কৃষ্ণময়ীর অলংকার পর্ব ১৩

0
1059

#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্ব১৩

সাদা পর্দা ঘেরা বিলাসবহুল কেবিন। সাদা সোফায় বসে আছে তপা। পাশেই চেয়ারে বসে ডাক্তারের সাথে জরুরী বৈঠক করছে পলক। তপা কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছে। কারণ ডাক্তার হেসেই খুন হয়ে যাচ্ছে। পলকের মুখটা দেখতে পাচ্ছে না তপা। তার শরীরের থেকে থেকে কেঁপে ওঠা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে সেও হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে বোধহয় ঠোঁটের কোণে, চোখে মুখে । তপার বোধগম্য হচ্ছে না এত হাসির কারন। এবার তপার সন্দেহ হচ্ছে, তারা হসপিটালই এসেছে তো? নাকি কোনো সার্কাস দেখতে এসেছে? এত হাসি কেন? আশ্চর্য! তপা পলকের কথা শুনতে না পারায় রাগ হচ্ছে কেবিন এত বড় হওয়ার জন্য। ডাক্তারের কেবিন হবে কবুতরের বাসার মত। ছোট্ট, খুপরি, ঝুপড়ি মতো।এত বড় বিলাসবহুল হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ডাক্তার হবে বয়স্ক, চশমা পরা কোনো লোক। এত কিউট একটা মেয়ের ডাক্তার হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল? না তো।
কিয়ৎক্ষণ পরে তপা নিজের উপরই রেগে গেল। সে হিংসাত্মক আচরণ করছে। তাও কিনা সুশ্রী ডাক্তার কে। সেটাও আবার মিস্টার তাজওয়ারের জন্য। ভাবতেই নিজেকে কয়েক দফা মনে মনে ঝাড়ল সে।

তপার ভাবনায় ভাটা পড়ল পলকের হাতের স্পর্শ মাথায় পড়তেই। পলক তপার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলল,
“ভয় করছে?”
তপার এক মূহুর্তের জন্য কি হলো জানে না। চোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। পলকের চোখে পড়তেই হন্তদন্ত হয়ে পাশে বসে বলল,
“তিয়াশা। কি হয়েছে? বলো আমাকে। মাথা যন্ত্রণা করছে? পা ব্যথা করছে?”
তপা মাথা নাড়ালো। পলক আবারও বলল,
“তাহলে কি ভয় করছে? ডক্টর ব্যথা দেবে সেজন্য ভয় পাচ্ছো? ব্যথা দেবে না তো। যদি ব্যথা পাও তবে আমাকে বলবে। আমি ডক্টরের লাইসেন্স খেয়ে দিব।”
তপা পলকের পাগলামি দেখে হেসে ফেলল। পলক অবাক হয়ে বলল,
“তুমি হাসছো? আমি টেনশনে মরছি কি হলো ভেবে। আর তুমি মজা নিচ্ছো?”
তপা হাসি থামিয়ে মলিন গলায় বলল,
“আসলে এভাবে ভরসার হাত মাথায় রাখার মতো মানুষ তো আমার জীবনে খুবই নগন্য। তাই চোখে জল চলে এসেছে।”
পলক কিছু বলতে চেয়েও গিলে ফেলল কথাগুলো । তপার দিকে তাকিয়ে মোলায়েম গলায় বলল,
“ব্যান্ডেজ খুলতে হবে তো এখন।”
তপা মুচকি হেসে বলল,
“আমি রেডি।”
পলকও বিনিময়ে একটুখানি হেসে কোলে তুলে নিল। চেয়ারে বসিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এখানেই চলবে তো? নাকি তোর কোনো অসুবিধা হবে।”
ডাক্তার মুচকি হেসে বলল,
“আমার আবার কি হবে? আমি ডাক্তার। আমার রোগী আর মেডিসিন থাকলেই হয়। রাস্তাঘাটেও চিকিৎসা করতে পারি। এটাতো স্বয়ং আমার কেবিনের চেয়ার।”
পলক মাথা নেড়ে হেসে বলল,
“তুই আর পাল্টালি না।”
ডাক্তারও বিনিময়ে মৃদু হাসল। তপার দিকে তাকিয়ে মসৃণ কণ্ঠে শুধালো,
“আপুনি ভয় পেও না। আমি চেষ্টা করছি ব্যথা না দিতে।তুমি চোখ বন্ধ করে পাঁচ মিনিট স্বপ্ন দেখ। আমি আমার কাজ ফিনিশ করে ফেলি এর মধ্যে।”
তপা পুলকিত হলো ডাক্তারের ব্যবহারে। অথচ সে হাসাহাসি দেখে আনমনে কতগুলো কথা শুনিয়ে দিয়েছে। হোক না সেটা মনে মনে।
তপা সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে ফেলল। মিনিট খানেক পেরোতেই চোখ খুলে বড় বড় করে তাকাল পলকের দিকে। কয়েক সেকেন্ড পর আবারও চোখ বন্ধ করে পুনরায় চোখ বড় বড় করে তাকাল। এভাবে চলল তিন চার বার। পলক ভ্রু কুঁচকে তপার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে একটুখানি ঝুকে তপার মুখোমুখি হয়ে নিচু গলায় বলল,
“কি হয়েছে তিয়াশা? এরকম করছো কেন? একবার চোখ খুলছো আবার বন্ধ করছো। কোনো সমস্যা হচ্ছে?
তপা চোখ পিটপিট করে বলল,
” আমার বোধহয় চোখে সমস্যা হয়েছে মিস্টার তাজওয়ার।”
পলক অবাক হয়ে বলল,
“চোখে সমস্যা? কখন থেকে হলো? আর তুমিই বা বুঝলে কি করে?”
তপা ঠোঁট উল্টে বলল,
“এক্ষুনি হলো সমস্যা। চোখ বন্ধ করেও যা দেখি চোখ খুললেও তাই দেখছি।”
পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল। মৃদু স্বরে বলল,
“চোখ বন্ধ করে কি দেখতে পাচ্ছো? চোখ খুলেই বা কি দেখতে পাচ্ছো?
তপা বিরবির করে বলল,
” এই কুলক তাজওয়ার আমাকে পাগল করে ফেলবে মনে হচ্ছে। ব্যাটা সাংঘাতিক লোক। একে বলা যাবে না তপা। এ যদি একবার জেনে যায় চোখ বন্ধ করলেও আমি তাকেই দেখছি। তাহলে এর যন্ত্রণায় নির্ঘাত আমার পাবনার বাসিন্দা হতে হবে। কথাগুলো হজম করে ফেল তাড়াতাড়ি তপা। প্রয়োজনে দু’টো হজম ক্যান্ডি খা।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি বিরবির করছো? স্পষ্ট করে বলো।”
তপা জোর করে একটু হেসে বলল,
“কিছু না তো। আপনার কাছে হজম ক্যান্ডি হবে?”
পলক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। তপা এই সুযোগে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

ব্যান্ডেজ খোলা থেকে শুরু করে ড্রেসিং করা অবধি পুরোটা সময় পলক তপার পাশে দাঁড়িয়ে একহাত আঁকড়ে ধরেছিল। তপা ভরসার হাত পেয়ে নির্ভয়ে বসেছিল অনেকটা সময়। ড্রেসিং করা শেষে পলকের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বলল,
“হয়ে গেছে। এখন বল তো এত আঘাত কি করে পেল? মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিস। পা ভেঙে দিয়েছিস। ব্যাপারটা কি? তুই কি টর্চার করিস ওর ওপর?”
পলক ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তপা শব্দ করে হেসে উঠল। পলক অবাক হয়ে তপার দিকে অপলক চেয়ে রইল। তার কৃষ্ণময়ী এভাবে হাসতে পারে জানা ছিল না তো। একদম হৃদয় কাঁপানো হাসি। দম বন্ধ করা হাসি।অনূভুতি গুলো গলা অবধি এসে যেন আস্টেপিস্টে জড়িয়ে রয়েছে কণ্ঠনালি কে।
পলক গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“আমি টর্চার করি নি। বেচারি ভার্সিটির সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পড়ে গেছে।”
“তোর বউ ভার্সিটির স্টুডেন্ট। খুব তো বলতিস ছোট মেয়ে বিয়ে করবি না। সেম এজ বা দু এক বছরের ছোট কাউকে বিয়ে করবি। এখন কি হলো?”
তপা হা করে চেয়ে রইল। বলছে কি ডক্টর? বউ! এই কুলক তাজওয়ার তাকে বউ বলে পরিচয় দিয়েছে। কি সাংঘাতিক।
তপার চাহনি দেখে পলক মৃদু হেসে বলল,
“তোমার সাথে তো পরিচয় করিয়ে দেই নি তাই না? ও হচ্ছে মিথিলা। আমার স্কুল এন্ড কলেজ ফ্রেন্ড। ভার্সিটিতে গিয়ে আলাদা হয়ে গেছি। আমি ইউনিভার্সিটি ও মেডিকেলে।”
তপা মুচকি হাসল কেবল। তার এই কথার প্রেক্ষিতে কি বলা উচিৎ বুঝতে পারল না। তবে মিথিলা থেমে থাকল না। অনর্গল কথা বলে যেতে থাকল। থেকে থেকে আবার হাসির ফোয়ারাও বয়ে গেল। তপা দর্শক মাত্র। তার ভূমিকা কেবল শোনা, দেখা এবং মাঝেমধ্যে মুচকি হাসি বিনিময় করা।

কেবিন থেকে বেরিয়ে যেই না নিচে নামার জন্য সিঁড়িতে পা রাখবে তখন তপা চকিতে তাকাল। পলকের বুকে হালকা থাপ্পড় দিয়ে বলল,
“থামুন থামুন। একটু দাঁড়ান।”
সহসা এহেন আচরণে পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হয়েছে? ওয়াশরুম যাবে?”
তপা পলকের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
“ওই দিকে দেখুন। ওটা রাত্রি না?”
পলক চমকাল। তপার ইশারা করা জায়গায় দ্রুত তাকিয়ে দেখল রাত্রি হুইল চেয়ারে বসে আছে। ওর দৃষ্টি রেলিং বেদ করে বাইরে বিচরণ করছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। পলক অবাক চোখে দেখল রাত্রির পানে। মুখটা শুকিয়ে গেছে। মাথায় তপার মতই ব্যান্ডেজ। পায়েও একই অবস্থা।
কারো উপস্থিতি টের পেয়ে রাত্রি চোখ তুলে তাকাল। সামনে পলক ও তার কোলে তপা কে দেখে মাথা নিচু করে ফেলল। পলক তপা কে পাশেই একটা জায়গায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়ল। তপা অবাক হয়ে দেখছে রাত্রি কে। কৌতূহল দমাতে না পেরে বলেই ফেলল,
“আপু, আপনার এই অবস্থা কি করে হলো?”
রাত্রি মলিন হাসল। বাইরের দিকে তাকিয়েই বলল,
“নিয়তি। পরের জন্য কুয়ো খুঁড়লে সে কুয়োয় নিজেকেই পড়তে হয় জানো তো।”
তপা কিছু বুঝতে না পেরে চোখ পিটপিট করে চেয়ে রইল। পরক্ষণেই মনে পড়ল সেদিনের বলা কথাগুলো। সিসিটিভি ফুটেজ, ভার্সিটির বখাটে ছেলেটার ভাঙা হাত মনে পড়তেই তপা পলকের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“এসবের পেছনে আপনার হাত নেই তো?”
সোজাসাপটা প্রশ্নে পলক থতমত খেয়ে কেশে উঠল। আমতা আমতা করল।
“আমি কেন করবো? আমি কিছু করিনি। তাই না বল।” রাত্রির দিকে তাকিয়ে বলল পলক। রাত্রি মলিন হাসল।
“তপা ওদের দোষ নেই। আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে ফেলে দিয়েছিলাম তার শাস্তি আল্লাহ আমাকে সাথে সাথেই দিয়ে দিয়েছে। ওরা কিছু না করলেও রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার বলেও তো একটা ব্যাপার আছে তাই না?”
তপা ঈষৎ অবাক হলো। ও জানতো না রাত্রি ওকে ফেলে দিয়েছিল। সিসিটিভি ফুটেজে কি ছিল তা আর জানা হয় নি তার। কিয়দংশ সময় পর তপা মৃদু স্বরে বলল,
“ওরা মানে কে কে আপু? কাদের দোষ নেই?”
পলক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তপার দিকে। এ মেয়ে রীতিমতো গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিয়েছে।
“তুমি অসুস্থ তিয়াশা। চলো এখান থেকে। রাত্রিও তো অসুস্থ। ওর ও নিশ্চয়ই কথা বলতে ভাল লাগছে না। চলো এখান থেকে।”
তপা মৃদু আওয়াজে বলল,
“এত ভয় কিসের মিস্টার তাজওয়ার?”
“ভয়? আমি? আমি কেন ভয় পাব? আশ্চর্য। তোমার শরীর ভালো না তাই বললাম চলে যেতে।”
তপা মুচকি হেসে বলল,
“আমি আপনাকে হারে হারে চিনি। আপনি না করতে পারবেন যে কলেজের বখাটে ছেলেটার হাত আপনি ভেঙে দেন নি। পারবেন?”
পলক অবাক হয়ে চেয়ে রইল। কিছু বলছে না দেখে তপা আবারও বলল,
“আপুর মাথা আর পায়ের এই অবস্থা কি করে হলো? ভালভাবে বলুন। নয়তো আপনার মুখটাও আমি আর দেখব না। তপার কথা কিন্তু শুধুমাত্র কথা নয়, অলিখিত দলিল।”
পলক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাকে জব্দ করার জন্য এই একরত্তি মেয়েই যথেষ্ট। কথার কি তেজ।
“আমি কিছু করিনি। যা করার প্রান্ত করেছে।”
তপা চমকে উঠল। শেষে কিনা তার ভাই।
“আপনি কোথায় ছিলেন?”
“আমি চলে এসেছিলাম। আমি সত্যি কিছু করিনি।”
“ভাইয়া আপুকে পেল কোথায়?”
পলক আমতা আমতা করে বলল,
“আমি ভার্সিটির সামনে থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিলাম।”
তপা দু’হাত শক্ত করে মুঠোবন্দি করে ফেলল। তার কপালের রগগুলো দপদপ করছে।
শক্ত গলায় বলল,
“আমি ফোন ফেলে এসেছি বাসায়। ফোন দেন আপনার বন্ধুকে। এখানে ক্রাইম করে লেজ গুটিয়ে চট্টগ্রাম গিয়ে বসে আছে। ওর লেজ আমি দ্বিখন্ডিত করব আজ।”

পলক পকেট হাতড়ে ফোন বের করল। রাত্রি অবাক চোখে তপাকে দেখছে। যাকে ও ইচ্ছে করে আহত করেছে এত জঘন্য ভাবে। সে তাকে আঘাত করার জন্য নিজের লোকের উপর কতটা ক্ষেপে গেছে। রাত্রি ব্যাথিত হলো নিজের কৃতকর্মের জন্য।
“পলক, প্রান্ত কিছু করেনি তপা। ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল। আমি আমার বাসার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। ওদের সত্যিই দোষ নেই।”
পলক চমকাল। প্রান্ত সত্যি সত্যি রাত্রিকে ছেড়ে দিয়েছিল? কিন্তু কেন? কই তাকে তো বলে নি। কি চলছে প্রান্তের মনে? কেন বলল না। পলক নিজ মনে আকাশকুসুম চিন্তায় মগ্ন হলো।
রাত্রি মাথা নিচু করে মলিন কণ্ঠে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দিও তপা। আমি প্রথম দিন থেকে তোমার সাথে একের পর এক অন্যায় করে গেছি। অথচ তুমি আমাকে আঘাত করার অপরাধে নিজের লোককে কাঠ গড়ায় দাঁড় করাচ্ছো।কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমাকে এতটা আঘাত করতে চাই নি। ভেবেছিলাম একটু আধটু লাগবে। তুমি ভয় পাবে। ভয় পেয়ে পলকের জীবন থেকে চলে যাবে। কিন্তু আমি এখন বলছি তুমি যেও না পলক কে ছেড়ে। ও তোমাকে পাগলের মতো ভালবাসে তপা। এমন ভালবাসা হেলায় হারিও না। আমাকে দেখো চেয়েও পাচ্ছি না। এক টুকরো ভালবাসার জন্য কতটা বেহায়া হয়ে গেছি তবুও ধরা দিচ্ছে না আমার ঝুলিতে। তুমি ভাগ্যবতী। তাই না চাইতেও পেয়ে গেছো। হারিয়ে ফেল না। নয়তো পস্তাবে। মারাত্মক ভাবে পস্তাবে।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here