#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-১৭
এখন বাংলা মাস শ্রাবণ চলছে। যেভাবে বৃষ্টি হবার কথা সেভাবে হচ্ছে না। তবে আবহাওয়া মাঝেমধ্যে ঠান্ডা, মাঝেমধ্যে খুব গরম। জয়ীতার বিয়ে এক সপ্তাহ পর। আদনানের হাতে নাকি এক সপ্তাহ সময় আছে। এরপর ব্যস্ত হয়ে যাবে। আইপিএল খেলতে ইন্ডিয়া ছুটতে হবে। জয়ী অবশ্য বিন্দাস আছে। খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, একা একা ঘুরতে যাচ্ছে। এভাবেই চলছে। বিয়ের কারণে আবারও ভাইয়ের বাসায় এসে থাকা শুরু করলো। মা’ও এখানে আছে। বাবা বাড়িতে গেছেন, কয়েক দিন পর আসবে।
বিয়েতে রাজী হয়ে জয়ী বাবা, মা’কে কঠিন শর্ত দিয়েছে কোনোভাবেই যেন মায়ের পক্ষের আত্মীয়স্বজন কে ডাকা না হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে যদি তারা আসে তবে ও সেখান থেকে চলে যাবে৷ জয়ীতার বাবা, মা সবকিছু মেনে নিচ্ছে। না মানলে যদি মেয়ে আবার বেঁকে বসে!
সৌমি এখন এসে জয়ীর সঙ্গেই থাকছে। ওর বিয়ে নিয়ে খুব এক্সাইটেড। হলুদে কিরকম মেকাপ হবে। বিয়ের মেকাপ কেমন হবে। সবকিছু নিয়ে উচ্ছ্বসিত। শুধু লিজা এসবে অংশ নিতে পারছে না। কোথাও গিয়ে ওর মনে অনীশের সঙ্গে বিয়ে না হওয়া নিয়ে একটা ক্ষোভ আছে। তারমধ্যে জয়ীর মা তিনবেলা নয়বার করে লিজা আর ওর মায়ের সামনে বলছে, কোথায় অনীশ আর কোথায় আদনান। লিজার মা অবশ্য একবার বলেছিল,
“ক্যান অনীশ খারাপ কোত্থেকে? ”
জয়ীর মা বাড়ি মাথায় করে ফেলল। একরকম চিৎকার করে বলল,
“কী বলেন বেয়ান? কোথায় কচুগাছ আর কোথায় মেহগনী গাছ!”
জয়ী চা খাচ্ছিলো তখন। হাসতে গিয়ে মুখ থেকে চা পড়ে গেছে। সৌমি তো সামাজিকতা ভুলে হা হা করে হাসতে লাগলো। লিজা কপাল কুঁচকে ফেলল। সুযোগ বুঝে লিজা জয়ীকে ঠেস দিয়ে বলল,
“এবার অনীশ কে না করার কারণ বুঝলাম। ”
জয়ী স্বাভাবিক গলায়ই বলল, অনীশ কে না করার কারণ হিসেবে অন্য কোনো কিছুই দায়ী না ভাবী। নিজের মনগড়া অনেক কিছু বানিয়ে নিলেই তো হলো না।
লিজা তীর্যক হেসে বলল,
“তবে যাই বলো তুমি কিন্তু পাক্কা খিলাড়ি।”
জয়ীর মেজাজ বিগড়ে গেল৷ তবুও ঠান্ডা গলায় বলল,
“যেমন? ”
“আদনান ফয়সালের মতো সেলিব্রিটি ক্রিকেটার ফাঁসানো কী মুখের কথা! খুব চালাক না হলে কী পারা যায় বলো?”
জয়ী মৃদু হাসলো। ফাঁসানো শব্দটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিলো কাজিন মহলে। সেদিন চুপচাপ থাকলেও আজ আর চুপ থাকলো না। জয়ী বলল,
“ওই যে কথায় আছে না, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। আমার দশাও তাই। আমি দিন রাত তোমার সঙ্গে থেকেছি৷ তোমার কাছ থেকেই তো শিখেছি। ”
লিজার মুখ শক্ত হয়ে গেল। জয়ী এক চোখ টিপে বলল,
“তুমিতো আহামরি সুন্দরীও না। দিন রাত মেকাপ ঘষে ঘষে আমার ভাইকে ফাঁসিয়েছো তাই না! বুঝি বুঝি! ”
লিজা রাগে ফোসফোস করতে লাগলো। বলল,
“তুমি বড্ড বেশি লাঘাম ছাড়া কথা বলো জয়ী।”
“তুমি যদি নিজের সম্মান নিজে না রাখতে পারো, সেখানে আমি কী করব বলো! বাই দ্য ওয়ে, আদনান ফয়সাল সাহেব কে বলে বিদেশি মেকাপ কিট, বিউটি বক্স আনিয়ে দিলে কী তোমার মাথা ঠান্ডা হবে?”
লিজা আর কথা বাড়ালো না। রেগে চলে গেল।
***
আদনানের অবশ্য বিয়ে নিয়ে তেমন হেলদোল নেই। সবকিছু ছেড়ে দিছে তাসিন, নওশিনের উপর। ওরা কী করছে না করছে সে ব্যাপারে খোঁজ খবরও করে নি। আদনান আগের মতোই নিজের কাজে ব্যস্ত।
ক’দিন ধরে জুলিনার উপদ্রব শুরু হয়েছে। দুদিন আগে আদনান কে ফোন করে বলেছে,
“এই আদনান জয়ী তো আমার সঙ্গে কথা বলছে না। ”
আদনান বলল,
“মামী এই ব্যাপারে আমি তো কিছু জানি না। ”
“জানবি না ক্যান? অবশ্যই জানতে হবে। তোরা আম, দুধ একেবারে মিলেমিশে একাকার। আর আমি কী না আটি হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছি। ”
আদনান চুপ করে রইলো। কী বলবে বুঝে পেল না। জুলিনা আবারও বলল,
“কিছু একটা কর।”
“আমার সঙ্গে কথা হলে বলব।”
“কথা হলে বলবি মানে কী? তোর সঙ্গে কথা হয় না?”
আদনান আমতা আমতা করে বলল,
“হয় তো। ”
“আচ্ছা বলে দিস। ”
এটা হলো জুলিনার একটা রুটিন চেক। তাসিন, নওশিন দুটো হলো গাছবলদ। কিছু জিজ্ঞেস করলে নাকে বাজিয়ে বলবে,
“আঁমঁরাঁ তোঁ জাঁনিঁনাঁ। ”
কিন্তু জুলিনাকে তো সব খবর রাখতে হয়। জল কতদূর গড়ালো। না গড়ালে সেই ভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে যেন গড়ায়। তবে একটা ব্যাপার সত্যি জয়ী সত্যিই ওঁর সঙ্গে ভালো করে কথা বলছে না। সেদিন ওঁদের বাসায় গেলেও দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়েছে। ও’কে ছলনাময়ী নারী ভেবে ইগ্নোর করা শুরু করছে হয়তো। একটা ব্যবস্থা নিতে হয়। মেয়েটা কথা বলছে না দেখে জুলিনার পরানের মধ্যেও হাউকাউ করে। এই ব্যাপার টা’তো বুঝাতে হবে।
****
জয়ী আদনান কে প্রতিদিন রাতে ফোন করে। এটা অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে। প্রথম দিন ফোন করে বলল,
“শুনুন আপনাকে নিয়ে একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছি। ”
প্রথমে আদনানের ভারী ভালো লাগলো। মাঝরাতে ঘুম ভাঙানোয় খানিকটা বিরক্ত হলেও পরে ভালো লেগেছে। আদনান জিজ্ঞেস করলো,
“কী স্বপ্ন দেখেছেন?”
“দেখেছি আপনি শেরওয়ানি, পাগড়ী পরে বিয়ে করতে গেছেন। কিন্তু গিয়ে দেখেন যে বউ সেজেগুজে একটা ক্যাবলা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। ক্যাবলা ছেলেটা আবার আপনার বউয়ের ভাবীর আত্মীয় হয়। এদিকে বিয়ে করতে না পেরে আপনি ব্যাকুল হয়ে কাঁদছেন কারন মিডিয়ার সবাইকে ফেস করতে হবে। ”
আদনান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হতাশ গলায় বলল,
“খুব ই বাজে স্বপ্ন। ”
“হ্যাঁ। ভোরের দিকে দেখেছি তো, সত্যিও হতে পারে।”
“সত্যি হলে খুব খুশি হতেন মনে হচ্ছে?”
“না না। একজন মানুষ হিসেবে এই স্বপ্ন দেখার পর খুব খারাপ লাগছে। ”
“সো নাইস অফ ইউ জয়ীতা। ডোন্ট ওরি, আপনার স্বপ্ন সত্যি হবে না। কারণ স্বপ্ন দেখে কাউকে বলে দিলে সেটা আর ঘটে না।”
“ওহ। তবে নিশ্চিন্ত হলাম। ”
পরের দিন আবারও ফোন করলো। আদনান ভাবলো আজ আর ফোন টা ধরবে না। কিন্তু না ধরেও পারলো না। কেমন যেন মনে খচখচ করছিল। আদনান ফোন ধরে জিজ্ঞেস করলো,
“আজ আবার কী স্বপ্ন দেখেছেন?”
“না স্বপ্ন দেখিনি। একটা সিরিয়াল দেখছিলাম। প্রেগন্যান্ট ভাবীকে দুই ননদ সিড়ি দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিচ্ছে৷ ”
আদনান শব্দ করে হেসে ফেলল। জয়ীতা বিস্মিত গলায় বলল,
“হাসছেন কেন?”
“আপনি কী বাই এনি চান্স আমার সঙ্গে কথা বলার বাহানা খুঁজছেন?”
জয়ীতার গলার স্বর মুহুর্তেই পাল্টে গেল। বলল,
“আমি মোটেও ছ্যাঁচড়া না।”
এই বলে খট করে ফোন কেটে দিলো। পরের দিন জয়ী আর ফোন করলো না। আদনানের ঘুম হলো ছাড়াছাড়া। একটু পর পর উঠে ফোন দেখতে লাগলো। এভাবে কখন যে ফজর হয়ে গেল! ফজরের নামাজ পড়ে আদনান ঘুমালো। ঘুম ভেঙেছে দুপুর বারোটার পর।
***
বিয়ের তিন দিন আগেও জুলিনা জয়ীর সঙ্গে কথা বলল না। ফোন করলেও ফোন রিসিভ করে না। এদিকে ফোনে কথা বলাও দরকার। জয়ী নাকি বিয়েতে কটকটে কমলা রঙের লেহেঙ্গা পরবে। এই রঙ দেখলেই জুলিনার আবার মাথা গরম হয়ে যায়। কিন্তু ফোন করেও কথা বলতে পারে না। তাই বাধ্য হয়ে ম্যাসেজ লিখলো,
“আমি যা করেছি সেগুলো শুধু এতিম দের কথা ভেবে করেছি। তিনটা এতিম ছেলেমেয়ের কথা ভেবে করেছি। ভুল কিছু করিনি। মাঝেমধ্যে এতিম দের কথা ভাবতে হয়। ”
চলবে…..