ঠোঁটের উপর গভীর স্পর্শ অনুভুতি হতেই নীতির সারা শরীরে ঝংকার দিয়ে উঠলো। চোখ বন্ধ করেও অনুভব করছে কেউ তার উপর উবু হয়ে শুয়ে আছে। তাকে গভীর নয়নে দেখছে। সেই দৃষ্টি খুব একটা শুভ নয়। বাহিরে মেঘের গর্জন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে আলোর ঝলকানিও রুমে আসছে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতির তান্ডব ব্যাতীত আর একটি শব্দ স্পষ্ট, তা হলো কারোর নিঃশ্বাসের শব্দ। রাত যথেষ্ট গভীর সেটা চোখ বন্ধ করেও নীতি বুঝতে পারছে। চোখ কি খোলা উচিত? বুকের ভেতর কিছু অজানা ভয় কাজ করছে। আচ্ছা এটা তো অবচেতন মনের একটা খেলাও হতে পারে। নীতির মনে হতে লাগলো তার উপরে উবু হওয়া মানুষটি মুখ ছেড়ে নিচে নামছে। গলায়, বুকে নিঃশ্বাসের আনাগোনাটা আরো গাঢ় হতে লাগলো। এক বুক সাহস একত্রিত করে চোখ খোলার সিদ্ধান্ত নিলো সে। চোখ খুলতেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। পুরো ঘর অন্ধকার। কিন্তু এই অন্ধকারেও কারোর গাঢ় অবয়ব তার উপর দেখতে পাচ্ছে। এটা কি সত্যি! নাকি ক্লান্ত মস্তিষ্ক তার সাথে খেলা করছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালে আলোর ঝলকানিতে রুমের ভেতর কয়েক সেকেন্ডের জন্য ও আলোকিত হলো। নীতির বুক টিপটিপ করছে, কারণ তার উপর সত্যি ই একটি পুরুষ উবু হয়ে আছে। আলো ছায়ার খেলাতে শুধু তার মুখটি স্পষ্ট দেখতে পারে নি নীতি। সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। মাথা কাজ করছে না, কি হচ্ছে এসব। এসব তো আগে কখনোই হয় নি। হাতের ডানে থাকা টেবিল ল্যাম্পটা অন করতে হাত বাড়ায় নীতি। বুকের ভয়গুলো ক্রমশ বাড়ছে। লাইটটা অতিদ্রুত অন করেই চোখ মেলে সে। রুমে মানুষ তো দূরে থাক একটা মাছির চিহ্ণটুকু নেই। তবে কি মনের ভুল ছিলো? লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে নীতি। এখনো বুক কাঁপছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে, একটু আগের দেখা কি তবে ভুল? জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে নীতি। সাইড টেবিলে রাখা পানির গ্লাসের সবটুকু পানি ঢকঢক করে খেলে নিলো সে। রুমের দরজার দিকে তাকালে দেখতে পায় তা ভেতর থেকে লাগানো। তার মানে ঘরে কেউ ই আসে নি। জানালাটা বাদে কিছুই খোলা নেই। আর জানালা দিয়ে আশাটা এতো সোজা নয়। কারণ জানালায় একে গ্রিল দেওয়া আর তারা আপাতত পাঁচ তলাতে থাকে। রুমের বারান্দার দরজাটাও ভেতর থেকে আটকানো। একটা মানুষের পক্ষে এতো দ্রুত জানালা থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। স্বপ্ন ছিলো, একটি ভয়ংকর স্বপ্ন। বুক চিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরোলো নীতির। এবার শান্তির ঘুম দিতে পারবে। জানালাটা লাগিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ভয়টুকু পুরোপুরি কাটে নি আদৌ কি কেউ ছিলো না??
সকাল ৮টা,
ডাইনিং টেবিলে সবাই নাস্তা করতে ব্যস্ত। নীতির বাসায় মাত্র চারজন মানুষই থাকে। নীতি, তার বাবা-মা এবং পুরোনো কাজের মেয়ে শালুক। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে নীতি, অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করছে সে। নীতি, আদনান সাহেব এবং ফারহানা বেগমের একমাত্র মেয়ে। তারা দুজন ই চাকুরিজীবী। সর্বদা বাসায় তাদের থাকাটা হয় না। তাই শালুককে রাখা যাতে নীতি একা একা না থাকে। কাল রাতের ব্যাপারটা এখনো বেশ ভাবাচ্ছে তাকে। বাবা কিংবা মাকে এব্যাপারটা বলা কি ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না নীতি। কিভাবে বলবে, কাল স্বপ্নে দেখে কোনো পুরুষ তাকে চুমু খাচ্ছে? তার মনে হয়েছিলো সত্যি সত্যি কেউ তার সাথে অসভ্যতামি করছিলো। ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায় না! নাস্তা শুধু নাড়াচড়া করতে দেখতে আদনান সাহেব নীতিকে জিজ্ঞেস করে,
– নীতি, মা তোমার কি শরীরটা ভালো নেই?
হঠাৎ এমন প্রশ্নে বেশ হতচকিয়ে উঠে নীতি। নিজেকে সামলে ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বলে,
– না তো বাপি, কেনো বলোতো?
– তাহলে খাচ্ছো না যে?
– খাচ্ছি তো, আচ্ছা বাবা স্বপ্ন দেখলে কি কখনো সেটাকে সত্যি মনে হয়?
– বুঝলাম না কথাটা?
– না মানে ধরো, তুমি দেখছো তুমি পানিতে বসে রয়েছো, আবার তোমার অনুভূতি ও হচ্ছে যেন তুমি সত্যি পানিতে বসে রয়েছো। এমন হয়?
– হুম হতেই পারে, এটাকে বলে “lucid dreaming” খুব স্ট্রেসড হলে এরুপ ড্রিম হয়।
– তোমার ও হয়?
– হুম হয়তো, সেদিন স্বপ্নে দেখছিলাম তোমার মায়ের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে। এবং আমি আসলেই তার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করছিলাম, হাহা
আদনান সাহেবের ঠেস মারা কথার উত্তরস্বরুপ ফারহানা বেগম ও বলে উঠেন,
– এমন স্বপ্ন তো আমিও দেখি, একদিন স্বপ্ন দেখেছিলাম তুমি রেশমির সাথে বেডরুমে রঙ্গলীলা করছিলে আর আমিও রেগেমেগে তোমার রেশমির চুল টেনে ধরেছিলাম। সেদিনের স্বপ এখার পর আমারো মনে হয়েছিলো আমি সত্যি সত্যি একজনের চুল টানছি।
– এখানে রেশমিকে টানছো কেনো?
– তুমি তবে আমাকে টানছো কেনো?
– মাঝে মাঝে সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হয় কেনো তোমার মুখ দেখতে হবে? কি দূর্ভাগ্য আমার!
– আমার ও জানো না?
মা-বাবার এইরকম ঝগড়ায় অভ্যস্ত নীতি। তাদের সম্পর্কটা একেবারেই ভালো নয়। দু জন দু জনকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। শুধুমাত্র নীতির কারণেই আজ এক ছাদের নিচে রয়েছেন তারা। নীতি যখন ক্লাস ফোরে পরে তখন এক্সট্রা ম্যারেটাল এফেয়্যারে জড়ান আদনান সাহেব। রেশমী নামক মহিলাটিকে বিয়ে করবেন বিধায় ফারহানা বেগমকে তালাক অবধি দিতে চান। নীতি তখন ছোট ছিলো বিধায় শেষ পর্যন্ত আবার সংসারে ফিরে আসেন আদনান সাহেব। কিন্তু সেই সংসার আর সংসার থাকে না। একটা পায়ের শিকল হয়ে দাঁড়ায় দুজনের কাছেই। প্রতি নিয়ত বাবা-মার মাঝে অকথ্য ভাষায় ঝগড়া, কথা কাটাকাটি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে নীতি। বদ্ধ দরজার ভেতরে কান্নাকাটি করতো খালি। একটা সময় ভালো থাকার জন্য নিজের মনের সাথেই মাইন্ড গেম খেলা শুরু করে সে। তার কাছে মনে হতে এটাই বাবা-মার ভেতরকার ভালোবাসা। তারা তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এভাবে করেন। এই ছলনার দুনিয়াতে এখনো তার বসবাস। চব্বিশ বছর হতে চললো এখনো এই স্বপ্নেই আছে, পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর কাপল তার বাবা-মা। মুখে দুষ্ট হাসি বলতে লাগলো,
– তোমরা পারোও এতো ঝগড়া কি করে করতে পারো? হয়েছে এবার থামো। আমার ক্লাস আছে। আসতে আসতে আজ দেরি হবে। তোমরা কি আজ রাতে ফিরবে?
নীতির প্রশ্নের উত্তরে ফারহানা বেগম বলেন,
– আজ রাতে শালুকের সাথেই থাকতে হবে তোমার। আমি কাল ফিরবো আর তোমার বাবারটা জানি না
– আমি পরসু ফিরবো (আদনান সাহেব)
– ঠিক আছে, আমি উঠলাম। আমি যাবার পর কিন্তু কোনো ঝগড়া চলবে না। ওকে?
– হুম
আদনান সাহেব এবং ফারহানা বেগম খুব ভালো করে জানে তার মেয়ে জন্য তাদের একসাথে থাকতেই হবে। আর পাঁচটা মেয়ের মতো তার পরিবারটা এতো সুখের নয়। এই সত্যিটা নীতি কখনোই মেনে নেয় নি, হয়তো মানবেও না____
বেলা ১১টা,
বন্ধুদের সাথে ক্যান্টিনে আড্ডা দিচ্ছে নীতি। ক্যাম্পাসের সবথেকে ডেয়ারিং গ্রুপ যদি কেউ তাকে সেটা হলো নীতির গ্রুপ। র্যাগিং থেকে শুরু করে সব কিছুর নাটের গুরু তারা। এতোটাই বাউন্ডেলে, তবে পড়ালেখায় আবার ঠিকই বেশ ভালো। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই নীতি বলে উঠলো,
– আজ নির্ভীক আসে নি?
– উহু, ওর রিসেন্ট গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্যাস্ত সে।
আফরার কথায় বুঝে গেলো আজ আর নির্ভীক আসছে না ক্লাসে। নীতির গ্রুপের লিডার নির্ভীক। নীতির খুব ভালো বন্ধু সে তবে একটা স্বভাবই বেশ নীতিকে বিরক্ত করে তা হলো তার লুচ্ছমি। বিরক্তস্বরে নীতি বলে উঠে,
– এটা কতো নাম্বার রে?
– ৫, এটাই নাকি তার রিয়েল লাভ। লাভ না কচু
আফরা মেয়ে বেশ ঠোঁট কাটা, মেয়েটির সাথে বন্ধুত্ব অনার্স থেকে। নীতির যে নির্ভীকের প্রতি ভালোলাগা কাজ করে সেটা তার ভালো করেই জানা আছে। হঠাৎ নীতির অন্য একজন বন্ধু এসে খবর দেয় আজ নাকি তাদের কলেজে নতুন স্যার জয়েন করেছে। আজ নাকি সেই তাদের ক্লাস নিবে। তাই এখনই ক্লাসে ছুট লাগাতে হবে। চায়ের কাপটা রেখেই সবাই দৌড়ালো ক্লাসে। ক্লাসে ঢুকতেই তারা দেখলো স্যার অলরেডি চলে এসেছে। নতুন স্যারকে দেখেই মুখ হা হয়ে যায় নীতির। স্যার হিসেবে যথেষ্ট হ্যান্ডসাম লোকটা, ছ ফিট লম্বা, বেশ পুরুষালি দেহের গড়ন। গায়ের রঙটা উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের। বেশ কায়দা করে চুলগুলিয়ে জেল দিয়ে স্টাইল করা। লোকটার সবথেকে অবাক করা জিনিসটা হলো তার চোখ জোড়া। গভীর, বাদামি কালো চোখ। নীতির কাছে চোখজোড়াটাই সবথেকে রহস্যময়ী লাগলো। ক্লাসে ঢুকার অনুমতি চাইলেই তাদের ক্লাসে ঢুকতে অনুমতি দেয় লোকটা। এবার বেশ সুন্দর করে বলে,
– লেট মি ইন্ট্রোডিউস মাইসেলফ, আমি স্নিগ্ধ রহমান। তোমাদের সাইকোলোজির টিচার। আপাতত টেমপোরারি আমি এই ক্যাম্পাসে রয়েছি। তবে খুব দ্রুত পার্মাটেন্ট হয়ে যাবো। আমি অবশ্য তোমাদের বাকি টিচারদের মত এতো সিনিয়র না। পি.এইচ.ডি এখনো কমপ্লিট হয় নি। লেকচারার কেবল, আজ একটা ঝামেলার জন্য এই সেমিস্টারে আমি ক্লাস নিবো।
লোকটার কন্ঠটা মন দিয়ে শুনছে নীতি। মনে হচ্ছে লোকটি যেনো তার সাথেই কথা বলছে। এত সুন্দর কারোর কন্ঠ হতে পারে! পারে তো এই যে সামনে দাঁড়ানো। লোকটির সব কিছুই কেন যেনো বেশ আকর্ষনীয় লাগছে। কেনো! কারণটা জানা নেই নীতির। এই অনুভূতিটা বেশ অন্যরকম।
সন্ধ্যা ৬টা,
শীতের দিনে এই এক ঝামেলা, সন্ধ্যাটা অনেক দ্রুত হয়। ক্লাস আগেই শেষ হয়ে গেছে কিন্তু আসতে আসতে দেরী হয়ে গেছে। আজ নির্ভীকের দেখা না পাওয়াতে মনটা ভালো নেই নীতির। নীতি বাসায় চলে এসেছে, অবাক কান্ড বেল বাজাচ্ছে কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না। বাধ্য হয়ে নিজের চাবি দিয়ে দরজাটি খুলেছে সে। ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। আরো অবাক কান্ড শালুককে ডাক দিলেও আওয়াজ পাচ্ছে না। হলো টা কি? সুইচের কাছে দিতেই কেউ পেছেন থেকে ঝাপটে ধরলো। চিৎকার করার আগেই………
[ আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন? আমাকে মনে আছে? আজ এক সপ্তাহ পর আবারো নতুন গল্প নিয়ে ফিরে এসেছি। গল্পটি কেমন লেগেছে জানাবেন। এই প্রথম থ্রিলার লিখছি। আপনাদের ভালোবাসা আশা করছি। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ কাল রাত ৭টায় দিবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]
#কে!!
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি