#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
পর্বঃ১৭
নিভু নিভু আলোয় পৃথার মুখাবয়ব দেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল সিজান। নিঃশব্দে গিয়ে পৃথার পাশে বসে পড়ল। পৃথা নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সামনে। তার অবস্থা দেখে বোঝার উপায় নেই সে ইহজগতে আদৌ আছে কিনা। সিজান সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করছে। মনে মনে কথা গুছিয়ে নিলেও মুখ ফুটে বের হতে চাইছে না কিছুই।
কিয়ৎকাল পর সিজান আচমকা দোলনা ছেড়ে পৃথার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসল। সহসা এহেন কান্ডে পৃথা তাকাল সিজানের মুখপানে। ক্লান্তি হীন সে দৃষ্টি। নেত্রকোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দুফোঁটা নোনাজল। মৃদু আলোয় তা সিজানের দর্শনেন্দ্রিয়ে ধরা পড়ল কিনা কে জানে। পৃথা নিরলস ভঙ্গিতে তাকিয়েই রইল।
সিজান অপটু হাতে পৃথার এক হাত মুঠোয় পুরে নিল। পৃথার গতিহীন কলেবরে কিঞ্চিৎ পরিমাণ কাপণ ধরল তাতে।
সিজান নিম্নস্বরে বলল,
“আমি জানি আমি ভুল করে ফেলেছি। ওইটুকু সময়ের মধ্যে কি থেকে কি বলেছিলাম আমি ভাবিনি তখন। তখন কেবল একটাই ভাবনা ছিল আমার। তপাকে সরাতে হবে ওই নরক থেকে। নাহলে ও বাঁচবে না। সত্যিই বাঁচতো না ও। বাঁচতে দেওয়া হতো না ওকে। আমি তপা কে সরানোর জন্য এর থেকে ভালো উপায় আর পাই নি। কিন্তু আমি যে ভুল ছিলাম সেটা সময় গড়াতেই বুঝতে পারি। এতগুলো মানুষের অবহেলা আমি সইতে পারছিলাম না। বাবাও কথা বলছিল না। আর তুমি? তুমি কি বললে? তোমাকে আমি নিলামে তুলে দেব। এতটাই জঘন্য আমি? এতটাই নিকৃষ্ট মনে করো আমাকে? আমি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দিতে পারি তোমাদের জন্য। তোমার জন্য। আর সেই তুমি বললে আমি তোমাকে নিলামে তুলে দেব। সেই মূহুর্তে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল জানো? কিন্তু আত্মহত্যা যে মহাপাপ। তাই চেয়েও পারি নি। কিন্তু ওই কথাটায় হৃদয় এতটাই আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল যে আর সামনে আসার সাহস পাই নি। কিন্তু তপার অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে আর থাকতে পারি নি দূরে সরে। যাইহোক আমি নিজের জন্য আর কোনো সাফাই দেব না। আমি জানতাম না তুমি এখানে আছো।”
পৃথা নিষ্পলক চেয়ে থেকেই মুখ খুলল।
“জানলে আসতে না?”
“এসে কি লাভ? সেই তো মুখ ফিরিয়ে বসে আছো।”
পৃথা হাত ছাড়িয়ে শক্ত গলায় বলল,
“তাহলে চলে যাও। আংকেলের সাথে যাও নি কেন?”
“সত্যি চলে যাব?”
পৃথা কিছু বলল না। কিন্তু কিঞ্চিৎ সময় পার হতেই সিজান ফোঁপানোর আওয়াজ শুনলো। সেই সাথে পৃথার কেঁপে উঠাও অনুভব করতে পারল।
পুনরায় পৃথার হাত দু’হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলল,
“এভাবে কাঁদিস না প্লিজ। আমার ভুলের জন্য এভাবে কাঁদলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। প্লিজ শান্ত হ। ”
পৃথা তবুও ফুঁপিয়েই যাচ্ছে দেখে সিজান পৃথার হাত ছেড়ে দু’হাতে নিজের কান ধরে বলল,
“দেখ কান ধরছি ছোট বেলার মত। এবার তো কান্না থামা।”
পৃথা নিচের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল,
“আমি আর ছোট নেই সিজান ভাই।”
সিজান ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বলল,
“তাহলে কি বড় হয়ে গেছিস?”
পৃথা নাড়ালো। সিজান মৃদু হেসে বলল,
“তাহলে কি এখন বড় বড় আদর দিয়ে রাগ ভাঙাতে হবে?”
পৃথা অকস্মাৎ তাকাল সিজানের দিকে। মৃদু আলোয় মুখটা আবছা দেখতে পেল। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে সে তার দিকেই।
পৃথা ওড়নার কোণ চেপে ধরে বসে রইল চুপচাপ। সিজান পুনরায় বলল,
“কি রে বললি না তো। বড় বড় আদর দেওয়ার মত বড় হয়েছিস?”
পৃথার কান লাল হয়ে গেছে বোধহয়। উঠে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সিজান হাত টেনে বসিয়ে দিল নিজের সামনে। পৃথা হঠাৎ টানে তাল সামলাতে না পেরে টালমাটাল হয়ে পড়ে যেতে নিল। সিজান একহাতে পৃথাকে আগলে নিয়ে নিজের সামনে বসিয়ে দিল। দুজনেই ছাদের মেঝেতে বসে তাকিয়ে রইল একে অপরের দিকে। পৃথার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো মূহুর্তেই। চোখের কার্নিশে জমা হলো বিন্দু বিন্দু নোনাজল। পৃথা অক্ষিপল্লব ঝাপটে ঝাপসা হওয়া দৃষ্টি স্বচ্ছ করার বৃথা চেষ্টা করল।
চিলেকোঠা থেকে আসা আবছা আলোয় সিজান স্পষ্ট দেখতে পেল পৃথার নেত্রকোণের মুক্তোর মতো ঝিকঝিক করা জলটুকু। হাত বাড়িয়ে মুছে দিতেই পৃথা শব্দ করে কেঁদে উঠল। সিজান দুবাহু মেলে আবদ্ধ করে নিল বাহুডোরে। বক্ষপিঞ্জরের লুকায়িত দগদগে ক্ষতটা যেন মূহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল। সেখানে জমা হলো গভীর প্রেমের সুপ্ত কিছু অনূভুতি। কিছু পাওয়ার এক অবিস্মরণীয় মূহুর্তের স্মৃতি।
চায়ের কাপে চামচ দিয়ে টুংটাং শব্দ তুলে তপা মুচকি মুচকি হাসছিল। তপার মুখের লুকোচুরি হাসি দেখে পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তোমার মনের ভেতরে কি চলছে বলো তো? এরকম চুন্নি মার্কা হাসি দিচ্ছো কেন?”
তপা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। ঈষৎ রেগে বলল,
“হুয়াট ডু ইউ মিন বাই চুন্নি মার্কা হাসি?”
পলক মুখ টিপে হাসল। তপার দিকে তাকিয়ে ইনোসেন্ট মুখ করে বলল,
“এমা তুমি চুন্নি মার্কা হাসি বোঝো না?”
তপা মাথা নাড়ালো।
পলক হেসে বলল,
“থাক বুঝতে হবে না। ছোট মানুষ এসব বুঝবে না।”
তপা বিরক্তির সহিত বলল,
“আমি ছোট? তাহলে বড় কে? রাত্রি?”
পলক অবাক হলো। মেয়েতো জেলাস! আরেকটু রাগিয়ে দিতে বলল,
“হ্যা রাত্রি তো বড়ই। ও আমার ব্যাচমেট। বয়সও সমান। ও লেখাপড়া না করে আদুবোন হয়ে রয়েছে। ও তোমার থেকে যথেষ্ট বড়।”
তপা অগ্নিঝড়া চোখে তাকাল। কিছু বলতে চেয়েও বলল না। মস্তিষ্ক জানান দিল সে বাড়াবাড়ি করছে। এই বাড়াবাড়িটা তার জন্য না। হিংসে করাটাও তার সাজে না। তাই নীরবতাই মেনে নিল।
পলক পুনরায় বলল,
“বললে না তো ওরকম হাসছিলে কেন?”
তপা কাপ রেখে ধারালো কণ্ঠে বলল,
“আপনার গুষ্টির ষষ্টি উদ্ধার করছিলাম হেসে হেসে।”
পলক ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মেয়ে তো ঝগড়াও করতে জানে। একে নিয়ে সংসার করতে গেলে বহুত কাঠখড় পোড়াতে হবে। ভাবতে ভাবতে গালে হাত রেখে তপার দিকে তাকাল। পরে মোহাবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে রইল প্রহরের পর প্রহর।
তপা চোখ পিটপিট করে চেয়ে রইল খানিকটা সময়। পরে মৃদুস্বরে বলল,
“আমি রুমে যাব এখন।”
পলক ধ্যান ভেঙে বলল,
“হুম। চলো দিয়ে আসি।”
কোলে নেওয়ার জন্য দু’হাত বাড়িয়ে দিতেই তপা পলকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি হেঁটে হেঁটে চলে যাই? আর কত এভাবে অকেজো হয়ে ঘুরে বেড়াবো। আপনিই বা কতদিন এভাবে কোলে নিয়ে নিয়ে ঘুরবেন?”
পলক মৃদু হেসে বলল,
“তুমি চাইলে আজীবন কোলে নিয়ে ঘুরবো। ক্লান্ত হবো না।”
তপা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“চাপা মারছেন?”
“চাপা না। সত্যি সত্যি। তুমি কি কখনোই আমার অনূভুতি বুঝবে না কৃষ্ণময়ী?”
তপা মলিন কণ্ঠে বলল,
“আমার সাধ্য থাকলে আমি আপনাকে ভালবাসতাম মিস্টার তাজওয়ার। কিন্তু আমি নিরূপায়। পঁচে যাওয়া মন নিয়ে ভালবাসা যায় না। দুর্গন্ধ যুক্ত শরীর নিয়ে ভালবাসতে নেই। ছুঁয়ে দিলে যে শরীর সুবাস না ছড়িয়ে দুর্গন্ধ ছড়াবে সে শরীরের মালিকের ভালবাসা পাওয়ার অধিকার নেই। ভালবাসা চাইতেও নেই। কলঙ্কিনী হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে নেই।”
” চাঁদেরও তো কলঙ্ক আছে। তুমি নাহয় আমার কলঙ্ক হয়েই রইলে।”
তপা মাথা নিচু করে মৃদু হাসল। লোকটা এত ভাল কেন? নিঃস্বার্থ ভালবাসা কি একেই বলে?
পরক্ষণেই শক্ত গলায় বলল,
“” আপনি আবেগে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন মিস্টার তাজওয়ার।”
পলক ঠোঁট কামড়ে হাসল। মুখে হাসি ফুটিয়েই বলল,
“আমার বয়স কত জানো? আটাশ বছর। এই বুড়ো বয়সে এসে আবেগে গা ভাসাবো? আমি জানি তোমার একটা অতীত আছে। হয়তো সেটা ভয়ঙ্কর। কিন্তু সেসব নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। মানুষের অতীত একান্তই তার ব্যক্তিগত। আমি সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারি না। হ্যা আমি চাইলে সবটা জানতে পারব। কিন্তু আমি সেটা চাই না। যদি নিতান্তই তোমার কখনও জানাতে ইচ্ছে হয় সেদিন জানাবে। আমি মনোযোগী ছাত্রের মতো শুনবো। কিন্তু তার আগে তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। যখন আমি ছিলাম না তখন হয়তো তোমার সাথে কিছু হয়েছে। অতীত সবারই থাকে। কারো ভালো, কারো ভয়ানক। তোমার অতীতটা যে মোটেও সুন্দর নয়। সেটা আমি বুঝতে পেরেছি ঘুমের ঘোরে তোমার চিৎকার শুনে। কিন্তু সেজন্য তুমি আমার ভালবাসাকে আবেগ বলে চালিয়ে দিতে পারো না। সেই অধিকার আমি তোমাকে দেই নি। আর না কখনো দেব। তুমি আমাকে ভালবাসো না। ঠিক আছে। মেনে নিলাম। কিন্তু আমার ভালবাসাকে অপমান করার অধিকার তোমার নেই। দ্বিতীয় বার এই ভুল করো না।”
তপা চোখ পিটপিট করে চেয়ে রইল। কি এমন বলল যে একটা পুরো রচনা শুনিয়ে দিল। তবুও ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলল। মনে মনে আওড়ালো,”ভালবাসা সুন্দর। ভয়ঙ্কর সুন্দর।”
ইস্পাত কঠিন বুকের উষ্ণ স্পর্শে বলিষ্ঠ হাতের আলিঙ্গনে মুখরিত কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পৃথা নড়েচড়ে উঠল। সিজান পৃথার নড়াচড়ায় খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল,
“সাপের মত মোচড়া মুচড়ি করছিস কেন তুই?”
পৃথা মুখ তুলে চেয়ে দেখল সিজানের মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। মৃদু হেসে বলল,
“ছাড়ো সিজান ভাই। তপা এসে পড়বে।”
সিজান বিরক্ত চাহনি দিয়ে বলল,
“ও আসবে কি করে? হাঁটতেই তো পারে না ভালো করে।”
“ও তো রুমে নেই। পলক ভাইয়া নিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। ভাইয়া যদি নিয়ে আসে তখন?”
সিজান পৃথাকে ছেড়ে সরে বসল। হাত দুটো হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“কখন গেল?”
“কিছুক্ষণ আগে। তুমি রুমে ছিলে। তপা আমার সাথে বসে ছিল। তখন চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেছে।”
সিজান হেসে ফেলল পৃথার কথা শুনে। সত্যি সত্যি চ্যাংদোলা করে নিল নাকি। পরক্ষণেই দায়িত্ববান ভাইয়ের মত বলল,
“আমার বোনটা ভাল থাকবে তো পৃথা?”
পৃথা সিজানের হাতদুটো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল,
“তুমি নিশ্চিতে থাকো। পলক ভাইয়ার থেকে ভালো তপা কে কেউ রাখতে পারবে না।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল দুজন। চোখে চোখে কথা চলতে থাকল অবিরত। নীরবতার রেশ কাটিয়ে সিজান বলল,
“পৃথা আমায় বিয়ে করবি তো?”
পৃথা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“তো তুমি কি ভেবেছো? খেয়ে ছেড়ে দেব? পৃথা অতটাও খারাপ নয় সিজান ভাই। পৃথার কথা তেঁতো তেঁতো হলেও মনটা নিখাঁদ সোনা।”
সিজান অবাক হয়ে চেয়ে রইল। কি বলবে তা ভাবতে গিয়ে বুঝল তার ডিকশনারী আপাতত শূন্য। এই কথার প্রেক্ষিতে কি বলা উচিৎ তা তার ছোট্ট মস্তিষ্কে বিদ্যমান ডিকশনারী এখনো ধারণ করে উঠতে পারে নি।
চলবে…