। এতো গরীব দেশে বৃষ্টি হবার কী দরকার! বৃষ্টি হবে দার্জিলিং টাইপ জায়গায়।
জুলিনা বাসার সামনে এসে পড়লো বিপাকে। গাড়িওয়ালা কে ভেতরে নেয়া যাবে না তাই হেটে যেতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো ওঁর ড্রেস। আজ ওঁ পরেছে বোরখা টাইপ একটা ড্রেস। এই ড্রেসের নাম দোকানদার ও’কে আরাবিয়ান ড্রেস বলে বিক্রি করেছে। যদিও কিনেছে গুলশানের এক ফুটপাত থেকে। সবাই কে বলেছে উত্তরার ফড়িং থেকে কেনা। ড্রেস টা’র একটা সুবিধা হলো বোরখা টাইপ হওয়ায় ঘরের জামাকাপড় এর উপর পরেও বের হওয়া যায়। এই ড্রেসের সঙ্গে হিজাব পরেছে। হিজাব পরার কারণ অবশ্য ওঁর চুল। অ*সভ্যের মতো একদল মানুষ আছে যারা ফ্যাশন না বুঝে হাসে। তাদের জন্য এই ব্যবস্থা। অবশ্য ওঁর কাছে খারাপ লাগছে না। তাছাড়া জয়ীতাও বলেছে ভালো লাগছে। তার মানে নিশ্চয়ই ভালো।
গেট দিয়ে ঢোকার সময় অস্কার জুলিনাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো৷ ভিন্ন রকম গেটাপের কারনে অস্কার জুলিনাকে প্রথমে চিনতে পারলো না। জুলিনা হিজাব খুলে এক ধমক দিলো। বলল,
“এই হা*রামজাদা ভেউ ভেউ বন্ধ কর। চাপকায়ে সিধা করে দেব। ”
অস্কার পরেরবার আরেকটু কম গতিতে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। যার অর্থ জুলিনাকে সে চিনতে পারছে।
***
জয়ীতা জুলিনাকে দেখে বলল,
“আন্টি এটা কী পরেছো? পি*শাচিনী ড্রেস?”
জুলিনার মুখ টা ছোট হয়ে গেল। বলল,
“চুপ বেক্কল! এটা আরাবিয়ান ড্রেস? ”
“না আন্টি। আমি যে প্রোডাকশনে এসিস্ট করেছি সেখানে একটা রুপকথা টাইপ সিরিজ বানাচ্ছিল। সেখানে এমন ড্রেস নেয়া হয়েছিল পিশাচিনী ক্যারেক্টারের জন্য। এগুলো কাস্টমাইজড ড্রেস। পরে ইউজ করার পর বিক্রি করে দেয়। ফুটপাত থেকে কিনেছেন?”
জুলিনার মেজাজ এতো বিগড়ে গেল। ইচ্ছে হলো নিজের জুতা খুলে নিজের কপালেই মারবে। দোকানদার ছ্যামড়া আরাবিয়ান ড্রেস বলে শকুনী না পিশাচিনীর ড্রেস ধরিয়ে দিয়েছে।
জুলিনা নওশিন কে অসহায় গলায় বলল,
“অন্য একটা ড্রেস দে আমার মাপের। এই ড্রেস দিয়া আমি ঘর মুছব। ”
***
খেতে গিয়ে আরেক বিপদ। জয়ী পায়েশ দেখে বলল,
“আন্টি এটা তোমার রান্না?”
জুলিনা বড় গলায় বলল,
“হ্যা। ”
জয়ীতা দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল,
“সেদিন যেটা খাইয়েছিলে ওটার থেকে ডিফারেন্ট লাগছে মনে হচ্ছে!”
জুলিনা থতমত খেল। আসল ব্যাপার হলো ও তেমন রান্নাবান্না পারেও না। যা পারে সেগুলো খেয়ে লোকজন গালাগাল করে। বিভিন্ন অনলাইন ফুডগুলো বাইরের লোকেদের সামনে নিজের রান্না বলে চালায়। জুলিনা নওশিন কে ইশারায় বলল, যেন কিছু না বলে।
জয়ীতা খিচুড়ির বক্স খুলে বুঝে গেল। এটা বিখ্যাত অনলাইন ফুড পেজ খাওয়া দাওয়ার রান্না। ওদের সিগনেচার ফুড। খাবারের ডেকোরেশনে ওদের লোগো টা শসা, গাজরে ডিজাইন করে দেয়। জয়ীতা নওশিনের দিকে তাকালো। নওশিন নিঃশব্দে হাসছে।
ওদিকে আদনান ফেরার সময় গাড়ি ভর্তি করে ফল, চকলেট নিয়ে এলো। ড্রাইভার একবার জিজ্ঞেস করলো, স্যার এটা কোনো বাচ্চাদের স্কুলের জন্য। অনেক মানুষের তো এজন্য জিজ্ঞেস করলাম। আদনান মনে মনে বলল, হ্যাঁ বাচ্চাই, তবে চব্বিশ বছরের এক বাচ্চার জন্য।
চলবে…