#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১৪
প্রায় ত্রিশ মিনিট সময় ধরে পলকের ফ্ল্যাটে ঘাপটি মেরে বসে আছে তপা। শুধু বসেই নেই। কাঁদছে সে। নীরব অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে ক্রমাগত। যাকে বলে অঝোর ধারায় বর্ষণ। ছুটির দিন হওয়ার দরুন পলক ফ্ল্যাটে বসে অলস সময় কাটাচ্ছিল। ভেবেছিল বাড়ি গিয়ে একবার ঘুরে আসবে। যেই ভাবা সেই কাজ। চটপট রেডি হতে শুরু করে। কিন্তু এহেন সময় দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পেয়ে বিরক্ত হয়। দরজার দিকে এগুতে এগুতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এত টাকা খরচ করে কলিং বেল কি রূপ দেখানোর জন্য লাগিয়েছি নাকি? শক্তির অপচয় দরজার উপর না করে এক আঙুলে বেল টা প্রেস করলে কি তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে? আশ্চর্য।”
দরজা খুলেও অপর প্রান্তের মানুষটিকে কিছুটা ঝাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু সে কি জানতো দরজার বাইরের মানুষটার তার কলিজায় বসবাস।
তপার মুখ দেখে বেমালুম পুরুষ সিংহের ন্যায় তর্জন গর্জন থেমে গেল। প্রথমে তপাকে দেখে মনটা সুপ্রসন্ন হলেও চোখের পানি লক্ষ করতেই হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তিয়াশা কি হয়েছে? কাঁদছো কেন তুমি?”
তপা কিছু না বলে পলক কে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিল। কান্না লুকোতে চেষ্টা করেও ডুকরে ডুকরে উঠলো।
“আমি কি কিছুক্ষণ এখানে থাকতে পারবো?”
তপার হিচকি তুলে তুলে বলা কথায় পলক খানিকটা অবাক হলো। যে নিজেই পালাতে চায় সে কেন নিজে থেকে থাকতে চাইছে? আনমনেই বলল,
“সে তুমি যতক্ষণ ইচ্ছে থাকো।কিন্তু কি হয়েছে সেটা তো বলো। আমার টেনশন হচ্ছে। পৃথা কোথায়?”
তপা মৃদু স্বরে বলল,
“ভাইয়া। ভাইয়ার সাথে কথা বলবো।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“প্রান্ত?”
তপা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
প্রান্ত ফোন ধরেই বলল,
” তোর জন্য কি ছুটির দিন গুলোতেও শান্তিতে একটু ঘুমাতে পারবো না?”
তপা ঝরঝর করে কেঁদে বলল,
“ভাইয়া।”
প্রান্ত শোয়া থেকে এক ঝটকায় উঠে বসল। আতংক গ্রস্ত গলায় শুধালো,
“কি হয়েছে বোন আমার? কাঁদছিস কেন? পলক কিছু করেছে?”
তপা তখন হেঁচকি তুলে কাঁদছে। পলক ফোন প্রায় কেঁড়ে নেওয়ার মত ছো মেরে নিয়ে নিল।
“তোর বোন সেই কখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। থামাথামির কোনো লক্ষণ নেই। কিছু বলছেও না। কি করব আমি?”
পলক কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“তুমি আমার *** এর প্রেমিক হয়েছো? প্রেমিকার কান্না থামাতে পারছো না। দুই মিনিটের মধ্যে যদি ওর কান্না না থামে তবে আমি নিজে তোর লাভ স্টোরির ভিলেন হবো খোদার কসম।”
পলক ভ্রু কুঁচকালো। এখন যত দোষ নন্দ ঘোষ।
“আমি কি ওকে জড়িয়ে ধরবো?”
প্রান্ত চমকাল। তার বন্ধু এমন নাদান বাচ্চা কবে হলো বুঝতে পারল না। পুরুষ সিংহ প্রেমের ছোঁয়া পেয়ে বিড়াল ছানায় রূপান্তরিত হয়েছে ভেবে মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল প্রান্ত। আর যাই হোক প্রেমে সে পড়বে না। কস্মিনকালেও না। এ যেন আজন্ম শপথ।
পলক আবারও বলল,
“কি হলো ধরবো?”
প্রান্ত প্রায় ধমকের সুরে বলল,
” প্রেমে পড়ার আগে আমার অনুমতি নিয়েছিলি?এই যে আমি থাকতেও আমার সামনে আমার বোনকে কোলে নিয়ে ঘুরিস তখন আমার পারমিশন নিস? কত বড় বেয়াদব ভাইয়ের কাছে জানতে চাইছে তার বোনকে জড়িয়ে ধরবে কিনা। আমি লাইনে আছি। আগে কান্না থামা তারপর ওর কাছে ফোন দে।”
পলক তপার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“কান্না অনেকক্ষণ আগেই থেমে গেছে। নে কথা বল।”
পলকের জড়িয়ে কথা শুনেই তপার কান্না থেমে মুখে শোভা পেয়েছে অবাক হওয়ার রেশ। কি অনায়াসে প্রশ্ন করল ‘আমি কি ওকে জড়িয়ে ধরবো?’ যেন প্রান্ত বললেই বুকে জড়িয়ে নিত। তপার মনের ভেতরে সুপ্ত অনূভুতিরা ডানা ঝাপটাতে শুরু করল।
পলক ফোন বাড়িয়ে দিতেই তপা মৃদু স্বরে বলল,
“ভাইয়া।”
বলতে বলতে আবারও চোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। পলক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তপার দিকে। কি এমন হয়েছে মেয়েটার। এত শক্ত মনের মেয়েটা কেন এত দুর্বল আজ? কেন তার মনের এত শোচনীয় অবস্থা?
প্রান্ত শান্ত কণ্ঠে বলল,
“কি হয়েছে আপু? ভাইয়া কে বল।”
তপা হেচকি তুলে বলল,
“মামা এসেছে ভাইয়া।”
প্রান্ত অবাক হয়ে বলল,
“আংকেল এসেছে ভালো কথা। কিন্তু তুই এভাবে কাঁদছিস কেন? আংকেল এলে তো তোর খুশি হওয়ার কথা।”
তপা মলিন কণ্ঠে বলল,
“মামা একা আসেনি। সাথে ও এসেছে।”
প্রান্ত নিশ্বাস আঁটকে রেখে বলল,
“ও মানে কে এসেছে?”
“ভাই।”
“সিজান?”
তপা মৃদু আওয়াজে শুধু সম্মতি সূচক বলল,
“হুম।”
প্রান্ত দু’হাত মুঠো করে বসে রইল। ইচ্ছে করছে এক উড়ালে তপার কাছে চলে যেতে। বোনটা নিশ্চয়ই খুব অসহায় বোধ করছে।বোনের পাশে কাউকে তো চাই এখন। শক্ত করে হাতটা ধরে রাখার জন্য হলেও চাই। টাল সামলাতে না পেরে পা দু’টো টলে গেলে শক্ত হাতে তাকে আঁকড়ে রাখার জন্য হলেও আপন একজন মানুষ চাই।
প্রান্ত কিছু বলার আগেই তপা ফোনটা পলকের হাতে দিয়ে খোড়াতে খোড়াতে অন্য রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ফ্লোরে বসে পড়ল। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু সে জানে চিৎকার করে কাঁদলে পলক তাকে দুমিনিট ও থাকতে দেবে না এখানে। টেনে হিঁচড়ে বের করে কান্নার কারন জানার জন্য পাগল করে ফেলবে।তার চোখের জল পলক কে উতলা করে সেটা সে জানে। তাই শত ব্যথা সহ্য করেও চুপচাপ বসে রইল। পলক দরজা ঠেলে ভেতরে আসার চেষ্টা করলে তপা কান্নারত কণ্ঠে বলল,
“আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই প্লিজ। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আমি পরে দেব। প্লিজ আমাকে একটু বাঁচতে দিন।”
পৃথা চুলায় রান্না বসিয়ে ব্যস্ত হাতে কাজ শেষ করছে। তপার মামা বিছানার এক কোণে চুপচাপ বসে আছে নিচের দিকে তাকিয়ে। মনে মনে ভীষণ রাগ হচ্ছে নিজের উপর। কেন আজই সিজান কে নিয়ে আসতে হলো তার। মেয়েটাকে অমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে দেখে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। তাই তো বুকে শত আঘাত লুকিয়ে থাকলেও পাথরের মত চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও গড়ায় নি।
সিজান ছাঁদ থেকে দ্রুতপদে রুমে ঢুকে পৃথার খোঁজ করল।পৃথা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো হাঁকডাক শুনে। তপার মামা মোর্শেদুল হক ও চোখ তুলে তাকালেন ছেলের দিকে। কিন্তু তিনি আজ নির্বিকার। ছেলের দিকটাও তিনি বুঝতে পারেন। আবার মেয়েটার অভিমানও ফেলনা নয়। তিনি যাবেন কোন পথে? দু’দিকেই তার আপনজন দাঁড়িয়ে। একদিকে গেলে অন্যদিক অন্ধকার।
সিজান পৃথার সামনে গিয়ে থমথমে গলায় বলল,
” তপা কোথায় গেল পৃথা? তাজমহল লেখা ফ্ল্যাটে কারা থাকে? তপা কেন সেখানে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল?”
তপা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“ওই ফ্ল্যাটে কারা নয় বলুন কে থাকে?”
“কে থাকে?”
সিজানের প্রশ্নে পৃথা এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করে গড়গড় করে বলল,
” ওই ফ্ল্যাটে ভাইয়ার বন্ধু থাকে। পলক তাজওয়ার। তপার এ জগতে আমাদের পর বিশ্বাসের জায়গায় সেই আছে। তাই হয়তো নিজের তিক্ত অতীত সামনে আসায় সহ্য করতে না পেরে সেখানে চলে গেছে। ভালোই করেছে। মাঝখান থেকে আমাকে শুধু নোংরা মুখটা দেখার জন্য রেখে গেল। আর হ্যা সে কিন্তু একা থাকে। এখন কি তার সাথে জড়িয়েও তপার চরিত্রে কালি লেপ্টে দিবেন? আগেই জানিয়ে রাখি পলক তাজওয়ার কিন্তু প্রান্ত শাহরিয়ার নয়। তপার চোখের এক এক ফোঁটা পানির জন্য সে আপনার এক একটা হাড়গোড় ভাঙতে পারে।তাই যা বলার সাবধানে বলবেন।”
সিজান চমকাল। মোর্শেদুল হক ও বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকালেন পৃথার দিকে।
“উনি কি তপার কিছু হয়? আমি বলতে চাচ্ছি তপা কি তাকে ভালবাসে?”
পৃথা মুচকি হাসল।
“তপা ভালবাসে কিনা সঠিক বলতে পারছি না।হয়তো বাসে। তবে বিশ্বাস করে। নিজের থেকেও বেশি। কিন্তু পলক ভাইয়া ভালবাসে। মারাত্মক ভাবে ভালবাসে। সে যদি একবার জানে আপনি তপাকে কাঁদিয়েছেন। আপনার জন্য তপা কষ্ট পাচ্ছে। তাহলে আপনার অবস্থা সে টাইট করে ফেলবে। নিজের ছোট বেলার বান্ধবীর মাথা ফাটাতে চাওয়ার আগেও সে দুবার ভাবে নি। আপনি তো চুনোপুটি। সো সময় থাকতে লেজ গুটিয়ে পালান।”
সিজান আহত চোখে তাকাল। তবে এটা ভেবে ভাল লাগলো তার ছোট্ট অভাগী বোন টাকে কেউ ভালবাসে। তার বোনের কথা ভাবার জন্যও কেউ আছে। প্রচন্ড কষ্টের সময় আগলে রাখার জন্য কেউ একজন বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে। অপেক্ষা করবে কখন তাতে একরাশ কষ্ট নিয়ে সে ঝাপিয়ে পড়বে।মোর্শেদুল হকের মনটা পলক কে একবার দেখার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। কার ভরসার মেয়ে তার এভাবে চলে গেল সেটা তো তার জানতে হবে, দেখতে হবে। কিন্তু মেয়ে তার যথেষ্ট বিচক্ষণ সেটা সে জানে। কিন্তু অভিমানের পাল্লা যে তার বড্ড বেশি ভারী।
“পৃথা? কোথায় তুমি? আমি ভেতরে আসবো?” পলকের কণ্ঠ শুনে পৃথা প্রায় দৌড়ে এলো রান্নাঘর থেকে। সিজান, মোর্শেদুল হকও নড়েচড়ে বসলেন।
“ভাইয়া আসুন। তপা আসে নি?”
“নাহ। তিয়াশা দরজা বন্ধ করে বসে আছে। দরজা খুলছেই না। আমার ঘরে আমাকেই ঢুকতে দিচ্ছে না।?”
বলতে বলতে বিছানায় চোখ পড়তেই দু’জোড়া উৎসুক চোখের উপর দৃষ্টি পড়ল তার। পৃথা পলকের দৃষ্টি বুঝতে পেরে বলল,
“ইনি তপার মামা আর ইনি মামার ছেলে।”
পলক সালাম দিল। মোর্শেদুল হক সালাম বিনিময় করে টুকটাক কথা বললেন। কিন্তু সিজান নির্বিকার।হয়ে কেবল চেয়ে রইল।
পলক সিজানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি ব্যাপার ভাই আমার চেহারা কি খুব খারাপ? দেখতে ভয়ংকর লাগছে? কথা কেন বলছেন না?”
সিজান মুখ খুলে প্রথম কথাটা বলল,
“আমার বোন টাকে ভাল রাখতে পারবেন?”
পলক চমকাল। কি দিন আসল পলক তাজওয়ার শুধু চমকাচ্ছেই। ক্যারেক্টার কেমন উল্টো লাগছে তার। যে কিনা সবাইকে চমকে দিত। আজকাল তা তো হচ্ছেই না বরং ক্ষণে ক্ষণে সে চমকাচ্ছে।
পলক মৃদু হেসে বলল,
“নিজের প্রাণ থাকতে খারাপ থাকতে দিব না ওকে।”
“ভাই আপনি ওকে এখানে নিয়ে আসতে পারবেন এখন? আমার ওর সাথে জরুরি কথা আছে। অনেক গুলো দিন চলে গেছে। অভিমানের পাল্লা কেবল ভারী হচ্ছে। একদিনের ক্ষুদ্র রাগ আজ বিশালতায় আকাশ ছুঁয়ে গেছে। এখনো অভিমান গলাতে না পারলে জানিনা কখনো পারব কিনা। আপনি দেখুন না আসে কিনা।”
পলক আশ্বাস দিয়ে বলল,
“আপনি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি এক্ষুনি কান টেনে নিয়ে আসছি পাঁজি টার।”
সিজান শত কষ্টের মাঝেও মৃদু হাসল। মোর্শেদুল হকেরও বেশ মনে ধরেছে পলক কে।
পলক বলে গেল কান টেনে নিয়ে আসবে। কিন্তু সে মিথ্যে বলেছে। কান টেনে আনার পরিবর্তে সে পাঁজা কোলা করে তুলে এনেছে। বেশ হুমকি ধামকি দিয়ে দরজা খুলিয়েছে সে। দরজা খুলতেই এক মূহুর্ত নষ্ট না করে কোলে তুলে নিয়ে গটগট করে ছাঁদে চলে এসেছে।
সিজান হা করে তাকিয়ে আছে। মোর্শেদুল হক মাথা নিচু করে নিয়েছেন। কেবল পৃথা মিটিমিটি হাসছে। সিজান পৃথার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বিরবির করে বলল,
“এই পিথাগোরাসের উপপাদ্য এদের কেমিস্ট্রি কি বরাবরই এরকম?”
পৃথা চমকে উঠল। কতদিন, ঠিক কতদিন পর সিজান এভাবে ডাকল তাকে। পৃথার কান্না পেয়ে গেল। কিন্তু নিজেকে সামলে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তো কি সবাই আপনার মত? আনরোমান্টিক? ভীতুর ডিম? যার প্রেমিকার চোখের দিকে তাকাতেই হাত পা কেপে জ্বর চলে আসে। ব্যাটা নিরামিষের ডিব্বা কোথাকার।”
চলবে…