#কোকিলারা
#লেখিকা- মোর্শেদা হোসেন রুবি
#পর্ব- ০১
সাধারণত বাসর রাতের গল্পগুলো একটু অন্যরকম হয়। মন কেমন করা একটা উদাসী ভাব জাগে মনে। তার উপর যদি নবদম্পতির মধ্যে রেশারেশি থাকে তাহলে তো কথাই নেই। ঐ বাসর রাতের টুইস্টই আলাদা। আমি ইদানিং ফেসবুকে এসব গল্পই খুঁজে খুঁজে পড়া শুরু করেছি। এ ধরণের গল্পের প্রথম অভিজ্ঞতা হয় গত কয়েক মাস আগে। ঘনিষ্ট বান্ধবী মুনের মারফত। ও’ই আমাকে যাবতীয় গল্পের লিঙ্ক সাপ্লাই করত। গত সপ্তাহেও ওর দেয়া একটা গল্প পড়লাম যেখানে নতুন স্বামী স্ত্রী পরস্পরের জানের শত্রু। কেউ কাউকে দেখতে পারেনা। তবু কেমন করে যেন বিয়েটা হয়ে গেল। অদ্ভুত ব্যপার। ব্যপারটা অনেকটা এরকম, যেন বাসর রাতে দুজন ঝগড়া করবে বলেই বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত দুজন নিরীহ সেজে ছিল। যেইনা বিয়ে হলো অমনিই সে কী ঝগড়া। ঝগড়ার একপর্যায়ে ডাবল বেড। অর্থাৎ স্বামী ফ্লোরে আর স্ত্রী বিছানায়। ঝগড়ার গোড়াতেই স্ত্রী স্বামীকে সতর্ক করে বলে দেয়, ‘ ভুলেও যদি আমাকে ছোঁবার চেষ্টা করিস তো তোর একদিন কী আমার একদিন।’ ডায়ালগটা সেই লাগে। আসলে এসব গল্পে টেনেহিঁচড়ে নব দম্পতিকে এক ছাদের নিচে জড়ো করা হয় এবং এটা করতে গিয়ে কোন যুক্তির ধার ধারা হয় না। আমাদের কারো মনে কখনোই এই প্রশ্নই জাগে না যে এত মুখরা মেয়ে বা এত ঝগড়াটে ছেলে কেন চুপচাপ পরস্পরকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল। কোন যুক্তিতে। তবে গল্প পড়তে গেলে পাঠক নিজেই জেনে যাবে যে ওরা আসলে জানতোই না কার সাথে ওদের বিয়ে হচ্ছে। দেখা গেল বাসর ঘরে ঢুকেই বর বধূকে বা বধূ বরকে বলছে , “এ কী, তুই…?” হাউ ইনোসেন্ট। যাই হোক, গল্পের এই অংশটুকুর সাথে সত্তর আশি দশকের সময়ের একটা মিল পাই আমরা কচিকাঁচা পাঠকরা। তবে গল্প যেমনই হোক, প্রতিটা গল্পই পড়তে গিয়ে বারবার শিহরিত হতে হয়। ছুঁতে না দেবার সংকল্প থেকেই বারবার অকারণ ছোঁয়াছুঁয়ি। আহা, সে কী রোমান্টিক মুহূর্ত।
সেদিনও রাত এগারোটার দিকে খেয়েদেয়ে মোবাইলটা নিয়ে বসেছিলাম। মুন একটা নতুন গল্প পাঠালো। পড়তে গিয়ে বুঝলাম পুরোটাই আঠারো প্লাশ। টানা পড়ে শেষ করতে গিয়ে একেবারে রাত তিনটা বেজে গিয়েছিল। ব্লাডারের প্রচন্ড চাপ উপেক্ষা করে এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেছি গল্পটা। তবু কম্বল থেকে বেরোইনি । দুর দুরু বুকে অপেক্ষা করেছি কখন সেই চরম রোমান্টিক মুহূর্তটা আসবে। যখন মাঝরাতে স্বামী বেচারার ঘুম ভেঙে যাবে আর পানি খেতে গিয়ে, নয়ত সিগারেট টানতে গিয়ে দেখবে বউ ঘুমিয়ে কাঁদা। ওর আঁচল সরে গেছে নয়ত পা বেরিয়ে গেছে ইত্যাদী। প্রচন্ড রকমের সুড়সুড়িমূলক ছিল গল্পটা। পড়তে গিয়ে ব্লাডারের চাপের পাশাপাশি আরো কিছু চাপ আমাকে বেসামাল করে দিচ্ছিল। প্রবল প্রেষণা চেপে এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে শেষ পর্যন্ত শুতে গেলাম। তখনও জানতাম না আমার জীবনটাও এমনই একটা গল্প যা একদিন ফেসবুকের পাঠকরা পড়বে। এটাও জানতাম না যে, গল্পের রোমান্টিক মুহূর্ত বাস্তবে আদৌ ততটা রোমান্টিক নয়। স্বামী ছুঁতে এলে শিহরণ তো জাগেই না চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। এসব গল্পের শেষটা যেমনই হোক, পুরোটাই আসলে এক বুক কষ্টের সমষ্টি।
তবে ঐ দিনের পর থেকেই এ ধরনের গল্পের নেশা চেপে গিয়েছিল। মনে মনে নিজেকে ঐ নায়িকার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে শুরু করলাম। ফেসবুকে খুঁজে খুঁজে এ ধরণের গল্পই বেশি পড়তে লাগলাম, যার স্টার্টিং লাইনেই থাকবে নায়িকার শরীর আর নায়কের হাভাতে চাহনীর বর্ণনা। পুরোপুরি ভক্ত হয়ে গেলাম এ ধরণের লেখার। যদিও গল্পগুলো পড়তে গেলে লেখার ধরণটা কেমন যেন কাঁচা মনে হতো। আর এটা বুঝতাম পাঠ্য বইয়ের গল্পগুলো থেকে। ওগুলো পড়ার সময় আলাদা করে ‘পড়ছি’ অনুভূতিটা মনে জাগ্রত হতোনা বরং ওগুলো পড়তে গেলে আপনা হতেই গল্পের ভেতর ঢুকে যাওয়া হয়ে যায় আর এগুলো পড়তে গেলে চৌদ্দবার হোঁচট খেতে হয় আর বেশ বুঝে বুঝে পড়তে হয় বলে কিছু জায়গায় বিরক্তও লাগে। তবে বিষয়বস্তু রসালো বলে কষ্টটা গায়ে লাগেনা। সম্ভবত
এসব গল্পে প্রচুর টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করা হয় বলে খেয়ে দারুণ মজা পেতাম আমরা। খাবারটা উপকারী খাদ্য না বাসিপচা অখাদ্য সেটা যাচাই করার মানসিকতাটা ততদিনে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মনে সারাক্ষণ প্রেম প্রেম ভাব। শেষ পর্যন্ত প্রেমেও পড়ে গেলাম। কলেজের এক সিনিয়র ভাইয়ার সাথে। ভর্তির দিন থেকেই ভাইয়া আমাকে সুইটি বলে ডাকত। নবীন বরণের দিন তো ভাইয়া বলেই ফেলেছিল, আমি নাকি সাংঘাতিক সুইট। তারপর দেখা হলেই হাই হ্যালো আর চটপটি ফুচকা। এভাবে ক্রমে ক্রমে ভাইয়াটা কীভাবে যে আমার সাঁইয়া হয়ে গেল টেরই পেলাম না।
হঠাৎ একদিন মাথায় বাজ পড়ল আমার। ভাইয়ার সাথে প্রেম জমে ক্ষীর হবার আগেই আমার বড় ফুপু হুট করে কোত্থেকে যেন এক বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলেন আমার জন্য। ছেলে উচ্চশিক্ষিত, ভালো বংশ। নামকরা এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ভালো স্যালারি পায়। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি। পাত্রের পুরো পরিবারকে ফুপু ভালভাবে জানেন তাই খোঁজখবর করে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। ফুপুর কথায় বাবা থেকে শুরু করে বাড়ির কাজের মেয়েটা পর্যন্ত এক লাফে রাজি হয়ে গেল সেদিন। বাবা ওদের আসতে বলে দিলেন আর তারই ফলশ্রুতিতে আজ আমি ঐ উঁচু বংশের পাত্রের শোবার ঘরে বসে ডাইরী লিখছি। আনা ফ্রাঙ্কের ডাইরী। যদিও আমার নাম আনা ফ্রাঙ্ক নয়। নিকিতা জামান আনা।
-” কী করছো আনা ? ” পুরুষ কণ্ঠের ডাকে চমকে তাকালাম। আমার সদ্য বিবাহিত স্বামীপ্রবর কখন যে আমার খাটের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন টেরই পাইনি। অজান্তেই ডাইরী ধরা হাতটা পেছনে নিয়ে গেলাম। লোকটা অবশ্য আমার ডাইরি দেখার ব্যপারে তেমন উৎসাহ দেখালেন না। ধুপ করে বিছানায় বসে পড়ে বললেন ,” বাইরে যে কী অবস্থা। মেহমানের ভিড়ে শান্তিতে একটু বসারও উপায় নেই। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়েই এ ঘরে চলে আসতে হলো। তুমি খেয়েছ ? ” আন্তরিক কণ্ঠ লোকটার। আমার খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু তার বিপরীতে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল আমার। তীব্র ক্ষোভ নিয়ে তাচ্ছিল্যভরে বলে উঠলাম, ” আপনাদের বাড়িতে এরচে ভাল আর কী আশা করেন আপনি ? সব তো খেত থেকে উঠে আসা পাবলিক। এরাই আপনার ফ্যামিলি। দেখলেই বোঝা যায় পুরো গ্রাম শুদ্ধ উঠে এসেছে। এতো বড় ব্যাটেলিয়ানের মাঝখানে থাকতে হবে জানলে…!”
-” জানলে ? ” লোকটার চোখে কৌতুক, ঠোঁটে স্মিত হাসি। মনোযোগ হাতের ঘড়ির দিকে। ওটা খোলার চেষ্টা চলছে। লোমগুলো ঝামেলা করছে বলে দেরী হচ্ছে।
-” জানলে ভুলেও পা বাড়াতাম না। প্রথমেই মানা করে দিতাম। ”
-” লোকজন তো সব দুদিনের জন্য। সাময়িক কিছু লোকের জন্য আমাকে বিয়ে করতে না ? স্ট্রেঞ্জ।”
-” সাময়িক না স্থায়ী সেটা বিষয় না। বিষয় হচ্ছে আপনি তাদের একজন। কাজেই ওদের দেখলেই আপনাকে দেখা হয়ে যায়।” রাগের মাথায় কথাটা বলে লোকটার চেহারায় রাগ বা অপমানের চিহ্ন দেখার আশায় তাকালাম। কারণ আমার প্রচন্ড ইচ্ছে হচ্ছে লোকটাকে আমি ইচ্ছেমত অপমান করে তুলোধুনো করে ফেলি। এই লোকটার অতি আদিখ্যেতার জন্যই আজ আমি এখানে। নইলে এসময় আমি রাজিবের পাশে থাকতাম। ওর বাইকের পেছনে বসে দুরন্ত বাতাসে উড়ন্ত চুল উড়িয়ে ছুটে যেতাম দুর দুরান্তে আর নয়ত কোন দারুণ ক্যাফে শপে বসে রিকিঝিকি মিউজিকের সাথে সময়টা কাটাতাম। সেসব না করে আমি এই বেকুবটার ঘর সামলাচ্ছি। ইতোমধ্যে সকাল থেকে দু’বার চা পর্ব সমাধা হয়ে গেছে। আর আমি অভাগি সেই চা বানিয়ে কাজের মেয়ের হাতে তুলে দিয়েছি সার্ভ করার জন্য। কারণ তারা সবাই নাকি আজ আমার হাতে চা খাবেন।
-” এক গ্লাস পানি দিতে পারবে ? ” ঘড়িটা বেড সাইড টেবিলে রেখে বলল লোকটা। তীব্র স্বরে বলতে চাইলাম, নিজের হাত নাই, নিয়ে খেতে পারেন না ? কিন্তু চিরাচরিত কিছু সংস্কারবোধ থেকেই কথাটা ঠিক ঐভাবে মুখে আনতে পারলাম না। উষ্মার সাথে বললাম, ‘ পারব না কেন। এই কাজের জন্যই তো দুনিয়াতে এসেছি। নারীরা পুরুষের খেদমত করবে এটাই তো নারীর ধর্ম। ” বলে বিছানা ছাড়তে গেলে লোকটা আমার হাত ধরে ফেলল। মন বলল সে হাত ধরার বাহানা খুঁজছিল আসলে। আমার এই কথায় সেটা পেয়ে গেল।
-” আসলে ব্যপারটা এরকম না। আমি তোমাকে আদেশ করিনি। এটা নিছক আবদার বলতে পারো। নববধূর হাতে পানি খেতে চাওয়া নিশ্চয়ই অন্যায় নয়। তুমি মাইন্ড করবে জানলে আমি বলতামই না। ”
-” হয়েছে, হাত ছাড়েন। খপাখপ হাত ধরবেন না তো। আপনার হাতগুলো সাঁড়াশির মত। আমি ব্যথা পাই।”
-” ওহ্, স্যরি।” দ্রুত হাত ছেড়ে দিয়ে সে নিজেই উঠে গেল পানি আনতে। তবে আমার মনে সেটা খুব একটা আনন্দ যোগালো না। লোকটাকে অপমান করে সুখ পাচ্ছিনা আমি। যা’ই বলি সে মেনে নেয় বা মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে। এরপরে আর কী করতে পারি আমি। নাটক সিনেমার মত ভাঙচুর করার মত মানসিকতা জোটাতে পারব না কোনদিনও। কারণ সেটা করলে সবার আগে আমার বাপ ছুটে এসে ঠান্ডা চোখে আমার দিকে একঘন্টা তাকিয়ে থেকে বলবে, ” হাউ কুড ইউ পসিবলি ডু ইট? ” আব্বুর ঐ মৎসশীতল চাহনীর চেয়ে এই ব্যাটাকে সহ্য করা অনেক সহজ। তারচে এক কাজ করা যাক। একে অন্যভাবে সাইজ করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা কীভাবে জানি না। মুনকে ফোন দিতে হবে। এসব উদ্ভট আইডিয়া ওর মাথায় ভাল আসে। ওর বুদ্ধিতেই তো আমি পুরো বাসর রাত নাক ডেকে ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। এটাও ওরই দেয়া বুদ্ধি ছিল যে লোকটা গা ছুঁলেই চিৎকার করে তাকে হতচকিত করে দেব। বেচারার চেহারা সেদিন দেখার মতন হয়েছিল। সে শুধু জানতে এসেছিল রাতের খাবার খেযেছি কিনা। তাতেই এমন বিকট চিৎকার মেরেছি যে লজ্জায় গত দুদিন ধরে না ছুঁয়ে দুরে বসে কথা চালাচালি করছে। আমি মনে মনে হেসেছি আর ভেবেছি, অপেক্ষা করো, আরো কিছু উত্তমমধ্যম অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।
আজ আমার বিয়ের সপ্তম দিন। বাড়ির পরিবেশটার সাথে মোটামুটি খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছি। অবশ্য এজন্য ঐ আবাল পাবলিকটাকে মনে মনে কৃতিত্ব না দিয়ে পারছি না। ধৈর্যের প্রবল পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে চলেছেন ভদ্রলোক। ধণুর্ভঙ্গ পণ তার। আমাকে তার ভালোমানুষি দিয়ে বশ করবেন। আমি যদিও মুখে কিছু বলিনা তবে মনে মনে হাসি আর ভাবি, একটু অপেক্ষা করো। কিছুদিন পর হাম দিল দে চুকে সানাম মুভির মত, আমাকে রাজিবের হাতে তুলে দিয়ে আসতে বাধ্য হবা ভালমানুষ স্বামী আমার। অবশ্য যদি তোমার এই রূপটা ওরিজিনাল হয়ে থাকে।
সন্ধ্যের পরপর চা নাস্তা সেরে টিভি দেখছিলাম। বাড়িতে মেহমানের চাপ অনেকখানিই কমে গেছে। ক্ষেতুগুলো সব ক্ষেতে ফিরে গেছে। শ্বশুর মহাশয় নিজের রুমে বসে হয়ত টিভি দেখছেন আর শ্বাশুড়ি আম্মা গেছেন তার এক আত্মীয়াকে দেখতে। সে নাকি হঠাৎ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। শ্বাশুড়ি সেখানেই দৌড়াচ্ছে।
পাশেই রাখা আমার সেলফোনটা বাজলে না তাকিয়েই রিসিভ করলাম। ভাল করেই জানি ঐ বেকুবটা ফোন করেছে আর নয়ত আমার মা জননী । এ সময়টাতে এরা দুজনই ফোন করে। হ্যালো বলেই লাফিয়ে উঠলাম রাজিবের কণ্ঠ শুনে। ঢোক গিলে বললাম, ” তুমি ? ”
-” হ্যাঁ, আমি। কেমন আছো জানতে চেয়ে ফোন করলাম। বন্ধু হিসেবে এতটুকু অধিকার নিশ্চয়ই আছে আমার, কী বলো সুইটি? ”
বুকের ভেতর কাঁপন জাগালো নামটা। কাঁপা স্বরে বললাম, সাতদিন পর তোমার আমার কথা মনে হলো ? ”
-” আগে কীভাবে ফোন দিতাম বলো ? তুমি নিশ্চয়ই এক ঝাঁক দর্শনার্থী পরিবেষ্টিত হয়ে বসে ছিলে। আজ মনে হলো, তোমাকে ফ্রি পাবো। তাই সাহস করে ফোন দিলাম।”
-” আমাকে ফোন দেবার জন্য তোমার সাহসের এত আকাল পড়ে যাবে, আগে বুঝিনি তো।” বলতে গিয়ে সম্ভবত কিছু ক্ষোভ ঝরে থাকবে। রাজিব দ্রুত বলে উঠল, ” তোমাকে ফোন দেবার জন্য বা তোমার সাথে দেখা করার জন্য আমার সাহসের আকাল কোনদিনই পড়েনি আর পড়বেও না। বরং তুমি ভেবে দেখ যে তুমি আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারবে কিনা।”
-” না পারলে কথা বলছি কীভাবে ? ”
-” নিশ্চয়ই আশেপাশে কেউ নেই।”
-” থাকলেই বা মানছে কে ! ” কিছুটা দাম্ভিক শোনালো আমার কণ্ঠস্বর।
রাজিব উৎফুুল্ল হল, ” ওয়াও। দ্যাটস দা স্পিরিট। তাহলে আমরা মোলাকাত করতে পারি কী বলো ? ”
-” তা তো পারি কিন্তু এই সাক্ষাতের ভবিষ্যত কী সেটাও তো আমাকে জানতে হবে।” কথাটা কিছুটা অভিমান থেকেই বললাম কারণ এই গাধাটার সাথে বিয়ে হবার আগের রাতে রাজিবকে অনেকবার ফোন করেও পাইনি আমি। পরদিন যাওবা পেলাম রাজিব পালিয়ে যেতে রাজি হলো না। উল্টো আমাকে সবকিছু মেনে নিতে বললো কারণ ওর মায়ের শরীর নাকি খুব খারাপ। বাসায় এখন এসব নিয়ে কথা বলতে পারবে না।
-” ভবিষ্যত কী বলতে ? ” রাজিব বলল।
-” ভবিষ্যত কী তুমি বোঝো না ? আমি কী এই খ্যাত মার্কা বেকুবের সংসার করব সারাজীবন ? ”
-” ওহ্ আচ্ছা। এই কথা। আসলে এটা বেশ লম্বা আলোচনার ব্যপার। সামনা সামনি বসে কথা বলে সমাধানে আসতে হবে আমাদের। ফোনে এসব আলোচনা হয় না। কবে দেখা করতে পারবে বলো।”
-” তুমি চাইলে কালই মিট করতে পারি।”
-” বাব্বাহ্, বেশ সাহসী হয়ে গেছো মনে হয় ? ”
-” পিছুটান বা হারাবার ভয় মানুষকে ভীতু করে। দুটোর কোনটাই আমার নেই। ভয় বলতে একমাত্র বাপি। নইলে এদের ফিলিংসের চারআনা দামও আমার কাছে নেই। আমি তো কেবল বাপির কথা ভেবেই রাজি হয়েছি। তার উপর তুমি সেসময় চট জলদি কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারোনি। সবমিলিয়ে আমাকে রাজি হতে হয়েছে। নইলে, আমাকে ইয়েস বলানো অত সহজ ছিল না।”
রাজিব কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে বলল, ” ওকে, কাল দেখা হচ্ছে তাহলে? আমাদের রঁদেভূতে চলে এসো।
-” ঠিক সকাল এগারোটায়।” আনা যোগ করল।
-” ওকে, ডান।”
=====
-” কলেজে যাবে ? সকালে ? ” সশব্দে কুলকুচা করতে করতে বলল লোকটা। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে আমার। আক্কেল বলিহারি। ঘরের ভেতর যে মানুষ বেসিন দেয় এটা এই বাড়িতে না এলে জানা হত না। বারান্দায় যাবার দরজাটার পাশেই একটা পিলার পড়ায় তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে এরা। চিপার মধ্যে বেসিন ঢুকিয়ে দিয়েছে যত্তসব। রেগে কাঁই হয়ে মুখ গোঁজ করে বসে রইলাম। জবাব দিলাম না কথার। কারণ জবাব দিলেই কথা চালাচালি হবে। বেকুবটা বেসিনের কাজ শেষ করে ফিরে আসুক তারপর যা বলার বলব। আমাকে নিরব দেখে সে আর কিছু বলল না। শব্দ করে কুলি ফেলল। তারপর তোয়ালে হাতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল, ” কাল কিছু আছে নাকি কলেজে ? ”
-” কিছু না থাকলে যাওয়া যাবেনা নাকি ? ” মুখোভাব কঠিন করে বললাম। লোকটা কী বুঝল কে জানে। থমকে গিয়ে বলল,” না, তা তো অবশ্যই না। এমনিই জানতে চাইলাম। তোমার ওপর আস্থা আছে আমার।”
কথাটা আমার বহ্মতালু জ্বালিয়ে দিল,” হোয়াট ডু ইউ মিন বাই আস্থা আছে ? এটা বলে কী প্রমান করতে চাইলেন আপনি ? যেন আমি বাইরে গিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু না করি ?”
লোকটা আহত চোখে তাকাল।
-” আমি এসব ভেবে বলিনি আনা। বুঝতে পারছিনা, কেন তুমি আমার প্রতিটা কথার কদর্থ করছো। আমি তো শুধু বলতে চেয়েছি…!”
-” থাক্। আর সাফাই গাইতে হবে না। আপনাদের ছেলেদের আমার ভাল করে জানা আছে।” মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম। সেও বেহায়ার মত হেসে বলল,
-” কিন্তু আমার জানা নেই। এ ব্যপারে আমাকে নভিসই বলতে পারো। আচ্ছা, এসব কথা রেখে আমাকে নাস্তা দাও। ” বলেই দ্রুত সচকিত ভঙ্গিতে বলল,” স্যরি, নাস্তা চাইলাম বলে আবার মাইন্ড করলে নাকি ? ”
কড়া চোখে তাকিয়ে উঠে পড়লাম নাস্তা আনতে। মাথায় একটার পর একটা পরিকল্পনা সাজাচ্ছি একা একাই। কোনটাই মনমত হচ্ছেনা। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম আগে রাজিবের সাথে কথা বলব। তারপর যা করার সেভাবেই করব। আন্দাজে এটা সেটা ভেবে লাভ নেই। দেখি রাজিব কী বলে।”
চলবে….