কৃষ্ণচূড়ার এক সন্ধ্যা পর্ব ১১

0
471

#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [১১]
লাবিবা ওয়াহিদ

————————
রায়িন ট্রেডমিলের পাওয়ার বাড়িয়ে সমান তালে দৌড়াচ্ছে রায়িন। বর্তমানে রায়িন তার বন্ধুদের সাথে এক জিমে অবস্থান করছে। অনেকক্ষণ দৌড়ানোর ফলে রায়িনের কপালে ঘাম ছুটেছে৷ ট্রেডমিলের পাশে কাঁধে তাওয়াল ঝুলিয়ে ঠান্ডার পানির ফ্ল্যাক্সে কয়েকটা চুমুক দেয় রাব্বি। অতঃপর ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে বললো,
–“সিরিয়াসলি? কোনো মেয়ে তোকে অসুন্দর বলেছে? তাও তোর ছাত্রী? এটা কী বিশ্বাসযোগ্য রায়িন?”
–“একদম ঠিক বলেছিস রাব্বি। রায়িন আনরোমান্টিক হতে পারে তবে অসুন্দর নয়। কী রে? কখন থেকে দৌড়াচ্ছিস! রাগ লাগছে না?”

রায়িন ট্রেডমিলে সুইচ চেপে সেটা বন্ধ করে দিলো। গলায় ঝুলানোর তাওয়াল দ্বারা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে পা নামিয়ে ট্রেডমিলেই বসে পরলো। কিছুক্ষণ হাঁপালো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–“বিষয়টাতে আমিও চরম বিষ্মিত সানজিদ। ও কোন আক্কেলে আনরোমান্টিক বললো? আমি টিচার হই ওর!”
–“নিশ্চয়ই বকাঝকা বেশি করিস!”
–“তোর মুন্ডু!”
–“রায়িন, সত্যি করে কথা বলি ভাই? আমার মনে হয় মেয়েটা তোরে পছন্দ করে!”
–“কোনো ওয়ে-ই দেখি না আমি। যেখানে অন্য মেয়ের সামনে আমায় এসব বলে সেখানে আমি তো মেয়েটার পুরোই অপছন্দের!”

রাব্বি ধপ করে পিছের ফোমেএ মোড়াতে বসলো। গালে হাত দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বললো,
–“ব্যাপার তো কিছু আছে বন্ধু, ব্যাপার তো কিছু আছে! কথায় আছে একজন মানুষ যেরকম হয় তার লাইফ পার্টনার ঠিক তার বিপরীত হয়। কোনো একটা ব্যাপার তো আছেই।”
–“এছাড়া তুই তো আঙ্কেলের অফিসে জয়েন করেছিস। তাও তুই টিউশনি করাচ্ছিস কেন?”
সানজিদের হঠাৎ প্রশ্ন। রায়িন তপ্তশ্বাস ফেলে বলে,
–“আদন এবং নিথি, দু’জনেরই সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। ওদের মা আমায় খুব বেশি করে অনুরোধ করে ফেলেছে পড়ানোর জন্যে। বড়ো মানুষের অনুরোধ কী করে ফেলতে পারি? তাই চাইলেও ছাড়তে পারছি না!”
–“ওহ আই সি!”
–“তোরা থাক, আমি বাড়ি যাবো। পাপা দেখা করতে বলেছে!”

বলেই জিমের এক কর্ণার থেকে নিজের ব্যাগটা তুলে চেঞ্জিংরুমে চলে গেলো। তিন বন্ধু সেখানেই বসা। এর মাঝে সানজিদ আবার বলে ওঠে,
–“তোদের কিছু ফিল হচ্ছে?”
–“কিছুটা!”
–“আমার তো অনেক কিছু ফিল হচ্ছে!”
–“মানে, কী?”
–“শীঘ্রই ভাবী পেতে চলেছি!”

দুজনেই বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। রাব্বি ওদের দিকে কোণা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
–“দেখলি না, একটা মেয়ে ওরে অসুন্দর বলেছে বলে কেমন ফাটছে? জীবনে দেখছিস অসময়ে ওরে জিমে আসতে? মেয়েটার খোঁজ লাগাতে হবে৷ বন্ধু আমার তো কিছুই বলবে না, যা করার আমাদেরই করতে হবে!”

————————–
–“এভাবে কেঁদো না বুবু। আমার কষ্ট হচ্ছে তো!”
–“আমি পারছি না রে আদন। কেন মোহনা এমন করলো? স্যার নির্ঘাত আমাকে অনেক খা’রা’প ভাবছে। ঘৃণা করছে!”

আদন নিথির পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরলো। মিনমিন করে বললো,
–“ওরকম কিছু না বুবু। আমি তোমাকে আগেই সাবধান করেছিলাম এই মৌচাকের বিষয়ে। তুমি জানো না এই মেয়ে তোমার অগোচরে তোমার কত ব/দনাম করে বেড়ায়। তোমার জয় ভাইয়ার কথা মনে আছে? উনি তোমাকে পছন্দ করতো। এই কথাটা মোহনা আপু জানতেই তোমার নামে অনেক খারাপ কথা বলেছে। পরে দিয়ে মোহনা আপুর সাথে সম্পর্কে জড়ায় জয় ভাইয়া!”

নিথি থমকে তাকায় আদনের দিকে। জয় তার বন্ধু ছিলো। এর মানে মোহনাই জয়ের মন বিষিয়ে দিয়েছে? এরকম আরও কিছু ঘটনা আদন ব্যাখ্যা দেয় যেগুলা শুনে নিথির কান্না ক্রোধে রূপান্তরিত হয়। আপাতত নিজে ক্রোধ সংবরণ করে আদনের উদ্দেশ্যে বলে,
–“আমার জন্যে খাবার নিয়ে আয়, খুদা পেয়েছে!”

আদন দেরী না করে কিচেনের দিকে ছুটলো। আদনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে নিথি আপনমনে বিড়বিড়ায়,
–“আপনি কী আমায় ভুল বুঝলেন স্যার?”

আদন কিচেনের দিকে ছুটার সময়ই লক্ষ্য করলো শারমিন আক্তার ফিরেছেন। ছেলেকে ব্যস্ত দেখে শারমিন আক্তার প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
–“কী হলো, এভাবে ছুটছিস কেন?”

মায়ের কন্ঠস্বর শুনে নিথি তৎক্ষনাৎ ছুটলো ওয়াশরুমের দিকে। চোখ-মুখ ভালো ভাবে ধুঁয়ে মুছে নিলো। তাও নাক এবং চোখগুলো হালকা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। নিথি ঢোঁক গিলে। তার মা যে দেখলেই বুঝে যাবে। চোরের মতো ওয়াশরুম থেকে বের হয় নিথি। আদন খাবার দিয়ে গেছে। এর মানে কী শারমিন আক্তার রুমে এখনো আসেননি? নিথি হাফ ছাড়লো। দ্রুত খেয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো লাইট অফ করে। শারমিন আক্তার মেয়েকে চেক দিতে এসে দেখে মেয়ে শুয়ে পরেছে। এত তাড়াতাড়ি? শারমিন আক্তার চিন্তিত হলেন। মেয়েটা কী অসুস্থ? নিথির কাছে এসে কপালে হাত ছুঁলেন। নাহ, সব স্বাভাবিক। হয়তো সকালে জলদি উঠবে তাই ঘুমিয়েছে! শারমিন আক্তার মেয়েকে ডাকতে চেয়েও ডাকলেন না। মেয়ের কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে চলে গেলেন। শারমিন আক্তার চলে যেতেই নিথি চোখ মেলে তাকালো। সাথে সাথে কোণ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরলো। অদ্ভুত চিনচিন ব্যথা করছে বুকের বা পাশে।

সকালে প্রতিদিনকার মতো শারমিন আক্তার নাস্তা বানিয়ে গার্মেন্টসে ছুটলেন। নিথিও সময় মতো ঘুম থেকে উঠলো। আবারও মাথায় তীব্র ব্যথা অনুভূত হলো তার। নিজের মাথাতেই নিজের চাপড় মারতে ইচ্ছে হলো। কেন ঢং করতে কেঁদে বুক ভাসালো? এখন বুঝতে পারছে তো তীব্র ব্যথার নমুনা? বিরক্তির সাথে নিথি প্রথমে কিচেনে গেলো চা করতে। হৃধি একদমই চায় না সেদিনের মতো কোনো ঘটনার সম্মুখীন হতে। এছাড়া রোজ রোজ তো রায়িন তাকে বাঁচাতে আসবে না। যদি রায়িন বাঁচাতে আসতো তাহলে নিথি হাজারবার ওরকম ঘটনা চায়।

চা চুলোয় বসিয়ে আদনকে ডাকতে চলে গেলো। আদনকে উঠিয়ে ওয়াশরুম পাঠিয়ে নিথি নিজের রুমে এসে ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নিলো। তারপর আবার ছুটলো কিচেনে। এক কাপ চা করে তৃপ্তি নিয়ে চুমুক দিতে দিতে ডাইনিং এ আসলো। সুন্দর করে আদনের জন্যে খাবার বেড়ে নিজেও বসে পরলো। আদন তৈরি হতে হতে খেতে আসলো৷ দুই ভাইবোন মিলে নাস্তা করে একসাথে বাসা থেকে বের হলো। চাবি ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
–“চল, আজ তোকে আমি স্কুলে দিয়ে আসবো!”
–“তোমার ক্লাস নেই আপু?”
–“এক ক্লাস গ্যাপ দিবো। চিন্তা করিস না, আয় আমার সাথে!”

নিচে নেমেই আদনকে নিয়ে রিকশাতে উঠলো নিথি। আদনের স্কুল খুব দূরে নয়। তবে স্কুলটা ভার্সিটির বিপরীতে। তাই ভার্সিটি যেতে লেটও হতে পারে। তবে এ বিষয়ে নিথিকে ভাবান্তর দেখালো না। ভাব এমন, তার আজ ক্লাস করার কোনো ইচ্ছেই নেই! হয়তো করবে না ক্লাস, বাঙ্ক মারবে।

আদনকে স্কুলে দিয়েই স্কুলের বাইরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে নিথি। এক পা শব্দ করে নাড়াতে নাড়াতে কী যেন ভেবে নয়নাকে কল দিলো। দু’তিনবার রিং হতেই নয়না রিসিভ করলো,
–“হ্যাঁ বল! কই তুই?”
–“আদনের স্কুলের সামনে। দ্রুত চলে আয়। আজ দুই বান্ধুবী মিলে সারা শহর ঘুরে বেড়াবো। বাজারেও যাবো। ওইদিন এক জোড়া দুল পছন্দ করেছিলাম। সেটা আজই কিনে নিবো!”

অপরপাশ থেকে কল খট করে কেটে গেলো। নিথি ফোন কান থেকে সরিয়ে স্ক্রিনে তাকালো। কিছুক্ষণ বাদেই নয়নার নাম্বার থেকে একটা বার্তা আসলো।
–“সরি দোস্ত। আমি এখন ক্লাসে আছি। স্যার মাত্রই এসেছে। আগে বললে আমি ঠিকই চলে আসতাম!”

নিথির রাগ হলো। অসম্ভব রকম রাগ। রাগে হাত-পা থরথর করে কাঁপছে তার। নিথি বেশ শক্ত হাতে এক কঠিন গা*লি লিখলো। অতঃপর নয়নাকে বলে,
–“আমি একাই ঘুরতে পারি। লাগবে না তোর আসা!”

নয়নাকে মেসেজ করতে করতে নিথি যে কখন রাস্তার কাছাকাছি চলে এসেছে তার হুঁশ নেই। হঠাৎ হর্নে তার সম্বিৎ ফেরে। ঘাড় বাঁকিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। হ্যাঁ, বাইকটা তার দিকেই আসছে। নিথি আতঙ্কে হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। ভয়ে শক্ত হয়ে সেখানেই একই ভাবে দাঁড়িয়ে রয়। হাঁটু জোড়া কাঁপছে ভিষণ! এই বুঝি এখনই তার মৃত্যু ঘটবে। এবার নিথি চোখ – মুখে খিঁচে দাঁড়িয়ে রয়। ভয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হয়। নিথির কোনো কষ্ট লাগছে না কেন? ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে এলো তার। আজব তো! হঠাৎ বাজখাঁই কন্ঠস্বর শুনে নিথি চোখ মেলে তাকায়।
–“এই মেয়ে, যখন তখন রাস্তায় এসে দাঁড়াও কেন? মরার কী খুব সখ জেগেছে? কমনসেন্স নেই যে রাস্তায় কোনো গাড়ি আসলে সরে নিরাপদ স্থানে দাঁড়াতে হয়? এতই যখন মরার সখ তাহলে দশ তলা বিল্ডিং এর উপর চলো, ধাক্কা দিয়ে ফেলে তোমার সখ পূরণ করে দিবো!”

নিথি গোল গোল চোখে রায়িনকে পর্যবেক্ষণ করছে। ছেলেটা বাইকও চালাতে জানে? এ তো দেখছি গুণের বাহার। এছাড়া কালো প্যান্ট এবং জ্যাকেটে খুবই মারাত্মক লাগছে রায়িনকে। রায়িন চুটকি বাজালো নিথির সামনে। নিথির সম্বিৎ ফিরে এবং চমকে তাকায় রায়িনের দিকে। অপরাধীর মতো আমতা আমতা করে বলে,
–“স..সরি! আসলে, আমি খেয়াল করিনি!”
–“তা তো তুমি কোনো জনমেই রাখো না। সাইডে দাঁড়াও। আমি যাচ্ছি!”

বলেই হাতে থাকা হেলমেটটা মাথায় পরতে নিতেই নিথি বাঁধ সাঁধলো। রায়িন গম্ভীর মুখমন্ডল আরও গম্ভীর করে ভ্রু কুচকালো। নিথি আমতা আমতা করে বললো,
–“আ..আসলে, আমি ভার্সিটি যাবো। কিন্তু কোনো রিকশা বা সিএনজি পাচ্ছি না। আপনি প্লিজ আমায় ভার্সিটি লেফট দিবেন। আপনি এইটুকু হেল্প করলে আমার বড্ড উপকার হতো স্যার!”

রায়িন চুপসে নিথিকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো। এই সহজ-সরল মনের মেয়েটা কি না তারই আড়ালে তাকে অসুন্দর, নিরামিষ বলে বেড়ায়? রায়িন নিজের ক্রোধ প্রকাশ করলো না। নিরবে বাইকে উঠে পিছনে ইশারা করে গম্ভীর স্বরে বলে,
–“বসো!”

নিথির আনন্দ দেখে কে? অবশেষে তার প্ল্যান সাকসেসফুল হলো। আহা, অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করছে সে। বুকের ভেতর হতে এক বড়ো পাথর নামলো যেন। নিথি পারছে না খুশিতে খিলখিলিয়ে হাসতে। কিন্তু এখন হাসলে তার এই পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তাই যথাসম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে চুপ করে বাইকে উঠে বসলো। অবশ্য রায়িনের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে। যদি রায়িন কিছু মনে করে, সেই ভয়ে। এদিকে রায়িন ফুঁসছে। আপনমনে ভাবছে,
–“আমি দেখতে এতই অসুন্দর যে আমার থেকে ফাঁক হয়ে বসে মেয়েটা? দাঁড়াও, বুঝাবো তোমায় মজা!”

বাইক জোরে টান দিতেই নিথি মুখ থেতলে রায়িনের পিঠের উপর গিয়ে পরলো। এতে দু’জনের গায়েই যেন বিদ্যুতের শক দিলো। রায়িন সাথে সাথে নিজের বিবেকে ফিরে আসে। তার বাইকের গতি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এ কী করছিলো সে? মাথা কী তার গেছে? সে কেন এক কথায় তার বিবেক-বুদ্ধি ভুলে গেলো? কেন ভুলে যায় এই মেয়েটি আর কেউ না তারই ছাত্রী। নিজের উপর কঠিন রাগ হলো রায়িনের। আসলেই দিনদিন তার ব্যবহার সে ভুলে যাচ্ছে।

~চলবে, ইনশাল্লাহ।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। ভালোবাসা!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here