#কুয়াশার_মতো
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -২
প্রচন্ড রোদে পিচঢালা রাস্তা গরম হয়ে আছে, অতিরিক্ত তাপে শরীর ঘামতে শুরু করেছে। কয়েক মিনিট রোদের ভিতর হাঁটছি এতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অথচ রিকশাচালকরা সারাদিন রোদে পুড়ে রিকশা চালায়, তাঁদের কি কষ্ট হয় না? হ্যাঁ তাদেরও কষ্ট হয়, প্যাডেল দিতে দিতে পুরনো গামছার কপাল মুছতে থাকে। থামলে চলবে না, জীবিকার টানে ছুটতে হবে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখালাম রাস্তায় তেমন কেউ নেই, বেশিরভাগ লোক সূর্যের আলো থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। যাদের একান্তই অন্য উপায় নেই, তাঁরাই রোদে পুড়ছে।
সোহাগের এ সময় অফিসে থাকার কথা, সকালে কত ব্যস্ততা দেখিয়ে অফিসে চলে গেল। অথচ এখন কোন ব্যস্ততা নেই, দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। সবসময় সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করতে নেই। এতে লাভের পরিবর্তে ক্ষতিই বেশি। নানান চিন্তার মাঝে অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য নজরে পড়লো।
বয়স্ক একজন রিকশা চালাচ্ছে। অল্প বয়সী বাচ্চা মেয়ে উনার যাত্রী, সম্ভবত স্কুলে পড়ে। স্কুল ড্রেস পরে আছে। বাচ্চা মেয়েরটি একহাত দিয়ে লোকটার মাথার উপর ছাতা ধরে আছে, অন্য হাতে একটা শক্ত কাগজ নিয়ে বাতাস করার চেষ্টা করছে। লোকটা যথাসম্ভব আস্তে রিকশা চালাচ্ছে। মেয়েটার পায়ে রোদ লাগছে, নিজের পা দু’টোরে রোদ থেকে বাঁচাতে ছায়ায় নেওয়া চেষ্টা করছে। কিন্তু বারবার রোদের ভিতর চলে যাচ্ছে।
দৃশ্যটা অসম্ভব সুন্দর। আজ-কাল রাস্তাঘাটে এমন সুন্দর দৃশ্য খুব কমই নজরে পড়ে। রিকশাটা আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় কানে এলো বয়স্ক লোকটি বাচ্চা মেয়েটাকে বলছে, ” দিদি ভাই, বাতাস করতে হবে না। তোমার কষ্ট হচ্ছে। রিকশা চালালে এমনতেই গায়ে বাতাস লাগে।”
লোকটার কথায় তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট। এমন যাত্রী হয়তো কখনো উনার ভাগ্যে জোটেনি। এমন নয় ওরা আত্মীয়, মেয়েটার গলায় রুদ্রাক্ষমালা, লোকটার মাথায় টুপি। বাচ্চা মেয়েটার জায়গায় আমি থাকলেও উনার সাথে এমন ব্যবহার করতাম না। বরং তাড়া দিতাম, বাড়ি গিয়ে রান্না করতে হবে, চাচা একটু জোরে চালান। একবার জন্যও মনে হতো না উনার কষ্ট হচ্ছে। টাকা দিয়ে পরিশ্রম কিনছি এতে দরদ দেখানোর কি আছে! বাচ্চাদের মন বড়দের মতো হিসাব কষতে জানে না, এজন্যই ওরা নিষ্পাপ।
” এতো রোদের ভিতর হাঁটছ কেন? শরীর খারাপ হবে তো।”
চিরপরিচিত কণ্ঠস্বর। পাশ ফিরে দেখি সোহাগ, রিকশায় বসে আছে। সাথে চৈতী নেই, একাই কোথাও যাচ্ছে। রিকশাওয়ালা গামছায় মুখ মুছে কয়েক মুহূর্ত জিরিয়ে নিচ্ছে।
” কি হলো কথা বলছো না কেন? মাথা খা’রা’প হয়ে গেছে নাকি?”
” না, বাড়ি ফিরছিলাম। ”
” তো রিকশা বা সিএনজিতে যেতে, রোদের ভিতর হাঁটার কি দরকার? ”
” রোদ উপভোগ করার চেষ্টা করছি। এ সময়ে তুমি কোথায় যাচ্ছ? তোমার না অফিসে থাকার কথা?”
” সোহিনী কল দিয়েছিল, বললো আমাদের ওখানে আসছে। তাই বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। উঠে এসো। রোদে পুড়ে জ্বর বাঁধানোর তালে আছে। ”
” রোদে পুড়লে জ্বর হয় নাকি? জ্বর তো বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগালে হয়। ”
” কথা না বলে উঠে এসো। মামা চলেন। ”
সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। চৈতীর সাথে ঘুরতে বের হলে একা একা বাড়ি ফিরছে কেন? আবার অফিস দিয়ে বাড়ি ফিরতে হলে বাজারে কি কাজ? ছেলেটার কান্ডকারখানা মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। অবিশ্বাস করতেও পারছি না। বিশ্বাস – অবিশ্বাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি। যদিও অন্য কারণ আছে, আমার মন সোহাগকে অবিশ্বাস করতে চাইছে না। মনের মাঝে উদিত চিন্তাগুলোকে মিথ্যা প্রমান করতে চাইছে। এজন্য সামান্য কারণ পেলেও অবিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সোহাগ আমার ডান হাত ধরে আছে, আঙ্গুলের ভাঁজে নিজের আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে হাতটা চেপে ধরেছে। সাধারণত পরকীয়া আসক্ত পুরুষরা এমন কাজ করে না। তাঁদের কাছে বউদের সংস্পর্শ বিরক্তিকর লাগে, সবসময় অন্য চিন্তার ডুবে থাকে। এখন সোহাগের মাঝে সেসব কিছু লক্ষ্য করছি না। সুখী দম্পতির মতো হাত ধরে রিকশায় ঘুরছি।
” কোথায় গিয়েছিলে? কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে বলতে পারতে। সময়মতো দেখা না হলে মনে রোদের ভিতর বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যেতে। ”
” সোহিনী চিংড়ি মাছ খেতে চেয়েছে। বাড়িতে চিংড়ি মাছ নেই, তাই বাজারে গেছিলাম। ”
” আমিও বাজারে গেছিলাম। তোমাকে তো দেখলাম না।”
” তোমার বাজারে কি কাজ?”
” এমনই আসার পথে কিছু বাজার-সদয় করে নিয়ে আসলাম, বাড়িতে বোধহয় বিশেষ কিছু নেই। ”
” তুমি কি করে জানো বাড়িতে বিশেষ কিছু নেই? আমি তো কিছু বলিনি। ”
” তুমি না বললেও আমিই তো বাজার করি। কোন বেলা কি রান্না হচ্ছে সে খবরও রাখি। তাই সামান্য বিষয়টা বোঝা কঠিন কিছু নয়। ”
” আচ্ছা বুঝলাম। ”
” তোমার একটা কথা রাখা হয়নি। ”
” কি কথা রাখা হয়নি?”
” চৈতী ভাবীর সাথে আবারও কথা বলে ফেলেছি। বাজারে দেখা হলো। উনি নিজে থেকে এগিয়ে এসে কথা বললেন, একসাথে বাড়ি ফিরতেও বলেছিলেন। আমি রাজি হইনি। ”
বাজারে ওকে দেখে ফেলেছি একথা ওর জানার বিষয় নয়। আমার দিকে খেয়াল করেনি। তাহলে কি আমি ভুল ভাবছি? না কি সোহাগ অভিনয় করছে? আবারও দুই রাস্তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি না। চৈতীর ব্যাপারটা লুকালে অন্য বিষয় হতো কিন্তু এখন কি বুঝবো?
” কি চিন্তা করছো? ”
” কই কিছু না তো। ”
পরিবেশ স্বাভাবিক করতে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। এই মুহূর্তে কিছু বলা উচিত হবে না। বিষয়টা নিয়ে আর একটু দেখা প্রয়োজন। মিথ্যা অপবাদ হলে সোহাগের আমার উপর দিয়ে বিশ্বাস উঠে যাবে। সুন্দর সংসার নিজের হাতে নষ্ট করে ফেলবো। এমনটা হতে দেওয়া উচিত কাজ নয়। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই, সূর্যের তাপে শরীর ঘামছে। রিকশাওয়ালা বারবার কপালের ঘাম মুছচ্ছে। তীব্র গরমে উনার খুব কষ্ট হচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটার কথা মনে পড়লো। কাছে ছাতা নেই, থাকলে আজ আমিও অমন কিছু করে বসতাম। ভালো কিছু দেখে বাহবা দিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়া হয় না। একটু সামনে একটা গলি আছে, ওই পথ দিয়ে ঘুরে বাসায় যাওয়া যায়। সময় বেশি লাগলেও রাস্তার দু’পাশে বড় বড় গাছ, পাতার ছায়ায় শীতল পরিবেশ তৈরি হয়।
” মামা সামনের গলিপথ দিয়ে ঘুরে চলেন, ওদিকে রোদ কম। গাছের ছায়া আছে। ”
” আম্মা ওই পথে বেশি ঘুল্লি পড়ে, দেরি হয়ে যাবে। ”
” সমস্যা নেই, আপনাকে ভাড়া বাড়িয়ে দেবো। ”
” আইচ্ছা। তাহলে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছি। কথা কি আম্মা আমরা গাছের ছায়া পছন্দ করি কিন্তু গাছ লাগতে চাই না৷ ”
সোহাগ উনার কথায় তাল মেলালো। এই প্রসঙ্গে নানান কথা বলবে এখন। আমি চুপচাপ শুনতে লাগলাম। লোকটা খুব কাজের কথা বলেছে, রাস্তার পাশে গাছ লাগাতে বেশিরভাগ লোকের অনিহা। নিজেদের মালিকানা থাকে না, প্রয়োজন হলেই হুটহাট গাছ কাটা যায় না। ওটা তখন রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। বিনা অনুমতিতে গাছে কাটলে জে’ল জরিমানাও হতে পারে। তাই সব গাছ লাগানো অহেতুক ঝামেলা মনে করে, কিন্তু হাঁটার সময় বেছে বেছে গাছের ছায়ায় হাঁটবে।
এ গলিতে রোদের তীব্রতা নেই বললেই চলে, চারদিকে গাছের ছায়া। কখনো কখনো পাতার ফাঁক দিয়ে রোদের গুঁড়ো রাস্তায় পড়ে আছে। পিচঢালা নীলচে-কালো রাস্তায় সোনালি রোদ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সোহাগ আমার হাত আঁকড়ে ধরে রিকশাওয়ালা সাথে গল্প করছে। মাঝেমধ্যে আমিও ওদের কথায় তাল মেলাতে লাগলাম।
বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়ে গেল। দুপুরের রান্না করতে দেরি হয়ে যাবে, এদিকে ননদীও চলে আসবে। সময় এতো হিসাব করা কেন? একদিকে বেশি সময় দিলে অন্যদিকে কম পড়ে যায়। সোহাগ দু’শ টাকার কচকচে একটা নোট রিকশাওয়ালার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এসেছে। লোকটার চোখে মুখে খুশির ছাপ, আজ হয়তো একটু তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে পারবে। পরিবারের সময় দিতে পারবে, পরিবারকে সময় দেওয়া খিব জরুরি একটা বিষয়। অনেকেই এর গুরুত্ব বুঝতে পারে না।
ঘরে ঢুকে মিনিট পাঁচেক বিশ্রাম নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। সোহাগ গোশত নিয়ে এসেছে, আবার চিংড়ি মাছ কাটতে হবে। কোনটা আগে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। আগে পেঁয়াজ রসুন বেটে, সবকিছু গুছিয়ে নেবো। তারপর রান্না শুরু করবো।
” দেখি দেখি, আমার কাছে দেও। আজকের গোশতটুকু আমি রান্না করবো। ”
সোহাগ রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো বললো। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে রান্নার জিনিস খোঁজ করতে লাগলো।
” কি হলো? কোথায় কি রেখেছে? হাতের কাছে এগিয়ে না দিলে আমি কি সব খুঁজে পাই নাকি?”
” আমাকে সবকিছু খুঁজে দিতে হলে তুমি কি খুন্তি নাড়াবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? ”
” ওই আর কি! রান্নার অজুহাতে বউকে দেখবো। ”
” নিজের বউকে দেখতে অযুহাত লাগে নাকি? জানতাম না তো। ”
” তা লাগে না। তবে এভাবে দেখায় অন্য সুখ। ”
মুচকি হেসে কাজে মন দিলাম। বকবক করে সময় নষ্ট করলে কাজ হবে না। পেঁয়াজ কাটার সময় চোখ দিয়ে চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করলো। এটা নতুন কিছু নয়। সকল গৃহিনীর কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার, আমার কাছেও তাই।
সোহাগ এগিয়ে এসে ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিলো। আদুরে গলায় বললো, ” এতো কাঁদলে হবে? ”
বিরক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, এই নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করার কি প্রয়োজন। চোখে মুখে বিরক্তর ছাপ স্পষ্ট হলেও মনে মনে খুব খুশি হয়েছি। এই অতিরিক্ত ন্যাকামির ব্যাপারগুলো নিমেষেই মন ভালো করে দিতে পারে। সোহাগ আমার বেশ কাছে। কিন্তু দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম দরজায় চৈতী দাঁড়িয়ে। গোমড়া মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, সোহাগের ঠোঁটে লেগে থাকা হাসির রেখা মুছে গেছে। কি করবো বুঝে উঠতে পারলাম না। চৈতী মলিন গলায় বললো, ” ভুল সময়ে এসে পড়েছি। আসলে দরজা খোলা ছিল তাই। সরি। ” কথাগুলো বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই দরজা দিয়ে সরে গেল।
সোহাগ আমাকে উদ্দেশ্য করে কড়া গলায় বললো, ‘ দরজা লাগতে মনে থাকে না তোমার? ”
চলবে