#কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ
#পর্ব :০৬
#JannatTaslima (writer)
গুমোট আঁধারে আচ্ছন্ন গগন, কৃত্রিম আলোয় আচ্ছাদিত ধরণীতল। ব্যস্ত শহরের যানবাহন গুলোর কর্কশ ধ্বনি কানে ঢেউ তুলছে।উষ্ণ বায়ু বারংবার মুখে স্পর্শ একে দিচ্ছে।আকাশে আজ চাঁদ নেই, হয়তো আজ কৃষ্ণপক্ষ।ইতিমধ্যে এক শুক্লপক্ষের অবসান ঘটেছে। ভরা পূর্ণিমাটা দেখা হয়ে ওঠে নি আমার। কারণ ইদানিং খুব ব্যস্ত দিনাতিপাত করছি। সেদিন আন্কেল ঠের বুঝতে পেরেছিলেন, আধারিকা পিছু ফেরার মেয়ে নয়।তাই নিজের একটা ঠিকানা না করা অব্দি এখানে তাকতে দিয়েছেন আমায়।মাসখানেক হলো তাদের তিন সদস্য বিশিষ্ট ছোট্ট পরিবারে আগাছা হয়ে আছি। ব্যস্ত শহরের যান্ত্রিক জীবন গ্রামীণ আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা আমিটাকে বিষিয়ে তুলেছে।
অজানা কারণে চারতলার উপর বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত শহর দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল আজ।
তাই বোকার মতো কৃষ্ণপক্ষের আঁধারে ঢাকা গগন পানে চন্দকে খুঁজছি। আচমকা কোমড় অব্দি গড়িয়ে থাকা চুলের চুঁটিতে ঠান পড়লো। সঙ্গে নিজের সম্পর্কে কিছু আকস্মিক বাণী কর্ণগোচর হলো,
–কীরে পেত্নী ঔ রহস্য মানবীকে পেয়ে আমাকে তো প্রায় ভুলে গেছিস।আগের মতো গল্প করতেও আসিস না।বাবা বললো ঔ নিরব প্রাণী নাকি তোকে বদলে দিয়েছে । অবশ্য যার নিজের বদলানো প্রয়োজন সে আর অন্যকে কী বদলাবে।
(আমি বেশ বুঝতে পারছি কথা গুলো কার।পেছন ফেরে তাকাতে ওনি এমন একটা ভাব করলেন, যেনো চোর পুলিশের নিকট ধরা পড়েছে।)
–ওহ আপনি, আমি ভেবেছিলাম চাদঁনি। তা এখানে দাঁড়িয়ে কী করছেন চুপিচুপি নিজের প্রশংসা শুনছিলেন বুঝি?
–এগুলো আমার প্রশংসা না বদনাম।
–আপনার প্রশংসায় এর থেকে বেশি আর কী-ই বলা যেতে পারে।
–নিজে কারো থেকে প্রশংসা না পেলে অন্যের প্রশংসাই বা করবেন কী করে। কিছু দিতে হলেতো কিছু পেতে হয়, তাই না।
–কী বললেন আমি কারো প্রশংসা পাই না। আপনি জানেন আমার অফিসের বস আমায় কতটা পচ্ছন্দ করেন। ওনিতো সকলের নিকট আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
–বাচ্চাদের দিয়ে কাজ করাতে হলে তাতো একটু করবেন-ই।
–কী বললেন আমি বাচ্চা!তাহলে আপনিতো একটা বুড়ি। দেখতে চাঁদনির বয়সী হলেও কথা বার্তায় মনে হয় আপনার বয়স ষাটোর্ধ।
–আঁধার আটটা তো প্রায় হয়ে এলো নিশুকে আজ পড়াতে যাবে না।(চাঁদনির আহবানে লোকটা আজ আমার হাত থেকে বেচে গেলো)
–আজ শুধু আমার তাড়া আছে বলে আপনাকে কিছু বললাম না।(বলেই রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে চলে আসছিলাম, তখন তার টিটকারিপূর্ণ একটা বাক্য আমার কানে এলো)
–যান যান আপনি বড়জোড় চোখ দেখানো ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারেন। (বলেই উচ্চস্বরে হেঁসে ওঠলেন)
চন্দ্র নামের এই থার্ড পার্সন সিংগুলার নাম্বারকে আমার অসহ্য লাগে। লোকটার সাথে যখনই কথা বলি অদ্ভুতভাবে এরকম তিক্ত কথোপকথনের সৃষ্টি হয়।চাঁদনিদের সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে গেলে বলা যায়, গ্রামে তাদের অবহেলিত বেশ বড় ভিটে থাকলেও ঢাকায় ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকেন।আন্কেল প্রাইভেট ভার্সিটির প্রফেসর। চন্দ্র একজন আর্কিটেক্ট।বছর খানেক হলো চাকরিতে জয়েন করছেন পাশাপাশি নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট কিনার প্রচেষ্টায় আছেন।তাদের পরিবার মোটামুটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির।আন্কেলের ভার্সিটিতেই আমি আর চাঁদনি ভর্তি হয়েছি।পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার তখন আর কোনো সুযোগ ছিলো না।চাদঁনি এমনিই প্রাইভেট ভার্সিটি তে ভর্তি হতে চাইছিল। আমার তো আর পুরা কপাল।প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়া অনেক ব্যায়বহুল তবুও আন্কেলের আশ্বাসে ভর্তি হয়েছি।অ্যাডমিশন ফি আন্কেলই দিয়েছেন। আমি আমার জমানো অর্থ খরচ করতে চাইছিলাম কিন্তু আন্কেলের কারণে তা আর হয়ে উঠে নি। যদিও তাতে কিছুই হতো না। প্রসঙ্গক্রমে জানতে পারলাম আমার বাবা নাকি আন্কেলের সহপাঠী ছিলেন।ছাত্রজীবনে অনেক বড় বড় বিপদে তাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছেন।বাবা কখনো তার বিনিময় নেন নি।তাই তিনি সুযোগ সুবিধা মতো বাবাকে সহায়তা করতে চেয়েছিলেন। অথচ তা আর সম্ভব না হলেও
আমার মাধ্যমে আল্লাহ নাকি তাকে সেই সুযোগ দিয়েছেন।আমি অনার্সে লো ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হলাম আর চাদঁনি ইংলিশে।তবুও আন্কেলের প্রতি আমি অশেষ কৃতজ্ঞ।বইপত্র তেমন জোগাড় হয়নি,অল্প কিছু আছে সেগুলোও পুরনো।আপাততো দুইটা টিউশনি করাই,পাশাপাশি চাকরিরও অনুসন্ধান করছি।যদিও এই বাজারে মামা খালু ছাড়া কিছুই হয় না।
————-
একরাশ আতংক নিয়ে ফোনে ডায়ালকৃত নাম্বারের দিকে চেয়ে আছি। তৃতীয় রিং হওয়ার পর কারো হ্যালো ধ্বনি শুনতে পেলাম। যা মুহূর্তে বুকের ভিতর বিস্ফোরণ ঘটালো।দুনিয়ার সব থেকে মধুর ডাকটা উচ্চারণ করতে গিয়ে চোখের দুর্বোধ্য রহস্য গুলো আর বাঁধ মানলো না।ওপর প্রান্তের ব্যক্তিটির জন্য যেন এই একটা শব্দই যুতসই ছিলো। তিনি অবাকস্বরে বলে উঠলেন,
–তুই,,,,,,,,,
–আমি আঁধার মা।কেমন আছো তোমরা সবাই?
–আধারিকা (মা এবার ফিসফিস করে কথা বলছে)
–হ্যা আমি তোমার আধারিকা। কেমন আছো তুমি?
–ভালো,তুই এতোদিন কেমন ছিলি মা?কোথায় আছিস এখন?
–আলহামদুলিল্লাহ, আমি তোমার দোয়ায় এতোদিন ধরে ভালোই আছি?যেখানেই আছি খুব ভালো আছি ।আদনান আরিয়ান কেমন আছে মা?
এভাবে খানিক্ষন মায়ের সাথে ফোনালাপ হলো।দুজনেই বেশ অশ্রু গড়িয়েছি।ফোনালাপে জানা গেলো, আমার সম্পর্কে সবকিছু গ্রামের সবাই প্রায় জেনে গেছে। বিষয়টা নিয়ে এখনো গ্রামে কানা গুষা চলে। দিন পনেরো চাচারা আমায় হন্নি হয়ে খুঁজেছে।এখন অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিকের পর্যায়ে।আসলে পাঁচ সাতদিন ধরে বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছিল। বিশেষ করে মায়ের কথা। মাকে ছাড়া কখনো মামাবাড়ি গিয়েও থাকি নি।চাদঁনি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে, এক প্রকার জোর করে ফোন করতে বাধ্য করলো।
°°°°°°°°°°°°°°°
দিনের শুরু থেকেই আজ আমার মনটা বেশ প্রফুল্লিত।প্রথম আয় হাতে পেলাম বলে কথা।আমার ছাত্রী নিশুর মায়ের সাথে সময়ের ধারাবাহিকতায় আমার একটা মিষ্টি সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তারা এই ভবনের নয় তলার ফ্ল্যাটে থাকেন।মেয়েটা বেশ পাজি দিনে পড়তে বসে না, তাই রাতে গিয়ে পড়াতে হয়।আপু আমার চাকরির প্রয়োজন জেনে তার বোন জামাইয়ের নিজস্ব কিন্ডারগার্টেনে আমার শিক্ষকতার একটা ব্যাবস্থা করে দিলেন। আজ তার সাথে গিয়ে সব চূড়ান্ত করে এসেছি।চাঁদনি-আন্কেল শুনে খুব খুশি হয়েছেন।অপরাহ্নের শেষের দিকে চাঁদনির সাথে গিয়ে প্রয়োজন মাফিক কিছু কেনাকাটা করে ছিলাম।যদিও এতে আমার তেমন কিছুই হবে না।তবুও আমার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। আর কতোদিনই বা চাদঁনির পরিধানের জামা পড়ে কাটাবো। এখানে সকলে আমায় চন্দ্র -চাঁদনির আরেক কাজিন সানজুর চাচাতো বোন হিসেবে চেনে।যদিও এটা মিথ্যা না, গ্রাম সম্পর্কিত সানজুর চাচাতো বোন হই আমি।
,,,,,,,,,,
আজ শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। মধ্যাহ্ন ভোজের প্রস্তুতি চলছে। আমি আর চাঁদনি খাবার পরিবেশনে করছি।কাল রাতটা চাঁদনির সাথে গল্প করে কাটিয়েছি। আমি, সানজু আর চাঁদনি তিনজনই পিঠাপিঠি। চাঁদনির সাথে ভাব যেহেতু আগে থেকেই, তাই মাঝে মধ্যে রাতে ভাবের মেলা বেশ ভালোই জমে।কলিং বেল কুকিল কন্ঠে আহবান করছে।চাঁদনি সেই আহবানে সারা দিতে চলে গেলেও,আমরা বাকিরা সেদিকেই উৎসাহী।ড্রইং রুম থেকে একটা পুরুষালি গলার পাশাপাশি নারীর গলাও ভেসে আসছে।আমি আতংকিত হয়ে চন্দ্রের দিকে দৃষ্টি রাখছি।এটা বুঝি দেশের এই সচেতন নাগরিকের নৈতিক দ্বায়িত্ব পালনের সময়।না আমার ভাবনা গুলো নিতান্ত মিথ্যা প্রতিপন্ন হলো।সামনে দুটি অপরিচিত মুখমন্ডল।এদের চেহারা আমাদের বাড়ির কারো হওয়ার তো দূরের কথা, আমাদের বাড়ির কারোর চেহারার ত্রিসীমানায়ও নেই।এসব ভাবতে ভাবতে আমি তরকারির পাত্র নিয়ে কখন যে চন্দ্রের মাথার ওপর দাড়িয়ে পরেছি ঠেরও পেলাম না। যে কেউ দেখলে ভাববে আমি ওনাকে খুব যত্নের সাথে খাবার পরিবেশন করছি।আমি ওনাকে খাবারতো কী বিষও পরিবেশন করতে নারাজ।আগত মেহমানরা ডাইনিংয়ে দাঁড়িয়ে আন্কেলের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছে। আমার দিকে তাকিয়ে দুঃখিত আমাদের দিকে তাকিয়ে নারী কন্ঠস্বরটা বলে ওঠলো,
–ওমা চন্দ্র তুই বিয়ে করলি কবে বললি নাতো!!!
ঘটনার আকস্মিকতায় আগতরা ব্যাতীত রুমশুদ্ব
সকলেই অবাক।চন্দ্র এবার তার নিম্নদৃষ্টি উপরে নিক্ষেপ করলো।তাতে আমার হুস ফিরলো ঠিকই, কিন্তু চন্দ্রের ধবধবে সাদা টি-শার্টে দুই টেবিল চামুচ
দুই ঘন্টা ঝাল কৃত তরকারির জুল ফেলে।পরিস্থিতি সামাল দিতে চাদঁনিই সহায় হলো।আপুটা বাস্তবতা শুনে বেশ লজ্জিত হয়েছে। পরবর্তীতে পরিচয় পেলাম ওনারা চাদঁনির ফুপাতো বোন আর বোন জামাই।কাছাকাছি বাসা হওয়ায় সাপ্তাহিক ছুটির হেতুতে বেড়াতে এসেছেন।ঔ ঘটনার পর কদিন অস্বস্তিবোধের কারণে চন্দ্রের সামনে যাই নি।
~~~~~~~~
কিন্ডারগার্টেনে নিযুক্ত হওয়ার পর ব্যস্ততা আরো বেড়ে গলো।মর্নিং স্কুল হওয়ায় সকালে ক্লাস করাতে যেতে হয়।ছুটির পর ভার্সিটিতে যাই, মাঝে মাঝে ক্লাস মিস হয়ে যায়।বাসায় এসে দুপুরে খাওয়া সামান্য স্বস্তি তারপর আবার আসরের নামায পড়ে একটা টিউশনি। আর রাতে আটটার দিকে আবার নিশুকে পড়াই।এসবের ফাকে নিজেও পড়তে হয়।হঠাৎ হঠাৎ মায়ের সাথেও অল্প কথা বলি।সব মিলিয়ে ভালোই আছি। তবুও মনের মধ্যে সংশয়ের শেষ নেই। কারণ,
ব্লাকবোর্ডের মতো যদি জীবন হয়,
খড়িমাটির শুভ্র চিহ্ন পড়ার আশা থাকে।
হোয়াইট-বোর্ডের মতো যদি জীবন হয়,
কলমের কালো কালি পড়ার ভয় থাকে।
(by Jannat Taslima)
#চলবে,,,, ,,,,