#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৯
.
-“খালা আমার বিয়ে ঠিক করেছে অর্ঘ। গতকাল এর প্রতিবাদ করায় তিনি আমাকে অনেক মেরেছেন। গলা টিপে ধরেছিলেন। শেষে চুলা থেকে জ্বলন্ত লাঠি নিয়ে মেরেছেন। আমার সারা শরীর অসহ্য ব্যথায় কুঁকড়ে আছে। এভাবে তিলে তিলে মেরে ফেলার থেকে একেবারে কেন মেরে ফেলছে না আমায় বলতো! আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই।”
অর্ঘমা বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। শক্ত হয়ে বসে তাকিয়ে রইল নিধির দিকে। গোলগাল চেহারার মিষ্টি একটা মেয়ে। দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও অর্ঘমার চোখে নিধিকে সুন্দরই লাগে। তাছাড়া হাসলে নিধিকে বেশি সুন্দর লাগে। সৎ মায়ের অত্যাচারে নিধির চেহারার উজ্জ্বলতায় ভাঁটা পড়েছে। মলিনতা ভর করছে সারা দেহে। বিষণ্নতায় ঘেরা মুখখানি দেখলে বড্ড মায়া লাগে। অর্ঘমা নিধির পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
-“কার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে তোর সৎ মা?”
-“আমাদের পাড়ার এক বুড়োকে তুই একদিন ইচ্ছে মতো অপমান করেছিলি মনে আছে?”
-“আমার সাথে অসভ্যতা করার চেষ্টা করেছিল যে বুড়ো সেটা?”
-“হ্যাঁ। ওই পঞ্চাশোর্ধ বুড়োর সাথেই খালা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। বুড়োর আরও দুইজন বউ আছে। খালাকে টাকার লোভ দেখিয়ে রাজি করিয়েছে বুড়ো। আর আমার বাবাও বাঁধা দেননি এতে। তিনি মত দিয়েছেন।”
-“তুই ওই লোককে বাবা বলে ডাকিস কীভাবে? ঘেন্না হয় না তোর?”
-“হলেও তো কিছু করার নেই। আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, তুই তো জানিস! প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আর কতদিন দেখবেন আমাকে? ক্লাস টেনে পড়ছি। এসএসসি’র পর তিনি আর দেখবেন না। তাছাড়া বুড়োর সাথে একবার বিয়ে হয়ে গেলে আমাকে বোধহয় আর পড়তেও দিবে না।”
-“বিয়ে কবে?”
-“সামনের সপ্তাহে।”
অতঃপর নীরবতা পালন করল দু’জন। আসলে আর কিছু বলার মতো পাচ্ছিল না কেউ। ক্লাসের ঘন্টা পড়ে যাওয়ায় উঠে গেল তারা। আজ আর টিফিন করা হলো না কারোরই। নিধির মনের বিষণ্ণতা আজ অর্ঘমার মনেও প্রবেশ করেছে। বাকি সময়টা একদম চুপচাপ কাটাল দু’জন। ক্লাসে আর মনোযোগী হতে পারল না সেদিন।
___
অর্ঘমার মন খারাপকে ভালো করতে বিকেলের দিকে নীরদের কল এলো অর্ঘমার মায়ের ফোনে। অর্ঘমার ফোনটা এখনো অভ্র ব্যবহার করছে। অর্ঘমার মায়ের ফোনের তেমন একটা দরকার পড়ে না। তাই বাসায় থাকাকালীন ফোনটা অর্ঘমাই ব্যবহার করে। কল রিসিভ করতেই নীরদ বলল,
-“তৈরি হয়ে নাও। আমরা বের হব। ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছে। তিনি পারমিশন দিয়েছেন।”
-“কখন বের হবেন?”
-“আমি বাসার গলির সামনে বসে আছি বন্ধুদের সাথে। তুমি তৈরি হয়ে চলে আসো। অপেক্ষা করছি আমি।”
-“ঠিক আছে।”
কল কেটে অর্ঘমা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল। লাল রঙের একটা সেলোয়ার-কামিজ পরে হালকা সেজে নিল। খোলা চুলগুলো আঁচড়িয়ে বের হলো বাসা থেকে।
___
নীরদ সবেমাত্র হাই তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সামনে চোখ পড়তেই তার আর হাই তোলা হলো না। চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল। নীরদকে এভাবে হ্যাবলার মতো সামনে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার বন্ধুরাও সামনে তাকাল। অর্ঘমা আসছে। তাকে দেখে বন্ধুদের বুঝতে বাকি রইল না নীরদের এমন অভিব্যক্তির কারণ। সব বন্ধুরা মুখ টিপে হাসল। আসিফ নীরদের কানে ফিসফিস করে বলল,
-“পরী লাগছে না?”
-“হ্যাঁ। ভীষণ সুন্দর লাগছে। একদম নতুন বউ লাগছে।”
নীরদ কথাটা ঘোরের মাঝে থেকেই বলল। সব বন্ধুরা একসাথে ‘হোও’ বলে চিল্লিয়ে উঠতেই চমকে উঠল নীরদ। বন্ধুদের দিকে বেকুবের মতো তাকিয়ে থেকে বলল,
-“কী হয়েছে?”
-“বেশি কিছু না। শুধু অর্ঘমাকে নতুন বউয়ের মতো লাগছে এই আরকি।”
বিষম খেল নীরদ। তাকে খুকখুক করে কাশতে দেখে আসিফ পাশের দোকান থেকে একটা পানির বোতল এনে তার হাতে ধরিয়ে দিল। ততক্ষণে অর্ঘমা এসে দাঁড়িয়েছে তাদের সামনে। নীরদ পানি খেয়ে আড়চোখে বন্ধুদের দিকে তাকাল। তার বন্ধুরা মিটমিটিয়ে হাসছে। অর্ঘমা সবাইকে সালাম দিতেই সবাই সালামের জবাব দিল। সবার সাথে টুকটাক কথা বলে নীরদের সঙ্গে বেরিয়ে পরল। অবশ্য যাওয়ার আগে নীরদ তার বন্ধুদের চোখ রাঙাতে ভুলেনি।
___
একটা রিকশা ভাড়া করে অর্ঘমাকে উঠতে বলল নীরদ। অর্ঘমা উঠে বসতেই তার কাঁধের পাশ থেকে ওড়না সরে গেল। কাঁধের ওড়না ঠিক করে দিয়ে পাশে পড়ে থাকা ওড়নার বাকি অংশটুকু কুড়িয়ে নিয়ে অর্ঘমার কোলের মাঝে দিয়ে দিল। বিষয়টা প্রচন্ড ভালো লাগল অর্ঘমার। নীরদ তার পাশে বসে পেছনে হাত দিয়ে রিকশা ধরে রাখল। অর্ঘমার মনে একরাশ ভালো লাগা কাজ করছে।
প্রথম দিন থেকে নীরদকে শুধু পছন্দ করলেও ধীরে ধীরে তার এই ভালো লাগার রোগটা ভীষণভাবে বাড়ছে। নীরদ নিজের ছোট ছোট যত্ন দ্বারা অর্ঘমার মনে কতখানি জায়গা দখল করে নিয়েছে তা কি সে জানে? উঁহু, জানে না। এই যে আজ কতগুলো দিন যাবৎ অর্ঘমার মন মস্তিষ্কে নীরদ নামক মানুষটা কিলবিল করছে, এক মুহূর্তের জন্যও নীরদকে ভুলে থাকতে পারছে না; এতে তো অর্ঘমার পাগল হওয়ার জোগাড়। মনের ভেতরে হাজারো উল্টো পাল্টা চিন্তা ভর করে বসে আছে তার। এই যেমন এখন তার মন চাইছে নীরদের কাঁধে মাথা রেখে হাতে হাত রেখে বাকিটা পথ রিকশা ভ্রমণ করতে। কিন্তু কথাটা সে নীরদকে বলতে পারছে না। তাছাড়া নীরদই বা শুনলে কী বলবে?
আড়চোখে নীরদের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। দু’জনেই অপ্রস্তুত ভাবে চোখ সরিয়ে নিল। আশেপাশে তাকিয়ে আবারও একে অপরের দিকে তাকাল। হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসিটা ঠিক মানালো না ওদের। তাই আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে প্রকৃতি দেখায় মন দিল।
নীরদ ঘাড় ঘুরিয়েই জিহ্বে কামড় দিল। না জানে মেয়েটা কী ভাবছে! সারা রাস্তা টুকটাক গল্প আর একটু পর পর একে অপরের দিকে আড়চোখে তাকিয়েই সময় কাটাল দু’জন।
রিকশা থেকে নামার সময়ও নীরদ সাহায্য করেছে অর্ঘমাকে। এটা একটা রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে ফুটপাত। ফুটপাতের পাশ দিয়ে সারি সারি হাজারো গাছের সমারোহ। বেশিরভাগই ফুল গাছ। অর্ঘমার যেটুকু মন খারাপ ছিল তা কোথায় যেন কর্পূরের মতো উবে গেল। মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে গেল। মুখে দীর্ঘ হাসি ফুটে উঠল। নীরদের মনটা ভালো হয়ে গেল অর্ঘমার হাসি দেখে। এখানে আসা সার্থক মনে হলো তার।
-“ভালো লেগেছে জায়গাটা?”
-“ভীষণ।”
-“কিছু খাবে?”
-“উম.. আইসক্রিম।”
-“আচ্ছা, এসো আমার সাথে।”
কিছুটা সামনে এগিয়ে যেতেই একটা আইসক্রিমের দোকান চোখে পরল। সেখান থেকে দুটো আইসক্রিম কিনে একটা অর্ঘমার দিকে বাড়িয়ে দিল। হাসিমুখে আইসক্রিমটা নিয়ে প্যাকেট খুলে খেতে লাগল অর্ঘমা। আইসক্রিম খাওয়ার পাশাপাশি ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে লাগল তারা। আশেপাশে আরও অনেকেই রয়েছে। এই রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম। হঠাৎ দু’একটা গাড়ি শাঁই শাঁই করে চলে যাচ্ছে। এছাড়া রাস্তা ফাঁকাই বলা যায়। কয়েকজন কাপল আছে। তারা নিজেদের মতো ব্যস্ত।
কিছুটা সামনে এগোতেই লেকের দেখা পেল তারা। লেকের ঠিক সামনে বড় একটা গাছ। গাছটার নাম জানে না অর্ঘমা। তবে গাছের পাতাগুলো তার কাছে ভীষণ ভালো লাগে। ছোট ছোট পাতাগুলো দেখতে কিছুটা গোলাকৃতির। সবুজ আর হলুদের মিশেলে এই পাতাগুলো লেকের সৌন্দর্য যেন আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
নীরদের আইসক্রিম খাওয়া শেষ। অর্ঘমার হাতের কোণ আইসক্রিমটা এখনো রয়েছে। নীরদকে পেছনে ফেলে অর্ঘমা এগিয়ে গিয়েছে লেকের ধারে। তার মধুর হাসিতে নীরদের মন বারবার প্রশান্তিতে ছেয়ে যাচ্ছে। ফোন বের করে ফটাফট অর্ঘমার কতগুলো ছবি তুলে ফেলল। কিছুদূর তাকাতেই দেখতে পেল এক লোক ফুল বিক্রি করছে। অর্ঘমার দিকে একবার তাকিয়ে দৌড়ে গেল সেই ফুলওয়ালার কাছে। তরতাজা লাল টকটকে দেখে ছয়টা গোলাপ ফুল কিনল। পাঁচটা গোলাপ দিয়ে একটা তোড়া বানিয়ে একটা গোলাপ আলাদা করে নিয়ে ফিরে এলো অর্ঘমার কাছে। ততক্ষণে অর্ঘমার আইসক্রিম খাওয়া শেষ। ওড়না খুলে মাথায় ঘোমটা দিয়ে পেছন ঘুরতেই নীরদকে এদিকেই আসতে দেখল। তার হাতে গোলাপ দেখে কিছুটা অবাক হলো। একবার ভাবল জিজ্ঞেস করবে গোলাপ কার জন্য? কিন্তু পরক্ষণেই সেই ভাবনা বাতিল করে চুপ করে রইল। অর্ঘমার মাথায় ঘোমটা দেখেই পা জোড়া থেমে গেল নীরদের। অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসল। আবারও পা চালাল। কাছে এসেই গোলাপের তোড়াটা এগিয়ে দিল অর্ঘমার দিকে। অবাক চোখে চাইল অর্ঘমা। নীরদের হাসিমাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমার জন্য?”
-“আমি কী অন্য কারো সাথে এসেছি?”
-“না।”
-“তাহলে?”
অর্ঘমার হাসির রেখা দীর্ঘ হলো। গোলাপের তোড়াটা হাতে নিয়েই ঘ্রাণ নিল প্রথমে। নীরদের হাতে থাকা একটা গোলাপের দিকে তার নজর গেল। এটা কার জন্য? প্রশ্নটা মনে মনে করলেও মুখে করার সাহস হলো না। তার হাতে পাঁচটা গোলাপ থাকার পরও নীরদের হাতে থাকা ওই একটা গোলাপকেই তার হিংসে হচ্ছে। অর্ঘমার আড়চোখে একটা গোলাপের দিকে তাকানোটা নীরদের চোখ এড়ালো না। মৃদু হেসে অর্ঘমার আরো কাছে এগিয়ে এসে গোলাপটা তার কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,
-“এখন একদম পারফেক্ট লাগছে।”
চমকালো অর্ঘমা। পর পর তাকাল নীরদের দিকে। দৃষ্টির মিলন ঘটল। গোধূলি বিকেলের সোনালী আভা এসে পরল তাদের মুখের ওপর। নীরদের দৃষ্টি অর্ঘমার মুখপানেই স্থির হয়ে গেল। তার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল যা ধরতে পারল না অর্ঘমা।
চলবে…