#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [০৬]
লাবিবা ওয়াহিদ
—————————–
নতুন এক দিনের সূচনা ঘটলো। বেলা গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁইছুঁই। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো নিথি। হাই তুলতে তুলতে আদনকে হাঁক ছাড়লো। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে আদনের কোনো সাড়া শব্দ নেই। নিথি ভ্রু কুচকে রইলো। আদন কী শুনেও না শোনার ভান ধরছে নাকি? বিষয়টা মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হতেই নিথির মুখমন্ডলে রাগী ভাব ফুটে ওঠে। কোনরকমে চুল গুলো খোপা করলো সে। গাল পর্যন্ত চুলগুলো গালের দু’পাশে অবস্থান করছে। ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে আসলো। আদনকে হাঁক ছাড়তে ছাড়তে আদনের রুমে ঢুকে পরলো। যেহেতু আজ ছুটির দিন সেহেতু আজ আদন ফ্রী-ই আছে। কিন্তু এভাবে ঢুকে পরাটা যেন নিথির সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিলো। রায়িন বসে আদনকে পড়াচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে নিথির চোখ জোড়া অদ্ভুত ভাবে বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। রায়িন এতক্ষণ আদনকে পড়ার জন্যে বকছিলো। নিথিকে এই বেশে নজরে আসতেই তার কথা থেমে যায়। থমকে নিথির দিকে তাকায় সে। আদন মুখটা ভার করে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে ফিরলো।
এরকম ফ’কি’ন্নি বেশে রায়িনের সামনে এসেছে নিথি? নিথি একবার নিজের দিকে চোখ বুলিয়ে আরেকবার রায়িনের দিকে তাকালো। রায়িনের বেকুব চাহনি তার উপর নিবদ্ধ। নিথির মুহূর্তে-ই চোখ – মুখ লাল হয়ে এলো। সময় ব্যয় না করে এক ছুটে বেরিয়ে এলো। কী লজ্জা, কী লজ্জা। রুমে এসে সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিলো। দরজায় পিঠ ঠেকালো নিথি। বুক কাঁপছে তার। ফোঁস ফোঁস করে ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে সে। গাল জোড়া লাল হয়ে আছে। আবারও উদ্ভট ঘটনা ঘটে গেলো। নিথি দরজায় পিঠ লেপ্টেই ধপ করে বসে পরলো। ভাগ্য এত নিষ্ঠুর কেন? কেন সব আজব আর অনৈতিক ঘটনা প্রিয় পুরুষটির সামনেই হয়? এসবে এই ছেলে পটবে তো দূর, উল্টো এক ছুটে পালাবে। কেমন কান্না কান্না পাচ্ছে তার। নিথি এক দৌড়ে ওয়াশরুমে গেলো নাইট ড্রেস চেঞ্জ করতে। নাইট ড্রেস বলতে হাঁটু অবধি টি-শার্ট এবং প্লাজো। গরমের দিন এগুলোতেই কম্ফোর্ট ফিল করে নিথি।
মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। দরজা অতিক্রম করতেই নিথির শ্রবণ প্রিয় পুরুষটির শক্ত কন্ঠস্বর।
–“আজ যে পড়াগুলো দিলাম সেগুলো ঠিকভাবে কমপ্লিট করে নিবে। সামনে পরীক্ষা আসছে তোমার। এতো অনীহা হলে চলে না আদন। আমি আসছি!”
পায়ের শব্দ কিছু সময় শোনা গেলে আর শোনা যায় না। নিথির বুঝতে বাকি নেই রায়িন বেরিয়ে পরেছে। নিথি দেরী না করে দ্রুত ছুটলো বেলকনিতে। বেলকনির গ্রিলে হাত দিয়ে রায়িনের বের হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। আজ নিথিকে রায়িন পড়াবে না, সে সম্পর্কে তার জানা আছে। কিন্তু আজ হঠাৎ আদনকে কেন পড়াতে এলো তাও সকালবেলা? নিথির ভাবনার মাঝেই রায়িন কানে ফোন লাগিয়ে বেশ ভাবের সাথে বের হলো। নিথি সঙ্গে সঙ্গে বুকের বা পাশে হাত রাখলো,
–“আহ, কিলার লুক! পিছে থেকেই এতটা চমৎকার লাগছে না জানি ইন করা লোকটাকে সামনে থেকে কতটা সুন্দর লাগবে?”
নিথি গভীর দৃষ্টিতে রায়িনের দিকে তাকালো। সোনালী রোদ্দুরে তার গাল আর নাক কেমন গ্লো করছে। রোদে ঠিক ভাবে তাকাতে পারছে না, তাইতো চোখ এবং ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুচকানো।
–“আজ হিরো কী সানগ্লাস আনতে ভুলে গেছে নাকি?”
এর মাঝে রায়িন কথা বলতে বলতে নিথির বারান্দায় তাকায়। নিথি এতে অপ্রস্তুত, বিমূঢ় হয়। ক্ষণিকের জন্যে ভুলে যায় লুকানোর কথা। যখন সম্বিৎ ফিরে তখন নিথি লুকাতে গেলে রায়িন চোখ নামিয়ে হেঁটে চলে যায়। রায়িনের অস্তিত্ব যতক্ষণ না বিলীন হচ্ছে ততক্ষণ নিথি সেভাবেই দাঁড়িয়ে রয়। তবে নিথির মুখশ্রী জুবুথুবু। কেন বারংবার এই একটা মানুষের সামনে নিজেকে সর্বোচ্চ বোকা প্রমাণ করে সে?
নিথি লিভিংরুমে আসলো। আদন তখন আরামসে শারমিন আক্তারের ফোনে গেম খেলছে। নিথি কোনো বাক্য ছাড়াই আদনের মাথায় গাট্টা মারলো। আদন মুখ কুচকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো।
–“কী সমস্যা?”
–“স্যার যে আসবে আগে বললি না কেন?”
–“আমিও জানতাম নাকি আসবে? আম্মু সকালে ঘুম থেকে তুলে বলে স্যার আসবে! পরে স্যার-ই বললো একদিন গ্যাপ দেয়ায় আজকে সেই দিন উশুল করে নিলো!”
–“স্যার তোকে এতো বকে তুই রাগিস না?”
–“স্যার আমাকে একদিন বকলে বাকি তিনশো চৌষট্টি দিন ঠিকই ভালোবাসে। আমি তোমাদের মতো মেয়ে স্বভাবের নই যে একদিনের জন্যে বাকি দিনগুলার কথা ভুলে যাবো!”
–“কী বললি তুই?”
নিথি চোখ রাঙিয়ে কথাটি বলেই আদনের পিঠে এক ঘা বসালো। আদন আর্তনাদ করে দ্রুত সরে যায় এবং পিঠে হাত দিয়ে বলে,
–“আমি গেম খেলি দেখো না? তোমার জন্য আমি ম্যাচ হেরে গেলে তোমার মাথায় পানি ঢালবো! নয়তো স্যারের কাছে বিচার দিবো!”
–“আমিও আম্মুর কাছে বিচার দিবো!”
–“আহ! এই বেলায় কী শুরু করলি তোরা দু’জন?”
নিথি অভিযোগ দিতে মায়ের দিকে তাকাতেই দেখলো মায়ের চোখ লাল। আদনও লক্ষ্য করলো। মুহূর্তে-ই দু’জন শান্ত-শিষ্ট রূপ নিলো। নিথি করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মায়ের পানে। শারমিন আক্তার ছেলে-মেয়ের হঠাৎ থেমে যাওয়া দেখে দ্রুত নিজেকে সামলালেন। চোখে-মুখে রাগি ভাব এনে বলে,
–“এই, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে তুই নাস্তা খাবি না? আর আদন? তোমাকে বারণ করেছি না যখন তখন গেমস খেলবে না? ফোনটা হ্যাঙ মারে জানোই তো! ফোন রাখো বলছি, নয়তো তোমার গেম আমি ডিলিট করে দিবো!”
আদন ভদ্র ছেলের মতো গেম থেকে বের হয়ে ফোন রেখে দিলো। নিথিও বিনা-বাক্যে খেতে চলে গেলো। মাঝখান দিয়ে শারমিন আক্তারই থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে মনে ভাবলেন, মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে। যত দ্রুত সম্ভব তাকে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া প্রয়োজন।
নিথি রুটিতে কামড় বসাচ্ছে। তার চোখে ভাসছে কিছু সুখকর এবং বিষাক্ত স্মৃতি। হৃধির মনে আছে সে তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। একদিন তার বাবা ম/দ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরেছিলো, তার মা রাগ দেখাতেই খুব মারধর করে। মায়ের হাত ভেঙ্গে দিয়েছিলো সে। মাকে দেখেছে হসপিটালের বেডে সপ্তাহ খানেক কাঁতরাতে। সময়গুলো নিথি এবং তার ভাইয়ের জন্যে খুবই কঠিন ছিলো। আদন ছিলো সবে দুই বছরের শিশু। সেই দুই বছরের শিশুকে নিথি একা হাতে সামলিয়েছে। আর নিথিকে সামলিয়েছে নিথির দাদীমা। দাদী নিজেই চেয়েছিলো তার ছেলেকে জেলে দিতে। ছেলেকে পাপাচার, জু/ য়া খেলা থেকে বাঁচাতেই মূলত জোর করে বিয়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, হয়তো ছেলেটা এবার শুধরাবে। ঠিকই শুধরে ছিলো। কয়েকটা বছর বেশ হাসি-খুশিই কেটেছে সব। নিথি এলো তাদের ঘর আলো করে, বছর দশেক পর আদন। হঠাৎ-ই যেন জামাল সাহেব বদলে যেতে লাগলেন। বাড়ি ঠিকমতো আসেন না, শারমিন আক্তারকে পাত্তা দেন না, এমন অহরহ ঘটনা যা বিয়ের আগে ঘটতো। পরবর্তীতে শোনা যায় তিনি পরকিয়াতে লিপ্ত। এখন অবশ্য তিনি নিখোঁজ! কোথায় আছে, কী করছে সে খবর কেউ-ই জানে না। খোঁজ নেই তার দুই সন্তানের। শারমিন সেই থেকে নিজে সংসারের হাল ধরেছে। তখন তাদের এদিকে বেশ ভালো মানের গার্মেন্টস খুলেছিলো, নতুন। শারমিন আক্তার পড়াশোনা জানেন দেখে সেখানেই ঢুকে পরেন। এছাড়াও ওদের পরিবারে ঢাল হয়ে আছে নিথির চাচা এবং মামা’রা!
তাদের পরিবারে একমাত্র নিথির বাবাটা খারাপ হলেও পরিবারটা ভিষণ আদুরে। দাদীমা গত হয়েছেন দু’বছর হলো। বিষাক্ত অতীত ঘাটতে গিয়ে নিথির গলায় খাবার আটকে গেলো। কিছুতেই খাবার গলা দিয়ে নামছে না তার। মা কী করে তার পড়াশোনার খরচ, সংসারের খরচ আবার রায়িন স্যারের খরচ বহন করে? এছাড়া নিথি যে অন্যের দয়ায় চলতে পারে না। তার যে বড্ড আত্মসম্মানবোধ। নিথি খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মাকে এখনই বলতে হবে তার জন্যে রায়িনকে রাখার প্রয়োজন নেই। সে নিজেও এখন থেকে টিউশনি করাবে।
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।
#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [০৭]
লাবিবা ওয়াহিদ
————————–
মাস দুই কেটে যায়। নিথি আজ তার চাচ্চুর বাড়িতে এসেছে। প্রথম এক মাসে মাকে কিছুতেই নিথি বুঝাতে পারেনি। শারমিন আক্তার সাফ সাফ বলে দিয়েছে,
–“তোর দাদী তোর জন্যে আলাদা ফান্ড করে গেছিলো, সেখান থেকেই তোর পড়ালেখার খরচ চলছে। এখন যদি বাড়াবাড়ি কথা বলিস তাহলে চ’ড় মেরে মে’রে দাঁত ফেলে দিবো। যা নিজের রুমে। আসছে বড়ো বড়ো কথা বলতে, ফা’জি’ল মেয়ে!”
সেদিন বিকালেও শারমিন আরেকদফা হুমকি দিয়েছিলেন নিথিকে।
–“টিউশনি করানোর চিন্তা মাথাতেও আনবি না। আমার শরীর থেকে রুহ বেরিয়ে যায়নি যে তোকে ইনকাম করে খেতে হবে। তিন বেলা খাচ্ছিস, পড়ছিস এতেই শোকর কর। আর যেন এসব কথা না শুনি!”
নিথি দমে গেলেও এক দিক দিয়ে খুশি হয়েছে যে তার রায়িনকে আর হাতছাড়া করতে হবে না। সেদিন থেকে নিথি আরও মনোযোগী হয়, তার দাদী তার জন্যে এতকিছু করে গেছে। তারও তো উচিত তার দাদীর ইচ্ছেগুলো পূরণ করা। তাই নিথিও আঁটঘাট বেঁধে নেমেছিলো। ঠিক তার পরের সপ্তাহেই নিথির পরীক্ষা আরম্ভ হয়। নিথির পরীক্ষায় রায়িন অনেকটা হেল্প করেছে। এখন রায়িন মাষ্টার্স ফাইনাল দিচ্ছে। তাই আপাতত রায়িন এই মাসটা পড়াচ্ছে না। তবে নিথির জানামতে রায়িনের পরীক্ষা শেষের পথে। নিথির চাচাতো বোন আফিয়ার বিয়ের দেড় মাস বাকি। নিথির দুজন জেঠু। ভাইদের মধ্যে নিথির বাবা ছিলেন ছোট। নিথির বাবার পরেও এক বোন ছিলো। নিথির ফুপি দুজন। সবাই আশেপাশের এরিয়াতেই থাকে।
নিথি এখন মোহনার সাথে আফিয়ার রুমে বসে আছে। আফিয়া এবং মোহনা হচ্ছে নিথির মেজো জেঠুর মেয়ে। মোহনা নিথির সমবয়সী হলেও এক ক্লাস গ্যাপ যাওয়ায় সে সবে এইচএসসি দিয়েছে। এছাড়া বড়ো জেঠুর একটা ছেলে আছে। নাম সাজিদ। সাজিদ বিবাহিত এবং তার বউ সামিহা ওদের সাথে এক বাড়িতেই থাকে। আফিয়া বর্তমানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার ফিয়ন্সের সাথে কথা বলছে। আর দু’জন তারই অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। নিথি জানে না, যখনই সে নিশ্চুপ থাকে তখনই রায়িনের ভাবনা তার মস্তিষ্ক ঝেঁকে ধরে। নিথি অন্যমনস্ক হয়ে পরে প্রতিবার। কতদিন দেখে না তার প্রিয় রায়িন স্যারকে। ছবিতে দেখতে আর কতো ভালো লাগবে? অশান্ত, বেহায়া হৃদয় যে সরাসরি একপলক দেখতে চায়। মাঝমধ্যে রায়িনের হোস্টেলের সামনে দিয়েই হেঁটে আসে। তবে সৌভাগ্য করে রায়িনের দেখা পায় না। মোহনা নিথিকে ধাক্কিয়ে সম্বিৎ ফেরায়।
–“কী হলো? কোথায় হারালি?”
–“কই? কোথাও না!”
এর মাঝে ভাবী নাস্তা নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। একই সাথে আফিয়াও আসলো। চারজন মিলে ভিষণ আড্ডা দিলো। কখন যে বিকাল ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমে গেলো টেরই পাওয়া যায় না। এর মাঝে নিথি নিজের ফোনের রিংটোন শুনতে পেলো। ব্যাগ হাতড়ে ফোন বের করলো। স্ক্রিনের নামটি দেখতেই নিথির ভেতরটা ধ্ক করে উঠলো। এ যে “রায়িন”। মুহূর্তটা মাগরিবের আযানের ধ্বনিতে চারিপাশ মুখোরিত হলো। নিথি কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে কল রিসিভ করলো। অপরপাশ থেকে রায়িনের গম্ভীর কন্ঠে “হ্যালো” বলে উঠলো। রায়িনের কন্ঠস্বর শ্রবণ হতেই নিথির আবেশে চোখ বুজে এলো। একরাশ তৃপ্তি তার ভেতরে করা খাঁ খাঁ দূরে ঠেলে দিলো। এত সুন্দর কেন অপেক্ষার ফল? নিথি যেন সালাম দিতেই ভুলে গেছে।
–“হ্যালো? নিথি? আর ইউ হেয়ার মি?”
নিথির সম্বিৎ ফেরে। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সালাম জানায়। রায়িন সালামের উত্তর নিয়ে বলে,
–“আজ আমি পড়াতে আসতে চাচ্ছিলাম। তুমি কী বাড়িতে আছো?”
নিথি একপলক হাত ঘড়ির দিকে তাকালো। আমতা আমতা স্বরে বলে,
–“হ..হ্যাঁ স্যার, আসুন।”
–“ঠিক আছে। আদনকে তৈরি থাকতে বলিও। তোমাদের আজ একসাথেই পড়াবো!!”
–“ঠিক আছে স্যার, বলে দিবো!”
–“রাখছি, কেমন?”
নিথি অপ্রস্তুত হাসলো। তার এই হাসি আত্মতৃপ্তি এবং ভালো লাগার সংমিশ্রণ। কতদিন পর প্রিয় মানুষটির দেখা পাবে সে, ভাবা যায়? নিথি ফোন রাখতেই ভাবী সামিহা ভ্রু কুচকে বলে ওঠে,
–“কোন স্যার ছিলো, যার জন্যে মুখের হাসি মেঝেতে গিয়ে ছুঁয়েছে?”
নিথি বেসামাল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আমতা আমতা করে বললো,
–“তে..তেমন কিছু না ভাবী। আচ্ছা শুনো, আমার আর্জেন্ট বাসায় যেতে হবে। হোম টিউটর আসবে। এছাড়া আদনকেও জানাতে হবে। আমি এখন উঠি!”
বলেই নিথি উঠতে নিলে মোহনাও জেদ ধরে নিথির সাথে তাদের বাসায় যাবে। রাতটাও থেকে যাবে ওখানেই।
–“প্লিজ কেউ না করো না। এইচএসসি দিয়ে কবে থেকে বাসাতে বসে আছি। ঘুরাঘুরি হচ্ছে না, চাচীর বাসাতেও যাওয়া হচ্ছে না। প্লিজ আফিয়া আপু, আম্মুকে বুঝাও। আমি আজ যাবোই বলে দিলাম”
মোহনা যাবে দেখে নিথির মুখশ্রীতে খুশির ঝলকানি দেখা যায়। নিথিও আফিয়াকে বলে,
–“আসুক না আপু। সমস্যা কী? কতদিন আমার সাথে থাকেনি, আসলে আমার ভিষণ ভালো লাগবে। প্লিজ আমি নিয়ে যাই ওকে!”
নিথি মোহনাকে নিয়ে তার ছোট মা অর্থাৎ মোহানার মায়ের কাছে নিয়ে গেলো। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করিয়ে নিলো। মোহনা রেডি হতেই দুজনে দেরী না করে বেরিয়ে পরলো। রাস্তাতেই নিথি তার মাকে জানিয়ে দিলো স্যারের আসার কথা। রাস্তায় জ্যাম থাকায় একটু দেরী-ই হয়ে যায়। তবে সারা রাস্তায় মোহনা বকবক করেছে আর নিথি শুনেছে। নিথির ধ্যান আদৌ মোহনাতে ছিলো কি না তার জানা নেই। নিথির মন যে তার থেকে ছুটে রায়িনের কাছে যেতে চাচ্ছে। নিথি তার উত্তেজনা কত কষ্টে সামলাচ্ছে সেটা একমাত্র উপরওয়ালা ব্যতীত কারো বোঝার উপায় নেই। প্রিয় পুরুষটিকে বহুদিন পর দেখার ব্যাকুলতা বুঝি এতটাই আকাশচুম্বী? রাস্তাটাও দেখো, আজ যেন শেষ হতেই চাচ্ছে না। দু’পাশে দমকা হাওয়ায় মোহনীয় ভাবে উড়ছে কৃষ্ণচূড়ায় আবৃত রক্তিম গাছগুলি। এক সুন্দর সুঘ্রাণ পাচ্ছে নিথি, হয়তো কোনো নাম না জানা ফুলের। তবে নিথি যেন প্রতিটি কৃষ্ণচূড়ার ভাঁজে ভাঁজে রায়িনকে খুঁজে চলেছে। হয়তো রায়িন তার কৃষ্ণচূড়ার মতোই প্রিয় হয়ে উঠেছে। নয়তো কৃষ্ণচূড়ার ভাঁজে-ই কেন রায়িনের অস্তিত্ব খুঁজে পায় সে? @কৃষ্ণচূড়ার এক সন্ধ্যা-য় রায়িনের প্রথম সঙ্গ পেয়েছিলো বলে?
অবশেষে বহুল অপেক্ষার পর এই অধৈর্য শব্দের অবসান ঘটে। কোথায় যেন পড়েছিলো অপেক্ষা পৃথিবীর সবচেয়ে অধৈর্য এবং বিরক্তিকর শব্দ। তবুও মানুষ দিন, মাস, বছর পর্যন্ত অপেক্ষা নামক শব্দে আবৃত থাকে। অপেক্ষার কেন্দ্রবিন্দু-ই কাঙ্খিত মানুষটি। অপেক্ষা দ্বারাই মানুষ তার চরিত্রে কঠিন ধৈর্যের প্রমাণ দেয়। বিষয়টি অদ্ভুত হলেও এরকম চলে এসেছে বহু প্রজম্ম। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে এপার্টমেন্টে প্রবেশ করলো নিথি। মোহনা তার হিল পরে কিছুতেই নিথিকে ধরতে পারছিলো না। বাসায় এসে নিজের জুতা কোনরকমে খুলতে-ই শারমিন বলে ওঠে,
–“রায়িন তো এসে গেছে। তুই দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আয়!”
পায়ের অবশিষ্ট মোজাটা খুলতে খুলতে নিথি বলতে লাগলো,
–“মোহনা এসেছে। ওকে বসিয়ে দিও।”
বলেই মোজা খুলতে খুলতে রুমে চলে গেলো। তার এখন বহুত তাড়া, রায়িনকে প্রাণ ভরে দেখার তাড়া! কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে এসে উম্মুক্ত চুলগুলো খোপার মাধ্যমে বেঁধে রাখলো। অতঃপর মাথায় ঘোমটা দিয়ে পরিপাটি হয়ে হাতে বই নিয়ে দ্রুত ছুটলো আদনের রুমে। রায়িন বর্তমানে সেখানেই অবস্থান করছে!
বই-খাতা হাতে আদনের রুমে যেতেই মোহনাকে দেখলো আদনের বিছানায় বসে রায়িনের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা নিথির বুকে তীরের মতো বিঁধলো। তবে সে সাড়াশব্দ করলো না। রায়িন এতক্ষণে মোহনার উপস্থিতি খেয়াল না করলেও নিথির উপস্থিতি সে টের পেলো। ঘাড় বাঁকিয়ে নিথির দিকে তাকালো। নিথিও সবে রায়িনের দিকে তাকিয়েছিলো। মুহূর্তে-ই দৃষ্টি আদান-প্রদান হয় দুই জোড়া চোখের৷ নিথির হাসার চেষ্টা করে সালাম দিলো। রায়িন সালামের উত্তর নিয়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকালো এবং ঘড়ির দিকেই তাকিয়ে বললো,
–“বিশ মিনিট লেট!”
নিথির হাসিটা মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে গেলো। মুখটা কাচুমাচু করে বললো,
–“সরি স্যার। জ্যাম ছিলো তাই লেট হয়ে গেছে!”
–“এসে বসো!”
নিজের পাশের খালি চেয়ারে ইশারা করে বললো। বিছানার দিকে নজর যেতেই মোহনাকে দেখলো। মোহনা হতবুদ্ধি ভুলে হাত তুলে রায়িনকে জানালো। রায়িন উপর নিচে মাথা দুলিয়ে পুণরায় নিথির দিকে তাকালো। নিথি সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি নত করে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। অনুভব করছে তার হৃদপিন্ডের প্রখর ঢিপঢিপ শব্দ। চেয়ারটাতে বসতেই শারমিন আক্তার এলো রায়িনের জন্যে নাস্তা নিয়ে। রায়িনকে নাস্তা দিয়ে মোহনার উদ্দেশ্যে বললো,
–“তুমি বরং আমার সাথে এসো। ওরা পড়ুক!”
মোহনা ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে শারমিন আক্তারের সঙ্গে বেরিয়ে গেলো। আদন নিথির কানে ফিসফিস করে বলে,
–“নাই কোনো মোহ, আবার নাম রাখসে মোহনা। কোন নদীর মোহনা যে ঠান্ডা বাতাস না দিয়ে শুধু গরম বাতাস ছাড়ে?”
নিথি নিরবে আদনের পেটে চিমটি কাটলো। আদন হালকা আর্তনাদ করে দমে রইলো। রায়িন চায়ে চুমুক দিয়ে আদনের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়।
–“কী হলো আদন?”
–“ক..কিছু না স্যার!” হাসার চেষ্টা করে বললো আদন!
আজ যেন নিথির দৃষ্টি রায়িনের থেকে সরছেই না। রায়িন তাকে মনোযোগের সাথে একটা চ্যাপ্টার বুঝিয়ে দিচ্ছে। নিথি গালে হাত দিয়ে আপনমনে ভাবলো,
–“এত সুন্দর কেন আপনি? আপনার দিকে সারাদিন তাকিয়ে থাকলেও আমি ক্লান্ত হবো না। আপনি আমার মনের ক্যানভাসে আঁকা ছবির চেয়েও সুন্দর, তা কী আপনি জানেন? সবকিছু কুৎসিত লাগলেও কেন যেন আপনাকেই ভালো লাগে। আপনি সৃষ্টিকর্তার এক অপরূপ সৃষ্টি, স্যার।”
—————————–
রায়িন সবেই চলে গেলো। রায়িন যেতেই নিথি আদনের মাথায় এক গাট্টা মেরে বললো,
–“এই তুই মোহনাকে নিয়ে এসব বলিস কেন?”
–“বলি কী সাধে? উনি ধোঁয়া তুলশীপাতা না যে ওরে মাথায় তুলে রাখবো!”
–“কী করেছে ও? কেন সহ্য করতে পারিস না?”
–“সেটা বলবো না। তবে এই না’গি’নীর থেকে সাবধান, এ উপর দিয়ে যতই গরম ভেতরে ততই গরম। ওরে বিশ্বাস করিও না!”
–“আবার আজেবাজে বকলে তোকে এক চ’ড় লাগাবো আদন!”
–“দাও, দাও! আজকাল ভালো কথার কদর নাই। যখন নিজের পায়ে কুড়াল পরবে তখন ঠ্যালা বুঝবে।”
বলেই আদন চেয়ার ছেড়ে দুলতে দুলতে বেরিয়ে গেলো। আদনের কোনো কথা-ই নিথি ভালো ভাবে পাত্তা দেয়নি। সে আপাতত তার মন পুরুষকে ভাবতে ব্যস্ত। পরমুহূর্তে মাথায় এলো, আরে! বেলকনি দিয়ে রায়িনকে দেখাই তো হলো না। ধুর, সব দোষ ওই আদনটার৷ এই আদনের চক্করে সব ভুলে বসেছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই রায়িন অনেক দূর চলে গেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই নিথি বেরিয়ে এলো। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো তার।
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। বর্তমানে আমার সময়টা বড্ড অনিয়মিত কাটছে। ঠিকমতো লিখতে পারি না আবার কোনো কিছুতেই ফোকাস আসে না। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।