কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ২৩

0
524

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_২৩
জাওয়াদ জামী

রাতে খাবার পর ওরা আবার পুরোনো কথা আলোচনা করছে।
আরমান কথার মধ্যেই লক্ষ্য করল শ্রীজা সেখানে নেই। ও সোফা ছেড়ে শ্রীজার খোঁজে যায়।
বারান্দার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে শ্রীজা সূদুর পানে তাকিয়ে আছে।

” শ্রীজু, তুই এখানে, এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন! চল, ড্রয়িংরুমে, চল। ” শ্রীজার হাত ধরে আরমান ওকে নিয়ে আসতে চায়।

” ভাইয়া, আমরা সবাই তোমার উপর অবিচার করেছি, তাইনা? আমার মা খুব খারাপ। সে আর দাদিমা মিলে তোমার শৈশব, কৈশোর কেড়ে নিয়েছে। মায়ের মেয়ে হিসেবে তার সকল পাপের ভাগীদার বোধহয় আমিও তুমি ওদের ঘৃ’ণা কর, আমাকে করনা? ” শ্রীজা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।

” ওদের সাথে নিজেকে কেন জড়াচ্ছিস! আমি ওদের ঘৃ’ণা করি এটা ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে তোকে কিংবা শুভকে ঘৃ’ণা করার কথা ভাবতেও পারিনা। তোরা আমার ভাই-বোন। যদি কোন ভুল করে থাকিস, তবে সেটা শোধরানোর দ্বায়িত্ব বড় ভাই হিসেবে আমার। চোখ মোছ পা’গ’লী মেয়ে। এসব আজেবাজে ভেবে তুই মন খারাপ করছিস! আর মনে রাখিস, মায়ের মত আপন কেউ হয়না। সে যতই ব্যক্তি হিসেবে খারাপ হোকনা কেন, মা হিসেবে সব সময়ই পারফেক্ট হয়। তাই এসব ভাবনা কখনোই মনে ঠাঁই দিবিনা। ” আরমান নিজে বোনের চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।

” বউমা, শোন কাল তোমার অপর দুই মামা শ্বশুরও তোমার বাসায় আসছে। আমি তাদের ফোন করে আরমানের কথা জানিয়েছি। তারা সব শুনে রাতেই আসতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি তাদের নিষেধ করেছি। তারা আগামীকাল সকাল সকাল চলে আসবে। ” আরমানের মামা আতিক উচ্ছ্বসিত হয়ে কান্তাকে বললেন।

” ভালো করেছেন, মামা। আমিই আপনাকে বলতাম তাদের এখানে আসার কথা। তারা আসলে আমার খুব ভালো লাগবে। আচ্ছা মামা, বড় মামারা কি করেন? ”

” আমার বড় ভাই শিক্ষা অফিসার, মেজো ভাই এস আই। আর আমার বড় আপা স্কুল শিক্ষিকা, মেজো আপা গৃহিণী। আমার দুই আপা ঢাকায় থাকে, তাদের পরিবারের সাথে। আর বড় ভাইয়ের পোস্টিং গাজীপুর। আর মেজো ভাই থাকেন ময়মনসিংহ। আর তোমার এই অধম ছোট মামা একটা হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক। তোমার বাবার বাড়ি কোথায় বউমা? ”

” আমার বাবার বাড়ি নাটোর। তবে বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। শুধু দুইটা ভাই আছে। ”

” নাটোর! আমি কিন্তু নাটোর গিয়েছি। মেজো ভাইয়ের সেখানে পোস্টিং ছিল। সে দুই বছর সেখানের সদর থানায় ছিল। আমি দুই বছরে দুইবার সেখানে গিয়েছি। ”

” ওহ। এরপর আবার… কান্তা কথা শেষ করতে পারেনা। সেখানে আরমান আসে।

” মামা, আমার এই বোনটাকে আপনি চেনেন? আমার কিন্তু এই একটাই ছোট বোন। ”

” দুই-একবার বোধহয় দেখেছি। কিন্তু কথা হয়নি। তাইনা মা? ” মামা শ্রীজাকে প্রশ্ন করেন।

” হুম, মামা। তবে আমি জানতামনা আপনি মামা হন। তাদেরকে আপনার কথা জিজ্ঞেস করলে ধমকে রুমে পাঠিয়ে দিত। আমি যদি জানতাম, তবে ভাইয়াকে কবেই জানিয়ে দিতাম। ”

” তুমি আমার কথা শুনে মন খারাপ করেছ, মা? আমার কথায় যদি তোমার মন খারাপ হয়ে যায়, তবে আমি লজ্জিত। এতদিন পরে ভাগ্নেকে খুঁজে পেয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। ”

” আমি মোটেও মন খারাপ করিনি। কিন্তু নিজের মা আর দাদিমার কু’ক’র্মে’র জন্য লজ্জা পেয়েছি। মানুষ কতটা নীচ হতে পারে তাদের দেখেই জেনেছি। ” শ্রীজার চোখে আবার পানি জমা হয়।

” শ্রীজাপু, তুমি এভাবে বলোনা। ”

” শ্রীজু, আবারও শুরু করলি। আমি তোকে কি বলেছি, সেসব ভুলে গেলি? ”

এভাবে কেটে গেল আরও কিছু সময়।
মামা ঘুমাতে যায়।
এবার ওদের শোয়ার পালা। কিন্তু বাসায় দুইটামাত্র রুম। তার একটাতে মামা ঘুমিয়েছে। আর একটাতে কান্তারা ঘুমাবে। এখন সমস্যা হল শ্রীজা আর খালা কোথায় ঘুমাবে।
আরমান ওদেরকে রুমে ঘুমাতে বলে। ও কোথায় ঘুমাবে, শ্রীজা জিজ্ঞেস করলে, ও জানায় ড্রয়িংরুমে ঘুমাবে। কিন্তু খালা ও শ্রীজা নারাজ আরমানকে নিজের রুম ছেড়ে অন্য কোথাও ঘুমাতে দিতে।

” ভাইয়া, তুমি তোমার রুমেই ঘুমাবে, বুঝলে? আমি আর খালা রান্নাঘরে ঘুমাব। এই নিয়ে তোমার কোন কথাই শুনবনা। আমি আর খালা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ” শ্রীজা একগুঁয়ে গলায় বলে।

” এসব কি ধরনের কথা বলছিস তুই? তোরা রান্নাঘরের মেঝেয় ঘুমাবি আর আমি বড় ভাই হয়ে বিছানায় আরাম করে ঘুমাব! তুই ভালো করেই জানিস, তা কখনোই হবার নয়। তাছাড়া খালার যেখানে ঐ বাড়িতে আলাদা রুম ছিল, সেখানে আমি আজ এমনটা হতে দিতেই পারিনা। ”

” বাপজান, তুমি এমন কইরা কইতাছো ক্যান? এক রাইতেরই তো ব্যাপার। আমরা দুই মা আর মাইয়া গল্প কইরা রাইত পার কইরা দিমু। আমরা কি পরের বাড়িতে আছি? তুমি আর কতা কইওনাতো। যাও তুমি শুইয়া পর। আমরা বিছানা কইরাই শুইয়া পরমু। ”

” ঠিক, ঠিক, ঠিক। ভাইয়া, তোমার কোন কথাই এই মুহূর্তে শোনার ইচ্ছে নেই। আমাদেরকে নিজের মত থাকতে দাও। এরপরও যদি বেশি কথা বল, তবে সারারাত না ঘুমিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে কাটাব। ”

ওদের জেদের কাছে আরমান হার মানে। ওদেরকে রান্নাঘরে ঘুমাতে দিতে রাজি হয়। তবে ওর ভিষন খারাপ লাগছে।

” শ্রীজাপু, আমিও তোমাদের সাথে ঘুমাব। তার আগে তিনজন মিলে অনেক গল্প করব। খুব মজা হবে কিন্তু। ” কান্তা আনন্দে টগবগিয়ে বলে।

” এ্যাহ, এসেছে আমাদের সাথে ঘুমাতে! আমরা তোমাকে আমাদের কাছে নিলে তো। তুমি নিজের রুমে যেয়ে নাক ডেকে ঘুমাও, কে বারণ করেছে। আমাদের কাছে তোমার কোনও জায়গা নেই। ” শ্রীজা কান্তার ওপর একটু রেগেই গেছে। ওদের দু’জনকে একসাথে রাখতেই ওরা রান্নাঘরে ঘুমাচ্ছে, আর এই মেয়ে কিনা বলে ও তাদের সাথে ঘুমাবে।

শ্রীজার ধমক শুনে কান্তা আর কিছু বলেনা।
এদিকে আরমান ওদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে মনে মনে হাসে।

কান্তা বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে।

” কি হল, এমন তিরতির করে নড়ছ কেন? নিজেও ঘুমাও, আমাকেও ঘুমাতে দাও। ”

” আপনি ঘুমান। আমি কি আপনাকে বিরক্ত করছি, নাকি ধাক্কা দিচ্ছি! আমি তিরতির করে নড়াচড়া করব না লাফাব সেটা আমাকেই বুঝতে দেন। ”

” মাথা হট হয়ে আছে মনে হচ্ছে! কি ঘটল আবার? যাইহোক, তোমার একটা ধন্যবাদ পাওনা আছে। ”

” বাব্বাহ্, আপনি কাউকে ধন্যবাদ দিতে জানেন! কিন্তু আমি আবার কি করলাম! আমাকে এত সম্মানিত করার কারন কি? কান্তারে, তোর কপাল দেখছি আজ ওপেন হয়ে গেছে! ”

” কানের নিচে একটা দিব। খালি টিটকারি মারার তালে থাক? যত দিন যাচ্ছে, ততই বেয়াদব হচ্ছ। ”

” আপনি না বললেন, আমাকে ধন্যবাদ দিবেন। তো দেরি করছেন কেন! তারাতারি দিয়ে ফেলুন। আমার আবার অত সময় নেই।”

” আজকাল মনে হচ্ছে তোমার একটু বেশিই ভাব হয়েছে? কাউকে পাত্তা দিচ্ছনা! ”

” আমার ভাব হবেনা তো কি আপনার ভাব হবে? হাজার হোক আমার জামাই বিসিএস ক্যাডার। বউ হিসেবে আমার ভাব নেয়া কি উচিত নয়? ”

” তোমার জামাই বিসিএস ক্যাডার। তবে আমি কে? ”

” আপনি খোঁ’চা’র ওপর পিএইচডি ডিগ্রিধারী, আমার য’ম। ”

” তারপর? শুধু এতটুকুই? ”

” আপনি শ্রীজাপুর বড় ভাই, গোমড়ামুখো বুড়ো, বদের হাড্ডি আরমান। ”

” ব্যাস, আর কিছুই নই? তবে তোমার কে? ”

” ঐযে বললাম, আমার য’ম। যে খালি সময়-অসময়ে আমাকে ধমকায়। ”

” তোমার সব ব্যবস্থা হবে অ্যাডমিশনের পর। কিছুদিন দূরে ছিলাম, তাতেই এত বেড়েছ। একবার নিজের কাছে নিয়ে যাই, তারপর বোঝাব আমি কে। য’ম নাকি অন্য কিছু। ”

” আপনার সাথে গেলে তো। ”

” তো কার সাথে যাবে? কে সে দুর্ভাগা ব্যক্তি! আমাকে রেখে কার ঘাড় ভা’ঙ্গা’র প্রস্তুতি নিচ্ছ? যাক অবশেষে তোমার সুবুদ্ধি হয়েছে। এজন্য আরেকটা ধন্যবাদ তুমি পাবে। ”

আরমানের এই কথা শুনে রা’গে কান্তার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। বদ লোক এসব কি বলছে?
ও রেগে আরমানের পেটে, বুকে, পিঠে কয়েকটা ধপাধপ লাগিয়ে দেয়। ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে দেয়। রা’গ একটু প্রশমিত হলে ধপ করে বালিশে মাথা দেয়। ওপাশ ফিরে চুপটি করে শুয়ে থাকে।

সকালে নাস্তার পর, কান্তা সব পরিষ্কার করে দুপুরের রান্নার জোগাড় করছিল। আজ মামা আছে, তাই একটু তারাতারি সব কাজ করে রাখছে।
আরমান মামার সাথে বসে গল্প করছে।
কান্তা সবজি কাটতে কাটতে লক্ষ্য করল, মামা বাইরে গেল, আর আরমান সোফায় বসে ফোনে কিছু একটা করছে।

কিছুক্ষণ পর বেশ কয়েকজন মিলে হুড়মুড়িয়ে বাসায় প্রবেশ করে। চারজন পুরুষ এবং পাঁচজন নারী প্রবেশ করেছে বাসায়।
আরমান তাদেরকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু ও কাউকে চিনতে পারছেনা।

” তুমি আরমান! আমাদের সেই ছোট্ট আরমান! ” একজন বয়োবৃদ্ধা এসে আরমানের চোখেমুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে।

” একদম আইরিনের মত দেখতে হয়েছ! ঠিক যেন আইরিন আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! তোমাকে কত খুঁজেছি। ” আরেক মধ্যবয়স্ক নারী ডুকরে কেঁদে উঠেন।

আরমান তাদের চিনতে না পারলেও বুঝতে পারছে তারা কে হতে পারে।

ড্রয়িং রুম থেকে আসা কান্নার আওয়াজে কান্তাও এক পা দু পা করে সেদিকে আসে।
সেখানে উপস্থিত সবার চোখে পানি।
সবার কথাবার্তা শুনে কান্তা বুঝতে পারে তারা আরমানের মামা এবং খালা।

আরমানের আজ নিজেকে খুব সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। সে সব পেয়ে গেছে। এখন শুধু মা’কে ফিরে পাওয়ার পালা।

সবার সাথে কথা বলে, গল্পগুজব করে, হাসি-ঠাট্টায় কেটে গেছে কয়েক ঘন্টা। এখন তাদের ফিরে যাবার পালা।
আরমানের দুই খালা কান্তাকে একজোড়া সোনার বালা, আর একজোড়া সোনার দুল উপহার দিয়েছে। তারা তাদের ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে কান্তার কথা শুনে, আসার পথে সেসব কিনে এনেছে।
আর আরমানের দুই মামা শাড়ি এনেছে।
শেষ বিকেলে সবাই আরমানের বাসা থেকে বিদায় নেয়।
আরমান যাবে রাত আটটার গাড়িতে।

গত রাতের পর থেকে কান্তা আরমানের সাথে নিজের বলেনি। সবার সাথে প্রানখুলে কথা বললেও আরমানকে এড়িয়ে চলেছে।

আরমান রুমে এসে ব্যাগ গোছাচ্ছে। কান্তা আরমানের জন্য খাবার সাজাচ্ছে। ও আরমানের সাথে তার কয়েকদিনের খাবার বেঁধে দিবে। তাই সব গোছগাছ করছে।
সব কাজ শেষ করে কান্তা রুমে আসে। ততক্ষণে আরমানের ব্যাগ গোছানো শেষ।
কান্তা রুমে এসে ওর সাথে কথা না বলে নিজের মত কাজ করতে থাকে।
কান্তা রুমের এদিক-ওদিক হাঁটছে আর এটা-সেটা গোছাচ্ছে।
আরমান আঁড়চোখে কান্তার কাজকর্ম দেখছে।
এবার আর সে বসে থাকতে পারেনা। উঠে যেয়ে কান্তার হাত ধরে এক টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। টুপ করে চুমু দেয় কান্তার গালে।
কান্তা তখনও নিশ্চুপ।

” বিসিএস ক্যাডারের ভাব ওয়ালি বউয়ের বুঝি খুব বেশি রা’গ হয়েছে? এত রা’গ করলে বি পি হাই হয়ে যাবে। তখন খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মিষ্টি খাওয়া যাবেনা। আর মিষ্টিই যদি না খেতে পার, আর তখন জামাইয়ের প্রমোশনের মিষ্টি খেতে পারবেনা। তোমার সাধের কাঁচাগোল্লা খেতে পারবেনা। ভেবে দেখেছ তোমার কত লস হয়ে যাবে? ”

” আপনার প্রমোশনের মিষ্টি খেতে আমার বয়েই গেছে। আপনার মিষ্টি আপনিই খেয়েন। ”

” কি রান্না করলে? আমি কিন্তু কিছু নিতে পারবনা। ”

” আপনি নিবেননা, আপনার ঘাড় নিবে। আমি সব গুছিয়ে রেখেছি। নিয়ম করে খাওয়াদাওয়া করবেন। কোনরূপ অনিয়ম করবেননা। নিজের খেয়াল রাখবেন। ” কথাগুলো বলতে বলতে কান্তা কেঁদে ফেলে।
ওকে শান্ত করতে আরমানের বেশ বেগ পেতে হয়। তবে পুরোপুরি শান্ত ও হয়না। থেকে থেকেই কেঁদে ওঠে।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আরমান কান্নারত কান্তাকে রেখেই বেরিয়ে যায় ওর গন্তব্যে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here