কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ৩৮

0
719

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩৮
জাওয়াদ জামী

” ভাইয়া, আমাদের প্রিন্সেসের নাম কি রাখবে বলতো? আমি গতকাল থেকে অনেক খুঁজেও মনের মত নাম পাইনি। ” শ্রীজা প্রিন্সেসকে আদর করতে করতে আরমানকে জিজ্ঞেস করে। আরমান তখন ব্যাগ গোছাচ্ছিল। ও আগামীকাল সকালেই চিটাগংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। আর কান্তা মেয়ের পাশে শুয়ে আছে। ওর শরীর ভিষণ ক্লান্ত।

” আইরিন বিনতে আরমান কায়া। তোদের সুবিধার্থে ছোট নাম হিসেবে ‘ কায়া ‘ রেখেছি। ” আরমান কাজের ফাঁকে জবাব দেয়।

” দাদিমার দেয়া নাম রেখেছ, ভাইয়া! ” শ্রীজা স্তম্ভিত।

” কেন তোর পছন্দ হয়নি? ”

” কেন পছন্দ হবেনা! তুমি কি অপছন্দ হওয়ার মত নাম রেখেছ! ভাবি তোমার পছন্দ হয়েছে? ”

” খুউউব পছন্দ হয়েছে। ”

” আমি যেয়ে সবাইকে প্রিন্সেসের নামটা জানিয়ে আসি। ” বলেই এক দৌড়ে রুম ছাড়ে শ্রীজা।
আরমান ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে হাসে।

” আবার কবে আসবেন? ” মন খারাপ করে আরমানকে জিজ্ঞেস করে কান্তা।

” আগামী পনের দিনের মধ্যে আসতে পারবনা এই গ্যারান্টি দিতে পারি। ”

” তবে কি আপনার প্রিন্সেসের আকিকা আপনাকে ছাড়াই হবে? এতটা পাষাণ আপনি কবে থেকে হয়েছেন! ” কান্তার কথা শুনে হাতের কাজ রেখে কান্তার দিকে এগিয়ে আসে আরমান।
দুই হাতের আঁজলায় কান্তার মুখ নিয়ে একটু উঁচু করে।

” আমি পাষাণ হইনি। আর কোনদিন হবওনা। যার কাছে তোমার মত স্ত্রী আছে, একটা পুতুলের মত প্রিন্সেস আছে, সেই পুরুষ কখনও পাষাণ হতে পারেনা। সে হয় মহাপ্রেমিক, পাগল স্বামী আর শ্রেষ্ঠ পিতা। আমিও তেমনি একাধারে মহাপ্রেমিক ,পাগল স্বামী আর শ্রেষ্ঠ পিতা হওয়ার চেষ্টায় আছি। সেই সার্টিফিকেট একমাত্র তুমিই দিতে পারবে। ”

” আপনি অলরেডি সেই উপাধিগুলো অর্জন করেছেন। একশোয় একশো নম্বর পেয়েছেন আপনি। কিন্তু আমি এই পনের দিন আপনাকে ছাড়া থাকব কেমন করে! আর আপনিও কি আপনার প্রিন্সেসকে না দেখে থাকতে পারবেন? ”

” আমার কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে। তুমি ঢাকা আসার পর থেকে নিয়মিত অফিস করা হয়না। বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে বারবার ঢাকা আসতে হয়েছে। এবার আর তা করতে পারবনা। তুমি কষ্ট করে এই কয়েকটা দিন থাক। আমি পনের দিন পর এসে তোমাদের নিয়ে যাব। ”

” আমি পনের দিন পর চলে গেলে বাবা-মা যে কষ্ট পাবে। তারা কেবলমাত্র নাতনিকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে আছেন। তাদের এই উচ্ছ্বাসে আমি বাঁধা দিই কেমন করে! আমি একমাসের আগে এখান থেকে যেতে পারবনা যে। ” কান্তা মুখ ভার করে বলে।

” তবে এই একটা মাস আমাকে ছাড়াই একটু কষ্ট করে থাক। আমি চেষ্টা করব ছুটি নিতে। তোমাদের ছেড়ে থাকতে আমারও কষ্ট হবে। ” আরমান কান্তার পুরো মুখে আর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায়।

জাবেদ ঘরে বসে স্কুলের কাজ করছে। তার পাশে আরাফ বই নিয়ে বসে আছে। শিখা ঘর গোছাচ্ছে। আলমিরাতে কাপড়চোপড় রাখতে যেয়ে একটা প্যাকেট পায় শিখা। কৌতুহলবশত সেটা খুলে দেখে সে। প্যাকেট খুলতেই দুইটা বাক্স পায় সে। গহনার বাক্স। অবাক হয়ে বাক্স দুটো খুলতেই শিখা দেখল একটাতে সোনার চেইন সাথে কারুকার্যখচিত লকেট আর একজোড়া সোনার দুল। আরেক বাক্সে ছোট একজোড়া সোনার চুরি। শিখা ভাবছে ও নিজেতো এগুলো কিনেনি, তাহলে এগুলো অবশ্যই জাবেদ কিনেছে। কিন্তু কার জন্য এগুলো কিনেছে সে? আর ওকেই বা জানায়নি কেন?

” এগুলো কার জন্য কিনেছ? আমাকে দেখাওনি কেন? ” চুরি জোড়া হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে শিখা।

” দেখানোর প্রয়োজন মনে করিনি তাই দেখাইনি। সবকিছু যে তোমাকে দেখিয়েই করতে হবে, এটা কি কোথাও লেখা আছে? তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করে কেন সেগুলোতে হাত দিয়েছ? সেগুলো যেমন ছিল তেমনভাবে রেখে দাও। ” বিরক্তি নিয়ে জবাব দেয় জাবেদ।

” তুমি সংসারের ক্ষতি করে কার না কার জন্য এসব কিনেছ, আমি জিজ্ঞেস করলেই দোষ? কার জন্য কিনেছ এসব? আমার সংসার ধ্বংস করে লুকিয়ে লুকিয়ে কাকে এসব দিবে? ”

” এই সংসার শুধু তোমার নয়, আমারও। তোমার থেকে সংসারের ওপর মায়া আমার কম নেই। তুমি যখন নিজের বোনকে সোনার দুল, রিং, চেইন গড়িয়ে দিয়েছ, বড় বোনের মেয়েকে চেইন দিয়েছ, মামাত বোনের মেয়েকে চেইন দিয়েছ, মামাতো ভাইয়ের ছেলেকে ব্রেইসলেট দিয়েছ, তোমার ভাইকে চেইন দিয়েছ তখন সংসারের চিন্তা কোথায় ছিল? তখন আমি কি একবারও তোমাকে কোন প্রশ্ন করেছি? আজ আমি যখন এই সামান্য জিনিসগুলো এনেছি, তখন তোমার এত প্রশ্ন কেন? ওগুলো যেখানে ছিল সেখানেই চুপচাপ রেখে দাও। ”

জাবেদের খোঁটা শুনে মিইয়ে যায় শিখা। কিন্তু ও দমবার পাত্রী নয়। পূর্ণদমে আবারও কথা বলে।

” আমি আমার কাছের মানুষদের দিয়েছি। এতে কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু তুমি এসব কার জন্য কিনেছ? তোমার কাছের কে এমন আছে? ” সন্দেহের সাথে জিজ্ঞেস করে।

” কেন, আমাকে কি তোমার বেওয়ারিশ মনে হয়? আমার কি কোন আত্মীয়, আপনজন থাকতে পারেনা? তুমি আমার সংসারে আসার আগ পর্যন্ত আমার সবকিছু ছিল। কিন্তু তুমি এসে সবাইকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করেছ। আমার আত্নীয়-স্বজনদের অকারনে অপমান, অসম্মান করে, নিজের বাপের বাড়ির সবাইকে নিয়ে মেতে থেকেছ। অথচ আমার আত্মীয়স্বজনদের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা তোমার বাপের বাড়ির কারও নেই। ”

” তুমি আমাকে কি মনে করেছ? আমি তোমার কেনা পুতুল? যখন যা ইচ্ছা তাই বলবে? তোমার সব আত্মীয় স্বজনরা লাটসাহেব আর আমার বাপের বাড়ির সবাই ফকির? তুমি কার জন্য এসব কিনেছ? এক কথায় জবাব দাও। ” শিখা এবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে।

আরাফ মায়ের এরূপ উচ্চবাচ্য দেখে মনে মনে বিরক্ত হয়, কিন্তু কিছু বলার সাহস পায়না।

” আমার ভাগ্নীর জন্য এগুলো কিনেছি।” উত্তর দিয়ে নিজের মত কাজ করতে থাকে জাবেদ।

” ভাগ্নী! তোমার ভাগ্নী আবার কে? কোথায় থেকে আবার তোমার ভাগ্নী গজালো? ”

” ভালোভাবে কথা বল। আমার ভাগ্নী কে হতে পারে, কোথায় থেকে আসতে পারে এটা বুঝতে হলে নিশ্চয়ই তোমাকে পিএচডি ডিগ্রীধারী হতে হবেনা। ” জাবেদের চোখমুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে শিখা একটু ভয় পায়। বেশ কিছুক্ষণ ভাবনার পরও ওর খটকা যায়না।

” তবে কি তোমার বোনের মেয়ে হয়েছে? ”

” হুম। ”

” কবে? তোমাকে খবর দিয়েছে? নাকি বেহায়ার মত তুমি যেচে ফোন করেছ? ”

” বোনের খবর নিতে গেলে যদি বেহায়া হতে হয়, তবে আমি এক হাজার বার বেহায়া হতে রাজি আছি। এতে তোমার সমস্যা হচ্ছে কেন? ”

” তোমার বোনের মেয়ে হয়েছে ভালো কথা। কিন্তু এই অভাবের মধ্যে এতগুলো জিনিস কেন কিনলে? তোমার বোনের স্বামী নাকি এএসপি হয়েছে। সে কি দিয়েছে তোমার ছেলেকে? যে আজ তার মেয়ের জন্য তুমি এত কিছু কিনেছ? ”

” বিয়ের পর আমার বোনকে কয়দিন নায়র এনেছ তুমি? আরমানকে কয়দিন জামাই আদর করেছ যে ছেলের জন্য আশা করছ? কিছু পেতে কিছু দিতে হয়। এই কথাটা বোধহয় তোমার জানা নেই? তুমি তাদেরকে কিছু না দিয়েই, ছেলের জন্য পেতে চাচ্ছ? তা তোমার বাপের বাড়িতে যে এতকিছু দিয়েছ, তারা আমাকে কি দিয়েছে? ঐ বছরের একটা ঈদে পাঞ্জাবি ছাড়া কিছুইতো দেয়না। আর আমার ছেলের হাতে পাঁচশো টাকা ধরিয়ে দিয়ে দ্বায়িত্ব সাড়ে। তবুও তুমি তাদের পেছনে হাজার হাজার টাকা খরচ কর কেন? তখন সংসারের অভাবের কথা চিন্তা হয়না? ”

এবার শিখার মুখ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ও ভেতরে ভেতরে রাগে গজরাতে থাকে। জাবেদ কান্তার মেয়েকে এত কিছু দিবে, সেটা ও মানতেই পারছেনা।

আরমান গতকালই চিটাগং চলে গেছে। কান্তা মেয়েকে নিয়ে অলস সময় পার করছে। মেয়েকে খাওয়ানো ছাড়া কোন কাজই করতে হচ্ছেনা ওকে। আকলিমা খানম দুইজন কাজের মেয়ে রেখেছে কান্তা আর ওর মেয়ের কাজ করার জন্য। বসে থেকে ওর হাত-পায়ে খিল ধরে গেছে। আরমান আধাঘন্টা পরপর ফোন করে ওদের খবর নিচ্ছে। সুযোগ পেলেই ভিডিও কলে মেয়েকে দেখে নিচ্ছে। এ নিয়ে বাসার সবাই হাসাহাসি করছে। শ্রীজা পদে পদে কান্তাকে খোঁচাতে ছাড়ছেনা।

দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই ড্রয়িংরুমে বসে আছে। শ্রীজা প্রিন্সেসকে কোলে নিয়ে ওর মায়ের সাথে গল্প করছে। খালা কান্তার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে। কান্তার চুল এখন অনেকটাই বড় হয়েছে। কোমড় ছুঁয়েছে ওর ঘন কালো চুলগুলো। খালা সুন্দর করে ওর চুলে বিলি কাটছে। এতে একটু তন্দ্রাভাব আসে কান্তার।

গল্পগুজব, হাসিঠাট্টার মাঝেই কলিং বেল বেজে ওঠে। একজন মেইড উঠে যেয়ে দরজা খুলে দেয়। কিন্তু সে আগন্তুককে চিনতে না পারায় আকলিমা খানমের শরণাপন্ন হয়। আকলিমা খানমও যেতে পারছেনা। তাকে কেবলমাত্র হুইচ চেয়ার থেকে সোফায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে। বাধ্য হয়ে শ্রীজাকে উঠতে হয়। ও প্রিন্সেসকে কোলে নিয়েই দরজার কাছে যায়।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটিকে দেখে প্রথমে চিনতে না পারলেও কয়েক মুহুর্ত পর বুঝতে পারে এরা কারা। সে হেসে তাদের ভেতরে আসতে বলে।

আগন্তুককে নিয়ে ভেতরে আসতেই কান্তার চোখ যায় সেদিকে। ও অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায়। দুই বছর পর ও ভাই আর ভাতিজাকে দেখছে।

জাবেদ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ শ্রীজার কোলে থাকা পুতুলের দিকে৷ একটু পর দারোয়ান চাচা মালিকে সাথে নিয়ে ভেতরে আসে। তাদের হাতে অনেক জিনিসপত্র।

কান্তা এতদিন পর ভাইকে দেখে আবেগে কেঁদে ফেলে। দ্রুত পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে আরাফকে। দুই বছরের ব্যবধানে ছেলেটা কত বড় হয়েছে! কে বলবে, এই ছেলে একদিন ফুপুর ন্যাওটা ছিল! ফুপুর ওড়নার কোনা ধরে এটাসেটা বায়না করত!

আরাফকে বুকে জরিয়ে নিয়ে হুহু করে কেঁদে ফেলে কান্তা। জাবেদের চোখেও পানি।

এদিকে শ্রীজা জিনিসপত্রের কথা দারোয়ান চাচাকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানায়, এসব জাবেদ এনেছে।

আকলিমা খানমের সাথে জাবেদকে পরিচয় করায় কান্তা। আকলিমা খানম হেসে তাকে বাড়িতে স্বাগত জানায়।

বিঃদ্রঃ আপনাদের দেয়া নামের মধ্যে থেকে ‘ কায়া ‘ নামটি রাখলাম আরমান-কান্তার প্রিন্সেসের জন্য। অনেকেই ইনবক্সে আমাকে অনুরোধ করেছিল এই নামটি রাখবার জন্য। আপনারা যারা অন্য নাম সাজেস্ট করেছিলেন, সবগুলো নামই সুন্দর ছিল। অনেক অনেক ভালোবাসা রইল আমার পাঠক মহলের জন্য।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here