#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [২০]
লাবিবা ওয়াহিদ
——————————-
–“আচ্ছা, রায়ার এরকম অস্বাভাবিক আচরণের কারণ কী?”
রায়িন কফিতে চুমুক দিতে দিতে নিথির পানে কোণা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। নিথি তখক্ন উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে রায়িনের দিকে। রায়িন চোখের সামনে থেকে ফাইলটা সরিয়ে কফিটা কোলে রাখলো। কফির মগটা মৃদু উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। রায়িন কফিটার দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে শুধায়,
–“তুমি বানিয়েছো?”
নিথি কাচুমাচু ভঙ্গিতে আওড়ায়, “হু!”
রায়িন নিরব থাকলো। নিথি তার কৌতুহল দমাতে না পেরে পুণরায় বললো,
–“বলুন না স্যার!”
সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রায়িন। বেশ সময় নিয়ে বললো,
–“রায়ার মানসিক প্রব্লেমটা হয়েছে ক্লাস টেনে থাকতে। ওকে একটা ছেলে রোজ ডিস্টার্ব করতো, আজেবাজে কথা বলতো। রায়া আবার ছিলো ভীতু স্বভাবের। তাই সবসময়ই ছেলেটাকে এড়িয়ে চলতো এবং ভয়ে ভয়ে থাকত। একদিন ছেলেটা সুযোগের অসৎ ব্যবহার করলো। রায়াকে টেনে-হিঁচড়ে…”
চোখ বুজে এলো রায়িনের। গলা ধরে আসছে তার। চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার আওড়ায়,
–“এক নিরব গলির মাঝে আমার বোনকে রে’প করতে চেয়েছিলো। কিন্তু সৌভাগ্যবশত সময়মতো আমি চলে গেছিলাম। আরেকটু দেরী করে ফেললে হয়তো আমি আমার প্রাণপ্রিয় বোনটাকে হারিয়ে ফেলতাম। কিন্তু সেদিন আল্লাহ’র রহমত ছিলো৷ পরবর্তীতে ওই রা’বিশকে শাস্তি দেয়া হয় কিন্তু রায়া সেদিনের যন্ত্রণা ভুলতে পারেনি। তাকে প্রতিনিয়ত সেই দিনটা কুড়ে কুড়ে খেত, একটা মেয়ের জন্যে ওটা খুবই বাজে সিচুয়েশন। ডিপ্রেশনে থাকতে থাকতে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়। তোমার সাথে ঘটে যাওয়া সময়টাতেও আমার বোনের কথা মনে পরেছিলো। সিচুয়েশনটা তুমি সামলে উঠতে পারলেও আমার বোনটা পারেনি। ও ছিলো তখন টিনএজ! ওর জন্য সহজ ছিলো না। এছাটা ম্যাচিউরিটিও তার মধ্যে তখন আসেনি।”
নিথি নিরবে সবটা শুনে নিলো। চোখে মুখে অধিক বিষ্ময়। মেয়েটার সাথে এতকিছু ঘটেছে? রায়িন আবারও বললো,
–“রায়া অচেনা কারো সাথে মিশে না, অচেনা দেখলেই ভয় পায়! সেখানে তোমার সাথে এতটা মিশেছে আমার ভাবনার বাইরে। তুমি কী ম্যাজিক জানো নিথি? ইউ নো হোয়াট, তোমার সঙ্গ পাওয়ার পর থেকে আমার বোনটা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে?”
নিথি চমকে রায়িনের দিকে তাকালো। তার জন্যে মানে? নিথি আটকে গলায় বলে,
–“আমার জন্যে?”
–“হুম। রায়ার সাথে এভাবে বন্ধুসুলভ ভাবে কেউ মিশতে পারেনি। এছাড়া তুমি অচেনা হয়েও তোমায় সেদিন রায়া ভয় পায়নি। এরপরের ঘটনা গুলোও ছিলো অপ্রত্যাশিত!”
নিথি চুপসে যায়। মনগহ্বরে কোথাও এক জায়গায় শান্তির ঘন্টা বাজছে। নিজের জন্যে একজন মানুষ যদি স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়, তাহলে এর চেয়ে প্রাপ্তির আর কী থাকতে পারে?
রায়িন কফিটা শেষ করে শূন্য মগটি নিথির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
–“আরেক কাপ কফি হবে?”
নিথি লাজুক হাসলো। দৃষ্টি নত করে মগটা হাতে নিয়ে বলে,
–“আনছি!”
নিথি চলে গেলো। রায়িন নিথির যাওয়ার পানে তাকিয়ে ফিচেল হাসলো। মেয়েটা অনেক সরল মনের। রায়িন ভেবে পায় না, এতটা সহজ-সরল কেন এই মেয়ে? কই, আগে তো এতটা সরল ছিলো না। তখন তো মনে হতো নিথি চঞ্চল প্রকৃতির! বিয়ের পর বুঝি মেয়েরা এভাবে বদলে যায়? এছাড়া নিথি তো রায়িনকে ভালোবাসে। রায়িন ভাবনায় বুদ হলেও বাস্তবে ফিরে এসে নিজের কাজে ধ্যান দেয়। নিথি আরেক মগ কফি আনতেই রায়িন কাজ করতে করতে বললো,
–“কাল থেকে ভার্সিটি যাচ্ছো তুমি। আমি দিয়ে আসবো আর ড্রাইভার চাচা নিয়ে আসবে। আমি চাই না বিয়ের কারণে তোমার লেখাপড়ায় কোনোরকম ইফেক্ট পরুক!”
—————————-
নিথি এবং রায়িনের দিনগুলো বেশ ভালো যাচ্ছে। নিথি এখন রেগুলার ভার্সিটি যেতে শুরু করেছে। রোজ রায়িন তাকে দিয়ে আসে আর আসার সময় বাড়ির ড্রাইভার তাকে নিয়ে আসে। মাঝেমধ্যে রায়িন-ই যায় নিথিকে নিতে। রায়িন যখন তাকে চমকে দেয় তখন নিথির বক্ষঃস্থলে খুশির জোয়ার ওঠে। সে যথেষ্ট চেষ্টা করছে, রায়িনকে তার সাথে সহজ করতে। রায়িন তাকে ভালো না বাসুক, রায়িন তো তারই স্বামী। আজ হোক বা কাল, একদিন ঠিকই রায়িনের মনে ভালোবাসা জাগবে। সেটা নিথি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। এতগুলা দিন যেহেতু রায়িনের জন্যে অপেক্ষা করেছে আরও কিছুটা দিন নাহয় অপেক্ষা করলো। অপেক্ষায় ক্ষতি কী? একদিন হয়তো দেখা গেলো এই অপেক্ষা তাকে সুফল দিলো। অপেক্ষার শেষেই আসবে প্রাপ্তি!
–“কী রে নিথু, আজ বেশি খুশি খুশি লাগছে তোকে?”
নিথি থতমত খেয়ে নয়নার দিকে তাকালো। নয়নার অধরে দুষ্টু হাসি। নিথি লাজুক বনে নয়নার পিঠে এক চা’পড় মারলো। মিনমিন করে বললো,
–“অ’সভ্য! প্রতিদিন এভাবে নানান কথা বলে জ্বা’লাস কেন?”
–“কী বলবো বল! যবে থেকে বিয়ে হয়ে ভার্সিটিতে আসা শুরু করেছিস তবে থেকে তোর মুখে হাসি লেগেই থাকে। সাথে ননস্টপ ভাবনা তো আছেই। না জানি রায়িন ভাইকে নিয়ে কত আকাশ পাতাল ভাবিস!”
–“আমি ভাবলে তোর কী? আমি সারাদিন, সারারাত ভেবে যাবো!”
–“হায়রে আমার রোমান্টিক বান্ধুবীরে! তা ভাইয়া এতদিনে কয়টা পা*** দিলো?”
এবার নিথির ধৈর্য ধরে নয়নার সামনে বসে থাকা হলো না। মেয়েটার মুখ পুরোই লাগামহীন! সরাসরি এমন এমন প্রশ্ন করে বসে যে নিথি নিজেই গুটিয়ে যায় লজ্জায়। নিথি যেতে নিলে নয়না শরীর কাঁপিয়ে হেসে নিথিকে টান দিয়ে চেয়ারে বসালো!
–“আরে কই যাস!? আমি তো মজা করছিলাম। আমি তো চাই তুই সারাজীবন এমন হাসি-খুশি থাক। তোর রায়িন স্যারকে পাইছিস তুই! কতটা লাকি তুই, ভাবতে পারছিস?”
কথাগুলো বলতে বলতেই নয়না নিথিকে পাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। নিথি নিজেও ভাবছে, সত্যি-ই তো! কতকিছু-ই না করেছে একমাত্র রায়িনের জন্যে। সব পাগলামি, আবেগ ঢেলেছে রায়িনের পায়ের কাছে। কত ডেকেছে উপরওয়ালাকে, একমাত্র রায়িনকে পাওয়ার জন্যে। রায়িনকে স্বামী হিসেবে পাওয়াটা এতটাও সহজ ছিলো না। তার কাছে প্রতিটা মাস বছরের ন্যায় লেগেছিলো।
আজ রায়িন আসবে তাকে পিক করতে। নিথি খুশিতে কী করবে জানা নেই। নয়নাও মুচকি মুচকি হাসছে বান্ধুবীর চঞ্চলতায়। নিথির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে নয়না আপনমনে বলে ওঠে,
–“খুব ভালো থাক তুই নিথি!”
——————————-
–“একটা কথা বলবো?” বেশ ইতস্তত নিয়ে বললো নিথি। রায়িন ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিয়ে বললো,
–“হুম!”
–“ফুচকা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে!”
রায়িন কোণা চোখে তাকিয়ে পুণরায় ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো। এদিকে নিথি অস্বস্তিতে জমে দই হয়ে যাচ্ছে। আবদারটাকে কী রায়িন খারাপ ভাবে নিবে? নিথি পিটপিট করে সামনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কয়েকটা ফুচকার স্টল পেছনে ছুটছে। মন খারাপ হয়ে গেলো নিথির৷ দৃষ্টি নত করে চুপচাপ হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিনিট পাঁচেক পরে হঠাৎ গাড়ি থেমে যায়। নিথি মাথা তুলে তাকায়। এত দ্রুত বাড়ি চলে আসার তো কথা না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে এখনো রাস্তাতে। পাশ ফিরে রায়িনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো রায়িন সিটবেল্ট খুলছে। রায়িন সিটবেল্ট খুলে বলে,
–“নামো!”
নিথি হতবুদ্ধি হারিয়ে নেমে পরলো। যেন সে রায়িনের বাধ্য বউ! নামতেই পাশে দেখলো ফুচকার স্টল। ভীড়-ভাট্টা নেই এখানে। নিথি অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়।
–“এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? খাবে না!”
নিথি চমকে রায়িনের দিকে তাকালো। এর মানে রায়িন তাকে ফুচকা খাওয়াবে। মন নেচে উঠলো নিথির।
———-
রাতে রায়িন ল্যাপটপ চাপছিলো। নিথি তার মুখোমুখি বসে পড়ছে। নিথি থেমে থেমে রায়িনের দিকে তাকাচ্ছে। এর মাঝে খাবারের ডাক পরলো। নিথি কিছু না ভেবে এক অপ্রত্যাশিত কান্ড ঘটিয়ে ফেললো। নিজের লাজ-লজ্জা ভুলে রায়িনের গালে চুমু দিয়ে বলে,
–“আপনি জানেন খুব ভালো। আপনি আমাকে ফুচকা খাইয়েছেন, আমার কত কেয়ার করেন। ভালোবাসি আপনাকে স্যার!”
বলেই এক মুহূর্তও সেখানে না দাঁড়িয়ে এক ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বুকের ওঠা-নামার শব্দ খুব তীব্র। বুক ধরেই দৌড় দিয়েছে নিথি। নিঃশ্বাসও যেন গলায় দলা পাকিয়ে আছে। একবুক সাহস নিয়ে এসব বলেছে সে। এছাড়া রায়িনকে লাইনে আনার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলো না। এদিকে রায়িন রোবটের মতো বসে আছে। গালে তার হাত আলতো স্পর্শ করে আছে। সবটা কেমন মাথার উপর দিয়ে গেলো তার। কী হলো ব্যাপারটা?
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। চেয়েছিলাম এই পর্বেই গল্পটার এন্ডিং টানবো কিন্তু পারিনি। তিনদিন অপেক্ষা করানোর জন্যে আমি সত্যি-ই লজ্জিত। ইদানীং রাইটিং ব্লকে আছি সাথে পরীক্ষাও চলছে। লেখার মানসিকতা পাই না ঠিকমতো। আজও লিখতে পারছি না তাও নিজের উপর জোর খাটিয়ে এইটুকু লিখলাম। আর কলম চলছে না আমার। আমি সত্যি-ই দুঃখিত। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।