কৃষ্ণচূড়ার এক সন্ধ্যা পর্ব ১০

0
451

#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [১০]
লাবিবা ওয়াহিদ

———————————
ইদানীং নিথির বাড়িতে মোহনার আসা-যাওয়া বেড়েছে। যেখানে সে মাসে একবার করে আসতো সেখানে সে রোজ ঘটা করে আসছে। নিথি অবশ্যই বুঝে মোহনার পরিকল্পনা কারণ, মোহনা আসেই রায়িনের আসার পূর্বে। একসময় নিথি অতীষ্ঠ হয়ে রায়িনকে বললো,
–“স্যার, আপনাকে যদি একটা রিকুয়েষ্ট করি, রাখবেন?”
–“বলো!”
–“আপনি যদি সকালে আসেন, পড়াতে?”
–“কেন?” রায়িন ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো।
নিথি আমতা আমতা করে বললো,
–“সকালে পড়ালে আমি ভার্সিটির পড়া বুঝে ভার্সিটি যেতে পারতাম। তাহলে পড়াটা মনে থাকতো আর কী!”

রায়িন নিশ্চুপ থাকলো। গম্ভীর ভঙ্গিতে বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলে,
–“সকালে আমার অফিস থাকে। সম্ভব না!”

নিথি মুখটা বেজার করে রায়িনের দিকে তাকিয়ে আছে। আদন মুখ টিপে হাসছে। নিথি নিজের পা দিয়ে আদনের পায়ে দুম করে এক শট মা’রলো। আদনের হাসি মুহূর্তে-ই চলে গেছে। নিথির এখন বিরক্ত লাগছে, চরম বিরক্ত। ওই তো মোহনার ফাঁকা কলসির কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। আজও এসেছে মেয়েটা। নিথি দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে যাচ্ছে। হাতদুটো তার মুঠিবদ্ধ। এত কিসের জেলাসী তার? গা জ্বালা যেন তড়তড় করে বাড়ছে তার। মোহনাকে যদি কিছু বলতে পারতো! মন, তনু দু’টোই শান্তি পেতো। কিন্তু বর্তমানে শান্তির মা হারিয়ে গেছে। এজন্যই যে অশান্তির বাপ ঘাড়ে এসে চাপসে।
একসময় নিথির খেয়াল এলো মোহনা দুলতে দুলতে আদনের রুমের দিকেই আসছে। নিথি চট করে দাঁড়িয়ে গেলো। আদন, রায়িন উভয়েই চমকে উঠে। নিথি রায়িনের উদ্দেশ্যে আমতা আমতা করে আওড়ায়,
–“আ..আমি ওয়াশরুম যাবো!”

রায়িন নিজেকে তটস্থ করে বলে,
–“যাও!”

নিথি এক মুহূর্ত দেরী না করে ছুট দিলো।
–“তোমার আপুর কী হয়েছে আদন? এমন বিহেভ করছে কেন?”
আদন রায়িনের দিকে বোকার মতো চাহনি দিয়ে বলে,
–“আমিও জানি না স্যার। মনে হচ্ছে মোহনা আপুর সাথে তার লেগেছে!”
–“মোহনা কে?”
–“রোজ দেখেন না একটা মেয়েকে? সে তো আপনাকে দেখতে প্রতিদিন এই সময়ে আসে!”

রায়িনের পতিক্রিয়া বুঝা যায় না। সে পুণরায় নিথির বইটায় চোখ বুলাতে মনোযোগী হয়।

———————-
–“তোর সমস্যা কী? প্রতিদিন এক টাইমে এখানে কী? আর কোনো সময় নাই?”
–“আমি এই সময়ে ফ্রী থাকি, তাই আসি। এছাড়া আমার চকলেট বয়কে না দেখলে আমার ঘুম আসে বল? আজ তো সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার সাথে দু’মিনিট কথা বলবো। দেখিস এক চুটকিতে তোর স্যার থেকে দুলাভাই এ পরিণত হবে!”

নিথির যেন সীমা লঙ্ঘন হলো। সে এক চিৎকার দিয়ে বলে,
–“এমন আজা’ইরা, ফা”লতু ছেলেকে কখনোই আমি আমার দুলাভাই বানাবো না। এর যা রাগ, রাগের ঝাড়িতে তুই উল্টো পথে পালাবি। কতবার বলবো?”
–“তোর এত ফাটছে কেন বল তো? আমার লাইফ, আমি বুঝবো!”
–“ঠিক আছে, তুই মর ওরে নিয়ে আর যা-ই কর। আমার পড়ায় ডিস্টার্ব দিস না!”
–“ওকে!”

বলেই মোহনা উল্টো পথে হেঁটে বৈঠকঘরে চলে গেলো। নিথি চমকে গেলো মোহনার সহজ স্বীকারোক্তিতে। কী হলো বিষয়টা? এত সহজে রাজি হলো কীভাবে?

রুমের ভেতর থেকে রায়িন ঠিকই সবটা শুনেছে। রায়িন বেশ বেকুব হয়েছে নিথির এরূপ কথাবার্তায়। মিনমিন করে বলে ওঠে,
–“মেয়েটা কী আমাকে এসব বললো? আসলেই আমি ফা/লতু? সব মাথার উপর দিয়ে গেলো, দেখছি!”

নিথি মনমরা হয়ে আদনের রুমে ঢুকলো। নিজের আসনে বসতেই রায়িন গলা ঝেড়ে বলে ওঠে,
–“এই বুঝি তোমার ওয়াশরুম যাওয়া? ওয়াশরুম গিয়েছিলে নাকি ঝগড়া করতে? মিথ্যা বলবে জানলে কখনোই পারমিশন দিতাম না। যেটুকু সময় তুমি ওয়েস্ট করলে সেটুকু সময়ে কিছু পড়লেও তো কাজে দিতো!? ডাফার!”

রায়িনের হঠাৎ বকুনিতে নিথি চুপসে গেলো। এখন তার ভেতরটা আরও গুড়িয়ে গেলো। ঝাপসা, টলমল চোখ নিয়ে বাকিটা সময় রায়িনের কাছে পড়লো। রায়িন চলে যেতেই আদনও উঠে গেলো। ঠায় বসে রইলো শুধু নিথি। মিনিটখানেক পর আদন ছুটে এসে নিথির উদ্দেশ্যে বলে যায়,
–“আপু, দেখে যা! কী হচ্ছে!”

নিথি চমকে আদনের দিকে তাকালো। আদনের চোখে-মুখে বিষ্ময়ের ছাপ। নিথি ভ্রু কুচকে বললো,
–“কেন? কী হয়েছে?”
–“বিশ্লেষণ করতে পারবো না, তুমি নিজের চোখে এসে দেখে যাও!”

নিথি দেরী করলো না। তার ভেতরটা কেন যেন কুঁ ডাকছে। আদন কেন এভাবে বলছে? কী হয়েছে? নিথি দ্রুত পা চালিয়ে আদনের পিছু নিতে নিতে লিভিংরুমে আসলো। সেখানে যেতেই নিথির পা জোড়া থমকে গেলো। রায়িন এবং মোহনা কথা বলছে। মোহনা নিথির উপস্থিতি টের পেতেই মোহনা গলা খাঁকারি দিয়ে রায়িনকে বললো,
–“জানেন, নিথি মানে আমার কাজিন! সারাদিন আপনার নামে বদনাম করে। আপনি নাকি বদরাগী, গম্ভীর, আনরোমান্টিক মানুষ। দেখতেও একদম ভালো না। আপনার প্রেমে কেউ পরবে না। কিন্তু এই মেয়ে এখনো বুঝলো না প্রেমের আসল অর্থ। আমি তো ওর কথার সাথে আপনার ব্যক্তিত্ব কিছুতেই মিলাতে পারি না! ইভেন আপনাকে অ’ভদ্রও বলেছে!”

রায়িনের অধরে লেপ্টে থাকা হাসি মুহূর্তে-ই উধাও হয়ে যায়। রায়িন গম্ভীর চাহনিতে নিথির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কী ভয়ংকর সেই চাহনি। নিথির মনে হলো কোনো আ’জ’রা’ইল তার সম্মুখে দাঁড়ানো, এবং সেই আ’জ’রা’ইল তার ভয়ংকর চাহনি দ্বারা তার জান কবজ করছে। নিথি আতংকে, লজ্জায়, জড়তায় উল্টো পথে দৌড় দিতে নিতেই দেয়ালের সাথে কপালে এবং নাকে দুম করে বারি খেলো। রুমের বাতাসে ভেসে ওঠে নিথির চাপা আর্তনাদের ধ্বনি। রায়িনের সামনে আরও একটি অপ্রস্তুত ঘটনা। মোহনা জোরে হাসতে গিয়ে হাসতে পারলো না। হাসি চেপে রাখলো। একে তো রায়িন নিথিকে বলবে সেই খুশি, দ্বিতীয়ত এমন ব্যথা পেয়েছে। এবার নিথির ব্যথায়, যন্ত্রণায় চেপে রাখা কান্নাটুকু গড়গড় করে বেরিয়ে এলো। গাল বেয়ে নোনাজল গড়াতে লাগলো। আদন ছুটে আসে বোনের কাছে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
–“আপু তুমি ঠিক আছো?”

আদনের এরূপ প্রশ্নে নিথির চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো, “ভালো নেই! তোর আপু ভালো নেই!”

নিথি এখনো দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে৷ একবারও ফিরেও তাকালো না রায়িনের দিকে। ভিষণ লজ্জা এবং অপমান তাকে ঘিরে ধরেছে। কেন মোহনা তাকে এভাবে অপমান করলো তাও তার প্রিয় পুরুষটির সামনে? হ্যাঁ বলেছে সে এসব। কিন্তু মন থেকে তো বলেনি। তার হৃদয় তো জানে রায়িন তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ! নিথি আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। ছুটে বেরিয়ে গেলো। নিথি বেরিয়ে যেতেই রায়িন কিছুক্ষণ নিথির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। রায়িনের চোখে-মুখে অদ্ভুত বিষ্ময়। আপনমনে ভেবে উঠে,
–“আমি এতই অসুন্দর যে একবার ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না? মেয়েটা আমাকে নিয়ে এসব ভাবে সবসময়? কী অদ্ভুত মেয়ে মানুষের মতিগতি!”

রায়িন আর দাঁড়ায় না। মোহনার সম্মুখে দাঁড়ানোটা তার কাছে বিরক্তিকর লাগছে। সৌজন্যতা বজায় রাখতে মেয়েটির সাথে দু’মিনিট কথা বলেছে সে। কিন্তু মেয়েটা খুবই বিরক্তিকর।
–“আমি আসছি!”
–“এত দ্রুত। আচ্ছা, আপনার নাম্বা..”

রায়িন তাকে বলার সুযোগ দেয় না। দ্রুত প্রস্থান করে। আদন চোখ গরম করে মোহনার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“ঠিক আগের মতো এবারও আরেকজনের মন আমার আপুর জন্যে বিষিয়ে দিলে। তুমি খুব খারা’প! আসলেই তোমার মাঝে মোহ নাই তাইতো তোমার নাম মোহনা!”
–“চুপ! বে/য়া/দব!”
–“বের হও আমার বাসা থেকে। নয়তো আমি সত্য সত্যি পাথর এনে তোমার দিকে ছুঁড়বো!”
–“তোদের এই লো কালচার বাড়িতে আমি থাকতে আসি নাই! সো ফু/টানি কম মার! যত্তোসব আলতু ফাল”তু পোলাপান!”

বলেই মোহনা তার হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মেজাজ তারও খারা’প। একটুর জন্যে রায়িনের থেকে নাম্বারটা নিতে পারলো না।

~চলবে, ইনশাল্লাহ।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। মূলত চোখের জন্যেই ছোট করে দিতে হয়েছে। আপনাদের অপেক্ষা করাতে চাই না তাই ছোট করেই দিলাম। এই লেখাটা আমার সারাদিনের পরিশ্রম। ফোন রেখে রেখে লিখেছি। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here