#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
পর্ব-১
সাইমুন কে দেখলেই জয়ীর বুক ঢিপঢিপ করতো। এটা নতুন কিছু না। অনেক দিনের পুরোনো রোগ। সাইমুন দের বাসায় যতবারই যেত এই রোগ দেখা দিতো। সাইমুন অবশ্য চুপচাপ। জয়ীকে দেখলে হাই, হ্যালো, কী অবস্থা এরমধ্যে কথা শেষ করে ফেলতো। কিন্তু ছেলে কাজিন দের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতো। ক্রিকেট, রাজনীতি, সিনেমা সব বিষয়ে বিরক্তিহীন আড্ডা চলতো। বয়ঃসন্ধির পর প্রেম, ভালোবাসা ব্যাপার গুলো মেয়েরা আপনাআপনিই শিখে যায়। জয়ীও শিখে গেল। সাইমুন কে দেখলেই হৃদয়ে অদ্ভুত কাঁপুনি, ঝিমঝিম ভাব সব এসে যেত। সম্পর্কে সাইমুন ওর খালাতো ভাই। ছুতো পেলেই তাই ওদের বাসায় ছুটে যাওয়া। একসময় ব্যাপার টা সাইমুনের চোখেও পড়লো। জয়ী সাইমুনের ব্যবহার করা পারফিউমের বোতল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। সাইমুন সেটা দেখে বলল,
“জেন্টস পারফিউম পছন্দ জয়ী? আগে বললেই হতো একটা কিনে দিতাম। ”
জয়ী তখন লজ্জায় মাথানিচু করে ফেলল। সাইমুন তখন মুচকি হেসে বলল,
“আপাতত পড়াশোনাটা চালিয়ে যাও। বাকীটা পরে দেখা যাবে। ”
জয়ী যেন সেদিন আকাশের চাঁদখানাই হাতে পেয়ে গেল। এরপর শুরু হলো প্রেম। বয়সের ব্যবধানও দুজনের মধ্যে কম নয়। জয়ী তখন মাত্র ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছে। আর সাইমুন গ্রাজুয়েশন শেষ করে বাইরে পড়তে যাবার জন্য অপেক্ষা করছে। বাড়িতে তখনও জয়ীকে মোবাইল ফোন দেয় নি। ভাইয়ার ফোন থেকে লুকিয়ে মাঝেমধ্যে সাইমুন কে ফোন দেয়া হয়। সাইমুন বিরক্ত হতো না। ফোন ধরেই বলতো,
“হ্যালো জয়ী, কী অবস্থা? ”
জয়ীর গলা আটকে যেত। কী এক দম বন্ধ করা অবস্থা! অতিরিক্ত ভালোলাগায় তো মাঝেমধ্যে চোখে পানিও এসে যেতো। প্রেম আসলে লুকিয়ে চুরিয়ে হয়ও না। জয়ী ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু নাবিলাকে বলল। নাবিলা আবার ওর আরেক বন্ধুকে বলল। এভাবে করে পরিচিত দের সঙ্গে সঙ্গে অপরিচিতরাও জেনে গেল। জয়ীকে একটু চাপ দিয়ে সাইমুন কে দেখেও ফেলল সকলে। ছবি দেখে কারো কারো আবার হিংসায় জ্বলে যাবার মতোও অবস্থা! জয়ীর এতো সুন্দর বয়ফ্রেন্ড! আনস্মার্ট একটা মেয়ে এতো হ্যান্ডসাম ছেলেকে কিভাবে পটিয়ে ফেলল!
সাইমুন বাইরে যাবার পর এই ঘটনা আত্মীয় মহলেও সবাই জেনে গেল। প্রথমে জানলো জয়ীর কাজিন রা। রিতি আপু তো রীতিমতো চোখ, নাক কুচকে ফেলল! কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করলো, জয়ী আর সাইমুন! সিরিয়াসলি! কিভাবে সম্ভব!
এরপর মোটামুটি জয়ী সবার কাছেই পপুলার হয়ে গেল। ছোট রা তো কেউ কেউ ভাবী বলেও ডাকতে শুরু করলো। আর বড়রাও কেউ এখন আর জয়ীকে হেলাফেলা করে না।
প্রেমের সময় কারোর কারোর বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। আগে জয়ী পড়াশোনায় ভালো থাকলেও আস্তে আস্তে অধঃপতন হতে শুরু করলো। ইয়ার ফাইনালের রেজাল্ট দেখে বাবা মায়ের তো চক্ষু চড়কগাছ। একী রেজাল্ট! ক্যামেস্ট্রি তে মোটে চৌত্রিশ! ফিজেক্সে উনচল্লিশ!
পড়াশোনার প্রেশার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ব্যবহারের উপরও কড়া নজরদারি জারি হলো। জয়ী তখন কাঁদতে কাঁদতে সাইমুন কে সব খুলে বলল। সব শুনে সাইমুন বলল,
“ইটস ওকে জয়ী। আগে পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। বাকীটা পরে দেখা যাবে। ”
অনেক কষ্টে জয়ী পড়াশোনায় মনোযোগ দিলো। সব মিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। সপ্তাহে একদিন সাইমুনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায়। তবুও এই কষ্টটুকু মেনে নিয়েছে সুদিনের জন্য। সাইমুন বলেছে দেশে ফিরেই বিয়ে করবে। বেশী দেরি করবে না।
কিন্তু জয়ীর জীবনে সুদিন এসেছিলো অন্যভাবে। চৌদ্দমাস পর সাইমুন দেশে ফিরেছিলো ইন্ডিয়ান বান্ধবী মিশেল কে নিয়ে। জয়ী আর সাইমুনের নানু মারা যাওয়ায় ওদের আসতে হয়েছিলো। তখনই সাইমুন জানালো যে ও মিশেল কে বিয়ে করবে।
****
আদনান আবারও নোভার নাম্বারে ফোন করলো। এবারও একই দশা। কল বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে। আদনান দাঁড়িয়ে আছে ময়মনসিংহ স্টেশনে। নোভা ও’কে এখানেই দাঁড়াতে বলেছে। কমলাপুর কিংবা জয়দেবপুর স্টেশন ওদের জন্য রিস্ক জোন হয়ে যায় বলে এখানে দাঁড়ানো। আদনান ঘড়ির দিকে তাকালো। দুপুর একটা থেকে এখানেই আছে। খাওয়া বলতে একটা কলা আর এক স্লাইস কেক। এছাড়া আর কিছুই পেটে পড়ে নি।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। ফোন করেছে ওর বন্ধু সজল। আদনান ফোন টা ধরলো। ফোন ধরতেই সজল বলল,
“আন্টি বারবার ফোন দিচ্ছে। কী বলব?”
আদনান শুকনো ঢোক গিলল। আজ সকালে বাড়ি থেকে আসার আগে মায়ের ড্রয়ারে থাকা টাকার বান্ডেল টা নিয়ে এসেছে। এতক্ষনে নিশ্চয়ই মা বুঝেও ফেলেছে যে আদনান ই এই কাজ টা করেছে।
সজল নরম গলায় বলল,
“ঢাকায় চলে আয় আদনান। ”
“নোভা আমাকে এখানেই দাঁড়াতে বলেছে। যদি ও আসে?”
“ও আসবে না। দুপুরেই ওর বিয়ে হয়ে গেছে। জেনেও কেন শুধু শুধু অপেক্ষা করছিস। ”
আদনান এবার কেঁদে ফেলল। নিঃশব্দ কান্না না। শব্দ করেই কেঁদে ফেলল। সজল বলল,
“আদনান আমি কী আসব?”
আদনান কিছু বলল না। চুপ করে রইলো। ফোনের ওপাশে সজলও চুপ করে আছে। আদনান চোখ মুছে বলল,
“আসতে হবে না।”
“তাহলে ঢাকায় চলে যায়। লাস্ট ট্রেন টা মিস করিস না। ”
আদনান হ্যাঁ বলে ফোন টা কেটে দিলো৷ আবারও একবার নোভার নাম্বারে ফোন করলো। এবার ফোন টা বন্ধ। নোভা এরকম কেন করলো সেটাই ও বুঝতে পারছে না৷ প্রথমে ভেবেছিল হয়তো পালিয়ে আসার সুযোগ পায় নি। কারো কাছে ধরা পড়ে গেছে৷ কিন্তু নোভার বান্ধবী জিনিয়া ফোন করে জানালো নোভা ইচ্ছে করেই আসে নি। বরং বিয়েতে যেন আদনান কোনো ঝামেলা না করতে পারে তাই কৌশলে ও’কে দূরে সরিয়ে দেয়া৷
***
ট্রেনের টিকিট কেটে পকেটে রেখে প্ল্যাটফর্মে বসে রইলো আদনান। নোভার সঙ্গে ওর পরিচয় অনেক দিনের। একই স্কুলে পড়তো। নোভা ছিলো ফার্স্ট গার্ল। আদনান পড়াশোনায় ছিলো এভারেজ৷ তবুও ওদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। একসময় প্রেম ও হলো। আদনানের পড়াশোনা কোনোকালেই ভালো লাগতো না। ওর জীবনে ভালোলাগা কিংবা প্রায়োরিটির জায়গা ছিলো কেবল ক্রিকেট আর নোভা৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হলো! সবকিছুই ওর জীবন থেকে চলে গেল।
***
ভীড় ঠেলে ট্রেনে উঠে নিজের সিট টা খুঁজে পেল আদনান। পাশের সিটেই একটা মেয়ে বসে আছে৷ কেউ কারোর দিকে ঠিকমতো তাকাচ্ছে না। আদনান বসে আছে। সারাদিনের অভ্যাসমতো মোবাইলে তাকাচ্ছে একটু পর পর। ট্রেন চলছে ঝিকঝিক শব্দে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। রাত বেশী হয় নি যদিও।
হঠাৎ কী ভেবে যেন আদনান পকেটে হাত দিলো৷ ওয়ালেট টা নেই! আদনান দাঁড়িয়ে ভালো করে পকেট হাতাতে থাকলো৷ মেয়েটা এতক্ষন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেও এবার আদনানের দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
“কোনো সমস্যা?”
আদনান উদ্ভ্রান্তের মতো পকেট হাতাতে থাকলো। মেয়েটাও উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“পকেটমার হয়েছে?”
আদনান এবার কথা বলল। হ্যাঁ।
মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো,
“কত টাকা ছিলো? ”
“অনেক। পঁচিশ হাজার সাতশ। ”
“এতো টাকা কেউ সঙ্গে রাখে। তাও আবার এই ধরনের পাব্লিক প্লেসে!”
আদনান কিছু বলল না। মেয়েটা বলল,
“টাকা পাওয়া যাবে না। ওই চিন্তা বাদ দিন। বাসা পর্যন্ত যেতে যে টাকা লাগবে সেটা আমি দেব আপনাকে। এতো টেনশন করবেন না। ”
আদনান চুপচাপ বসে রইলো। নিজের দুঃখে এতোটাই কাহিল টাকার টেনশন তেমন হলো না। আশেপাশের কয়েকজন খুব আফসোস করলো। কেউ কেউ আদনান কে গাধা, বেকুব বলল৷
কমলাপুর স্টেশনে নেমে মেয়েটা নিজেই ওর বাসায় যাওয়ার খরচ দিলো। আদনান টাকাটা হাতে নিতে নিতে বলল,
“আপনার টাকাটা ফেরত কিভাবে দেব?”
“আমার নাম্বার টা রাখুন। সুযোগ বুঝে পাঠিয়ে দিবেন। ”
“আপনার নাম?”
“জয়ীতা।”
জয়ীতার দেয়া নাম্বারে আদনান যতবারই ফোন করেছে ততো বারই কর্কশ গলায় জবাব এসেছে রং নাম্বার। সেদিন হয় ও ভুল করেছিল নাম্বার তুলতে। নাহয় জয়ীতা ভুল করেছিল। তাই আর টাকাটা ফেরত দেয়া হয় নি।
চার বছর পর জয়ীতা আর আদনানের দেখা হলো। জয়ীর মনে না থাকলেও আদনান ও’কে দেখেই চিনে ফেলল।
দেখা হবার ধরন টা একটু অন্যরকম। আদনান এখন ক্রিকেট প্লেয়ার। জাতীয় দলে শুরু থেকেই ভালো খেলছে। ভক্তদের জন্য রাস্তাঘাটে বেরোনোও মুশকিল। ছুটি কাটাতে তাই দেশের বাইরে যেতে হয়। টিমমেট দের সঙ্গে দিল্লীতে গিয়েছিলো ঘুরতে। এক রেস্টুরেন্টে বাঙালী ভক্তদের সামনে পড়ে গেল। আদনান ঝামেলা এড়াতে ভক্তদের পাশ কাটিয়ে চলে আসতে গেলে একটা মেয়ে শক্ত করে ওর হাত ধরে বলল,
“আমাদের টাকায় ঘুরতে এসে বাহাদুরি! যারা যারা সেলফি তুলতে চায় সবার সঙ্গে তুলবেন। ”
আদনান অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। এই তো সেই মেয়ে। জয়ীতা! কী আশ্চর্য! নামও মনে আছে।
চলবে…