কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে পর্ব ২০

0
1065

#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-২০
পুরো খাটভর্তি গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। এমন ভাবে ছড়ানো যে বিছানার চাদর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। দেয়ালে জায়গায় জায়গায় রজনীগন্ধা আর গোলাপ লাগানো। দেখতে ভালোই লাগছে৷ জয়ীতা ঘরটা ঘুরেফিরে দেখলো। বিশাল বড় ঘর। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দাটাও বড়। সেখানে কিছু ফুল গাছ লাগানো। নয়নতারা, কাঠগোলাপ, কামিনী এই তিনটা গাছ জয়ীতার চেনা। বাকীগুলো চিনছে না। আদনান খুব গোছানো মানুষ। জয়ীতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আদনান যতটা গোছানো ও ঠিক ততোটাই অগোছালো। বর্ষাকালে তো ও মশারী টাঙালে কয়েকদিন খুলেও না।

এমন গোছানো মানুষের ঘরে ও থাকবে কী করে! ও’কে তো দুদিনেই বের করে দিবে।

আদনান ঘরে এসে দেখলো জয়ীতা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। বলল,

“তুমি এখনো ফ্রেশ হও নি? পায়ের কী অবস্থা? ”

জয়ী খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছে। দুই পায়ের গোড়ালির অবস্থা খুব একটা ভালো না। আদনান একটা ওষুধ এগিয়ে দিয়ে বলল,

“এটা লাগালে ঠিক হবে। ”

জয়ী ওষুধ টা নিতে নিতে বলল,

“আমার জন্য জুতা কে কিনেছে। ”

“তাসিন, নওশিন কিনেনি। বাকী রইলো তোমার অতি আদরের আন্টি। ”

জয়ী হতাশ গলায় বলল,

“ওনার কথা আর কী বলব! তাও ভালো এক সাইজ কম জুতার মাপ৷ তাই পায়ে ঢোকাতে পেরেছিলাম। ”

“ওষুধ টা লাগিয়ে নিলে ঠিক হয়ে যাবে। ”

জয়ীতা এবার আবারও খাটের দিকে তাকালো। বলল,

“আমি কী এখানেই ঘুমাব?”

“সেটাই তো হওয়ার কথা। ”

“এতো ফুলের মধ্যে?”

“ফুল সরানোর ব্যবস্থা করছি। ”

জয়ী ওয়াশরুমে ঢুকলো। এই বাসার ওয়াশরুম টাও সুন্দর। জয়ী আয়নায় নিজেকে দেখলো। বিয়ের সাজে সবাইকেই কী এতো ভালো লাগে! মেকাপ টা তুলে নিতে হবে আগে।

মেকাপ তুলে, গোসল সেড়ে জয়ী যখন ঢুকলো তখন খাটে একটা গোলাপের পাপড়িও নেই। জয়ীর ইচ্ছে করলো এক্ষুনি শুয়ে পড়তে। বিয়ের ঝামেলায় দুটো দিন ভালো করে ঘুমাতেও পারে নি।

আদনান ঘরে ঢুকে দেখলো জয়ীর গোসল হয়ে গেছে। ওর পরনে টিশার্ট আর ট্রাউজার। ভেজা চুল থেকে পানি পড়ছে। মুখের মেকাপ ধুয়ে ফেলার পর বেশ স্নিগ্ধও লাগছে। আদনান কিছু সময় দেখলো। জয়ীতার সঙ্গে চোখাচোখি হবার পর জিজ্ঞেস করলো,

“কিছু খাবে নাকি শুয়ে পড়বে?”

জয়ীতা সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল,

“আপনিও কী এই ঘরে ঘুমাবেন?”

আদনান খাটের পাশের সোফায় বসলো। এতক্ষন দাঁড়ানো ছিলো। বসে বলল,

“তুমি কী চাইছো আমি অন্য ঘরে কিংবা ফ্লোরে ঘুমাই। ”

জয়ীতা ঠোঁট উল্টে বলল,

“সেটা আপনার ইচ্ছে, আপনার বাড়ি, আপনার খাট, আপনার ফ্লোর, আপনার ছাদ। আমি কী করে বলব!”

“তুমি পায়ে ওষুধ টা লাগিয়ে নাও। ”

আদনান ঘর থেকে চলে গেল। জয়ীতা হতাশ হলো। আদনান ওর সঙ্গে এক খাটে ঘুমালে মহাবিপদ। জয়ীতার ঘুমানোর স্টাইল মোটেও ভালো না। বাড়িতে বিশাল খাটে একা ঘুমালেও মাঝেমধ্যে মশারীসমেত ধুমধাম পড়ে যাবার অভ্যাস আছে। এখানে যদি আদনানের গায়ে লাত্থি মেরে বসে তাহলে ব্যাপার টা তো ভারী লজ্জার হয়ে যাবে।

****
জুলিনার ফোনে আদনানের কল এসেছে। জুলিনা ঘুমিয়েছিল। ফোন পেয়ে উঠে বসলো। বলল,

“হ্যাঁ আদনান বল। ”

“মামী আপনি এতো রাতে যেতে গেলেন কেন? থেকে যেতেন?”

“থাকলে তোর ফুপুদের দাঁত থাকতো না। বদগুলারে বিদায় কর। শুধু খাইতে আসে। কই তোদের কোনো বিপদে, আপদে তো ওঁদের দেখিনা। খাবারের সময় দেখি। কী খাওয়াটা খাইছে জানিস! আর ভন্ডর বউ টাও এমন খাইছে যেন একমাস না খেয়ে ছিলো।”

আদনান চুপ করে রইলো। জুলিনা মাঝ রাতে চলে যাওয়ায় ফোন করে একটা খোঁজ নিলো কিন্তু ওঁ খাতা খুলে বসেছে।

আদনান জিজ্ঞেস করলো,

“মামী আপনি নাকি ইচ্ছে করেই জয়ীতার জন্য এক সাইজ ছোট জুতা কিনেছেন?”

জুলিনা থতমত খেল। বলল,

“কে বলছে?”

“যারা জানে তারা বলছে। ”

“কাল এসে তাদের দুটো করে থাপ্পড় দিয়ে যাব।”

“জয়ীতা কিন্তু পায়ে খুব ব্যথা পেয়েছে। ”

“ওরে বাবা! বিয়ে করতে না করতেই বউয়ের জন্য এতো দরদ! খুব তো পীর বাবা সেজেছিলি! বিয়ে করব না, অমুক, তমুক…… জুতার সাইজ কম হয়েছে বলেই তো হাত ধরাধরি করলি দুজন। ”

আদনান অতিদ্রুত ফোন রাখতে বলল,

“এখন রাখছি মামী। কাল দেখা হবে। ”

জুলিনার রাখার ইচ্ছে নেই। আরও কিছুক্ষন কথা বলার ইচ্ছে। কিন্তু তবুও রাখতে হলো। বাসর রাত বলে কথা! একটা ব্যাপার আছে না?

****
আদনান ঘরে এসে দেখলো জয়ী তখনও বসে আছে। আদনান আবারও জিজ্ঞেস করলো,

“ওষুধ লাগিয়েছো?”

“হু। ”

“তাহলে শুয়ে পড়ো। ”

“হু। ”

বিশাল খাটের একপাশে আদনান বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়লো। শুয়ে বলল,

“আমরা আস্তে আস্তে সংসার করা শিখে নেব কেমন! এক্ষুনি চাপ নেয়ার দরকার নেই। ”

জয়ীতা হাই তুলে বলল,

“আর যদি না পারি তাহলে কী বাসায় পাঠিয়ে দিবেন?”

“না। বাসায় কেন পাঠাব? এতো টাকা পয়সা খরচ করে বিয়ে করেছি বাসায় পাঠানোর জন্য?”

“তার মানে আমি যদি আপনাকে ডিভোর্স দিতে চাই তাহলে টাকা পরিশোধ করতে হবে?”

আদনান জয়ীতার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বলল,

“তুমি কী আসলেই একটু ইমম্যাচিউর? নাকি সত্যিই তাড় ছেড়া?”

জয়ীতা রেগে গেল। বলল,

“ভালো করে কথা বলবেন আমার সঙ্গে। আপনার বংশে পাগল আছে বলে ভাববেন না যে সবাই ই পাগল। ”

“রাতের আর অল্প সময় বাকী আছে। ঘুমিয়ে পড়ো। ”

জয়ীতা শুয়ে পড়লো। বিশাল খাটের দুই পাশে দুজন। মাঝখানে কোলবালিশ থাকলে ভালো হতো। সেটা নেই। জয়ীতা ঠিক করেছে কাল নওশিন কে বলবে কোলবালিশ এর ব্যবস্থা করতে।

আদনান চোখ বন্ধ করে বলল,

“তোমার বালিশের নিচে সাইন করা চেক আছে। দেনমোহরের টাকা। মামী বলল বিয়ের রাতেই নাকি দিতে হয়। ”

জয়ী হাত বাড়িয়ে চেক টা নিলো। বেশ বড় একটা এমাউন্ট। জয়ী তবুও বলল,

“আমি কিন্তু ছয়শ বিশ টাকা পাই। সেটাও দিয়ে দেয়া উচিত ছিলো। ”

আদনান পাশ ফিরে লাইট অফ করে দিয়ে বলল,

“ওই টাকা জীবনেও ফেরত দেব না।”

***
খাটের দুই প্রান্তে দুজন ঘুমালেও আদনান কিছুক্ষন পর টের পেল জয়ীতা রীতিমতো খাটে যুদ্ধ করছে। হাত, পা একেকদিক ছুড়ছে। কখনো আদনানের মুখে লাগছে, কখনো নাকে লাগছে। দুই হাত দিয়ে জয়ীতাকে ঠিক করে দিলেও আধাঘন্টা পর আবারও সেই একই অবস্থা। কিছুক্ষন চেষ্টা করে শেষমেস আদনান হাল ছেড়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

আদনানের ঘুম ভেঙেছে আজ দেরিতে। ঘড়িতে আট টা বেজে চল্লিশ মিনিট। ওর এক হাত মাথার নিচে আরেক হাত দিয়ে জয়ীতাকে জড়িয়ে ধরা। জয়ীতার মাথাটা আদনানের বুকে। এক হাত দিয়ে আদনান কে জড়িয়ে ধরা। আদনান মৃদু হাসলো। মাথার নিচের হাত টা জয়ীতার মাথায় রাখলো। প্রথমে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো। দ্বিতীয়বার দিতে গিয়ে বিপাকে পড়লো। আদনানের আঙুল চুলে আটকে গেছে। আঙুল ছাড়াতে গেলে জয়ীতার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলে আদনান কে এতো কাছ থেকে দেখে অবাক হলো। আদনান ভ্রু নাচিয়ে বলল,

“ঘুম ভাঙলো৷ গুড মর্নিং। ”

জয়ীতা সরে যেতেই আদনান উঠে বসলো। বলল,

“রাতে স্বপ্নে কার সঙ্গে এতো যুদ্ধ করছিলে?”

জয়ীতা বলল, সরি। আপনিও তো কম বেহায়া না।

আদনান হেসে ফেলল।

***
নওশিন এসেছিল জয়ীতার খোঁজে। জয়ীতা কী খাবে সেটা নিয়ে অস্থির হয়ে গেল। তাসিন কে ইউনিভার্সিটিতে যেতে হলো। আজ এসাইনমেন্ট দেবার লাস্ট ডেট। জয়ী নওশিন কে বলল,

“আপাতত চা খাব। তারপর তোমাদের সঙ্গে খাব। একা খাব না কিন্তু। ”

নওশিন গেল চা আনতে। চা’য়ের সঙ্গে ফোনও নিয়ে এলো। বলল,

“মামী কথা বলবে।”

জয়ীতা ফোন কানে ধরে বলল,

“হ্যাল্লো জয়ী কী করছিস। ”

“চা খাব। ”

“পায়ের ব্যথা কেমন? ”

“এখন একটু কম। ”

“আহারে! বেক্কল দোকানদার দের চাপকানো দরকার। এতোবার ঠিক সাইজ বললাম তাও ভুলটা ধরিয়ে দিলো। ”

“কী আর করা!”

“শোন, নওশিন রে বল বাসা থেকে হাভাতের দল দের বের করতে।”

” কেন আন্টি। ওনারা থাকুক না। ”

“সব খেয়ে শেষ করবে। ”

“তাতে কী?”

জুলিনা গজগজ করতে লাগলো। আদনানের টাকা, পয়সা রক্ষা করতে প্রানপাত করতে লাগলো ফোনের ওপাশে। জয়ীতা কেবল শুনলো৷ জুলিনা শুনালো আদনানের দুই ফুপু আর আলম সাহেবের বউ কী কী খেয়েছেন। সেই তুলনায় উনি কিছুই খায়নি। দুটো মুরগী, দুই বাটি স্যুপ, দুই বাটি ফিরনি আর গোটা সাতেক কালোজাম খেয়েছেন।

জয়ীতা বুঝতে পারলো না কী বলবে। কিছু বলার থেকে চুপ করে শোনাই ভালো।

এরপর ফোন করলো জয়ীতার বাবা। তার সিগনেচার উপদেশ কিছুক্ষন শুনালো। বড়দের সম্মান করবে, ছোটদের স্নেহ করবে। স্বামীর সঙ্গে সদা সত্য কথা বলবে। জয়ীতা শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ করতে লাগলো৷

এরপর মায়ের সঙ্গে কথা বলল। মা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ও জয়ী শুনছিস? বড় আপা, মেজপা, মেজ ভাবী সবাই ফোন করছে। কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না যে এমন হিরার টুকরো জামাই তোর। ওরা পত্রিকার ফটো দেখেই সবাই ফোন করছে। সবাই মনে হয় জ্বলছে। জ্বলুক আরও জ্বলুক। সবসময় আমাকে বলতো আমার ছেলেমেয়েরা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয় নি। তাদের নাম, ডাক নেই। এবার দেখুক।

এরপর ফোন করলো জিহাদ। জয়ীতার হাত ব্যথা হয়ে গেল। জিহাদের সঙ্গে কথা বলার সময় জয়ীতা স্পিকার ম্যুডে দিয়ে সামনে রাখলো। জিহাদও হড়বড় করে বলতে লাগলো,

“জয়ী কাজিন গ্রুপে আগুন লাগছে আগুন। রিতি, চৈতি, জিসান, স্নেহা, নাদিম সবাই তো শকড। তারচেয়েও বড় কথা কী জিনিস। সাইমুন নাকি আদনানের ডাই হার্ড ফ্যান। আদনানের ব্যাটিং দেখার সময় নাকি পানিও খায় না৷ ওরা তোকে ফেসবুকেও পাচ্ছে না। ব্লক দিয়েছিস! ইশ! ব্লক কেন দিলি!

জয়ীতা হাসলো। জিহাদ আবারও বলল,

“এই শোন সাইমুন ও আমাকে ফোন করেছিল। আমি কিন্তু মায়ের মতো মিনমিন করিনি। বলে দিয়েছি যে আদনান প্রাইভেসির জন্য কাছের লোকজন ছাড়া বাকীদের ডাকতে নিষেধ করেছে। তোরা তো কেউ জয়ীর কাছের কেউ না। তবে ওদের ডাকলে ভালো হতো! সামনাসামনি ওদের মুখগুলো দেখা যেত। আইপিএল শেষ করে আদনান ফিরে যদি বউভাতের রিসিপশন করে আমি কিন্তু ওদের দাওয়াত দেব।

জয়ীতা জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল। আদনান ঘরে আসছে। আপাতত ওর জীবনের এই চাপ্টার টা আদনানের অজানাই থাকুক। কে জানে, সব শুনে হয়তো আদনানেরও মনে হবে ও হ্যাংলা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here