কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ৮

0
572

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৮
জাওয়াদ জামী

আরমান বেরিয়ে যেতেই খেঁ’কি’য়ে উঠে দাদিমা।

” ঢং করে স্বামীকে খাবার বেঁধে দিচ্ছে! নিজেকে মহান প্রমান করার চেষ্টা করছে। একেই বলে দুইদিনের ভালোবাসা। দেখব কতদিন এই ভালোবাসা থাকে। ”

” দুইদিনের ভালোবাসাই তো দাদিমা। আমি এই বাসায় এসেছি কয়েকদিন হচ্ছে। এই কয়েকিদনকে তো আর হাজার বছরের ভালোবাসা বলা যায়না। আর স্বামীকে খাবার বেঁধে দিলেই বুঝি মহান হয়ে যায়! তাহলে তো মনে হয় পৃথিবীর সকল স্ত্রীই মহান। কারন খাবার বেঁধে দেয়ার পাশাপাশি রাঁধতেও হয়। সে হিসেবে যতদিন দাদু বেঁচে ছিল আপনি তাকে রেঁধে খাইয়েছেন, তাহলেও আপনিও মহান সাজার চেষ্টা করেছেন! এমনকি আমার শ্বাশুড়িমাও! ”

” এই মেয়ে, তোমাদের কথার মাঝে আমাকে টানছ কেন? বেয়াদব মেয়ে , কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেই জ্ঞান নেই। বাবা-মায়ের কাছ থেকে শিক্ষা না পেলে যা হয়। বড়দের সম্মান দিতে জানোনা। ” আকলিমা খানম কান্তার উপর রে’গে উঠে।

” আমার বাবা-মা আমাকে শিক্ষা ঠিকই দিয়েছে। আমার মনে হয় শিক্ষায় আপনাদের ঘাটতি আছে। তাছাড়া আমি এই বাসায় নতুন, কিন্তু আপনারা শুরু থেকে যা ট্রিট করলেন! সম্মান একটা আপেক্ষিক বিষয় বুঝলেন। এটা ভালোবেসে আদায় করে নিতে হয়, জোর করে পাওয়া যায়না। আপনারা আমার সাথে যা যা করবেন, আমি আপনাদের সেগুলোই ফিরিয়ে দিব। ”

” শহিদ, তোমার ছেলের বউয়ের সাহস দেখেছ? তোমার সামনেই আমাদের সাথে বেয়াদবি করছে! তুমি মুখ বুজে এর অসভ্যতা দেখে যাবে? কিছুই বলবেনা? ”

” বউমা, তুমি কি আমার জন্য রান্না করেছ? আমার ডায়াবেটিস আছে। সকাল সকাল খুব ক্ষুধা লাগে। আরমানের সাথে যদি আমার জন্য খাবার বানাতে তবে খুব ভালো হত। মা গো, বড়দের সাথে বিনয়ী আচরণ করতে হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় তোমাকে সব অন্যায় মেনে নিতে হবে। অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করবে, যদি আমিও অন্যায় করি তখনও। ” শহিদ আহমেদ স্থির গলায় বললেন।

” আপনার কথা মনে থাকবে। বাবা, আমি আজ আপনার জন্য কিছুই বানাইনি। শুধু উনার জন্য বানিয়েছিলাম। কাল থেকে আপনার জন্যও বানাব। আপনি সকালে কি খান তাই বলুন। ”

” রুটি, পরোটা যা খুশি দিও। সকাল সকাল খেয়ে অফিস যেতে পারলে আমার জন্য সুবিধা হবে। ”

” আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি কিছু বানিয়ে নিয়ে আসছি। ” বলেই কান্তা রান্নাঘরে যায়।

এদিকে আকলিমা খানম ও তার শ্বাশুড়ি ছেলের এমন ভাবলেশহীন আচরণে রা’গে ফুঁসছে।

আরমান ওর আনা খাবারের ব্যাগ কোচিং-এ রেখে ভার্সিটির দিকে রওনা দেয়। ও ওপরে ওপরে যতই বিরক্ত হোক, ভেতরে ভেতরে খুব খুশি হয়। মেয়েটা সত্যিই গৃহকর্মে নিপুণা। আর যথেষ্ট দ্বায়িত্বশীল।

কান্তা শ্বশুরের জন্য পরোটা, করলা-আলু ভাজি তৈরি করে আনে।
শহিদ আহমেদ পুত্রবধূর এমন দ্বায়িত্বশীল আচরণে ভিষন খুশি।
তিনি খুশিমনে তিনটা পরোটা খেয়ে নেন।

শ্বশুরকে খাইয়ে কান্তা যায় কাজের খালার কাছে। তার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সবার খাবার তৈরি করে।
সবার খাওয়া শেষ হলে, লেগে পরে দুপুরের রান্নার জোগাড়ে।
খালার সাথে মিলে একে একে কয়েকরকম আইটেম রান্না করে। একবারে রাতের জন্য তরকারি রান্না করেছে। যেগুল রাতে খাবে সেগুলো সরিয়ে রেখে দুপুরেরগুলো ডাইনিং টেবিলে রেখেছে।
কান্তা সাহায্য করায় খালা খুব স্বস্তি পায়। বেচারিকে একা হাতে রান্নাঘর সামলাতে হয়। আকলিমা খানম শুধু নির্দেশ দিয়েই খালাস। সে এক গ্লাস পানিও ঢেলে খায়না।
কান্তাকে কাজ করতে দেখে তারা বউ, শ্বাশুড়ি বেশ খুশি হয়। না চাইতেও কাজের মানুষ পেয়েছে।
আসলে আকলিমা খানম এমন একটা মেয়ে আরমানের জন্য খুঁজছিল। যাকে কোন কাজের জন্য চাপাচাপি করতে হবেনা। যে মুখ বুজে আকলিমা খানমের সকল কথা মেনে নিবে। তাকে আকলিমা খানম যেমন ভাবে চালাবে সে তেমনভাবে চলবে।
আজ আকলিমা খানমের মনে হচ্ছে তার প্রথম চাওয়া পূরণ হয়েছে। কিন্তু শেষের চাওয়া বোধহয় একটু পিছিয়ে আছে।
সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, হাল ছাড়বেনা। এই মেয়েকে যে করেই হোক বশ মানিয়েই ছাড়বে।

দুপুর পর্যন্ত প্রচন্ড ব্যস্ততায় কেটেছে। রান্নাঘরে যাবতীয় কাজ সেরে কান্তা রুমে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ রেষ্ট নিয়ে, আলমিরার দিকে নজর দেয়। আলমিরা খুলে আরমানের সব পোশাক বের করে যেগুলো ধোয়ার প্রয়োজন সেগুলো ঝুড়িতে রেখে, বাকিগুলো ক্যালেন্ডার করে গুছিয়ে আলমিরাতে সাজিয়ে রাখে। প্রত্যেকটা শার্ট-প্যান্ট এমনভাবে রেখেছে, যাতে প্রয়োজনের সময় খুব সহজে হাতের কাছে পেয়ে যায়।
এরপর রুম ঝাড়ু দিয়ে, মুছে ঝকঝকে করে ওয়াশরুমে ঢোকে।
অনেক সময় নিয়ে ওয়াশরুম ধুয়েমুছে সাফ করে গোসল সেরে বেরিয়ে আসে।
এরপর জোহরের নামাজ আদায় করে বই নিয়ে বসে। ও খুব ভালো করেই জানে কেউ ওকে খেতে ডাকবেনা। শ্রীজা থাকলে ডাকত।

সবার খাওয়া হলে কান্তা রান্নাঘরে এসে খালার সাথে বসে খেয়ে নেয়। এরপর নিজের রুমে যেয়ে ভাতঘুম দেয়।

শহিদ আহমেদ সন্ধ্যায় বাসায় এসে কান্তার কাছে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেন। ড্রয়িংরুমে তখন সবাই বসে আছে।

” মা, প্যাকেট খুলে দেখ, পছন্দ হয় কিনা। এরপর থেকে তোমার যা যা লাগবে আমাকে বলবে। একটুও লজ্জা পাবেনা। মনে করবে নিজের বাবার কাছে চাইছ। ”

” জ্বি, বাবা। ” কান্তা বেশ বুঝতে পারছে ওর শ্বাশুড়ি আর দাদি শ্বাশুড়ির বিষয়টি পছন্দ হয়নি। তাই ও এটা নিয়ে কোন কথা বাড়ায়না।

কান্তা সন্ধ্যায় সবাইকে চা-নাস্তা দিয়ে রুমে যায়।

কান্তা ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে চুলে চিরুনী চালাচ্ছে। এমন সময় রুমে আরমান প্রবেশ করে। আয়নায় আরমানকে দেখে কান্তা চিরুনী রেখে উঠে দাঁড়ায়। এরপর উচ্ছ্বসিত হয়ে কিছু একটা বলতে চাইলেই মুখ খোলে আরমান।

” বিয়ের আগে ছবিতে তোমার হাঁটু বরাবর চুল দেখেছিলাম। বেশ মুগ্ধ হয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু আজ এ কি রূপ দেখালে! ‘ একই অঙ্গে অনেক রূপ ‘ এই উপমার সাথে তোমার মিল পাচ্ছি। অনেক গুণে গুণবতী তুমি। ” ইচ্ছে করেই আরমান কান্তাকে খোঁ’চা’য়।

কিন্তু আরমানের কথা শুনেই কান্তার দু’চোখ ভেঙ্গে কান্না আসে। মানুষটা কেন বুঝেনা চুল কা’টা’র কথা মনে হলেই ওর কান্না পায়। ওর কত সাধের চুল। কত যত্নে রেখেছিল এতদিন। অন্যরা কি করে বুঝবে ওর চুল হারানোর কষ্ট!
কান্তা মাথা নিচু করে কাঁদছে।

” এভাবে কাঁদছ কেন! তোমরা মেয়েরা কিছু হলেই হয় কাঁদবে, নয় কোমড় বেঁধে ঝগড়া করবে৷ এছাড়া আর কিছু কি জানোনা? এই যে আমি তোমাকে খোঁ’চা দিলাম, কিন্তু বিনিময়ে তুমি কি করলে? চুল কা’টা’র কারন না জানিয়ে, ন্যাকা কান্না জুড়ে দিলে! একটু তো শক্ত হতে শিখ। পুরাতন তুমিকে ভে’ঙে, নতুন তুমিতে রুপান্তরিত হতে কত সময় নেবে?
ওহে্ নারী রণঙ্গিনী, এবার জাগ। ”
আরমানের এমন খেয়ালী কথার মানে বুঝতে পারেনা কান্তা।
মানুষটাকে কখনো কঠিন শিলা মনে হয়, কখনো মনে হয় কাদামাটি।

” আমাকে বলে ‘ একই অঙ্গে অনেক রূপ ‘! অথচ তিনিই ক্ষনে ক্ষনে রং বদলায়, তা স্বীকার করলে তো। গিরগিটি একটা। ”
আরমান ওয়াশরুমে ঢুকলে বিরবির করে বলে কান্তা।

” সকাল সকাল রান্না করে, স্ত্রীর দ্বায়িত্ব পালন করে, এখন বুঝি শরীরে জং ধরেছে! এক দিনেই এই অবস্থা! তবে বাকি জীবন সংসার করবে কেমন করে? আজ রাতে বোধহয় খাবার জুটবেনা। আরমান কপাল গুণে এমন একটা বউ পেয়েছিস। ”
আবারও সেই খোঁ’চা! কান্তা বুঝতেই পারেনি আরমান কখন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।
কান্তা ভেতরে ভেতরে ফুঁ’স’ছে। কোন উত্তর না দিয়ে আরমানের দিকে তাকিয়ে আছে।

” এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছ কেন! আজকাল পেটের ক্ষুধা কি চোখে ট্রান্সফার হয়েছে? পেটের ক্ষুধার ঔষধ খাবার এটা আমার জানা আছে। কিন্তু চোখের ক্ষুধার ঔষধ কি তা জানা নেই। আচ্ছা, চোখ তু’লে ফেললে কি চোখের ক্ষুধা যায়? মেডিসিন মন্দ নয়, কি বল? এ্যাপ্লাই করব নাকি? ”
কান্তা এবার হকচকিয়ে যায়। এটা কি মানুষ নাকি হ’নু’মা’ন!
কিন্তু ও মুখ খুললেই আবার এই লোকটা খো’চা মারবে। তাই কিছু না বলে রান্নাঘরে যায়।

এদিকে কান্তা রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই আরমান হা হা করে হেসে উঠে। আচ্ছা জব্দ করেছে মেয়েটাকে।

কান্তা খাবার দিয়ে একে একে সবাইকে খেতে ডাকে।
শহিদ আহমেদ বাসায় ছিলেন। কান্তা ডাকতেই তিনি ডাইনিং টেবিলে আসেন। শ্রীজা, আকলিমা খানম, দাদিমাও আসে।

কান্তা আরমানকে ডাকতে আসে।

” ডাইনিং টেবিলে আসুন। সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। ”

” আমি কোথাও যাচ্ছিনা। পারলে খাবার রুমে নিয়ে আস, নইলে আমি বাইরে থেকে খেয়ে আসব। ” ফোন টিপতে টিপতে জবাব দেয় আরমান।

” খুব তো অন্যকে জ্ঞান দিতে পারেন। কিন্তু নিজের বেলায় ঠনঠনাঠন। আমি টেবিলে খাবার দিয়েছি। বাবাকে বলে এসেছি আপনি তার সাথে খাবেন। এখন আপনি যদি সেখানে না যান, তবে কোন অসুবিধা নেই। শুধু আমি সবার কাছে অপমানিত হব। আর আমার অপমানে কার কি যায় আসে। দয়া করে এই বাসায় আমাকে এনেছেন এই অনেক। তাছাড়া.. ”
কান্তাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে আরমান দরজার দিকে যায়।

” হয়েছে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা? এবার এস আমার ক্ষুধা লেগেছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। তোমার দেয়া সব খাবার দুইজন স্টুডেন্ট খেয়ে নিয়েছিল। ” আরমান গটগটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

আরমানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কান্তা মুচকি হাসছে। লোকটাকে বোকা বানাতে পেরে ওর খুব ভালো লাগছে।

ছেলেকে চেয়ার টেনে বসতে দেখে শহিদ আহমেদ ভিষণ খুশি হন। কতদিন পর ছেলেটা তার সাথে বসে খাবে৷

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here