#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_২৪
#নন্দিনী_নীলা
নীলগিরি কে বলা হয় বাংলার দার্জিলিং। দীগন্ত জুড়ে সবুজ পাহাড় আর মেঘের লুকোচুরি যে কাউকে এর রূপ দিয়ে বিমোহিত করে রাখবে। যদি সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ২২০০ ফুট উচ্চতায় মেঘ ছোঁয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে নীলগিরি সেই ইচ্ছে পূরণ করবে। নীলগিরি পাহাড় চূড়াতেই রয়েছে সেনাবাহিনী পরিচালিত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটক কেন্দ্র গুলোর একটি নীলগিরি পর্যটক কেন্দ্র। বান্দরবান জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে ২২০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের নাম নীলগিরি।
নীলগিরি চারপাশে চোখ মেলে তাকালে সারি সারি মেঘের পাহাড়ে আছড়ে পড়া ও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য সবাইকে বিমোহিত করবে। নীলগিরির চূড়া থেকে পাহাড়ের সারির পাশাপাশি আকাশ পরিস্কার থাকলে চোখে পড়বে বগালেক, বাংলাদেশের পঞ্চম সর্বোচ্চ পাহাড় চূড়া কেওক্রাডং, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত এবং চট্টগ্রাম বন্দর ও সাঙ্গু নদী।
ভোর সকালে তৃষ্ণাকে তুলে নিয়ে এসেছে এই অপরুপ সৌন্দর্যের দৃশ্যে। তৃষ্ণার শশুর শাশুড়ি গতকালের জার্নিতে নেতিয়ে গেছে আরা আসেনি।
এসেছে তৃষ্ণা – জায়ান, জোভান, আয়ান- উষসী, আরিফ ও উর্মি।
তৃষ্ণার এক হাত খুব যত্ন সহকারে ধরে জায়ান প্রতিটা পা ফেলছে আর তৃষ্ণা মুগ্ধ নয়নে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করছে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে জায়ান খুব সুন্দর করেই সব চিনিয়ে দিচ্ছে।
তৃষ্ণা গ্রামের মেয়ে অনেক হাঁটার অভিজ্ঞতা আছে। জায়ানের বাহু ধরে হাঁটছে।
এদিকে উষসী একটু হেঁটে হাঁপিয়ে গেছে। এদিকে আয়ান ভালো হওয়ার নাটক করে উষসীর মন জয় করে ফেলেছে অনেকটাই। এখন উষসীকে হাঁপিয়ে যেতে দেখে ও জোর করে পাঁজকোলে তুলে নিলো ফট করেই।
উষসী চোখ কপালে তুলে বলল,” কোলে নিচ্ছো কেন?”
” তুমি হাঁটতে পাচ্ছ না তাই।”
” আমাকে কোলে নিয়ে তুমি হাঁটতে পারবে না নামাও।”
“পারব। তুমি আমার গলা জড়িয়ে ধরো।”
উষসী তো খুশিতে বাক বাকুম। আয়ান উষসীর মনের সব দুটানা কাটাতেই এই কাজ টা করেছে। ওর চোখে ভালো হওয়ার জন্য। উষসীর চাহনি দেখে মনে হচ্ছে উষসী ওকে বিশ্বাস করতে পারছে। উষসী থেকে থেকে লজ্জা পাচ্ছে। এদিকে আয়ান ঘেমে একাকার। এই উষসী যে এতো ভারি হবে ও বুঝতে পারে নাই। ওকে দেখে তো চিকনই লাগে কিন্তু এতো ওজন হবে কে জানতো।
ভালো সাজতে গিয়ে এখন নাকানিচোবানি খাচ্ছে।
উষসী খুশিতে আয়ানের গলা জড়িয়ে লজ্জায় কাঁচুমাচু হচ্ছে। এদিকে আয়ান নামাবে কি করে ভেবে না পেয়ে আর কুলাতে না পেরে ঠাস করে কোল থেকে ফেলে দেয়। উষসী ওমাগো বলে চিৎকার করে ওঠে।
জায়ান আর তৃষ্ণা ওদের পেছনে ছিল। ওদের দুজনের কান্ড কারখানা এতোক্ষণ দুজনেই পর্যবেক্ষণ করেছে। এই ঘটনা ঘটতেই তৃষ্ণা জায়ানের বাহু থেকে মাথা উঠিয়ে নিলো মৃদু চিৎকার করে।
” এএএ পরে গেল তো।”
সবাই ছুটে এসে উষসী কে মাটি থেকে তুলেছে। আয়ান চোরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। বেশি ভালো হতে গিয়ে এখন আরো খারাপ হয়ে গেল।
উষসী তো ওমাগো, বাবাগো, আমার কোমর ভেঙে গেল গো বলে চেঁচিয়ে কাঁদছে।
তৃষ্ণা উষসীর শরীরের ময়লা পরিষ্কার করে দিলো। উষসী এখন দাড়াতেও পারছে না। দাঁড়ানো থেকে ফেলে দিছে ওর কোমরের অবস্থা শেষ।
উষসী আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,” তুমি ইচ্ছে করে আমাকে ফেললে তাই না। বেশি ভালবাসা দেখাতে গিয়ে আমাকে বিছানায় ফেলার ব্যবস্থা করে দিলে। বউকে কোলে নিয়ে একটু হাঁটতেও পারো না। এতো ফিটফাট শরীর নিয়ে ঘুরো কেন? অকৃতজ্ঞ স্বামী। এখন আমি হাটবো কি করে।”
জায়ান বলল,” যে ফালিয়েছে সেই কোলে করে নিয়ে যাবে।”
আয়ান বলল,” আমি তো নিয়ে যেতেই চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার গায়ে যে এতো ওজন আমি কি জানতাম। কীভাবে যে পরে গেলে। এখানে কারো পায়ে ব্যথা হলো না তোমার কেন হলো।”
” এই এই তোমাকে কি আমি বলেছি আমায় কোলে নাও। নিজে জোর করে নিজেই ফেলে দিলে। আবার কোলে নাও বলছি তোমার জন্য আমি অকেজো হয়েছি আমার দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে।”
আয়ান বিড়বিড় করে নিজেকেই বকছে। কেন যে আলগা পিরিত দেখাতে গেল।
আয়ান উষসীকে আবার কোলে নিয়ে খুব কষ্টে হাঁটছে। উষসী তখন লজ্জা মুখে থাকলেও এখন আছে শয়তানি মুখে।
” কি গো মোর পেয়ারের স্বামী খুব মজা লাগছে তাই না।।”
আয়ান জোর করে মুখে হাসে টেনে মাথা নাড়ায়।
জোভান ফোন টিপতে টিপতে আগে চলে গেছে।
সবার পেছনে আছে আরিফ আর আরিফের আগে উর্মি। উর্মি হাঁটতেছে আনমনে।
হঠাৎ কেউ ওর বাহু ধরে টেনে ধরে পেছনের দিকে তারপর বলে উঠে, ” আরে দেখে হাঁটেন। এখনি পায়ে কাঁটার আঘাত খাইতেন।”
উর্মি সামনে তাকিয়ে দেখলো আসলেই ওর পা ফেলার জায়গায় কাঁটা ডাল পরে আছে।
উর্মি ধন্যবাদ দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
আরিফ ওর পেছনে পেছনে আসছে এতোক্ষণ আনমনে ছিল বিধায় বুঝতে পারেনি। এখন বুঝতে পেরে আনইজি লাগছে।
আরিফ হঠাৎ বলে উঠল,” সরি!”
উর্মি চমকে পেছনে ফিরে বলল,” কেন?”
” আমার জন্য আপনি জায়ানের কাছে অনেক ধমক খেয়েছেন তাই না।”
তৃষ্ণা কপাল কুঁচকে বলল,” আপনি লুকিয়ে কথা শুনেছেন!”
” সরি আমি ভুল করে শুনে ফেলেছি। আরেকটা কথা আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো লজ্জায় এতোটা রুড বিহেভ করেন। তাই আপনার আমার প্রতি সংকোচ লজ্জা কাটিয়ে ফেলতে ওমনটা করতাম। এজন্য আপনার চোখেই আমি অনেক খারাপ হয়ে গেছি। বুঝতে পারি নি। আপনি যে আমাকে একটু ও পছন্দ করেন না। কিন্তু গতকাল আপনার কথায় স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়েটা আমি করব না।আপনি চিন্তা করবেন না। এই বিয়ে ভাঙার সমস্ত দোষ নিজেকেই দিব।”
উর্মি বিষ্ময়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। অবাক নয়নে আরিফের দিকে তাকিয়ে দেখল লোকটাকে আজ খুব অন্যরকম লাগছে। শক্তপোক্ত পুরুষ লাগছে। যার মধ্যে নাই কোন ছেলেমানুষি।
উর্মি বলল, ” আমি আসলে আপনাকে খারাপ ভাবিনি। এই বিয়েটা আমি করতে চাইনা। আপনি এমনিতেই মানুষটা ভালোই।”
তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলল,” ভালো হলে এতো বিরক্ত ওই চোখে থাকতো না। যাইহোক বাদ দেন। সবাই চলে গেল। চলুন এগোনো যাক।”
উর্মি নিজেও লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পরলো কথাটা বলে। কম খারাপ আচরণ তো করেনি। কিন্তু একটা কারণে খুব শান্তি লাগছে। বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে এইটাই ওর মনটা ফুরফুরে করে তুললো।
আরিফ এগিয়ে গিয়ে ও এর জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
” তাড়াতাড়ি আসুন। এদিকের জায়গা বিপজ্জনক একসাথে যাই।”
উর্মি মাথা নিচু করে আরিফের সাথেই হাঁটতে লাগলো।
_______________________
তৃষ্ণা হাঁটতে হাঁটতে বলল,” আপনি আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে পারবেন?”
জায়ান ভ্রু কুটি করে তাকালো তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণা শুকনো ঢোক গিলে বলল,” না মানে। উষসী ভাবিকে কোলে নিয়ে হাঁটতে অনেক কষ্ট করছিল আপনার ভাই তাই জানতে মন চাইল আপনি পারবেন কিনা।”
জায়ান হাতের সেল ফোন অফ করে পকেটে রেখে বললেন,” দেখতে চাও নাকি শুনতে চাও?”
তৃষ্ণা বোকা চোখে তাকিয়ে বলল,” দেখব কি করে?”
” এদিকে আসো দেখাই।”
তৃষ্ণা কে কাছে ডেকে বলল জায়ান। তৃষ্ণা কাঁচুমাচু মুখ করে এগিয়ে এলো জায়ানের দিকে। জায়ান নিচু হয়ে ফট করেই তৃষ্ণা কে পাঁজকোলে তুলে নিলো। তৃষ্ণা ভয় পেয়ে জায়ানের গলা জড়িয়ে ধরেছে। দেখাবে বলে যে কোলে তুলে নিবে তৃষ্ণা ভাবতেই পারেনি। চোখ বড়ো বড়ো করে জায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। জায়ানের মুখে দুষ্টু হাসি।
তৃষ্ণা লজ্জা মাখা গলায় বলল,” আপনি আমাকে কোলে তুললেন কেন? কষ্ট হবে আপনার নামান।”
” তোমার হাজব্যান্ড এর জিম করা বডি এতো অল্প ওজনের বউ কোলে নিয়ে এই পথ পাড়ি দিতে না পারলে এত শক্তি বানিয়ে লাভ কি?”
” আপনার থেকেও ত আপনার ভাই মোটা তিনি উষসী ভাবিকে কোলে নিয়ে হাপাচ্ছিল।”
” সেই চিন্তা তোমার করা লাগবে না। আসো আমরা একটা রোমান্টিক সময় পার করি।”
বলতে বলতে জায়ান তৃষ্ণার গালে চুমু খেলো। তৃষ্ণা লজ্জা চোখ বন্ধ করে নিলো।
___________________________
জোভান ফোন দিয়েছে মিহির কে।
” কোথায় তুমি?”
” পেছনে তাকাও।”
পেছনে তাকিয়ে দেখল মিহির দাঁড়িয়ে আছে। জোভান ফোন কেটে মিহির এর কাছে এসে বলল,” কি খবর তোমার?”
” ভালোই। উর্মি কোথায়?”
” আছে ওর হবু বর এর সাথে কোথাও।”
মিহির বলল,” তাহলে আমাকে এখানে এনেছ কেন? তাদের প্রেম কাহিনী দেখাতে?”
“তুমি কি ভালোবাসো আমার বোনকে?”
মিহির থেকে বলল,” হ্যা বাসি।”
” তাহলে ওকে কি এমন করেছো যে ও তোমার সাথে কথা বলতে চায় না। এতোটা অবহেলা কেন করেছো?”
” সব তোমার ভাইয়ের জন্য সে আমাকে হুমকি দিয়েছিল। উর্মির সাথে কথা বললে আমার পড়ালেখা ও এই শহরে থাকতে দিবে না।”
” হ্যা সব জানি আমি। এজন্যই আমি আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমার সাথে যোগাযোগ করেছি। আমার বোনের জন্য। উর্মি আমার বোন আমার রক্ত তাই ওর কষ্ট আমি বুঝি। ও তোমাকে ছাড়া আর কারো কাছেই ভালো থাকবে না। আমার বোনের সুখের জন্য আমি জায়ানের বিরুদ্ধে গিয়েছি।”
মিহির কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে আছে।
” উর্মি আর আমি তো জায়ান ভাইয়ার আপন ভাই বোন নয়। এজন্য আমাদের প্রতি তার ভালোবাসা নাই। নিজে নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে সুখে আছে কিন্তু আমাদের সুখ কেড়ে নিতে চায়। আমি তা হতে দেব না। আমার বোনের সুখ আমি দেখব। তোমাদের বিয়ে আমি দেব।”
মিহির বিস্মিত কন্ঠে বলল,” আপন ভাই বোন না মানে কি বলছো তুমি জোভান?”
জোভান মিহির কে টেনে আড়ালে নিলো।
” তুমি এখন চলে যাও। সময় মতো উর্মির সাথে দেখা করিয়ে দেব।”
মিহির হাজারো কৌতুহল নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছে। কিন্তু জোভান আর কোন উত্তর না দিয়ে চলে গেল।
#চলবে……..