কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩৪

0
1866

#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৩৪(১)
#নন্দিনী_নীলা

সময়টা রাত দুইটার দিকে।
তৃষ্ণা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মাঝেই বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। ও যেহেতু বিছানায় একা এজন্য একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাচ্ছে এভাবে গড়াগড়ি করে ঠাস করে বিছানা থেকে ফ্লোরে পরে গেল। তৃষ্ণা ফ্লোরে পরতেই ওর নিদ্রা ছুটে যায়।
জায়ান বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। থপ করে কিছু পরে যাওয়ার শব্দ পেয়ে ও চমকে উঠে আর দ্রুত ভেতরে আসে। ড্রিম লাইটের আলোয় দেখল তৃষ্ণা ফ্লোরে বসে আছে স্তব্ধ হয়ে। ব্যথা পেয়েছে কিনা ওর মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে না।
জায়ান রুমের লাইট অন করে দ্রুত তৃষ্ণার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,,” পরলে কীভাবে? দেখি উঠো বেশি ব্যথা পেয়েছ?”
তৃষ্ণা হতবিহ্বল চোখে তাকাল জায়ানের দিকে। ও নিচে বসে আছে স্তম্ভিত হয়ে। ওর বুঝতে পারছে না ও এতো বড়ো খাট থেকে পরে গেল কিভাবে? তাও জায়ান পাশে থাকা সত্ত্বেও। পরার সময় ওর মনে হলো না ওর পাশে কেউ ছিল। তাহলে কি ও একা ছিল বিছানায়? তৃষ্ণা প্রশ্নতুক চোখে তাকাল জায়ানের দিকে আর জিজ্ঞেস করল,,”আপনি কোথায় ছিলেন? আমি পরে গেলাম কীভাবে?”
” বেলকনিতে ছিলাম। তুমি ঘুমের মধ্যে এতো নড়াচড়া করলে যে মাঝখানে থেকে ফ্লোরে চলে এলে।”
” সকাল কি হয়ে গেছে?”
বলতে বলতে তৃষ্ণা জায়ানের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ চিনচিন ব্যথা করছে। হাত পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে বলল,,” আপনি বেলকনিতে কি করছিলেন এতো রাতে? আড়াইটা বাজে। এখনো তো সকাল তো হয়নি।”
জায়ান তৃষ্ণার ঘুমঘুম ফোলা চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,” ঘুম আসছে না। এজন্য আঁধার রাত্রি উপভোগ করছিলাম।”
” আপনি ওসব উপভোগ করতে না গেলে আমি পরে যেতাম না। নিশ্চয়ই ঘুমের মধ্যে আপনায় খুঁজে নিতে ছটফট করেছি আর নিরাশ হয়ে পরে গেছি।”
জায়ান বলল,,” তুমি ঘুমাও।”
” আপনি কি ঘুমাবেন না আজ?”
” আমি একটু একাকি থাকতে চাইছি।”
” আমি আবার পরে যাব আপনি না থাকলে।”
” এর আগে মনে হয় একা থাকো নাই!”
” থেকেছি তখন পরতাম না। আজ পরে গেছি তাই আপনাকে আমার সাথেই থাকতে হবে।”
বলেই তৃষ্ণা ওয়াশরুমে থেকে চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো।
” আপনাকে খুব বিষন্ন লাগছে। আপনার কি কোন কারণে মন খারাপ?”
” মাথাটা যন্ত্রণা করছে।” জায়ান কপালে হাত দিয়ে বলল।
তৃষ্ণা লাইট অফ করে বিছানায় বসে বলল,,” আসুন আপনার মাথা টিপে দেই। ভাল লাগবে।”
জায়ান দ্বিমত করল না। বাধ্য ছেলের মতো বিছানায় উঠে বসল। আর তৃষ্ণা কোলের উপর মাথা রেখে পা ভাঁজ করে শুয়ে পরল। তৃষ্ণা চমকে উঠে ও নিজেকে সামলে নিল।
তৃষ্ণা জায়ানের মাথার চুল টেনে ধরে বলল,,” মায়ের কথা মনে পরছে তাই না? উনার জন্য আপনি কষ্ট পাচ্ছেন।”
জায়ান সত্যি ডুকরে কেঁদে উঠল। জায়ানকে সব সময় শক্তপোক্ত, গম্ভীর, কঠিন পুরুষ বলেই মনে হয়েছে। সে তেমনটাই। ওকে ভালবাসে অনেক কিন্তু নরম, বা কাঁদতে পারে, এমনটা কখনো মনে হয়নি। সব সময় যে মানুষটাকে শক্ত বলে মনে হয়েছে আজ তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে ওর বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। মায়ের প্রতি তার যে অসীম ভালবাসা তা এই কান্নায় প্রকাশ পাচ্ছে অথচ একটু আগেও ও ভেবেছিল জায়ান তার মাকে ভালবাসা তো দূরে থাক পাগল বলে হয়তো অবজ্ঞা করে। তখন কেন জানি ওর জায়ানের উপর রাগ হচ্ছিল নিজের মাকে এভাবে অবজ্ঞা করার জন্য। কিন্তু এই মুহূর্তে জায়ানের এই হাহাকার, কান্না ওর ভাবনা ভুল বলে প্রমাণ করছে।
মাকে উনি একটু নয় অনেক বেশিই ভালবাসে কিন্তু তাহলে কেন নিজেকে তার থেকে দূরে রাখে। চাইলেই তো তিনি মায়ের চিকিৎসা করাতে পারে তা না করিয়ে কেন বন্দি করে রেখেছে।
তৃষ্ণা হঠাৎ বলে উঠল,, ” যান মায়ের সাথে দেখা করে আসেন।”
জায়ানের কান্নার শব্দ অনেক আগেই থেমে গেছে। আবেগের বশে একটু কেঁদে উঠলেও দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। কিন্তু তার চোখ দিয়ে গলগলিয়ে এখনো অশ্রু ঝরছে। আর সেই জলে তৃষ্ণা শাড়ি ভিজে যাচ্ছে।
জায়ান তৃষ্ণার কথার পিঠে কিছু বলল ও না নড়ল ও না। তৃষ্ণা জায়ানের মুখটা সোজা করে বলল,,” কথা বলছেন না কেন?”
“শুয়ে পরো। একটু ঘুমাতে চাই। সকালে আর রেস্ট নেওয়ার টাইম পাওয়া যাবে না।”
” কথা এরিয়ে যাচ্ছেন?”
” যা মনে করো।”
তৃষ্ণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জায়ানের পাশেই শুয়ে পরল।
“আমি ঠিক আছি। এতো চিন্তা করতে হবে। ঘুমাও।”
জায়ান তৃষ্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল।
তৃষ্ণা জায়ানের বক্ষস্থলে অধর স্পর্শ করে বলল,,” আপনি ঠিক নেই।”
জায়ান বিষন্ন মুখ এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল,,”ব‌উয়ের আদর স্পর্শ পেলে সব কষ্ট কোথায় যেন মিইয়ে যায়। একটু বেশি করে আদর করে দাও। আমি একদম ফিট হয়ে যাব।”
তৃষ্ণা মাথা উঁচু করে বলল,,” তাই? এই অবস্থায় ও মজা করছেন?”
“মজা নয় রিয়েলি।”
” তখন এতো ভালবাসার কথা বলে তো আমায় ঘুম পাড়িয়ে দুঃখ বিলাস করতে গেছিলেন। আর আমি সেই দুঃখে বিছানা থেকেই পরে গেলাম।”
” আমি কিন্তু সত্যি বুঝি নি তুমি পরে যাবে।”
“যান আজ আপনার বিষন্নতা কাটাতে আমি সব মেনে নিলাম।”
” ব‌উ স্বেচ্ছায় আমন্ত্রণ করলে আমি কি মানা করতে পারি।”
” কি! কি বললেন? আমি আমন্ত্রণ করলাম কখন?”
” এই এখনি তো করলে!”
” মোটেও না আপনি আবদার করছেন বিদায়।”
” তাহলে একটু আদর করো দাও না।”
তৃষ্ণা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। জায়ান কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়েই যেন ঘায়েল করে দিবে। ওকে সম্মোহিত করে ফেলবে। ড্রিম লাইট আজ এতো আলো দিচ্ছে কেন?
জায়ানের ঠোট টিপে হাসা ও স্পর্শ দেখতে পাচ্ছে আর এতে ও আরো লজ্জায় কাঁচুমাচু করতে লাগে।
জায়ান ঠোঁট উঁচু করে বলল,,” তারাতাড়ি করো মাথা ব্যথা করছে। ঘুমাব তো।”
তৃষ্ণা কিছুই করতে পারছে না ও মুখ লুকাতে আরো জায়ানের বুকের সাথে মিশে যাচ্ছে। তা দেখে জায়ান তৃষ্ণার থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে বলল,,” প্লিজ।”
তৃষ্ণা চোখ খিচে বন্ধ করে লাজুক গলাতেই বলল,,” আমি পারছি না।”
জায়ান তৃষ্ণার থুতনি ছেড়ে দিল।
” আচ্ছা ঘুমাও।”
জায়ান চোখ বন্ধ করে নিল। তৃষ্ণা চুপ করে জায়ানের বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। কথা রাখতে না পেরে ওর খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু ওর যে লজ্জা লাগে ও কীভাবে.. উনার মনটা এমনিতেই খারাপ ও আরো বাড়িয়ে দিল।
জায়ান তৃষ্ণার মাথাটা টেনে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,,” ঘুমাও তো।”
” আপনার কষ্ট কমানো বদলে বাড়িয়ে দিলাম। আমি আসলেই আপনার যোগ্য নয়।”
” বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করলে এই এক জ্বালা। সব কিছুতেই উল্টো বুঝে।”
বলেই জায়ান নিজেই গভীর ভাবে তৃষ্ণা কে স্পর্শ করল। তৃষ্ণা জায়ানের আদর স্পর্শ সাদরে গ্রহণ করল।
____________________________

হলুদে ঝামেলা হ‌ওয়ার জন্য। বিয়ের দিন জেসমিন বেগম নিজে বারবার করে পাগলটার ঘর পাহারা দিচ্ছেন। বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। আজ সবাইকে এ রুমে আসতে মানা করেছেন‌। আদ্যিখেতা করতে গিয়ে দরজাটা বন্ধ না করেই চলে আসে সবাই। বিপদ সেই ওর ঘাড়েই পরে। মেয়ে বিয়েতে এসব ঝামেলা দেখতে চান না তিনি।
তৃষ্ণা সকাল থেকে পাগলটার ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে কিন্তু চাবির অভাবে ভেতরে যেতে পারছে না। লিলির থেকে খবর পেয়ছে অনেক মার দিয়ে রুমে নেওয়া হয়েছিল। তৃষ্ণা মার দেওয়ার কথা শুনেই যেতে চেয়েছিল। জায়ান কে এসব বলে কষ্ট দিতে চায় না এজন্য তাকেও বলতে পারছে না। জায়ান ওর মাকে খুব ভালবাসে মায়ের জন্য আপসেট ও থাকে। গতকাল রাতেই সেটার প্রমাণ পেয়েছে ও। লোকটাকে এসব বলে আর কষ্ট দিতে চায় না।
সকালের দিকেই তৃষ্ণা ভাই ভাবি এসে উপস্থিত হলো। তারা হলুদে আসবে বলে আসেনি এ
জন্য তৃষ্ণা ভেবেছিল আজ ও আসবে না কিন্তু আজকে এসে ওকে চমকে দিয়েছে।
বরপক্ষ চলে এলো যথাসময়ে। যেহেতু ও বাড়ির একমাত্র ব‌উ তাই গেইট থেকে শুরু করে সব কিছুতেই ওকে নিয়ে আনন্দ উল্লাস করছে সবাই‌। আরিফ আর ওর সব ফ্রেন্ডরা ওর পাশেই বসা স্টেজে। তৃষ্ণার হাতে দেওয়া হয়েছে বর এর খাবার। এতো বড়ো প্লেট নিয়ে ও হাঁটতে পারছে না ওর সাথে আরো দুজন জায়ানের মামাতো বোন গেল। তৃষ্ণা প্লেট রেখে আসতে যাবে তখন নজর গেল রহিতের দিকে। রহিতের হাত ব্যান্ডেজ করা।তাও ডান হাত ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,,” আরে আপনি গতকাল এসেছিলেন সেই না?”
রহিত ফ্যাকাশে মুখে মাথা নাড়াল।
” আপনার হাতে কি হয়েছে। গতকাল ও না ঠিক ছিল।”
রহিত বলল,,” ভুল জায়গায় হাত দেওয়ার জন্য শাস্তি হিসেবে হাত ভেঙে দিয়েছে।”
” মানে?” অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল তৃষ্ণা।
” আপনি দয়া করে এখানে থেকে যান। নয়তো কথা বলার জন্য না আবার আমার জিভটাই কেটে নেয়। আমি ব‌উয়ের সাথে প্রেম বাক্য না আউরিয়ে বোবা হতে চাই না।”
তৃষ্ণার দৃষ্টি বিষ্ময়ে ভরা। বোকা চোখে তাকিয়ে ভ্রু কুটি করে নিচে নেমে এলো।
___________________________

উর্মির বিদায়ের সময় খুব দ্রুত ঘনিয়ে এলো। তৃষ্ণা এমনিতেই খুব নরম মনের আর তৃষ্ণা কে উর্মি খুব আপন করে নিয়েছিল এজন্য তৃষ্ণা বিদায় এ খুব কাঁদল। আত্নীয় স্বজন সবাই কেঁদে পরিবেশটা মুহূর্তের মধ্যে কান্না বাড়ি বানিয়ে দিল।
তৃষ্ণা জায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু মানুষটা কাঁদে নাকি। কিন্তু জায়ান একটুও কাঁদল না। কিন্তু মুখটা যথেষ্ট গম্ভীর ছিল। জোভান সেকি কান্না। এই ছেলে মেয়েদের থেকেও বেশি কাঁদে। সে কেঁদে কেঁদে উর্মি কে তো গাড়িতেই উঠতে দিচ্ছিল না পরে জেসমিন বেগম তাকে জোর করে টেনে সরিয়ে আনে আর উর্মি কে গাড়িতে তুলে দেয়।
তৃষ্ণা জায়ানের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,,” আপনার যমজ ভাইকে বিয়ে বাড়ি দেখলাম না। তিনি কোথায়?”
জায়ান ভ্রু কুঁচকে বলল,,” বলো কি সিরিয়াসলি? বাট আই ডোন্ট নো‌।”
” বলেন কি আপনি কিছুই জানেন না? আপনি কি বাড়ি থাকেন না?”
” থাকব না কেন? কিন্তু আমি সত্যি জানতাম না ও বাসায় নাই। আমি তো ভেবেছি আমার সামনে আসছে না হয়তো। আরো এতো টেনশনের মাঝে ওর কথা মনেই ছিল না।”
” সকালেই শুনলাম জেসমিন মা আপনার বাবাকে তাঁর খোঁজ করতে বলছে।”
জায়ান তৃষ্ণার দিকে থেকে চোখ সরিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে উর্মি কে বিদায় দিয়ে এলো। তৃষ্ণা ভীড় ঠেলে আর কাছে যায় নি‌।
#চলবে……

#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৩৪(২)
#নন্দিনী_নীলা

তৃষ্ণা এক গ্লাস পানি এনে সাদিকুর রহমানকে দিল। মেয়ের বিদায় তিনিও কেঁদেছেন। সবাই মনমরা হয়ে বসে আছে ড্রয়িংরুমে। সেই মুহূর্তেই আয়ান বাসায় প্রবেশ করে। জায়ান রুমে ছিল। তৃষ্ণা পানি দিয়ে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিল তখনি মেইন দরজা দিয়ে প্রবেশ করে আয়ান।
জেসমিন বেগম আয়ানের পাশে বকুলকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখে কপাল কুঁচকে এগিয়ে আসে।
” এসব কি আয়ান? তোমার একমাত্র বোনের বিয়ে আর তুমি অনুপস্থিত। এতো কল করলাম ফোনটা অবধি অফ করে রেখেছ। বোনের বিদায় এ পর্যন্ত উপস্থিত হলে না কেমন ভাই তুমি?”
তিনি বকুল কে অসম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আয়ান কে প্রশ্ন করল। তৃষ্ণা তাদের কথা শুনে থেমে গেছে। আয়ানের উত্তর শুনতেই দাঁড়িয়ে পড়েছে।
” মা আমি দরকারি কাছে বিজি ছিলাম।”
জেসমিন বেগম এবার বকুলের দিকে তাকিয়ে বলল,,” কি এমন তোমার দরকারি কাজ?কেমন কাজ করতে যাও জানা আছে। এই মেয়ে তোমার সাথে কেন?”
আঙুল উঠিয়ে বলল।
তৃষ্ণার দৃষ্টি বিষ্ময়ে ভরা, হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। ও দাঁড়িয়ে আছে জেসমিন বেগমের পেছনে। ওর দৃষ্টি বকুলের মাথা নিচু করে থাকা ছোট মলিন মুখশ্রীর দিকে। তার থেকে ও বড় শখ খেয়েছে আয়ান বকুলের হাত ধরে আছে দেখে। বড়ো বড়ো চোখ করে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছে হাতের দিকে। আয়ান বকুলের ছোট হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে রেখেছে। ও যে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। কথাই বলতে পারছে না।

” কি হলো উত্তর দিচ্ছো না কেন?”
আয়ান মাথা নিচু করে বলল,,” আমি বকুল কে বিয়ে করেছি।”
” হোয়াট?” জেসমিন বেগম চেঁচিয়ে উঠল। তৃষ্ণা দু’পা পিছিয়ে গেল। চোখে জল ছলছল করছে। বকুলের চোখ বেয়ে গলগলিয়ে অশ্রু ঝরছে।
বাইরের চেঁচামেচির শুনে জায়ান নিচে নেমে আসে।
তৃষ্ণার শরীর অসাড় হয়ে আসছে। এতো বড় শক ও নিতে পারছে না। ও পরে যেতে নেয় জায়ান ছুটে এসে ওকে ধরে ফেলে। তৃষ্ণা অজ্ঞান হয়ে গেছে।‌ বকুল আয়ানের থেকে হাত ছাড়াতে মুচড়া মুচড়ি করছে।
” ছাড়ুন আমার হাত বুবুর কাছে যাব।”
” চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। নচেৎ ফলাফল ভালো হবে না।”
বকুল অসহায় চোখে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। জায়ান তৃষ্ণাকে এক হাতে আগলে দাঁড়িয়ে আছে।
” দুনিয়ায় এতো মেয়ে থাকতে তোর আমার শালিকা কেই বিয়ে করতে হলো?”
” ইটস মাই মেটার। তোর বিয়ের সময় আমি যখন কোন বাধা সৃষ্টি করি নাই। তুইও এখানে বাড়তি কথা বলবি না।”
বাসার সমস্ত আত্নীয়-স্বজন দরজার কাছে এসে ভীড় করেছে। কাহিনী বুঝার জন্য সবাই নিশ্চুপ চেয়ে আছে। সবাই ফিসফিস করে হাসাহাসি করছে।
জায়ান তৃষ্ণাকে পাঁজকোলে তুলে বেডরুমে এসে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এলো। আয়ান নিজের কথা শেষ করে বকুলের হাত টেনে ভেতরে প্রবেশ করে। জায়ান এসে ওদের পথ আগলে দাঁড়ায়।
” সামনে থেকে সর।”
” বকুলের সাথে আমার কথা আছে ওর হাত ছাড়।”
” তোর সাথে কোন কথা বলবে না বকুল।”
” বকুল?” বকুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল জায়ান।
বকুল ঢোক গিলে বলল,” উনি যা বলবেন তাই হবে।”
জায়ান সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। আয়ান শয়তানি হাসি দিয়ে বকুলকে নিয়ে উপরে চলে যায়। জায়ান ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ফোন বের করে কাউকে কল দিয়ে বলল,,” ড্রাইভারের খোঁজ পাওয়া গেছে?”
” স্যার আমি মজনুর বাড়ি গেছিলাম ও মারা গেছে এক্সিডেন্ট এ।”
” হোয়াট?”
জায়ান ফোন নামিয়ে কপালে আঙুল চালাতে লাগল। রাগান্বিত মুখশ্রী করে একবার জেসমিন বেগমের দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো।
জেসমিন বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে পরল সোফায়।
এই বাসায় কি সব হচ্ছে দুই ছেলেই নিজে নিজে বিয়ে করে নিল। একজনকেই সহ্য করতে পারে না আবার আরেকজন।
___________________________

আয়ান বকুলকে রুমে এনেই ছুঁড়ে মারে। বকুল ফ্লোরে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলে,,” আপনার কথা মতোই আমি সব করেছি এবার আমাকে ছেড়ে দিন।”
আয়ান বকুলের পাশে বসে ওর ওর গাল চেপে ধরে বলতে লাগল,,” বকুল ফুল কেঁদো না। তোমাকে ছাড়ার জন্য তো ধরিনি। এখনো তো কাজ শুরু‌ই করতে পারলাম না এখনি ছেড়ে দেব? আরেকটা কথা বকুল ফুল তোমার বোনের সাথে বেশি আড্ডাবাজি করবে না। আর ভুল করেও এসব বলতে যাবে না। যা শিখিয়ে দিয়েছি তাই বলবে মনে থাকবে?”
বকুল ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে গলগলিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। এতো জুড়ে চেপে ধরেছে যে মনে হচ্ছে গালের চামড়া ছিঁড়ে খেলবে।
আয়ান বকুলকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বকুল ওই ভাবেই বসে আছে।
চোখ য‌ত‌ই মুছে নিচ্ছে ফের ভিজে উঠছে। আয়ান ওয়াশরুমে থেকে বেরিয়ে আলমারি থেকে নিজের টিশার্ট বের করে গায়ের কোর্ড শার্ট খুলতে লাগল। বকুল মাথা নিচু করে ওইভাবেই বসে আছে। আয়ান কাজ শেষ করে বাইরে থেকে তালা দিয়ে নিচে এসে বলল,,” মা খেতে দাও তো।”
জেসমিন বেগম বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে আয়ানের দিকে।
” কি হয়েছে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছো কেন?”
” তোমার কি লজ্জা নাই? ওই মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসছো কেন?”
” মা তোমাদের পছন্দে তো একবার বিয়ে করলাম‌ই এবার নিজের পছন্দে করলাম। এতে এতো রিয়েক্ট কেন করছ? জায়ানের বেলায় তো কিছুই বলো নি তাহলে এখন কেন এতো কথা বলছ?”
” সব কিছুতে জায়ানের নাম নিবে না।”
” অফকোর্স নেব। ওই তো আমার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। ও ছাড়া আর কার নাম নেব?”
” তোমার এতো বাড়াবাড়ি সীমা অতিক্রম করছে এবার।”
” বাবা কোথায়?”
” জানি না।”
রাগে জেসমিন বেগম চলে গেল। আয়ানকে কাজের মহিলা খেতে দিল। আয়ান রাক্ষসের মতো খেয়ে বলল এক প্লেট নিয়ে উপরে আসতে। কাজের মহিলা ওর পেছনে পেছনে উপরে এসে খাবার দিয়ে গেল।
” আমি একটু বুবুর লগে দেখা করে আহি।”
” নাহ।”
বকুল আয়ানের পা জড়িয়ে বসে পরল।
” একটু যেতে দিন। এহনি চলে আসমু।”
” পা ছাড় নয়তো লাথি খাবি।”
আয়ানের ধমক খেয়ে বকুল সরে গেল।
___________________________

জায়ান তৃষ্ণার মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে।
” তৃষ্ণা চোখ খোল।”
তৃষ্ণা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে উঠে বসল।
জায়ান তৃষ্ণার গালে হাত রেখে বলল,,” ঠিক আছ?”
” ওই শয়তানটা আমার বোনকে বিয়ে করেছে।” ফুপাতে ফুপাতে বলল তৃষ্ণা।
” শান্ত হ‌ও।”
” এতো কিছু হয়ে গেছে আর আমি শান্ত হবো? আপনার ভাই একটা খুনি। আবার নোংরা চরিত্রে তার খারাপ দৃষ্টি আমি দেখেছি। তার মতো একজন আমার বোনের বর আমি কিভাবে মেনে নেব। এসব কীভাবে হলো আমার পাগল পাগল লাগছে আপনার ভাই কেন আমার বোনের সর্বনাশ করল।” বলেই তৃষ্ণা ঠুকরে কেঁদে উঠল।
” উফফ কেঁদো না তো। কেঁদে তুমি কিছু সমাধান করতে পারবে? পারলে নিজের বোনকে আমার কাছে নিয়ে আসো ওর সাথে আমার কথা আছে।”
“কোথায় বকুল?”
” আয়ানের রুমে হয়তো‌।”
তৃষ্ণা লাফ দিয়ে বিছানায় থেকে নেমে এলো। বকুলকে খেতে দিয়েছে। আয়ানের ধমক খেয়ে বকুল খাবারে কেবল হাত দিবে। তখনি তৃষ্ণা ছুটে এসে বকুলের হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল।
” আমার সাথে আয়।”
আয়ান আটকাতে যেয়ে ও পারল না তৃষ্ণা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়েছিল।
বকুলকে টেনে নিজের রুমে নিয়ে এলো।
” ওই শয়তান’টার হাতে কীভাবে পরলি? কি করেছে ও তোকে সব বল আমাকে।”
তৃষ্ণা বকুলের হাত ধরে জিজ্ঞেস করল। জায়ান নিশ্চুপ বসে আছে বকুলের কথা শোনার জন্য।
” কিরে কথা বলছিস না কেন? তোদের বিয়ে হয়নাই তাই না। বাবা মার থেকে আয়ানের কাছে কীভাবে গেলি বল আমাকে।”
” বুবু আমাদের বিয়ে হয়েছে এটা সত্য।”
‘ মিথ্যা বলছিস তুই। কাউকে ভয় পাওয়ার দরকার নাই সত্যি টা বল আমাদেরকে। তোর দুলাভাই ওকে শাস্তি দেবে।”
বকুল চুপ করে আছে।
” কথা বলছিস না কেন থাপ্পড় খাবি কিন্তু।”
বকুল বলল,,” আমি স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছি আমার আয়ান কে পছন্দ ছিল আগে থেকেই। তাই বিয়ের কথা বলাতেই রাজি হয়ে গেছি।”
তৃষ্ণা রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ঠাস করে চর মেরে দিল। বকুল আর্তনাদ করে কেঁদে উঠল। আয়ান এমনিতেই গাল চেপে ধরে ব্যথা দিয়েছিল এখন আবার চর খেয়ে ওর মাথা ভনভন করছে। তৃষ্ণা বকুলকে আবারো জিজ্ঞেস করল বকুল কথা বলছে না দেখে তৃষ্ণা মারতে লাগে। জায়ান তৃষ্ণাকে জোর করে সরিয়ে ইশারায় বকুলকে চলে যেতে বলে।
তৃষ্ণা জায়ানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে শব্দ করে কেঁদে দিল।
” শান্ত হ‌ও।”
” ও কেমন মিথ্যা বলল দেখছেন। আয়ান ওকে কব্জা করে নিয়েছে আমার বোন আমার কথার উত্তর দিল না।”
” ও ভয় পাচ্ছে। ওকে আসতে ধীরে জিজ্ঞেস করিও। কেন ভয় পাচ্ছে।”
” কেন আবার আপনার ওই ভাই আমার বোনকে ভয় দেখিয়েছে। আমি ছাড়ব না উনাকে আমার বোনের জীবন নষ্ট করতে দেব না আমি।”
________________________

” এই হাতের দাগ আমার তৃষ্ণা বেবির নাকি।”
বলেই আয়ান বকুলের গালে স্পর্শ করল। তৃষ্ণা এতো জোরে থাপ্পড় দিয়েছে যে লাল দাগ ফুটে উঠেছে।
বকুল আয়ানের হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,,,” আমার বুবুকে একদম খারাপ নজরে দেখবেন না। আমার বুবু আপনার ভাবি। বুবুকে সম্মান দিবেন।”
আয়ান বকুলের হাত মুচড়ে ধরে বলল,,” তোর কথায় আমি আয়ান চলব? বেশি কথা বলবি তো একদম জানে মেরে ফেলব।”
#চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here