#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-১৫
জয়ী ঢাকায় ফেরার দুদিন পর ই বাড়ি থেকে মা, বাবা এলো বিনা নোটিশে। মায়ের সঙ্গে বাবাকে দেখে জয়ী খানিকটা চিন্তিত হলো। বাবা সচরাচর আসেন না, হঠাৎ এলো নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো কারণ আছে। এরা আবার সবাই মিলে জোর করে ক্যাবলা অনীশের সঙ্গে বিয়ে দিবে না তো! অনীশ ব্যটা ক’দিন ধরে হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জারে সমানে বিরক্ত করছে। জয়ী অবশ্য ম্যাসেজ সিন করে নি। ভিতরে কী লিখেছে দেখার আগ্রহও হয় নি। কিন্তু বাবা, মা’কে দেখে ভয় লাগছে! জয়ী শুকনো ঢোক গিলল। কল্পনায় ওর আর অনীশের ভবিষ্যতও দেখে এলো। দেখলো ও শাড়ি পরে সেজেগুজে বসে আছে আর অনীশ ক্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে। জয়ী একটু লজ্জা পেল। অনীশ তখনও তাকিয়ে আছে। তার দেখা যেন শেষ ই হয় না।
কল্পনা শেষ করে জয়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“হে আল্লাহ এতো ভালো ছেলে আমার আসলে সহ্য হবে না। ব্যটা সারাক্ষন তাকিয়ে থেকেই কাটিয়ে দিবে। উফ কী বিরক্তিকর! ”
জয়ীর বাবা, মা জয়ীকে অবশ্য এখনো কিছু বলে নি। তারা এমন হাবভাব করছে যেন ঘুরতে এসেছে। কিন্তু জয়ী অপেক্ষায় আছে দুঃসংবাদ শোনার। কেন যেন মনে হচ্ছে দুঃসংবাদ ই হবে। এদের সুসংবাদ ওর জন্য শুভ হবে না।
***
আদনান ঘুরতে এসেছে একাই। বেশী না, তিনদিনের জন্য। ঘুরতে আসা বললে আসলে ভুল হবে। ঘোরাঘুরি করছে না মোটেও। রিসোর্টের ভেতরেই হেটে, বসে কফি খেয়ে একটা দিন কাটালো৷ বাকী দুটো দিনও এমনই কাটানোর ইচ্ছে। আদনানের কেন যেন মনে হচ্ছে ওর বিয়ে নিয়ে মহা ঝামেলা হবে৷ কী ঝামেলা হবে সেটা যদি আগে থেকে জানতে পারতো তবে কিছু ব্যবস্থা নিতে পারতো। আদনান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দীর্ঘ দিন আরাম আয়েশে থেকে থেকে ওর আর ঝামেলা ভালো লাগছে না। সব রকম ঝামেলা থেকে ও মুক্তি চায়।
আদনান পত্রিকার পাতা উল্টালো। গত কদিন ধরে পত্রিকায় আদনান ফয়সালের বিয়ে নিয়ে নানান কিছু লেখা হচ্ছে। যার কারনে টিমমেট, কলিগ দের কাছ থেকেও আদনান প্রচুর ফোন পাচ্ছে। কিন্তু ও বলবে কী! গতকাল ই শুনলো যে জয়ী এখনো পর্যন্ত জানেই না যে আদনানের সঙ্গে ওর বিয়ের কথা হচ্ছে।
****
জয়ীদের বাসায় সন্ধ্যেবেলা জুলিনা তাসিন আর নওশিন কে নিয়ে হাজির হলো। জুলিনা একদম শাড়ি পরে সেজেগুজে এসেছে৷ গাঢ় লিপস্টিক লাগাতেও ভুল করে নি। তবে দেখে মনে হচ্ছে একটা লিপস্টিকের অর্ধেক ই মাখিয়েছে। ঠোঁটের উপরে, থুতনিতেও লিপস্টিক লেগেছে হালকা। জয়ীকে দেখে যখন দাঁত বের করে হাসলো তখন ও দেখলো দাঁতেও লিপস্টিক লেগেছে৷ সৌমি ওর স্বভাবমত হাসতে লাগলো। জুলিনা জিজ্ঞেস করলো,
“হাসিস ক্যান বেক্কল?”
সৌমি হাসি বন্ধ করার চেষ্টা করলো। জয়ী বলল,
“হাসছে তোমার লিপস্টিক দেয়া দেখে৷ কপালেও খানিকটা মাখাতে।”
জুলিনা গেল লিপস্টিক ঠিক করতে। এই ফাঁকে তাসিন, নওশিনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেল জয়ী। এতক্ষন ওর বাবার জেরার মুখে পড়েছিল৷ ওর বাবা কলেজের টিচার৷ কম বয়সী ছেলেমেয়ে দেখলেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলে। জয়ী ভেবেই পায় না যে এতো কী প্রশ্ন করে। ছোটবেলায় তো ওর সমবয়সী কাজিন দের ডেকে সাতঘরের নামতা জিজ্ঞেস করতো। এখন কী করে!
জয়ী তাসিন নওশিন কে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“হাই গার্লস কেমন আছ?”
তাসিন জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি আমাদের সব জায়গায় ব্লক কেন দিলে? আমরা কী করেছি?”
জয়ী লজ্জা পেল। এই মেয়ে দুটো খুব ভালো। আদনানের জন্য এই দুজনের সঙ্গে ওর আচরণ টা খুব খারাপ হলো। জয়ী বলল,
“সরি। ”
নওশিন বলল,
“আমাদের বাসার সিড়িগুলো তো আমরা বানাই নি৷ তাই আমাদের উপর রেগে থেকে কী লাভ বলো!”
জয়ী হেসে ফেলল। বলল,
“ওই যে বলেছিলাম না, আমার মাথার ঠিক নেই। ”
ওরা দুজন হেসে ফেলল। তাল মিলিয়ে জয়ীও হাসলো।
****
জয়ীর মায়ের খাবার দাবারের বাহার দেখে জয়ীর সন্দেহ আরও প্রকট হলো। পায়েশ, পুডিং, পিঠে। তারপর আবার পোলাও, কাবাব, রোস্টের সরঞ্জাম রেডি। সৌমিও হাত লাগিয়ে কাজ করছে। জয়ী মায়ের অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“এতো আয়োজন কার জন্য মা?”
মা চাপা গলায় বলেন, কার জন্য আবার? জুলি আর বাচ্চা দুইটার জন্য।
জয়ী বুঝতে পারলো না যে তাসিন, নওশিন কোন দিক থেকে বাচ্চা। জয়ী বলল,
“আচ্ছা। কিন্তু আয়োজন দেখে তো মনে হচ্ছে কারোর বিয়ে লেগেছে। ”
জয়ীর মা থতমত খেল। সে সৌমির দিকে তাকালো। সৌমি এমন ভাব করলো যে কিছুই শুনতে পায় নি। জয়ীর খটকা লাগা আরও বাড়লো। ব্যাপার টা তো ও’কে বেশ ভাবাচ্ছে। জুলিনার কী কোনো ছেলে আছে নাকি! কিংবা পাতানো কোনো ছেলে! যাকে ওর সঙ্গে জুটিয়ে দিতে চাইছে।
জয়ী অনেক কিছু ভাবলো, কিন্তু আদনানের কথাই ভাবলো না।
***
জুলিনা এবার লিপস্টিক পাল্টে বেগুনি রঙের লাগিয়েছে। এবার অতি সচেতনতার কারনে পুরো ঠোঁটে লাগেও নি। অর্ধেক ঠোঁটে লেগেছে৷ জুলিনা হেসে হেসে জয়ীর বাবার সঙ্গে গল্প করছে। জয়ীর বাবাও তার লেকচার শুরু করে দিয়েছে। রান্নাঘরে মা আর সৌমি ব্যস্ত। জয়ী তাসিন, নওশিনের সঙ্গে কথা বলছে৷ কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা নওশিন, কোথায় যেন দেখলাম তোমার ভাইয়া বিয়ে করছে।”
নওশিন আড়চোখে তাসিনের দিকে তাকালো। তাসিন বলল,
“কোথায় দেখলে?”
“পত্রিকায় দেখেছিলাম মনে হয়। অবশ্য পত্রিকাওয়ালারাও আজকাল বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু লিখে। ”
তাসিন বলল,
“কী জানি! আমরা এখনো তেমন কিছু শুনিনি। ”
দুজনেই মিটিমিটি হাসছে। জয়ী বুঝতে পারলো না যে ওর প্রশ্নে হাসার মতো ঠিক কী ছিলো!
***
খাওয়া দাওয়া শেষে জুলিনারা চলে যাবার পর জয়ী জানতে পারলো ওর বিয়ের কথাবার্তা ও’কে ছাড়াই অনেক দূর এগিয়ে গেছে। পাত্রের নাম শুনে তো ওর চক্ষু চড়কগাছ। আদনান ফয়সালের সঙ্গে ওর বিয়ে! কেন?
জয়ী প্রথমেই না বলে দিলো৷ এরপর শুরু হলো বাবা, মা ইমোশনাল কথাবার্তা। মা তো এক পর্যায়ে কেঁদেই ফেলল। এতো ভালো ভালো পাত্র ফিরিয়ে দিচ্ছে এদের অভিশাপে জয়ীর হয়তো এরপর বিয়ে নাও হতে পারে। টানা দুই ঘন্টা চলল এই নাটক। জয়ী বারবার বোঝাতে চেয়েও পারলো না। দুজন দুদিক থেকে বোঝাচ্ছে। তার সঙ্গে ভাইও যুক্ত হয়েছে। সে আগে আসতে পারে নি তাই এখন এসে শুরু করেছে। জয়ী অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরে গেল। জুলিনাকে ফোন করে রাগী গলায় বলল,
“আন্টি এসব কী হচ্ছে? এই ছিলো আপনার মনে? ”
জুলিনাও কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“যেদিন থেকে তোকে চিনলাম সেদিন থেকেই আল্লাহ কে বলছি আল্লাহ এই মেয়ে যেন হারায়ে না যায়। আল্লাহ শুনছে। ”
“আন্টি আপনার নাটক বন্ধ করুন।”
জুলিনা নাক টানতে টানতে বলল,
“আমারে ভুল বুঝিস না। আমি যা করছি সব তাসিন, নওশিনের জন্য। নাহলে আদনান পিশাচিনীদের কাউকে বিয়ে করতো। তখন মেয়ে দুটো কমলাপুর রেল স্টেশনে ভিক্ষে করতো। সেটা কী ভাল্লাগতো?
জয়ী ফোন কেটে দিলো। জুলিনাকে জাস্ট অসহ্য লাগছে। তারচেয়েও অসহ্য লাগছে আজ ওর বাবা, মা’কে। বিয়ে নিয়ে যা শুরু করেছে!
জয়ী আদনানের ম্যানেজার কে ফোন করলো। ফোন ধরতেই বলল,
“আদনান সাহেবের ফোন নাম্বার দিন। ”
ম্যানেজার কে আদনান আগেই বলেছিল জয়ী যদি কথা বলতে চায় যেন দেয়া হয়। ম্যানেজার নাম্বার দিলো। জয়ী ফোন করলো না৷ আদনান কে টেক্সট পাঠালো,
“আপনার সাহস দেখে স্তম্ভিত। আমার ছয়শ বিশ টাকা মেরে খেয়ে এখন আমাকেই বিয়ে করতে চাইছেন? হোয়াই? মিডিয়ায় এই খবর ফাঁস করলে কপাল থেকে কিন্তু বিয়ে ঘুচে যাবে। ”
টেক্সট পাঠিয়ে শান্তি পেল।
চলবে….