কৃষ্ণময়ীর অলংকার পর্ব ১৯

0
1013

#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১৯

দীর্ঘ তিন বছর পর অতিপরিচিত সেই বাড়িটায় পদধূলি পড়ল তপার। যে বাড়ির আনাচে কানাচেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য স্মৃতি বিজরিত মূহুর্ত। আছে আতংকজনিত অগণিত ঘটনা। তপা বাড়ির ভেতরে পা ফেলে চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস ছাড়ল। পলক পাশে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। নীরবতাই শ্রেয় মনে হলো তার।

মোর্শেদুল হকের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে দুদিন আগে। হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে এসেই সিজান জানিয়েছে তপা কে। নয়তো সে জানে মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতেই অসুস্থ হয়ে যেত। মায়ের পর তো মামাই একমাত্র মায়ের ছায়া।

আধঘন্টা যাবত মোর্শেদুল হকের পাশে বসে আছে তপা। সরার নাম গন্ধ নেই। পাশেই চেয়ারে বসে নিষ্পলক চেয়ে আছে পলক। এতক্ষণ অবধি সব ঠিকই ছিল। গন্ডগোলের সূচনা হলো ঘরে অযাচিত এক পুরুষের আগমনে। তপা সহসা আড়ষ্ট হয়ে বসল। নিজেকে গুটিয়ে নিল। পলক তপার হঠাৎ পরিবর্তন লক্ষ করে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল একজন লোক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে তপার দিকে। তপাও ততটা গুটিয়ে যাচ্ছে। পলক দ্রুত উঠে তপার পাশে বিছানার উপরই বসে পড়ল। লোকটা তপার থেকে হাত দুয়েক দূরে দাঁড়ানো। নজরে নজর মেলাতেই পলকের কপালের রগগুলো ফুলে উঠল। পুরুষ হয়ে অন্য একজন পুরুষের চোখের দৃষ্টি দেখে মনের গতিবেগ বুঝে নিল এক লহমায়।
মোর্শেদুল হকের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,
“মামা, উনি কে?”
মোর্শেদুল হক কিছু বলার আগেই হাজেরা বেগম বললেন,
“ও মামুন। আমার ভাই। বাবা মা ছাড়া ভাইটা আমার কাছেই থাকে।”
পলক চমকে উঠল। তপার দিকে তাকিয়ে দেখল তপা চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে।

সময় কেটে গেল নিমিষেই। বারোটা নাগাদ এলেও চোখের পলকেই যেন বিকেল হয়ে গেল। দীর্ঘ তিনঘণ্টা তপা বসে ছিল মোর্শেদুল হকের শিয়রে। সাথে ছিল পলকও। একবার বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তপা হাতের উপর হাত চেপে ধরে আটকে ছিল। আর সাহস হয় নি কোথাও যাওয়ার। মেয়েটা যে ট্রমার মধ্যে আছে এটা স্পষ্ট বুঝতে পারল সে।

সিজান জরুরী কাজে বের হয়েছিল। তাই তার সাথে দেখা হলো বিকেল নাগাদ। বাড়ি ফিরেই বাবার পাশে তপা কে বসে থাকতে দেখে চোখ চিকচিক করে উঠল তার। পলক সিজানের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তপা মৃদু স্বরে বলল,
“আমাদের ফিরতে হবে।”
পলক কিছু বলার আগেই সিজান বলল,
“আজই চলে যাবি? আজকের রাতটুকু থেকে যা না। কাল সকাল সকাল চলে যাস।”
তপা বিছানা থেকে উঠে এসে সিজানের সামনে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলল,
“এখানে থাকলে আমি মরে যাব ভাই। এ বাড়িতে পা ফেলার পর থেকে মনে হচ্ছে আমি হাঁপানি রোগী। রাত হলে আর অক্সিজেন পাব না। বাঁচতে হলে এই ধ্বংসাত্মক পরিবেশ থেকে বের হতে হবে। নইলে মরণ নিশ্চিত।”
পলক ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
সিজান আর কিছু বলল না।
হাজেরা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,
“সিজান খেতে আয় ওদের নিয়ে।”
সিজান তাকাতেই তপা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার গলা দিয়ে এবাড়ির এক ফোঁটা পানিও নামবে না। উনাকে নিয়ে যা। উনি এ বাড়ির অতিথি।”
পলক অবাক হলো তপার গাম্ভীর্য দেখে। সিজান বলা সত্বেও পলক গেল না। তার কৃষ্ণময়ীর গলা দিয়ে না নামা খাবার তার গলাধঃকরণ হবে কি করে?

ঝুপড়ি ঘরের তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল সিজান। পিছু পিছু তপা ও পলক। তপা ভেতরে ঢুকে অবাক হলো। ঠিক তিন বছর আগের মতোই রয়েছে। কেবল বিছানার উপর ছড়ানো ছিটানো জামাগুলোর অস্তিত্ব পেল না। ভাঙাচোরা টেবিলের উপর এখনো তার গোছানো বইগুলো রয়েছে। কেবল ধুলোর স্তূপ পড়েছে কয়েক ধাপে। তপা এক হাত ধুলোপড়া বইগুলোর উপর বুলিয়ে দিল।
সিজান গলা পরিষ্কার করে বলল,
“সেদিনের পর এই ঘরে আর কেউ আসে নি। বলতে পারিস আমি আসতে দেই নি। তুই চলে যাওয়ার পরের দিন আমিও চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু যাওয়ার আগে তোর বিছানার উপর ছড়ানো ছিটানো জামাগুলো আগুনে পুড়িয়ে ঘরে তালাবদ্ধ করে দিয়েছিলাম। সেই তালা আজ খোলা হলো।”
তপা মৃদু হাসল। কিছু বলল না। পলক কেবল নীরব দর্শক। সব দেখছে শুনছে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু আন্দাজ করতে পারছে ভয়ঙ্কর কিছুর আভাস।

আলাপচারিতা শেষে পলক সিজানের সাথে বেরিয়ে গেল কয়েক মিনিটের জন্য। হাত মুখ ধোঁয়ার জন্য তপা কে বলেই বেরিয়েছে পলক। টিউবওয়েলের কাছে গিয়ে সিজান পলকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাইয়া কিছু কথা বলার ছিল আপনাকে।”
পলক মৃদু হেসে বলল,
“তিয়াশার অতীতের ব্যাপারে?”
সিজান মাথা নেড়ে সায় জানালো।
“সেটা তিয়াশা যদি কখনো বলতে চায় তবেই শুনবো। ওর মুখ থেকে। অন্য কারো থেকে ওর ব্যাপারে কিছু শুনতে চাই না। হোক সেটা অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ।”

তপা বিছানায় বসে ঘরের আনাচকানাচে নজর বুলাচ্ছিল। এইতো সেদিন মা মারা যাওয়ার পর ঠাঁই হলো তার এই ছোট্ট কুটিরে। রাতের পর রাত কেটেছে এখানে ঘাপটি মেরে শুয়ে থেকে। রাতের আধারে চাঁদের আলোই ছিল এঘরের মৃদু আলোর একমাত্র উৎস। কৃত্রিম কোনো আলোর ব্যবস্থা তার জন্য বরাদ্দ ছিল না। জীবনটাও হঠাৎ হয়ে গেল সেই রাতগুলোর মত তিমিরে আচ্ছাদিত।

কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে তাকাল তপা। চোখের পাতায় ভেসে উঠল সেদিনের সেই দানবীয় মুখটা। সেই একই রকম ভাবে চমকে উঠল তপা। ভয়ে সিটিয়ে গেল মূহুর্তেই। দিকবিদিকশুন্য হয়ে গেল সেদিনের মতোই। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তপার দিকে যেতেই তপা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলল,
“পলক।”

শ্রবণেন্দ্রিয়ে তপার শব্দ পৌঁছতেই পলক দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল তপার ছোট্ট কুটিরে। সিজানও দৌড়ে গেল পিছু পিছু। হাট করে খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করে দেখল তপার থেকে হাত দুয়েক দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে মামুন। তপা নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে।
পলক তপার সামনে গিয়ে দুবাহু ধরে বলল,
“তিয়াশা, কি হয়েছে? এভাবে ডাকলে কেন? ঠিক আছো তুমি?”
তপা কিছু না বলে ফুপিয়ে উঠল। পলক দিকবিদিকশুন্য হয়ে তপার মুখ দু’হাতে আগলে নিয়ে বলল,
“শান্ত হয়ে যাও। আমি চলে এসেছি তো কিচ্ছু হবে না। দেখ আমাকে। একটা ফুলের টোকাও পরতে দেব না আর তোমার শরীরে। একবার তাকাও।”
তপা পলকের দিকে তাকিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলল,
“আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন।”

পলক অবাক হয়ে তাকাল। এক মূহুর্তে কি এমন হলো। এতক্ষণ তো দিব্যি ছিল মেয়েটা। পরক্ষণেই তপার হাত নিজের মুঠোয় আবদ্ধ করে বলল,
” আমরা এক্ষুনি ফিরব। আগে তুমি শান্ত হও। মামার কাছে যেতে হবে তো। মামা তোমাকে কাঁদতে দেখলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। আগে নিজেকে সামলে নাও। ”

সিজান মামুনের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল,
“আপনি কোন সাহসে এই ঘরে পা ফেলেছেন? এটা আপনার বোনের সাম্রাজ্য নয়। এটা আমার বোনের ছোট্ট কুটির। এখানে প্রবেশাধিকার আপনাকে দেওয়া হয় নি। বেরিয়ে যান এক্ষুনি। আমাকে চটাবেন না। নইলে পরিণাম ভাল হবে না। না আপনার জন্য আর না আপনার বোনের। তাই সময় থাকতে আমার চোখের সামনে থেকে দূর হোন। আর কখনো যেন এই ঘরের ত্রিসীমানায় না দেখি। দেখলে এই ঘরেই দাফন করে দেব।”

সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ হলো। ধরনীর বুকে নেমে এসেছে রাতের আধার। আকাশে এক ফালি চাঁদের মিষ্টি আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পৃথিবী জুড়ে।
তাজমহলের সামনে এসে পলক তালা খুলতে ব্যস্ত হলো। তপা মৃদু স্বরে বলল,
“খাবার নিয়ে অপেক্ষা করব। কিছুক্ষণ পরে চিলেকোঠায় গেলে চিরকৃতজ্ঞ হবো।”

“আমি যখন ক্লাস থ্রি তে পড়ি তখন আমার মা মারা যায়। বয়স কতই আর হবে নয় বা দশ বছর। একদিন স্কুলে ক্লাসে বসেছিলাম। হঠাৎ স্যার এসে বললেন, বাড়ি যেতে হবে আমার। সবাই নাকি অপেক্ষা করছে আমার। স্যার বাড়ি আসার সময় অনেক কিছু বোঝালেন আমাকে। মানুষ মরণশীল। সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন কিছু বুঝতে পারি নি। কিন্তু বাড়ির সামনে এসেই দেখতে পেলাম মানুষের ঢল নেমেছে যেন। কেউ আসছে, কেউবা আবার ফিরে যাচ্ছে। তখন আমার ঠিক কি হলো জানিনা। ব্যাগ ফেলেই ছুটে চলে গেলাম ভেতরে। উঠোনের মাঝখানে খাটিয়ার উপর শোয়ানো ছিল আমার মায়ের নিথর দেহ। কিন্তু আমি স্কুলে যাওয়ার সময়ও আমার মা আমাকে তৈরি করে দিয়েছে। আদর করে দিয়েছে। অনেকটা রাস্তা এগিয়েও দিয়ে এসেছে। অথচ স্কুল থেকে ফিরে পেলাম আমার মায়ের নিথর দেহ। আমি আজও জানিনা আমার সুস্থ সবল মা কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে লাশ কি করে হয়ে গেল। লোকে বলে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না। করতে পারি না। আমার বিশ্বাস আমার মাকে ঐ লোকটা মেরে ফেলেছে।”
চাঁদের আলোয় আবছা দেখতে পেল তপার মুখশ্রী। মেয়েটা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখাবয়ব দেখতে পেলেও কৃষ্ণবরণ মুখখানার বিষাদগ্রস্ত রূপটা দেখতে পেল না পলক। হয়তো সে দেখাতে চাইছে না। তাইতো রুমে পর্যাপ্ত আলো থাকা সত্বেও কথা বলার জন্য বেছে নিয়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছাদটা।
পলক মৃদু স্বরে বলল,
“কোন লোকটা?”
তপা কঠিন গলায় বলল,
“আমার জন্মদাতা।”
পলক চমকাল। নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না তার।এজন্যই কি ভালবাসার উপর এত অনিহা তার?

“মায়ের মৃত্যুর মাস খানেকের মাথায়ই তার নতুন স্ত্রী ঘরে এলো। যেখানে আমার মায়ের সাথে তার বনিবনা হতো না বললেই চলে। সেখানে তার নতুন স্ত্রীর কথায় সে উঠতো, বসতো। খেতে বললে খেত না বললে না খেয়ে থাকত। নতুন বিয়ের সাথে সাথে তার মেরুদণ্ডও যেন নেতিয়ে গিয়েছিল। অথচ আমার মায়ের বেলায় তিনি ছিলেন পুরুষ সিংহ। যাইহোক সেটা তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। স্ত্রী কে ভালবাসার অধিকার সবারই আছে। শুধু আমার মায়ের বেলায় সেই ঘরটা ছিল ভালবাসা শূন্য। তাদের নতুন সংসারে আমি ছিলাম আগাছা। যাকে উপরে না ফেলা অবধি শান্তি মিলছিল না সংসারে। বকাবকি থেকে শুরু করে গায়ে হাত তোলা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। আমার জন্মদাতা সেটা দেখেও দেখতেন না। আমি যেন অদৃশ্য ছিলাম তার কাছে। মা থাকাকালীনও তিনি খুব ভালো বাসতেন আমাকে তেমনটা কিন্তু নয়। তবে বকা বা মারা কোনোটা করতেন না। তার দাঙ্গা ছিল কেবল মায়ের সাথে। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর নতুন স্ত্রীর কথায় তিনি আমাকে দু’টো চড় মেরেছিলেন। সেদিন আমি খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিলাম সত্যি আর আমার মা নেই। নেই কোনো আপনজন। মাস তিনেক চলল এভাবেই। মার খেয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। খাবার জুটলে জুটতো নয়তো অনাহারে, অর্ধাহারে চলে যেত। একদিন সেই লোকটার কাছে তার নতুন বউয়ের নামে নালিশ করেছিলাম। আমায় বইগুলো ছিঁড়ে ফেলার কারণে। সেটাই কাল হলো। মেরে ঘর থেকে বের করে দিল।ছোট্ট শরীরটা রক্তাক্ত করে দিল। আচ্ছা বাবারা কি এমন হয়? আপনার বাবা এমন?”

পলক নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকাল। শক্ত পোক্ত মনের অধিকারী পলক তাজওয়ারের আজ কান্না পাচ্ছে। মেয়েটা সহ্য করেছে কিভাবে? ওই টুকু বয়সে। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল সে। জীবন থাকতে তার কৃষ্ণময়ীকে সে কষ্ট অনূভব করতে দেবে না। প্রয়োজনে নিজে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। শত আঘাত সহ্য করে নেবে। কিন্তু এই মেয়েটার গায়ে একটু আঁচও লাগতে দেবে না।

“সেদিন মামা কোনোভাবে খবর পেয়ে আমাকে নিয়ে এল মামার কাছে। মামির এতে ঘোর আপত্তি ছিল। বাবার বাড়ি থাকতে কেন তারা একটা আগাছা নিজের জমিতে লাগাবে। কিন্তু মামা নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। তাই মামি বাধ্য হলেন আমাকে আশ্রয় দিতে। কথা শোনালেও ঠিকমতো খাবার পেতাম। স্কুলে যেতাম। ভাই তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। ও আমাকে পড়াতো। দিনের বেলা সবার সাথে কাটলেও রাতটা ছিল নিঃসঙ্গ। একা একা ঐ ঝুপড়িতে থাকতে ভীষণ ভয় হতো আমার। প্রথম দিকে বাতি ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন অন্য ঘরের বাতি নষ্ট না হলেও আমার ঘরের বাতি দুদিনও যেত না। নষ্ট হয়ে যেতো। কিভাবে সেটা তখন জানতাম না। এরমধ্যে কি হলো মামির ভাইয়ের আমাকে আদর করা আমার পছন্দ হলো না। আমি কিন্তু তখন ছোট্টটি। তবুও মনে হতো লোকটার ছোঁয়া মামার ছোঁয়ার মত পবিত্র নয়। সিজান তাকে মামু ডাকতো। তাই আমিও মামুই ডাকতাম। মা হারা ছোট্ট মেয়ে টাকে আদর করার বাহানায় এলোমেলো ভাবে ছুঁয়ে দিত। রাতের অন্ধকারে মনে হতো কেউ এলোমেলো ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে। ভয় পেতাম। ভূতের ভয়। তখন তো জানতাম না আস্ত শয়তান পুষছেন মামি বাড়িতে। এভাবে চলল কিছুদিন। আমি থ্রি পেরিয়ে ফোরে উঠলাম। অসহায় ছিলাম দেখে হয়তো অন্য বাচ্চাদের থেকে আমি একটু বেশিই ম্যাচিউর ছিলাম। এদিকে আমি দিনদিন বড় হচ্ছিলাম আর মামুর ছোঁয়ার মাত্রা দিনদিন পাল্টাচ্ছিল। প্রথম দিকে বাহানা করে ছুঁলেও পরে আশেপাশে কাউকে না দেখলেই নির্ধিধায় ছুঁয়ে দিত। একদিন আমি মামির কাছে নালিশ জানালাম। মামু আমাকে ব্যাড টাচ করে। মামি সেদিন হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ছিল বোধহয়। রান্না ঘরের চ্যালাকাঠ দিয়ে পিটিয়েছিলো। দাগগুলো এখনো বোধহয় রয়ে গেছে। ব্যস আর নালিশ করলাম না বাকি জীবনে। মামা সারাদিন বাইরে থাকতো বিধায় টের পেত না কিছুই। সিজান টের পেল কিছুদিন পরেই। ও রাতে বাইরে বের হয়ে মামুকে আমার ঘর থেকে বের হতে দেখেছিল। পরের দিন আমাকে জিজ্ঞেস করল আমার ঘরে রাতে কেউ আসে কিনা। আমি কিন্তু তখনও ভূতের ভয়ই পেতাম। অন্ধকারে কেবল একটা অবয়ব ব্যতীত দেখতে পেতাম না কিছুই। দরজা জানালা সবই ছিল ভাঙা মতন। প্রবেশে কোনো বাঁধাই পেত না। সিজান জানাল ভূত নয় তার মামুই অবাধে বিচরণ করছিল আমার ঘরে। আমি বড় হতে হতে পাল্টে গেল তার বিকৃত মস্তিষ্কের নোংরা চিন্তা। রাতগুলো আরও যন্ত্রণাময় হতে শুরু করল। নারীদেহের পূর্ণ রূপ পাওয়ার আগেই নরপশুর আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হতে লাগল। ঘুমাতে পারতাম না আমি। একদিন সহ্য করতে না পেরে শুধু বলেছিলাম আমাকে ব্যাড টাচ করো না মামু। আমি মরে যাব। সেদিনের পর দানবটা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল। আগে তো কেবল হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিত। কিন্তু সেদিনের পর আঘাত করতে শুরু করল। তখন আমি ক্লাস ফাইভে। সিজান ভাইকে বলেছিলাম আমি মরে যাব। ভাই আমাকে একটা লাইট, লাঠি আর দা এনে দিয়েছিল। আসলেই যাতে আঘাত করি। এরপর কিছুদিন শান্তিতে ছিলাম। আমি কিছু বলতে পারি নি কাউকে। কেন জানেন? একদিন মামা আমাকে বলেছিল আমার শরীর দিনদিন খারাপ কেন হচ্ছে? আমি মামুর কথা তুলতেই মামি বলল বাচ্চা মানুষ। মামুন তো ওকে আদর করে ভালো বাসে। হয়তো ধমক টমক দিয়েছে তাই এরকম বলছে। এরপর যতবার যাকে বলতে চেয়েছি শুনতে হয়েছে বাচ্চা মানুষ। আর কিছু বলতে চেষ্টা করি নি। এর মাঝে কিন্তু প্রান্ত ভাইয়াও আছে । সেও আমাকে প্রাণ দিয়ে ভাল বাসতো। কিন্তু এসবের কিছুই জানতো না। কেবল ভাই আর আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। হয়তো মামাও বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু বলতো না। হয়তো লজ্জায় নয়তো অপরাধ বোধ। সিজানের নানু অসুস্থ হলো। তখন আমি ক্লাস সিক্সে। মামিসহ চলে গেল। কিছুদিন পর মামি চলে এলেও দানবটা এলো না। দীর্ঘ চার বছর আমি শান্তিতে ছিলাম। এরমধ্যে মামা ঘর সারিয়ে দিয়েছে। লাইটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন? তারপর থেকে আর আমার ঘরের বাতি নষ্ট হতো না। যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন সিজানের নানু মারা গেল। কিছুদিন পর দানবটা আবার হাজির হলো। কিন্তু রাতের অবাধ বিচরণে বাঁধা হলো শক্ত পোক্ত দরজা জানালা। আমি আবার ভয় পেতে শুরু করলাম। সামনে পরীক্ষা কিন্তু পড়ালেখা করার মনোবল পেতাম না। হ্যা তখন কিন্তু আমি আর ছোট্টটি নেই। পরিপূর্ণ নারী। হয়তো স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। কিন্তু একজন নারীই ছিলাম। এরমধ্যে সিজান কোনো ভাবে ভাইয়াকে জানিয়েছিল ব্যাপারগুলো কিন্তু আমি জানতাম না। এরপর এলো এক ভয়াবহ দিন। মামা, মামি, সিজান কোথাও গিয়েছিল। আমি স্কুল থেকে ফিরে ঘরে যেতেই দেখি মামু আমার ঘরে, আমার বিছানায়। আমি ঘরে যেতেই নিজের বিকৃত কার্য সম্পাদনের জন্য ঝাপিয়ে পড়ল আমার উপর।”
বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠল তপা।
পলক নির্বিকার। নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে তপার দিকে। তপা পুনরায় কিছু বলার আগেই পলক মলিন কণ্ঠে বলল,
“আমি আর কিছু শুনতে চাই না। প্লিজ চুপ করো।”
তপা তাচ্ছিল্য হেসে বলল ,
“কেন ঘেন্না ধরে যাচ্ছে আমার উপর?”
পলক দু কদম এগিয়ে তপার মুখোমুখি দাঁড়াল। মুখটা দু’হাতে আগলে নিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
“আমার ভালবাসা এতটাও ঠুনকো নয় কৃষ্ণময়ী। পালকের মত হালকাও নয়। যে একটা ঝড়ো হাওয়া তা উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে।”

“সেদিনই হয়তো আমি নিজের সর্বস্ব হারিয়ে ফেলতাম। কিন্তু নতুন প্রাণ সঞ্চার করল ভাইয়া। ঝড়ের বেগে কোথা থেকে এসে যেন বাঁচিয়ে নিল। কিন্তু কলঙ্ক থেকে বাঁচাতে পারল না। শুধু আমি নই। কলঙ্ক গিয়ে পড়ল ভাইয়ার গায়েও। সিজান ভাইও সেদিন বিরূদ্ধবাধী হলো। অবশ্য পরে জানিয়েছে কেন ওরকম ব্যবহার করেছিল। আপনিও তো ছিলেন ওখানে। তারপর সেদিনই চলে এলাম আন্টির কাছে। তারপর এসএসসি। এইচএসসি দিলাম হোস্টেল থেকে। ভার্সিটি তে গিয়ে তো আপনার সাথেই দেখা হলো প্রথম দিন।”

“আমাদের বাচ্চা হলে আমরা প্রথমে মামা ডাক শেখাবো কেমন? প্রান্ত আর সিজানের জন্য।”
তপা পলকের শান্ত কণ্ঠে এরকম কথা শুনে বিস্মিত হলো।
“আপনার ঘেন্না লাগছে না?”
পলক মৃদু স্বরে বলল,
“ঘৃণা করার কি যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল?”
“আমার শরীরে এক ফোঁটা জায়গাও নেই নোংরা স্পর্শ বিহীন। যেটুকু আমি আপনাকে দিতে পারি। হয়তো ধর্ষিত হই নি।কিন্তু মোলেস্ট হয়েছি বারবার। বহুবার।”
“মনটা তো এখনো অধরাই রয়ে গেছে। সেটুকুই দাও। নারীদেহ কেবল ব্যবহার করার জন্য নয় তিয়াশা। একবার কেউ ছুঁলে আর তাকে ভালবাসা যাবে না এমনটাও নয়। তবে কেন তোমার এত দ্বিধা? তুমি কি ভাবছো আমিও অন্য পাঁচ টা পুরুষের মতো বউকে অবহেলা করব?”
তপা কিছু বলল না। কেবল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই একটা দীর্ঘশ্বাসেই রয়েছে হাজারো না বলা কথা।

পলক গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠ খাদে নামিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল,
“আমায় একবার জড়িয়ে ধরবে কৃষ্ণময়ী।”

তপা কিঞ্চিৎ সময় নিল ভাবার জন্য। পরক্ষণেই পলকের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের বাঁধনে বাঁধা পড়ল। দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো পলকের পিঠ। নিবিড় থেকে আরও নিবিড়ভাবে। একটা সূচ গলার মত ফাঁক ফোঁকরও রইল না।
এক প্রহর, দু প্রহর কাটলো নিভৃতে। কিয়ৎক্ষণ পর প্রথমে নীরবে তারপর ফুপিয়ে অতঃপর গগনবিদারী চিৎকারে রূপ নিল তপার ভেতরের দলা পাকিয়ে আসা কান্নাগুলো। এতদিনের জমিয়ে রাখা কষ্টগুলো।
পলক বাহুডোরে তার প্রিয় কৃষ্ণময়ীকে জড়িয়ে কঠিন একটা প্রতিজ্ঞা করে ফেলল।
“যে জীবনে সুখের মুখ তিয়াশা দেখে নি। সেই এক জীবনকেই সুখের চাদরে মুড়িয়ে দেবে পলক তাজওয়ার। এই মূহুর্তে থেকে তোমার জীবন বদলে যাবে। কাল থেকে তুমি বাঁচবে নতুন ভাবে, নতুন পরিচয়ে। আগে ছিলে ভালবাসা। কাল থেকে তার সাথে যোগ হবে দায়িত্ব।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here