কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে পর্ব ২১

0
1050

#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-২১
(কপি করা নিষেধ। কপি করলে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে)

আদনানের ফুপুদের সঙ্গে জয়ীতার দেখা হলো খাবার দাবারের পর। ফুপুর ছেলের বউ জয়ীতাকে দেখে টিপ্পনী কেটে বলল,

“কিরে ভাই, একা একা খাইলেন। আমাদের কথা একবার মনেও পড়লো না?”

জয়ীতা হাসলো। নওশিন অপ্রস্তুত হলো। এদের বড্ড বেশী কৌতুহল। যে প্রশ্নগুলো ওদের কে করে সেগুলো জয়ীতাকে করলে মুশকিল৷ বেচারা কষ্ট পাবে।

আদনানের একজন ফুপু জিজ্ঞেস করলো,

“তোমার চুল এমন ক্যান? ”

জয়ীতা হেসে বলল, এটা স্টাইল।

অন্য ফুপুর দিকে তাকিয়ে বলল,

“এইটা কেমন স্টাইল! আমাগো সোজা চুলে কী খুব খারাপ লাগে! আজকালকার মেয়েদের দেখি এটা, ওটা মাখে, চুল কী করে। আর আমরা কিছু করিনাই, কই আমাদের কী খারাপ লাগে। ”

জয়ীতা আবারও হাসলো। এদের মুখের জবাব দিলে ও বেয়াদবের খেতাব পেয়ে যাবে। এতে অবশ্য ওর মাথা ব্যথা নেই। তবে আদনানের খারাপ লাগতে পারে। আদনান কে চলতে হয় হিসেব করে। পান থেকে চুন খসার উপায় অবধি নেই।

জয়ীতা তবুও দাঁতের পাটি বের করে বলল,

“এটা আসলে যার যার পারসোনাল ব্যাপার। এই যে আমার চুল নিয়ে কমেন্ট করলেন এতে কিন্তু আমার খারাপ লাগলো। এখন আমি যদি আপনার কুচকে যাওয়া চামড়া নিয়ে কমেন্ট করি তাতে আপনার খারাপ লাগবে। তারচেয়ে বরং আমরা এই বিষয়ে কথা না বলি সেটাই ভালো হয়। ”

দুই ভদ্রমহিলা এরপর লেগে গেল নিজেদের সাফাই গাওয়ার কাজে। তাদের উদ্দেশ্যে কিছুতেই জয়ীতাকে হার্ট করা ছিলো না৷ অথচ জয়ীতা স্পষ্ট বুঝেছে যে ও’কে খোচা মেরেই কথাগুলো বলা।

বিকেলে আদনান ফুপুদের বলল,

“আপনাদের যাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার ছোট বোনেরা এতো ঝামেলা সহ্য করতে পারছেন না। আর রান্নার খালার সঙ্গে আপনাদের ঝামেলা। তার রান্না নাকি মুখে তুলতে পারছেন না। তার উপর শুনলাম আমার বউকে নিয়ে নানান রকম কথা বলছেন। শ্বশুর বাড়ি নিয়ে নানান মন্তব্য! সবদিক বিবেচনা করে দেখলাম যে সমস্যা আপনাদেরই। তাই এখন যাওয়াই ভালো। বউভাতের রিসিপশন যখন জানানো হবে চলে আসবেন। ”

আত্মীয় স্বজনরা রীতিমতো হতভম্ব। তারা এমন মন্তব্য অনেক কেই নিয়ে করেন। কিন্তু মুখের উপর বাড়ি থেকে এভাবে যেতে কেউই বলেন না।

জয়ীতা ব্যাপার টা শুনে আদনান কে বলল,

“ইশ কী বিশ্রী ব্যাপার হলো। এভাবে মুখের উপর বললেন! ওরা ভাবলো আমি বলতে বলেছি। ”

আদনান গম্ভীর গলায় বলল,

“কে কী ভাবলো আমার তাতে মাথা ব্যথা নেই। মানসিক শান্তিটাই আসল। তাছাড়া আমার নতুন বিয়ে হওয়া বউকে নিয়ে মন্তব্য করলে সেটাও মেনে নেব না। ”

জয়ীতা চোখ কপালে তুলে বলল,

“ওরে বাবা! ”

“তোমার সঙ্গে অস্কারের আলাপ হয়েছে?”

“অস্কার এখনো এই বাড়িতে আছে? আমি তাহলে থাকব না। ”

“কেন? তুমি কুকুর ভয় পাও?”

“না। রাস্তার কুকুরদের ভয় পাই না। ওরা অনেক আন্তরিক। দেখতেও ভালো। কিন্তু অস্কার আমাকে দৌড় করিয়েছে। দেখতেও খারাপ। ”

আদনান নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“অস্কার তোমাকে কখন দৌড় করালো! তুমি নিজেই তো সিড়ি দেখলে লাফানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে যাও। ”

জয়ীতা চোখ পাকিয়ে বলল,

“নতুন বিয়ে করা বউকে এভাবে আন্ডারিস্টেমেট করতে এখন খুব ভালো লাগছে? ”

আদনান হেসে ফেলল। বলল,

“সরি। ”

জয়ীতা সরির ধার ধারলো না। ধড়াম করে ঘরের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল।

***
জয়ীতাদের বাড়ি থেকে সবাই এসেছে। আদনান সবার সঙ্গেই আন্তরিক ভাবে কথা বলছে। লিজাও এসেছে। তবে ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সবকিছুতেই খুব বিরক্ত। হতে পারে প্রেগন্যান্সির কারনে। জয়ীকে খুব একটা খোঁচালো না, আর জয়ীও ভাবীর সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলল।

বাবা, মা যাওয়ার সময় আবারও জয়ীকে সবরকম উপদেশ দিলো। জয়ী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবরকম উপদেশ শুনলো। তাদের কাছ থেকেই জানতে পারলো যে ও আদনানের সঙ্গে ইন্ডিয়া যাচ্ছে। ইন্ডিয়া থেকে ফেরার পর রিসিপশন হবে।

জয়ীতা ঘরে এসে আদনান কে জিজ্ঞেস করলো,

“আমি নাকি ইন্ডিয়া যাচ্ছি আপনার সঙ্গে? ”

“হ্যাঁ। ”

“কেন? আমাকেও ক্রিকেট খেলতে হবে। ”

আদনান ঠোঁট টিপে বলল,

“আমি সেরকম কিছু ভাবিনি। তবে তুমি খেলতে চাইলে ভিন্ন কথা। আমি খুশি হবো। ”

“আমার সঙ্গে ফাজলামো করছেন?”

“না। তুমি আমার বউ, তোমার সঙ্গে কী ফাজলামোর সম্পর্ক! তাহলে শুধু শুধু ফাজলামো কেন করব। ”

জয়ীতা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আদনানও চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না। জয়ীতা রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“আপনার কী আমাকে বোকা মনে হয়?”

“না। তোমার মাথা খারাপ সেটা ঠিক আছে, তা বলে তুমি বোকা নও। ”

জয়ীতা রেগে যাচ্ছে। মুখ বুঝে থাকা বদমায়েশ লোক টা’কে ও কিছুতেই পরাস্ত করতে পারছে না দেখে রাগ লাগছে। একের পর এক কথার জবাব দিয়েই যাচ্ছে। একটু ছাড় পর্যন্ত দিচ্ছে না। ওদিকে আবার বউ বউ করে মুখের ফেনাও বের করে ফেলছে।

আদনান মিটিমিটি হাসছে। জয়ীতা আবারও একাই একাই কিছু একটা ভেবে মাথা দোলাচ্ছে। দাঁতে দাঁত পিষে মাথা দোলাচ্ছে। তারমানে আদনানের গুষ্টি উদ্ধার করছে৷ আদনান হালকা কেশে বলল,

“এতো কার কথা ভাবছ জয়ীতা?”

জয়ীতা জবাব দিলো না। আগুন জ্বালিয়ে দেব টাইপ লুক দিয়ে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল।

****
আদনানের উপর হওয়া রাগ টা পানি হলো অনেকক্ষন শাওয়ার নেয়ার পর। জয়ীতা শাওয়ার নিয়ে যখন বের হলো তখন আদনান ঘরে নেই। ড্রেস নেয়ার জন্য আলমারি খুললে দেখলো সবকিছু আলাদা করে গুছিয়ে রাখা। এই বাড়িতে দুজন কাজের লোক। দুজনেই রাত আটটা পর্যন্ত থাকে৷ ওরা নিশ্চয়ই আলমারি গুছিয়ে রাখে নি। নিশ্চয়ই এটা নওশিন কিংবা তাসিনের কাজ।

জয়ীতা খোলা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিল৷ আদনান এসে পেছনে দাঁড়ালো। বলল,

“কাবার্ড আমি গুছিয়েছি। আমার জিনিসপত্র অন্য কেউ ধরুক বিষয় টা আমার পছন্দ না। সেজন্য এই ঘরে কেউ এসব গোছাতে আসে না। ”

জয়ী ভ্রু নাচিয়ে বলল, বাবা! সেলিব্রিটি ক্রিকেটার নিজের ঘর নিজে গোছায়! এটা কী লোক দেখানো নাকি?

আদনান মৃদু হেসে বলল,

“লোক দেখানোর হলে তো অনেক কিছুই দেখাতে পারতাম। ”

জয়ীতা অন্যদিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো। আদনান ফোনে চার্জ দিতে এসেছিল। ফোন চার্জে লাগিয়ে বলল,

“ও হ্যাঁ, বিয়েতে দেখলাম এক ভদ্রলোক গভীর দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। উনি কে?”

“ক্যাবলা মতো? ”

আদনান হেসে জিজ্ঞেস করলো,

“ক্যাবলা জিনিস টা কী?”

জয়ীতা ফোন বের করে অনীশের ছবি দেখালো। আদনান বলল,

“হ্যাঁ। তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ড? ”

“ইশ! এই ক্যাবলা তো আমার ভাবীর কাজিন। ”

“এর সঙ্গেই কী স্বপ্নে পালিয়েছিলে?”

জয়ীতা রেগে বলল,

“এই ক্যাবলার সঙ্গে আমার কিচ্ছু নেই। ভীষণ বোরিং। সারাক্ষন ছ্যাচড়ার মতো তাকিয়ে থাকে। ”

আদনান হাসলো। কিছু বলল না।

রাতের খাওয়া দাওয়া একসঙ্গে হলো। তাসিন, নওশিন আর ওরা দুজন। জয়ীতা নওশিন কে বলল,

“এই তোমরাও আমাদের সঙ্গে চলো। দারুন মজা হবে। ”

নওশিন হেসে বলল,

“আমাদের একগাদা এসাইনমেন্ট জমে আছে। নাহলে যেতাম। ”

তাসিন বলল, তাছাড়া ভাইয়া আমাদের নিতেও চায় না।

আদনান তাসিনের দিকে তাকালো। জয়ীতা জিজ্ঞেস করলো,

“কেন?”

“জানিনা। ”

জয়ীতা আড়চোখে আদনানের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমি তো জানি ছেলেরা বিয়ে হলে ইবলিশ হয়। তোমাদের ভাইয়া বিয়ের আগেই ইবলিশ ছিলো। ভেরি স্যাড। ”

আদনান জয়ীতার দিকে এক পলক দেখে আবারও খেতে লাগলো।

খাওয়ার সময় আদনান কথা বলল কম। জলদি খেয়ে উঠে গেল। অন্যদিকে জয়ীতা খাওয়ার চেয়ে কথা বেশী বলল। প্লেটের খাবার ঠান্ডা হলেও কথা শেষ হলো না। তাসিন, নওশিন ওরা খেয়েদেয়ে বসে বসে ওর কথা শুনতে লাগলো।

***
জয়ীতা ঘরে ঢুকে দেখলো আদনান বই পড়ছে। আদনান জয়ীতার দিকে না তাকিয়েই বলল,

“আমরা কিন্তু পরশু সকালে যাব। ”

“আমার পাসপোর্ট কোথায় পেয়েছিলেন?”

“তোমার ভাইয়ের কাছ থেকে। ”

“ওহ। আমার হয়েছে যত জ্বালা। ঘরে, বাইরে সব জায়গায় শুধু মীরজাফর। ”

জয়ীতা বিড়বিড় করে কথা বলায় আদনান স্পষ্ট শুনতে পেল না। বলল,

“কিছু বললে?”

“না। আমার ঘুমাতে লেট হবে। আমি এখন সিরিজ দেখব। আমার ফেভ্রেট টিভিএফের নতুন সিরিজ এসেছে। না দেখে শান্তি পাব না। ”

“আচ্ছা।”

“আমার কিন্তু অন্ধকারে ভয় লাগে।”

“লাইট অন থাকলে আমারও ঘুম হয় না।”

“তাহলে তাসিন দের কাছে যাই। ”

“না। লাইট জ্বালানো থাকুক। ”

জয়ীতা জিতে যাবার আনন্দে হাসলো। বদ ব্যটা এবার মজা বোঝ।

জয়ীতা খাটের এক পাশে শুয়ে সিরিজ দেখতে শুরু করলো। আদনান চোখের উপর বালিশ দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। এভাবে অভ্যস্ত না থাকায় অসুবিধে হলো। জয়ীতার হঠাৎ কী হলো। ও লাইট অফ করে দিলো। লাইট অফ করে মোবাইল দেখতেও ভালো লাগছিল না। তাই ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

***
আদনান বুকের উপর চাপ অনুভব করলো। জয়ীতার মাথা আজও ওর বুকের উপর। মারামারি, লাফালাফি করে শেষ পর্যন্ত আদনানের গা ঘেঁষে ঘুমিয়েই শান্তি পেয়েছে। আদনান এক হাত অতি সাবধানে ওর মাথার উপর রাখলো। আরেক হাতের আঙুলের ভাজে ওর আঙুল গুলো ঢুকিয়ে দিলো। এভাবে কেটে গেল কিছু সময়।

***
জয়ীতার ঘুম টা ভেঙে গেল। হাত বাড়িয়ে মোবাইল খুঁজে সময় টা দেখলো। সাত টা বেজে ছয় মিনিট। এতো জলদি ওঠার অভ্যাস ওর নেই। বেডের পাশের জানালাটা খোলা। সেই আলো চোখে লেগেই ঘুম ভেঙেছে। জয়ীতা বিরক্ত হয়ে পাশে ফিরলো। পাশ ফিরতেই মিষ্টি গন্ধ পেল। কী সুন্দর! চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো ধুমায়িত চায়ের কাপ। জয়ীতা উঠে বসলো। কাপ হাতে নিয়ে নাকের কাছে এনে ঘ্রান নিলো। মশলা দেয়া চা। দারুচিনি, এলাচি, তেজপাতার মাতালকরা ঘ্রাণ। জয়ীতা বাসী মুখেই চায়ে চুমুক দিলো। এরপর হাত বাড়িয়ে জানালার কাঁচ খুলে দিলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি না, টাপুরটুপুর বৃষ্টি।

জয়ীতা হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ছুয়ে দিলো। আদনান দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। মুগ্ধ চোখে দেখছে। মনে মনে বলছে,

“সরি জয়ীতা। লেট করে ঘুমালে আর ঘুম থেকে উঠলে তোমারই শরীর খারাপ করবে। তোমার সব খারাপ অভ্যাস এভাবেই ভালোবেসে ভালো অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। আই এম সরি।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here