কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে পর্ব ১৯

0
1049

#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-১৯
আজ জয়ীতার বিয়ে। গতকাল রাত অবধি নার্ভাস না লাগলেও এখন লাগছে। কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি। চাপা ভয় কাজ করছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর পর ই কেমন লাগছে। সৌমি জয়ীকে দেখে বলল,

“কিরে তোকে এমন লাগছে কেন? দেখে মনে হচ্ছে মেরে ধরে বিয়ে দিচ্ছে। ”

“সেটাই তো করছিস সবাই মিলে। চক্রান্ত করে বিয়ে দিচ্ছিস।”

সৌমি হেসে ফেলল। বলল,

“তুই রাজী না হলে পৃথিবীর কেউই কী তোকে বিয়ে দিতে পারতো?”

“রাজী হয়েছি তোদের সবার চাপে পড়ে।”

“শোন, এসব বাংলা সিনেমার ডায়লগ ছাড়। তোর নিজেরও ইচ্ছে ছিলো। ”

জয়ী একবার রাগী চোখে তাকালো। অন্যসময় হলে সৌমির সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে মিনিট খানেক তর্কও করতো কিন্তু আজ আর ভালো লাগছে না।

জয়ীর আরেকটা কারনেও ভয় হয়। লিজার বিয়ের আগে জয়ীর সঙ্গে আলাপ ছিলো। লিজা তখন ও’কে কতো ভালোবাসতো। শপিং এ গেলে নিজে যা কিনতো তা ওর জন্যও কিনতো। বাসা থেকে খাবার দাবার বানিয়ে পাঠাতো। বিয়ের পর একদম বদলে গেল। আচ্ছা ও কী এভাবে বদলে যাবে! তাসিন, নওশিন কতো ভালো! ও যদি বদলে গিয়ে ওদের সঙ্গে খারাপ করে! জয়ীর তো তাও বাবা, মা আছেন। একটা ভরসার জায়গা আছে। ওদের তো তাও নেই।

পরক্ষনেই আবার ভাবছে, ধ্যাৎ! আদনান তো ও’কে দুদিন পর ই ফের‍ত দিবে। তাসিন, নওশিনকে জ্বালাবে কী করে!

তবুও কী ভেবে যেন জয়ী তাসিন কে ফোন করলো।

তাসিন ব্যস্ত গলায় বলল,

“হ্যাঁ আপু বলো। ”

জয়ী কোমল গলায় বলল,

“তোমরা কেমন আছ?”

তাসিন দুষ্টমি করে বলল,

“আমরা ভালো আছি। ভাইয়া মনে হয় একটু বেশি ভালো আছে। ”

জয়ী হেসে বলল,

“নওশিন কী করছে?”

“বিয়েবাড়ির ঝামেলা সামলাচ্ছে। কী ব্যাপার আপু? কিছু বলবে?”

জয়ীতা আমতা আমতা করে বলল,

“আচ্ছা তোমাদের কী ভয় লাগছে?”

“ভয় লাগবে কেন?”

“আমি যদি বিয়ের পর বদলে যাই? টিপিক্যাল ভাইয়ের বউদের মতো হয়ে যাই?”

তাসিন হেসে ফেলল। বলল,

“না বদলাবে না। আমরা তোমাকেও খুব ভালোবাসবো। একদম বদলে যেতে দেব না।”

জয়ীতা হেসে ফেলল৷ আশ্চর্য হলেও সত্যি যে ওর এখন নির্ভার লাগছে।

“রাখছি তাসিন।”

“আচ্ছা। ”

***
ভারী মেকাপ, জুয়েলারি, লেহেঙ্গা সব মিলিয়ে জয়ীকে ভালোই লাগছে। সৌমি মুগ্ধ গলায় বলল,

“কী সুন্দর লাগছে রে তোকে!”

জয়ী হাসলো। আয়নায় নিজেকে দেখে ওরও ভালো লাগছে। তবে একটা ব্যাপার বুঝেছে। আদনান ফয়সাল ব্যটার ভালোই টাকা, পয়সা আছে। বিয়েতে খরচাপাতিও ভালোই করেছে। ও ভেবেছিল এক নম্বরের কঞ্জুস। কিন্তু এখন উল্টো মনে হচ্ছে। জয়ীতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিয়েতে এতো খরচ করে কী লাভ! সেই যে ছয়শ বিশ টাকা ফের‍ত দেয় নি সেটা তো ভুলতেই পারছে না।

পাশের রুমে জুলিনা সাজছিল। সাজগোজ সেড়ে জয়ীতার সামনে এসে বলল,

“এই দেখ তো কেমন লাগছে?”

জয়ীতা হেসে বলল, খুব সুন্দর।

আসলে মোটেও সুন্দর লাগছে না। জুলিনা নীল শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে চুলের কালার টাও নীল করেছে। কোন এক সিরিয়ালের ভিলেন কে নাকি দেখেছে এক এক কালার শাড়ির সঙ্গে মিশিয়ে হেয়ার কালার চেঞ্জ করে। জুলিনাও সেই কালার খুঁজে কিনে নিয়েছে৷ এতে যে বিশ্রী লাগে সেটা বুঝতে পারছে না। তাও ভালো নীল রঙা লিপস্টিক পায় নি। তাহলে একদম রুপকথার ডায়েনিদের মতো লাগতো৷

সৌমি, তাসিন, নওশিন সহ ওর বাকী বন্ধুরাও সুন্দর করে সেজেছে। সবাইকে দেখতেও খুব সুন্দর লাগছে। জয়ীর খুব ভালো লাগলো। এই যে সবাই কতো আনন্দ করছে দেখতেও ভালো লাগছে।

***
অবশেষে বিনা ঝামেলায় বিয়েটা হয়ে গেল। জয়ীতাকে যখন কবুল বলতে বলা হলো তখন সঙ্গে সঙ্গেই বলে ফেলল। যদিও ওর বন্ধুরা বলেছিল ভাব নিতে। কিন্তু জয়ী চিন্তা করে দেখলো ভাব নিয়ে কী হবে। বলতে যখন হবেই তখন শুধু শুধু ঢং করতে কেন হবে।

স্টেজে দুজন কে যখন বসানো হলো তখনই জয়ী আদনান কে দেখলো। আদনান ও’কে দেখে মৃদু হাসলো। জয়ী একটু এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“এত পয়সা খরচ করলেন অথচ জুতো কেনার সময় কিপ্টামি! এক সাইজ কম হয়েছে জুতা। পার্লার থেকে তো সৌমির হাত ধরে এসেছি। এখন কীভাবে আপনার বাড়ি অবধি যাব?”

আদনান বলল,

“বিয়ের কোনো কিছুই আমি কিনিনি। ওরা কিনেছে। তুমি কেন আগে থেকে জুতার সাইজ দাও নি?”

বিয়ের পর থেকে আদনান আপনি থেকে সোজা তুমিতে চলে এসেছে। জয়ীতা বলল,

“কী করিনি সেটা না ভেবে কী করব সেটা ভাবুন। ভুলেও ভাববেন না যে খালি পায়ে যাব।”

অন্যদিকে ওদের এভাবে কথা বলতে দেখে সবাই ফটো তুলতে ব্যস্ত৷ সবার ক্যামেরায় নব দম্পতির রোমান্টিক ছবি উঠতে লাগলো।

***
জুলিনার মেজাজ খুব ই গরম। আদনানের দুই ফুপু খেতে বসেই চিৎকার শুরু করেছে ভাত খাবে। যেভাবেই হোক তাদের ভাতের ব্যবস্থা করে দিতে হবে৷ সেটা নিয়ে জুলিনার মাথা গরম হয়ে গেল। এতোই মাথা গরম হলো যে রেগেমেগে বলল,

“হাভাতের দল তোমরা এইখানেও ভাত খাইতে আসছ! বাসায় নিয়া তোমাদের জনমের মনে ভাত গিলাবো। ”

ছোট খাট একটা ঝগড়া হতে হতেও হলো না। জয়ীর ভাই ব্যাপার টা ম্যানেজ করে নিলো।

অন্যদিকে জুলিনার সাজগোজ নিয়ে সবাই খুব প্রশংসা করেছে কিন্তু লিজা ভুল করে হেসে ফেলল। সেই থেকে জুলিনার মন একটু খারাপ। এই যুগের স্মার্ট একটা মেয়ে এভাবে ফ্যাশনেবল গেটাপে হাসছে! ভেরি স্যাড৷

জুলিনার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল যখন দেখলো আলম সাহেব তার পরিবার নিয়ে হাজির হয়েছে। একদম লজ্জা নেই ওই রাস্তার বেটির৷

***
আদনানের পরিচিত বন্ধু, কলিগ, সিনিয়র ক্রিকেটার রা সবাই আসতে শুরু করলো। ভদ্রতা করে হলেও তাদের জন্য দাঁড়াতে হয়। জয়ী অনেক কষ্টে দাঁড়ালো। কিন্তু বেশী সময় দাঁড়ানোও সম্ভব না। পায়ে লাগছে। আদনান বুঝতে পারলো। এগিয়ে এসে জয়ীর হাত ধরে ফিসফিস করে বলল,

“রিলাক্স। আমি আছি তো।”

জয়ী আদনানের দিকে তাকালো। ওর নার্ভাসনেস কাটতে শুরু করেছে। ও ফিসফিস করে বলল,

“হাত ছাড়বেন না প্লিজ। আমি কিন্তু ধপাস করে পড়ে যাব। ”

আদনান হেসে ফেলল।

হাত ধরা, একে অন্যের সঙ্গে একটু পর পর কথা বলা এসব দেখে সবাই ভাবলো দুজনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং খুব ভালো। এদের খুব ভাব, ভালোবাসা হবে। হবেই হবে।

***
জয়ীতার বাবা, মা’ও ভীষণ খুশি। বিয়ে হতে না হতেই মেয়ে জামাইয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে দুজনেই খুশি। সব টেনশন দূর হলো। লিজা একটু চুপচাপ ই আছে। জয়ীতার সঙ্গে কথা বলছে বুঝেশুনে। এই চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলা মেয়েটাকে সবাই কেন যে লাই দিয়ে মাথায় তোলে ও ভেবে পায় না। কিছু বললে জবাব দিতেই হবে। তাই কথা বলাও কমিয়ে দিয়েছে।

তবুও এক ফাঁকে জয়ীকে বলল,

“জয়ী তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। ”

আদনান পাশেই ছিলো। লিজা আদনানের দিকে তাকিয়ে বলল,

“হাই। জয়ী কিন্তু আমার একমাত্র ননদ। ”

আদনান হেসে বলল,

“হ্যালো ভাবী। ”

লিজা বলল,

“কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?”

“শিওর। ”

“আপনি কিন্তু আপনার মামীর মতোই বউ পেয়েছেন।”

জয়ীতা কপাল কুঁচকে তাকালো। লিজা মিটিমিটি হাসতে লাগলো। আদনান এক পলক জয়ীতা কে দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে হাসি আড়াল করার চেষ্টা করলো।

***
জুলিনা নওশিন কে ডেকে বলল,

“ভন্ডর বউয়ের অবস্থা দেখছিস?”

নওশিন বলল,

“মামী আপনি ওদিকে খেয়াল ই করবেন না। ওরা যা করে করুক। ”

জুলিনা নওশিন কে কঠিন করে ধমক দিলো। ওর এমনিতেই মেজাজ খারাপ৷ আদনানের পরিচিত একজন এসেছে ছোট বাচ্চা নিয়ে। সেই বাচ্চা ও’কে দেখেই চিৎকার করে ওঠে৷ সামান্য নীল চুলের জন্য এতো কিছু! মেয়েগুলো বলল সুন্দর লাগছে তাই আর সাজ পাল্টায় নি৷ ইচ্ছে করলো বাচ্চাটাকে এক থাপ্পড় দিতে৷ তুই বাচ্চা মানুষ তুই বুঝবি কী করে যে এটা ফ্যাশন।

***
যাবার সময় জয়ীতার মা খুব কাঁদলো। জয়ীতার নিজেরও চোখে পানি এসে গেল। অথচ মায়ের সঙ্গে বছরান্তে ওর মোটে তিন, চারবার দেখা হয়। মা’কে কাঁদতে দেখে জয়ীতার একবার বলতে ইচ্ছে করলো, মা কেঁদো না। তোমার মেয়েকে খুব শিগগিরী ফেরত পাঠানোর কথা। ওরা না চিনুক, আমি তো চিনি নিজেকে।

গাড়িতে বসে জয়ীতা আদনান কে বলল,

“আমি কিন্তু আর এক পা’ও,ওই জুতা পরে হাটব না। ”

“তাহলে জুতা খুলে নেব। ”

“হ্যাঁ সেটাই করব। ”

“কোরো। ”

বাসায় ঢোকার সময় আদনান বলল,

“এখানেও সবাই ক্যামেরা নিয়ে ওঁত পেতে আছে।”

জয়ী বলল,

“এই জুতা পরে হাটা সম্ভব না। ”

আদনান জয়ীতার হাত ধরে বাইরে আনলো। তারপর কোলে তুলে নিয়ে সিড়ির দিকে গেল। সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। আবারও ছবি তোলা হচ্ছে।

আদনান বলল,

“তুমি এতো ভারী? দেখে তো বোঝা যায় না৷ ”

“আমি ভারী না। লেহেঙ্গা, জুয়েলারি এসবের কারনে এমন লাগছে। ”

“ওহ তাই বলো। ”

জয়ীতা বলল,

“একটু সাবধানে পা ফেলে যান। আপনাদের সিড়িগুলো খারাপ।”

আদনান হাসলো। জুলিনা নওশিন কে ধাক্কা মেরে বলল,

“দেখ ছেমরি। বুদ্ধি করে এক সাইজ জুতা কম কিনছি দেখেই তো বউ কোলে উঠছে। বুদ্ধি দেখছ আমার! চুল কী এমনে পাকছে। ”

নওশিন হাসলো শব্দ করে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here