কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ১৭

0
603

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_১৭
জাওয়াদ জামী

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর স্বম্বিৎ ফিরে কান্তার। ও দৌড়ে রুমে আসে। ততক্ষণে আরমান রুমে চলে গেছে।
রুমে ঢুকে কান্তা আরমানকে দেখতে পেলোনা। চোখের পানি মুছতে মুছতে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়।
আরমান মেঝেতে মাথা নিচু করে বসে আছে। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। যেন মনযোগ দিয়ে দেখছে টাইলসের নকশা।

কান্তা দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আরমানের পাশে যেয়ে বসে। এক ঝটকায় আরমানের বাহু জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয়।

” আমি এতদিন ভেবে এসেছি, আমিই বোধহয় সবচেয়ে বেশি দুঃখী, আমিই শুধু কষ্ট করেছি। আজকে আমার সেই ভুল ধারণা ভে’ঙে গেছে। আমি আ’ঘা’ত পেয়েছি ভাই-ভাবীর কাছ থেকে। কিন্তু আঘাত পেয়েছেন নিজের বাবার কাছ থেকে, দাদির কাছ থেকে। আমার ভাইদের বোনপ্রীতি ছিলনা, তাই সহজেই ভাবীদের কু’ম’ন্ত্র’ণা’য় তারা দিশা হারিয়েছে। কিন্তু একজন বাবা কিভাবে তার সন্তানকে দূরে ঠেলে দিতে পারে! যার জন্য আপনাকে কত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। আপনার আ’ঘা’তে’র তুলনায় আমার আ’ঘা’ত কিছুইনা। এত কিছুর পরও আপনি এখানে কেন পরে আছেন! ”

আরমান প্রথমে কান্তার এমন কান্ডে হকচকিয়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নেয়। হাসি ফুটে ওঠে ওর ঠোঁটের কোনে।

” এই মেয়ে, তুমি এভাবে কাঁদছ কেন! শোন, জীবনে কষ্ট করেছি বলেই আজ এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। শহিদ আহমেদের করা অবহেলায় আমি নিজেকে চিনতে শিখেছি। রাজিয়া খানমের কথার আ’ঘা’ত, শারিরীক আ’ঘা’ত কিংবা আকলিমা খানমের করা অ’ত্যা’চা’র আমাকে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। আমার সাথে হওয়া অবিচারের কারনেই আমার ভেতরে বড় হওয়ার জিদ চেপেছিল। এতটা বড় হতে চেয়েছিলাম, যতটা বড় হলে কেউ আর অপমান করার সাহস করবেনা। আজ আমি আমার লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। সেখানে পৌছানো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এতকিছুর পরও এ বাড়িতে কেন পরে আছি যান? আমার মায়ের জন্য। তার চেহারা, তার কোন কথা কিংবা তাকে নিয়ে কোন স্মৃতি আমার মনে নেই। এখানে থাকলে আমি তাকে অনুভব করতে পারি। এই বাড়ির দেয়ালগুলো ছুঁয়ে দিলে মনে হয় আমি মাকেই ছুঁয়ে দিচ্ছি। একদিন এই বাড়িই তো তার পদচারণায় মুখরিত ছিল। হোকনা সে খারাপ। তবুও সে তো মা। কোন নারী যখন মায়ের রূপে বিরাজ করে তখন সে শুধুই দয়াময়ী। আর মায়ের রূপে নারীরা কখনোই খারাপ হয়না। মায়েরা সব সময়ই মায়াবতী হয়। ” আরমানের গলা ভারী হয়ে আসে।

” মা কোথায় গিয়েছেন? কেন গিয়েছেন? ” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে কান্তা।

” আমি এত কিছু জানিনা। আবার মনেও নেই। ছয় বছর বয়সে মায়ের সাথে মামার বাড়ি গিয়েছিলাম। সেখানে নাকি কয়েকদিন ছিলাম। তারপর সেখান থেকে দাদুর গ্রামে আমাকে নিয়ে যায় মা। সেখানে তিনদিন ছিল। এরপর একরাতে নাকি কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে যায়। অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে সবাই বলাবলি করতে শুরু করে, মা কারও সাথে পালিয়েছে৷ অবশ্য সেসব কথা আমার স্মৃতিতেও নেই। আমি রাজিয়া খানমের মুখ থেকে সেসব কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি৷ মা নিখোঁজ হবার পর থেকেই বাবা আমাকে ঘৃ’ণা করতে শুরু করে। আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। তার যুক্তি ছিল, খারাপ মায়ের সন্তান কখনোই ভালো হতে পারেনা৷ আমার কোন খরচ বহন করতনা। দারোয়ান চাচার কাছে থাকতাম। তিনিই প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। আমার সকল ব্যায়ভার তিনিই বহন করতেন। একটু একটু করে সবার অনাদরে বড় হতে থাকলাম। শুভর মা এ বাড়িতে বউ হয়ে আসল। শুরু হল আমার ন’র’কে’র দিন। এরপর একদিন খালা আসল এখানে। ধীরে ধীরে সে হয়ে উঠল আমার মা। ”

কান্তার মুখে কোন কথা জোগায়না। সন্তানের জন্য কোন বাবা এতটাও নি’ঠু’র হতে পারে! ও অনবরত কাঁদতেই থাকে।

” আজ থেকে এ বাড়ির কাউকে আর ভালোবাসতে পারবনা। তাদেরকে দেখলেই আপনার সাথে হওয়া অবিচারগুলো মনে পরবে। কিভাবে ছিলেন এতদিন তাদের মাঝে! না জানি কত কষ্ট হয়েছে আপনার। নিজের দুঃখগুলোকে আজ নগন্য মনে হচ্ছে। ” কান্তা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

” শোন মেয়ে, এ বাড়ি থেকে পাততাড়ি গোটানোর সময় এসে গেছে। এতদিন মায়ের ছোঁয়া পাবার আশায় এখানে পরে থেকেছি, কিন্তু আজ শুভর কথা শোনার পর থেকে সেই ইচ্ছে ম’রে গেছে।মনে মনে তৈরি থেক। যেকোন দিন এখান থেকে বেরিয়ে যাব। এখন কান্না বন্ধ কর। স্বামী-স্ত্রীর দুজনের মধ্যে কারও কোন সমস্যা হলে, একজনকে শক্ত হতে হয়, অপরজনকে শান্তনা দিতে হয়, আশার বানী শোনাতে হয়। কিন্তু তুমি সেসব না করে কেঁদেই চলেছ! তোমাকে দিয়ে কিচ্ছুটি হবেনা। ” কপট রা’গ দেখায় আরমান।

কান্তা মুখ খুলতে গেলেই দরজায় টোকা দেয় কেউ। শব্দ শুনে কান্তা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
শ্রীজা মাথা নিচু করে রুমে ঢোকে। সেখানে ভাইকে দেখতে না পেয়ে বারান্দায় যায়।
আরমান তখনও সেখানে ঠাঁয় বসা।
শ্রীজাও ভাইয়ের পাশে যেয়ে বসে।

” ভাইয়া, সেই ছোটবেলা থেকেই তোমাকে আমার ভাই বলে জেনে এসেছি। তুমি আমার সৎ ভাই সেই কথা কখনও মনে আসতে দিইনি। ছোট ভাইয়ার থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবেসেছি। তেমনি তুমিও সেই ছোটবেলা থেকেই সবটা দিয়ে আমাকে ভালোবেসেছ, আগলে রেখেছ। ছোট হওয়ায় তোমার অতীত সম্পর্কে জানতে পারিনি। হয়তো কখনো জানতেই চাইনি। তাই এতদিন অজ্ঞ ছিলাম। কিন্তু আজ যখন জানলাম তোমার জীবনযুদ্ধের কথা, আর নিশ্চুপ থাকতে পারলামনা। ওরা সবাই তোমার সাথে অন্যায় করেছে ভাইয়া। সবাই সমান দোষী। ঘৃণা জন্মেছে সবার ওপর। জানো ভাইয়া, মা, দাদিমা যখন তোমার সাথে দুর্বব্যহার করত আমার ভিষণ রা’গ হত। তাদেরকে বলতাম তোমার সাথে এমন না করতে। কিন্তু তারা কখনোই আমার কথা শোনেনি। উল্টো তোমার সাথে কথা বলতে নিষেধ করেছে। কিন্তু আমাকে ঠেকানোর সাধ্য কার। আমি আমার অতিপ্রিয় ভাইয়ের সাথে কথা বলব। বাঁধা দিয়ে তারা কি করতে পারবে। কিন্তু দেখ এতকিছুর পরও তোমার সাথে হওয়া অন্যায় আমি রুখতে পারিনি। কিন্তু আজ ওরা সীমা ছাড়িয়েছে। তুমি ওদের ক্ষমা করোনা ভাইয়া। কেন পরে আছ এখানে! চলে যাও, নিজের আপন দুনিয়া গড়ে তোল। এখানে থাকলে ওরা তোমার সাথে সাথে ভাবীর জীবনও দুর্বিষহ করে তুলবে। হয়তো দেখলে তোমার সংসারটাই তছনছ করে দিল। এই নি’ষ্টু’র জগতে সে-ই একমাত্র তোমার সুখ-দুঃখের সাথী। কেউ তোমার পাশে না থাকলেও ভাবী সকল পরিস্থিতিতে তোমার পাশে থাকবে। আর আমি দূর থেকে তোমাকে সাপোর্ট দিয়ে যাব। তবে যেখানেই যাও আমার সাথে যোগাযোগ রেখ। তোমাকে না দেখলে, তোমার সাথে কথা না বললে আমার ভিষণ কষ্ট হবে। ” শ্রীজা হুহু করে কেঁদে উঠে।

বোনের কান্না দেখে আরমান ওকে কাছে টেনে নেয়। ও খুব ভালো করেই জানে ওর বোন ওকে কত ভালোবাসে।

” অনেক কেঁদেছিস। এবার কান্না থামা। বেশি কাঁদলে তোকে দেখতে খুব বাজে লাগে। কাঁদতে কাঁদতে চেহারা যদি এমন বাজে হয়ে যায়, তখন তোকে বিয়ে করবে কে! তখন তোর বাবার অনেক খরচ হবে। কিংবা দেখা গেল কোন রিকসাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দিল। বিষয়টা কিন্তু খুবই বাজে হবে, ভেবে দেখেছিস? ”

” তুমি যতই আমাকে খোঁ’চা’ও, আজ আমি একটুও রা’গ’ব’না। যার সাথে খুশি বিয়ে দিও। তোমাকে ছাড়া কাউকে আমার পাশে দরকার নেই। ” নাক টানতে টানতে জবাব দেয় শ্রীজা।

কান্তা রুম থেকে দুই ভাই-বোনের কথপোকথন শুনছিল।

” শ্রীজু, আমি খুব তারাতারি তোদের ঘাড় থেকে নেমে যাব বুঝলি। এমনও হতে পারে ঢাকাতেই আর থাকবনা। তবে আমি যেখানেই যাই, তুই জানবি। কিন্তু তোর কাছে অনুরোধ থাকবে, তুই সেই কথা কাউকে বলবিনা। এমনকি তোর বাবাকেও না। আমি কোন পিছুটান রাখতে চাইনা। ”

এতক্ষণ ভাইকে অনেক কিছু বললেও, ভাইয়ের মুখ থেকে চলে যাওয়ার কথা শুনে শ্রীজা আওয়াজ করে কেঁদে উঠে। ও ভাইকে না দেখে কিভাবে থাকবে!

শহিদ আহমেদ নিজের রুমে বসে আছেন। আজকে আরমানের কথাগুলো তার কলিজায় কাঁপন ধরিয়েছে। এত বছর আইরিনের ওপর রা’গে’র জন্য নিজের ছেলেকে তিনি দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। একটাবারও ভাবেননি তার ছোট্ট ছেলেটা কি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সেই ছোট থেকেই ছেলেটাকে দূর দূর করেছেন। তার কোলে উঠতে চাইলে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন। তার কাছে বসতে চাইলে ধমক দিয়েছেন। ছেলেটার পেছনে একটা টাকাও খরচ করেননি। একটাবারও ভাবেননি ছেলেটার স্কুলে টাকার দরকার হতে পারে, ছেলেটার কোন টিউশনের দরকার হতে পারে। ছেলেটা কিভাবে পড়াশোনার খরচটা চালিয়েছে সেটা জানার কোন প্রয়োজনই বোধ করেননি তিনি। এত বছর পর আজ তিনি শুনছেন, তার ছেলেটা পড়াশোনার খরচ জোগাতে ক্লাস সিক্স থেকেই গ্যারেজে কাজ করেছে! আজ নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মেছে তার। কি করে পারল নিজের সন্তানকে এভাবে আ’ঘা’ত করতে! তার এসব আচরণের জন্যই বোধহয় ছেলেটা তাকে বাবা বলে ডাকেনা। কত বছর ছেলের মুখে বাবা ডাক শোনেননা তিনি! তিনি মনে মনে হিসাব কষছেন। কিন্তু তিনি হিসেব কষতে ব্যর্থ হন। তিনি হেরে গেছেন। পিতৃত্বের অহঙ্কার তার জন্য নয়। যে পিতা এক সন্তানকে অন্ধকারে রেখে অন্য সন্তানদের আলো দিতে চান, তিনি পিতা হবার যোগ্য নন।

” আইরিন, তুমি কেন এমন করলে? আমাকে ভালোবেসে তুমি আমার হাত ধরেছিলে। কিন্তু মাঝপথে সেই হাত ছেড়ে কেন অন্য হাত ধরলে? কি দোষ ছিল আমার? ছেড়েই যদি যাবে, তবে কেন এসেছিলে আমার জীবনে? আরমানের মুখের দিকে তাকালে আমি তোমাকে দেখতে পাই। তাইতো বারবার ছেলেটাকে আ’ঘা’ত করেছি। কিন্তু আজ সেই আ’ঘা’ত শতসহস্রগুন ভারী হয়ে আমার বুকেই আছড়ে পড়েছে। আমি ছেলেটার কাছে চিরকালের মত দোষী হয়ে রইলাম। ” অঝোরে কাঁদছেন শহিদ আহমেদ।

আকলিমা খানম বিছানা থেকে স্বামীর কান্না দেখছে আর রা’গে দাঁত কটমট করছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here